অধীরবাবু গড়িয়া অটো স্ট্যান্ডে নেমে আস্তে আস্তে বাড়ীর পথ ধরলেন। অফিস থেকে ফেরার পথে প্রায় সব দিনই তিনি ক্লান্ত থাকেন, কেন কে জানে … বয়স তো এমন কিছু বেশী নয়, এখন চল্লিশের নিচেই রয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবেন কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন, হয়তো ভিটামিন ডেফিসিয়েন্সি বা অন্য কিছু… কিন্তু যাওয়া হোয়ে ওঠে না নানা ঝামেলায়। আর জীবনে কাজের তো শেষ নেই… এই যে বাড়ী যাচ্ছেন, যাওয়ার পথে মেয়েকে পরাগবাবুর বাড়ী থেকে তুলে নিতে হবে কারণ তাঁর নিজের বাড়ীতে তিনি নিজে আর তার পাঁচ বছরের মেয়ে ঝুমুর ছাড়া আর কেউ থাকে না। আর অফিসেও কাজের শেষ নেই … আর অফিস বলতে একটা ছোট্ট পোস্ট অফিস, সেখানে তাঁকে চিঠিতে স্ট্যাম্প মারা থেকে শুরু করে সর্টিং করা… অ্যাড্রেস দেখে দেখে ঠিক ব্যাগে পোরা … এই সবই তাঁর দৈনিক কাজ। আজ থেকে প্রায় বছর ছয় সাত আগে বাবা গত হবার পর তাঁর জায়গায় এই চাকরীটা পেয়েছিলেন। সেই শুরু… প্রথম প্রথম ভয় পেতেন … বাবার ওপর ওয়ালার দয়ায় পাওয়া চাকরী … না খাটলে যদি চলে যায়। তারপরে সেটাই রোজকার ডিউটি হয়ে গেলো … অন্য কলীগরা যেখানে চা চানাচুর খাবার অছিলায় দিনের নানা সময় আড্ডা মারে, কেউ কেউ অফিস পলিটিক্সে থাকায় সারাক্ষণ ইউনিয়ান রুমেই পরে থাকে, অধীরবাবুর আর কিছুই করা হয় না। তার ওপর আছে এর ওর অনুরোধ … অধীর, আমার এই কাজটা ভাই একটু করে রেখ, আমার আজ একটু তাড়া আছে… অধীর, আজকে ভাই আমার একটা ইউনিয়ান মিটিং আছে, আমার কাউন্টারে একটু বসিস… ইত্যাদি। শরীরের আর দোষ কি, ক্লান্তি তো আসতেই পারে।
এই ভাবেই জীবন চলছিল। আজও তাই, অধীরবাবু আস্তে আস্তে মেন রাস্তা রাজা সুবোধ চন্দ্র মল্লীক রোড থেকে ডান দিকে বেঁকে ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পাশ দিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তায় ঢুকে পরলেন। বড় রাস্তায় বড়ই ঝামেলা … সব সময়ই যেন একটা মেলা চলেছে। বাস, ট্যাক্সি, অটো সব সময়ই হর্ন দিচ্ছে, এছাড়াও আছে অসংখ্য রিক্সা, মোটর সাইকেল আর সাইকেল। পায়ে হাঁটাও খুব একটা নিরাপদ নয় কারণ রাস্তার বাঁ দিকে ফুটপাথ বলে কিছু নেই, রাস্তার পাশে কিছুটা মাটি বার করা যায়গা … সেখান দিয়েই হাজার হাজার মানুষ রোজ দু বেলা হেঁটে যায়। অ্যাক্সিডেন্ট তো হয়ই … মাঝে মাঝেই হয়। একটু অন্য মনস্ক হলেই কোন মোটর সাইকেল বা বাস সাইড ঘেসে ধাক্কা দিয়ে যেতে পারে। এমন ঘটনা এই সব ব্যাস্ত রাস্তায় ঘটেই থাকে, ব্যাপারটা আরো সিরিয়াস বয়স্ক ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলাদের ক্ষেত্রে। এই তো সেদিন, গত বৃহস্পতিবার, ভদ্রলোক ব্যাঙ্কে পেন্সান তুলতে এসেছিলেন… একাই। ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অফিসটা মেন রাস্তা থেকে ডান দিকে মোড় নিয়ে একটু গেলেই। ভদ্রলোক ব্যাঙ্কের কাজ শেষ করে নিচে এসে বোধহয় একটা রিক্সা খুঁজছিলেন … গরমের দিন, তাই বোধহয় একটু ঘেমে গিয়েছিলেন, একটু মাথাও ঘুরছিল। একটু অন্য মনস্ক হয়ে বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর ঠিক সেই সময় একটা মোটর সাইকেল স্পীডে টার্ন নিতে গেলো। ধাক্কাটা খুব জোড়ে না লাগলেও ভদ্রলোক রাস্তায় ছিটকে পরলেন, মাথাটা পরলো একটু উঁচু হয়ে থাকা কংক্রিটের স্ল্যাবের ওপর… সঙ্গে সঙ্গে রক্ত। যারা কাছেই ছিল এগিয়ে এলো … ভদ্রলোকের শরীরটা তখন মাটিতে উপুর হয়ে পরে আছে, হাতে থাকা একটা ছোট্ট পলিথিনের প্যাকেট থেকে সামান্য কিছু পটল, আলু আর কিছু ওষুধ মাটিতে ছড়িয়ে পরেছে। ওনাকে উঠিয়ে তখনই কাছের কোন নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অধীরবাবু এই টুকুই শুনেছিলেন, কোলকাতায় এই রকম কতোই স্ট্রীট অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে… ঘটনাটা জানা যায় কিন্তু তারপরের ব্যাপারটা … ফলোআপ কোনদিনই খবরের কাগজে আসে না। এই ব্যাপারটাও তাই … তারপরে ভদ্রলোকের কি হোল আসে পাশের কেউ কোন খবর রাখে না।
এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অধীরবাবু রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন, লক্ষ্য পরাগবাবুর বাড়ী, ওখান থেকে ঝুমুরকে নিয়ে সোজা নিজের বাড়ীতে যাবেন। এই রাস্তাটা যে খুব ফাঁকা তাও নয়, প্রাইভেট কার, রিক্সা, মোটর সাইকেল সবই চলে কিন্তু তাও মেন রাস্তা থেকে ভালো … তাছাড়া সকালের থেকে এখন, এই প্রায় সোয়া ছটার সময় বলতে গেলে ফাঁকাই আছে। এই পথ দিয়ে যাবার আরো কারণ এই পথেই পরাগবাবুর বাড়ী, গড়িয়া পোস্ট অফিস ছাড়িয়ে একটু গেলেই বাঁ হাতে ওনার দোতলা বাড়ী। ভদ্রলোক একটু অদ্ভুত, হয়তো বাচ্চা ভালোবাসেন তাই ভালো চাকরী থেকে রিটায়ার করে নিজের স্ত্রীর সাথে একটা বাচ্চাদের ক্রেস খুলেছেন। বাবার থেকে পাওয়া দোতলা বাড়ী, তার ওপর নিজেদের কোন ইসু নেই, তাই ছয় সাতটা বাচ্চা নিয়ে সারাদিন হই হই করে কাটান। পয়সার কোন অভাব নেই, নিজের জমান টাকা, পেন্সান আর বাবার দেওয়া সম্পত্তি … এই নিয়ে বেশ উচ্চবিত্ত ফ্যামিলি। তাই একটু দুঃস্থ ফ্যামিলি দেখলে সামান্যই নেন। অবশ্য কম টাকা না হলে অধীরবাবুই বা কি করে মেয়েকে ক্রেসে রাখতে পারতেন তাঁর এই সামান্য মাইনেতে।
ক্লান্ত শরীরটা টানতে টানতে অধীরবাবু পরাগবাবুর বাড়ী পৌছলেন। মেয়ে তো বাবার আশায় দোতলার বাড়ান্দায় রেলিঙের গায়ে গাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গেটের কাছে এসে অধীরবাবু হাঁক পারলেন – কই ঝুম, আয় রে, এবার বাড়ী যেতে হবে।
গলার স্বর শুনে পরাগবাবুর স্ত্রী নয়নতারা বারান্দায় বেড়িয়ে এলেন।
নয়নতারা। ও বাবা অধীর, তুমি এসে গেছ … শরীর ভালো আছে তো।
অধীর। হ্যাঁ কাকিমা, এক রকম চলে যাচ্ছে। এই ঝুমকে নিতে এলাম।
নয়নতারা। হ্যাঁ হ্যাঁ … আমি হাত ধরে ওকে নিয়ে আসছি। বাচ্চা মানুষ, কোথায় লেগে টেগে যায় …।
নয়নতারা ঝুমুরকে নিয়ে নিচে নেমে এলেন, অধীর এগিয়ে এসে ঝুমুরের হাতটা ধরলো। একে বাচ্চা মেয়ে, তার ওপর আবার বেশ দস্যি, কোথায় কখন পড়ে টরে গিয়ে পা না কেটে ফেলে। এক মেয়ে, তাই অধীরবাবু ওর ব্যাপারে ভীষণ পুতুপুতু করে থাকেন। অধীর নয়নতারা চ্যাটার্জ্জীকে আজকের মত ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ীর পথ ধরলেন। ওনাদের বাড়ীটাও খুব দূরে নয়, একটু দূরে বুদ্ধ মন্দিরটা পার হয়ে একটু গিয়েই বাঁ দিকে গেলেই ছোট্ট একটা বহু দিনের পুরনো এঁদো বাড়ী।
এই বাড়ীটাই অধীরবাবুর ভরসা। এটাও তাঁর বাবার দান, অনলবাবু পোস্ট অফিসের চাকরী থেকেই একটু একটু করে জমিয়ে ছিলেন, সঙ্গে ছিল বউ মিনতির অসীম উৎসাহ, সাহস আর ধৈর্য। সারা জীবনের সমস্ত সুখ আর আকাঙ্ক্ষাকে বন্ধক রেখে ওনারা চেয়েছিলেন শুধু নিজের একটি বাড়ী। তা হয়েও ছিল, রিটায়ার করার বেশ কয়েক বছর আগে ব্যাঙ্ক থেকে কিছু লোন আর প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে বেশ বড় একটা লোন তুলে এই বাড়ী শুরু করেছিলেন। এই সব জায়গায় অবশ্য তখন জমির দাম খুব বেশী ছিল না, সেটাই একটা ভরসা … সে প্রায় বছর পঁচিশ আগেকার কথা, অধীরবাবু তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রিপারেশান নিচ্ছে। ওই বাড়ী শেষ হতে হতেই প্রায় বছর তিনেক লেগেছিল … অবশ্য করার কিছু ছিল না কারণ অনলবাবুর পুঁজি কম, কাজেই নানা সাপ্লায়ার পরখ করে সব থেকে কম দামের সিমেন্ট বালি ইত্যাদি কিনে আনতেন, আর তারপরই মিস্ত্রি কাজ শুরু করতো। তাছাড়া একবারে তো খুব বেশী কিছু কিনতে পারতেন না, কাজেই সেই রকম ঢিকির ঢিকির করেই বাড়ীর কাজ এগতো। বেশীদিন মাল কিনতে না পারলে অনেক সময় মিস্ত্রিরা এদিক ওদিক ভেগে যেত, সবারই তো পেট চলার ব্যাপার। এই ভাবেই বছর তিনেক অপেক্ষা করার পরে একদিন সত্যিই বাড়ী কাজ শেষ হোল। অনল আর মিনতিরা তখন নাকতলা এলাকায় একটা ছোট্ট ভাড়া বাড়ীতে থাকতেন। প্রায় প্রতি শনিবারই দুজনে বিকেলের পর বাড়ী দেখতে আসতেন … অসম্পূর্ণ বাড়ীর চার দিকে ঘুরে ঘুরে অসীম স্নেহে নিজেদের নতুন সন্তানকেই যেন দেখতেন।
অনলবাবু শুরু থেকেই নিজের বাড়ীর চিন্তায় মজে ছিলেন। সেই মাটি খুঁড়ে ভিত তৈরির সময় থেকেই প্রায়ই বাড়ী ফেরার পথে একবার করে নিজের জমিতে ঘুরে যেতেন। অফিস ছুটির পর যখন পৌছতেন তখন সব ফাঁকা, মিস্ত্রি এবং জোগালেরা সবাই চলে গেছে। তিনি একাই সন্ধ্যের সময় একা একা সেই হাঁ করে থাকা বিরাট গর্ত আর চারি দিকে ছরানো ইট বালি সিমেন্টের বস্তার মধ্যে ঘুরে ঘুরে কি সব পরখ করতেন… হয়ত পরে উনি নিজেও বলতে পারতেন না। আর শনি বা রবিবারে তো স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে এসে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে যেতেন, কখন কখন কিশোর অধীরকেও নিয়ে আসতেন। সে কি আর বিকালে মাঠের ফুটবল ছেড়ে একটা আর্ধেক তৈরি হওয়া সিমেন্ট আর ইটের আয়তক্ষেত্র দেখতে আসতে চায়, প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে আসতে হোত। অবশ্য অধীর নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না … সে স্বপ্নেও ভাবেনি যে বাবা মায়ের মৃত্যুর পর এই ছোট্ট বাড়ীটাই বাবা মার আশীর্ব্বাদ হয়ে তার আর তার ছোট্ট মেয়ের মাথায় ছাতা হয়ে দাঁড়াবে।
******
এই ভাবে প্রায় তিন বছর কাটলো। অনেক ত্যাগের সেই বাড়ীটা একদিন সত্যিই কমপ্লিট হোল। সেদিন আবার সকাল থেকেই বেশ বৃষ্টি। অনল আর মিনতি সকাল নটার মধ্যেই ছাতা টাতা নিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গড়িয়ায় নিজেদের বাড়ীতে ঢুকে গেলেন, তখন অবশ্য বাড়ীর পুরো খাঁচাটাই রেডি … শুধু ভিতরের কিছু ছোট খাট ইলেক্ট্রিকের আর প্লাম্বিঙের কাজ চলছিল। ওনারা ভিতরে এসে দুটো টিনের চেয়ারে সারাদিন বসে রইলেন, খাবার কথা কিছুই মনে নেই। যারা কাজ করছিল তারা তো দুবার চা খেল, তারপর দুপুর ডেরটায় লাঞ্চ … সেটাও হোল কিন্তু অনল আর মিনতি অনর, সেই চেয়ারে একবার বসেন আবার পরক্ষনেই উঠে কখন রান্নাঘর কখন বা বাথরুম কখন বা বেডরুমের তদারকি করছিলেন। মিস্ত্রিদের ডেকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করা, কখন একটু বকুনি দিয়ে এটা ওটা করিয়ে নেওয়া এসব চলছিল, এই ব্যাপারে মিনতি এক্সপার্ট। অনর্গল কথা বলে সে অসাধ্য সাধন করতে পারে এবং এই বাড়ীটা আজও তার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। বাড়ী তো হলো কিন্তু অফিস আর ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করতে আরো বহু বছর লেগেছিল … রিটায়ার করার মাত্র বছর দুয়েক আগে টাকা পয়সার সব ঝামেলা মিটলো … অনল্বাবু বাড়ীর দলিলটা হাতে পেলেন।
কোথাও একটা ছোট তাক, কোথাও একটা হাল্কা পার্টিশান দেওয়াল, বেডরুমের দেওয়ালে একটা লফট … এগুলো প্ল্যানে ছিল না কিন্তু মিনতি সমস্ত কিছু করিয়ে নিয়েছিল। মিনতির কোন বড় কলেজ ডিগ্রি ছিল না কিন্তু ছিল চমৎকার সাংসারিক সেন্স। কোথায় কি লাগবে বা কোথায় ভবিষ্যতে কি লাগতে পারে তা বোঝার একটা সুন্দর ক্ষমতা ছিল মিনতির …আর ছিল নিজের স্বামী আর সন্তানের প্রতি পরম মমতা … আজ যার দৌলতে অধীর আর ঝুমুর খেয়ে বেঁচে আছে। মিনতি আর অনলের আর একটা নেশা ছিল … ছোট্ট একটা বাগানের। সেটাও সম্ভব হয়েছিল মিনতির সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে। বাড়ীর পিছন দিকে রান্না ঘরের ঠিক পাশে একটা ছোট্ট দরজা করা হয়েছিল আর বাড়ীর চারিদিক কংক্রিট দিয়ে না বাঁধিয়ে পিছন দিকটা মাটিরই রেখে দেওয়া হোল, আর তাতেই ছোটখাট একটা সুন্দর কিচেন গার্ডেন তৈরী হোল। সামনে একটা ছোট্ট বাঁধান যায়গা যেটাকে সামান্য একটা গ্রীল দিয়ে ঘিরে তৈরী হোল মেকসিফট বারান্দা যেখানে মিনতি আর অনল যতদিন ছিলেন বিকেলে বসে বসে চা খেতেন আর ধিরে ধিরে কেমন সন্ধ্যে হয়ে আসে… পাখীরা কেমন চিৎকার করতে করতে গাছের কোটরে এসে বসে তাই দেখতেন। একটা সময়ে পিছনের ছোট্ট বাগানে মিনতি অনেক গাঁদা, অপরাজিতা ফুল ফুটিয়েছিলেন, ছোটখাট পুঁই শাক লাগিয়ে ছিলেন। হাত ছিল ভাল কাজেই যেটাই লাগাতেন সব লেগে যেত। অধীর সেই শাক বহুদিন খেয়েছে ভাতে মেখে। এসব অবশ্য অনেক আগের কথা, এখন গড়িয়া আর সেই ফাঁকা ফাঁকা একদম নেই। অনল আর মিনতির বাড়ীর আসে পাশে অনেক হাই রাইস উঠে গেছে … বাগানে আর রোদ্দুর আসে না। অধীরের অবশ্য সময়ও নেই, কাজেই পিছনের বাগানটায় বড় বড় ঘাস আর বুনো ফুলে ভরে গেছে … মশার আড্ডা, ব্যাং, শামুক আর কেঁচোর বাসস্থান … অধীর আজকাল খুব একটা যায় না। কিন্তু কি করে যেন মিনতির টাঙানো জামা কাপড় মেলার একটা দড়ি আজও বাঁধা আছে। বহু বছরের বর্ষার জলে বিবর্ন কিন্তু হাওয়ায় যখন একটু একটু করে দোলে আর মর্চে পরা দেওয়ালের হুকে একটু শব্দ হয় তখন আজও যেন মনে হয় মিনতি বাগানে গিয়ে গাছের পরিচর্যা করছে, একটু পরেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে আসবে।
******
মেয়ের হাত ধরে অধীর আস্তে আস্তে নিজের বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়াল। সেই কবে বাবা বাড়ীটা তৈরী করেছিল তারপর আর সারান হয়নি। পয়সার অভাবে অনল আর মিনতি বাড়ী তৈরীর পর বাইরেটা রঙ করাতে পারেন নি। ভিতরটা বাসোপযোগী করে ভাড়া বাড়ী ছেড়ে নিজের বাড়ীতে চলে এসেছিলেন। প্ল্যান ছিল যে পরে কোন সময় হাতে একটু বেশী পয়সা এলে বাইরেটা রঙ করাবেন, এছাড়াও ছিল কিছু জলের পাইপের অসম্পূর্ণ কাজ … কিন্তু যা হয়, আয় সামান্য হলে একটু এদিক ওদিক, কারো একটু শরীর খারাপ … কোথাও কোন নিমন্ত্রণে একটু দামি উপহার … ব্যাস, অন্যান্য অনেক প্ল্যান ওখানেই শেষ। আর অনলবাবু খুব বেশী আয় কোনদিনই করেননি কিন্তু খাওয়া দাওয়াটা বরাবরই একটু ভালো করার চেস্টা করতেন। পেটুক ছিলেন না কিন্তু মাঝে মাঝে মাংস আনা, বর্ষাকালে কয়েকদিন ইলিশ মাছ … এগুলো তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন করে গেছেন।
অধীর বাড়ীর সামনে এসে একটু থামলো। আসে পাশের বাড়ী গুলো আলোয় সাজান কিন্তু এই ছোট্ট একতলা বাড়ীটা অন্ধকার। কে আর আলো জ্বালাবে, বাড়ীতে তো বাবা আর বাচ্চা মেয়ে ছাড়া আর কেউই থাকে না। এই আবছা অন্ধকারেও বোঝা যায় বাড়ীর বাইরে শুধুই সিমেন্টের আস্তরণ, বহু বছরের বর্ষার আঘাত সয়ে দেওয়ালের নানা যায়গায় সবুজ শ্যাওলার স্তর পরে গেছে। অন্ধকারে ভালো দেখা না গেলেও অধীর খুব জানে যে এই দেওয়ালের কোথাও কোথাও সূক্ষ্ম ক্র্যাক এসেছে, চটলা খসে পরছে… এ সবই তার জানা … কিন্তু কি করার আছে? লো ইনকাম মিডল ক্লাস ফ্যামিলিতে এই ব্যাপার বহু যুগ ধরেই চলে আসছে … সময় মতো বাড়ী ঘর সারানো হয়ে ওঠে না।
ঝুমুরের নরম হাতটা বাঁ হাতে নিয়ে অধীর ডান হাতে বাড়ীর চাবিটা বার করলো। অন্ধকারের মধ্যে বার দুয়েকের মধ্যে চাবিটা লকের মধ্যে গলানো গেলো। সেই বহুদিনকার পুরনো তালা, চাবি নিয়ে একটু কসরৎ করতে হয়, কিন্তু আজ বেশী বেগ না দিয়েই খট করে খুলে গেলো। বাইরে বেশ অন্ধকার, যতটা না সন্ধ্যার চাদর তার চেয়ে বেশী আকাশের রঙ। বেশ কালো একটা মেঘের দল যেন নিজেদের মধ্যে খেলতে খেলতে হঠাৎ এদিকে চলে এসেছে।
অধীর ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে দিল … একটা হাল্কা হলুদ আভা নিয়ে ঘরের বাল্বটা জ্বলে উঠলো। অধীর একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললো … যাক, এখনও লোড শেডিং হয়নি। ঝুমুর ঘরে ঢুকেই বাবার হাত ছাড়িয়ে কোনের একটা চেয়ারে গিয়ে বসে পরেছে। এটা তার ভীষণ প্রিয় একটা বসার জায়গা … ছোটবেলায় সে এই চেয়ারেই দাদুর কোলে বসে থাকতো … এখন সে সুযোগ পেলেই এইখানে এসে বসে আর বাবার সাথে আগডুম বাগডুম বকে। বাড়ীটা দু ঘরের হলেও বেশ ছোট … ঘরে ঢুকেই একটা ছোট বসার জায়গা, তার পাশে একটা পাতলা প্লাই উডের পার্টিশান … তার পরেই একটা ছোট্ট বেডরুম যেখানে একদিন অধীর অপরাজিতাকে নিয়ে তার বিবাহিত জীবন শুরু করেছিল … এই তো কয়েক বছর আগেই। ডান দিকে ভিতরে ঢুকে আর একটা ঘর যেখানে জীবনের শেষ অবধি অনল আর মিনতি থেকে গেছেন। ঘরটা দক্ষিণ খোলা, কিছু আসবাব এখনো সেই সেদিনের মতোই সাজান … একটু ধুলো পরেছে কিন্তু অধীর এই ঘরের জিনিস খুব একটা নড়ায় না … থাকনা যেমন আছে। দুটো ঘরের মাঝে একটা ছোট্ট প্যাসেজ, সেখানে দুটো বাথরুম … এটা অবশ্য মিনতির প্ল্যান, একটা টয়লেট ছিল তার নিজস্ব।
অধীর জুতোটা খুলে বন্ধ দরজার পাশে রেখে নিজের ঘরের জানলাটা খুলতে গেলো, ওপাশ থেকে একটা কচি গলা শোনা গেলো।
ঝুমুর। বাবা, এবার কি করবে?
অধীর তখন প্যান্ট সার্ট ছেড়ে বাড়ীর জন্য পায়জামা আর পাঞ্জাবী পড়ছিল, ওখান থেকেই উত্তর দিল …
অধীর। এবার আমরা কিছু খাব ঝুম।
ঝুমুর। এখনই রাতের খাবার খাব?
অধীর। না না, আমি চা খাব আর তুই একটু মুরি খাবি। একটু পরে কিছু রাঁধবো।
ঝুম। বাবা, আজ রাত্রে আমায় তারা দেখাতে ছাতে নিয়ে যাবে?
অধীর প্যান্টটা পাট করে পাশের আলনায় রেখে খাটের পাশের জানলাটা খুললো, আশে পাশের হাই রাইস থেকে একরাশ আলো ঠিকরে এলও ঘরে। প্রথম যখন বাড়ীটা কমপ্লীট হয়, অধীর সবে হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দিয়েছে, তখনো রেসাল্ট বার হয়নি। অধীর ছোটবেলা থেকেই একটু একাকী … খেলা ধুলো বাদ দিলে সে একা ঘরে বসে থাকতে বা বই পড়তেই তার ভালো লাগে। আড্ডা দেওয়ার থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা সে জানলায় বসে আকাশ দেখতে ভালো বাসে। সেই সময় গড়িয়া ছিলো বেশ ফাঁকা, আশে পাশে বাড়ী ছিল কম আর ছিল একরাশ বড় বড় গাছ … আম, জাম ছাড়াও ছিল বট আর অশ্বত্থ আর নাম না জানা কিছু গুল্ম জাতীয় গাছ। কোন কাজ না থাকলে অধীর জানলায় বসে গাছ আর তার কোটরে নানান পাখীর আনা গোনা দেখতো … কখন কখন এমনও হয়েছে যে এমন বিভোর হয়ে ঘণ্টার পর ঘন্টা ধরে সে তাকিয়ে থাকতো যে এক একটা পাখীর একটা ছোপ বা একটা ভাঙা পালোক দেখে পাখীটাকে চিনতে পারতো। সময় যেন সেই সব পাখীর ডানার মতোই উরে যেত, ছুটির দিনে এক ঘেয়েমির কোন চান্সই নেই। আর ছিল মার রান্না ঘরের পাশের সেই ছোট্ট বাগান। মাঝে মাঝেই সে সেখানে যেত। মিনতির কাজই ছিল নানা গাছের বীজ জমিয়ে রাখা আর শুকনো গাঁদা ফুল সংগ্রহ করে রাখা। অঘীরের কাজ ছিল সেই বিজ বা ফুল বাড়ীর দেওয়ালের গা ঘেঁসে একটু কোপান মাটির ওপরে ফেলে দেওয়া আর রোজ জল দেওয়া। মাটিটা অবশ্য ভালোই ছিল তাই প্রতি বছরই গাছ উঠতো। সেই ছোট্ট ছোট্ট গাছ গুলোর দিকে তাকিয়ে পরম মমতায় অধীর হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে অল্প অল্প করে জল দিত যাতে নতুন পৃথিবীতে আসা প্রথম দুটো সবুজ পাতা মেলে দেওয়া কচি গাছগুলো ভেঙে না যায় বা অতিরিক্ত জলে মারা না যায়। একটু বড় হয়ে গেলে রোজ আর জল দিতে হোত না, গাছগুলো আপনিই বড় হোত। এছাড়াও আরো কিছু অজানা ফুল ফুটতো বাগানে, কি সুন্দর সাদা আর ভায়োলেট রঙের… অধীর নাম জানে না। কোথা থেকে এগুলো আসতো তাও সে জানে না, হয়তো পাখীগুলোই নিয়ে আসতো…। এই রকম সুন্দর ছেলে বেলায় অধীর তার মেয়ের মতোই আকাশ দেখতে ভালো বাসতো। তখন জানলায় এসে বসলেই আকাশ দেখা যেতো … বহু দূর অবধি বিস্তির্ণ উজ্জ্বল সুনীল আকাশ। আশে পাশে কোন বাড়ী তখনও হয়নি, কাজেই চোখের দৃষ্টি ছিল অবারিত। গরম কালের ঘন নীল আকাশ থেকে শুরু করে বর্ষার সজল কালো আকাশ … শীতের মন খারাপ করা ছাই ছাই রঙা আকাশ… সব কিছুই ছিল অধীরের খুব চেনা। একটু বিকেলের দিকে জানলায় এসে বসলেই একটা দৃশ্য অধীর মাঝে মাঝে দেখতে পেত। কালো মেঘের পটভূমিতে একদল সাদা বক কেমন সার বেঁধে আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে … এটা অধীরের ভীষণ প্রিয় একটা দৃশ্য। এটা দেখলেই অধীর চিৎকার করে বলতো – মা, আবার ওরা উড়ে যাচ্ছে, দেখবে এসো কেমন সুন্দর…! মিনতি আসতেনও … পরিণত বয়সেও একটা বাচ্চার মতো সমস্ত বিষয়ে উৎসাহ বোধহয় মনের গভীরে কোথাও বেঁচে ছিল … জানলার লোহার শিকের অপর গাল ঠেকিয়ে খানিক্ষন আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে মিনতি বলে উঠতো …
মিনতি। আচ্ছা বাবু, বলতো ওরা কোথায় যাচ্ছে?
বাবু, মানে অধীর খানিক্ষন বোকার মত তাকিয়ে থেকে বলতো – আচ্ছা মা, ধরো যদি সাইবেরিয়ায় যায় …!
মিনতি। সাইবেরিয়া, বাবা … সে জায়গা এখান থেকে কতদূর রে?
অধীর। ও বাবা, সে অনেক দূর। সে তো অন্য দেশে, রাশিয়ায় …।
মিনতি। রাশিয়ায় …। সে দেশ এখান থেকে কতদূর?
অধীর। ও বাবা … সে অনেক দূর। আমাদের দেশ থেকে উত্তরে … চায়না ছাড়িয়ে আরো উত্তরে যেতে হয়। অনেক দিনের পথ …।
মিনতি। সে তো ওরা থেমে থেমে যাবে। নানা জায়গায় নেমে বিশ্রাম নেবে … সেই যে শীতকালে চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখিসনি … পুকুরে কত রকমের বড় বড় পাখী … বক না সারস … কি যেন বলে। ওরাও তো বাইরের দেশ থেকেই এখানে আসে…।
অধীর। সেটাও ঠিক। আর সাইবেরিয়ায় তো ভীষণ ঠান্ডা তাই ওরা আমাদের দেশে চলে আসে, আবার শীত চলে গেলে ফিরে যায়। তবে ওই বড় বড় পাখীগুলো বোধহয় সাইবেরিয়ান ক্রেন।
মিনতি। ও যাই হোক, আমরা ছোটবেলায় অনেকবার চিড়িয়াখানায় গিয়ে ওই পাখীগুলো দেখেছি… আর লাল লাল খুব লম্বা পা ওয়ালা সেই পাখীগুলো। আমাদের ছোটবেলায় আরো অনেক বেশী আসতো। আমরা বকই বলি।
অধীর একটু হাঁসে, মা এই রকমই, সেই ছোটবেলায় যা শিখেছিল তা আর ছাড়বে না।
এমন সময় কোথা থেকে অনলবাবু ঘরে ঢুকে পরেন – এই যে, ছেলে আর মায়ে কি হচ্ছে…।
অধীর। বাবা দেখো … কতো হাঁস … আকাশ দিয়ে একসাথে উড়ে যাচ্ছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে।
অনল একটু দেখলেন … মানসিক ভাবে উনি অনেক বেশী প্র্যক্টিকাল। মিনতি হাঁসি মুখে অনলের দিকে ফিরলো – জানো বাবু বলছে ঐ হাঁসগুলো বোধহয় সাইবেরিয়ায় উড়ে যাচ্ছে।
অনল হাত নেরে ব্যাপারটা একদম উড়িয়ে দিল – আরে নানা … তোমরা বড় বেশী আগডুম বাগডুম ভাবো। এগুলো সেই হাঁস নয় … আর সাইবেরিয়া-টিয়া অনেক দূরের ব্যাপার। এরা বুনোহাঁস … এদিক ওদিক উড়ে নানা জায়গার জলায় নেমে খাবার খুঁজে বেরায়। সকালে বোধহয় এদিকের কোন জায়গায় নেমেছিল, এখন ফিরে যাচ্ছে। বারাসাত বা ডায়মন্ডহারবারের ওদিকে অনেক জলা এখনও আছে, শহরের বাইরে সেই সব জলায় ওরা দলবেঁধে থাকে।
ব্যাস, মা আর ছেলের আলোচনা শেষ। মিনতি একটু রেগে বললো – আঃ তুমি না বড় বেরসিক। আমরা দুজনে বেশ একটা মজার আলোচনা করছিলাম আর তুমি এসে সব ভন্ডুল করে দিলে। বাবু, তোর দূরে কোন জায়গায় বেড়াতে যেতে ভালো লাগে না? আমার তো এই ভাবেই সারা জীবন কেটে গেলো, তোর বাবার তো কোথাও নিয়ে যাবার সময় হোল না …।
অধীর বাবার দিকে তাকালো – সত্যি বাবা, তুমি আমাদের কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাওনি কেন? কত দেখার জায়গা তো ভারতেও আছে?
অনল আবার একমুখ হাঁসলেন, এসব আলোচনা তাঁদের বাড়ীতে প্রায়ই হয়, উত্তরও তৈরী। অনল ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন – বাবু, তোর মা কে জিজ্ঞাসা কর … আমার মাইনে কত ছিল। ট্রেনের ভাড়া দেওয়া, হোটেলে থাকা…খাওয়া … এতো পয়সা তোর বাবার নেই।
অধীর একটু হাসলো তারপর মাথা নারলো… সে এখন একটু বড় হয়েছে, টাকা পয়সার ব্যাপার স্যাপার গুলো একটু আধটু বোঝে। মানুষের বাঁচতে গেলে টাকা লাগে আর তার বাবার সে রকম ট্যাঁকের জোর নেই … সেটাও সে বোঝে। মিনতির হাতে একটা ন্যাতা ছিল, বোধহয় রান্নাঘর পরিস্কার করছিলেন … সেদিকেই চলে গেলেন। অনল আর কি করবেন, পায়ে চটিটা গলিয়ে পাড়ার মোরের দিকে এগোলেন… এই বিকেল বেলায় ওখানে বেশ একটা জটলা হয়, সমীর, অসীম, পরাগ, গৌরিপ্রসন্ন … পাড়ার পুরনো বাসিন্দারা সবাই আসে… বেশ সুন্দর একটা আড্ডা হয়। অধীর আর কি করবে, শরদিন্দুর একটা পুরনো উপন্যাস নিয়ে জানলার কাছে বসে পরলো … এই পাড়ায় তার সেরকম কোন বন্ধু হয় নি।
একটা সরু গলার স্বরে অধীরের সম্বিৎ ফিরে এলো। মাঝে মাঝেই সে স্মৃতির নদীতে মন কেমন করা ফেলে আসা অতীতের ছোটবেলার কোন ঘাটের দিকে পাড়ি দেয়, কিন্তু কোন বারই ঘাটে এসে তরী ভেড়ান হয় না … কোথাও একটা বাধা এসে যায়।
ঝুম। বাবা, তুমি কোথায় … আমায় শুনতে পারছো?
অধীর জানলাটা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। আসে পাশের উঁচু বাড়ীগুলোর থেকে পর্যাপ্ত আলো ঘরের মধ্যে আসছে, এর ওর বাড়ী থেকে টেলিভিশানের বা উঁচু পর্দায় গানের আওয়াজ ভেসে আসছে … কোথাও কারো বাড়ীতে একই সাথে বহু লোকের কথার আওয়াজ। ছোটবেলার সেই গা ছমছমে অন্ধকার আর সন্ধ্যে হলেই বাড়ীর পিছন থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁর আওয়াজ বা বর্ষাকালে ব্যাঙের ডাক… সব বেমালুম লোপাট। সে একটু আনমনা হয়েছিল, ঝুমের ডাকে আবার বাস্তবে ফিরে এলো,
অধীর। এই তো, জানলাটা খুলছি … এখনই আসছি।
সে বসার জায়গায় এলো, ঝুম তখনো চেয়ারের মধ্যে পা গুটিয়ে বসে।
ঝুম। আমায় আজ ছাতে তারা দেখাতে নিয়ে যাবে তো? তুমি তো কিছুই বললে না …।
অধীর জানে যে আজকে আকাশ একটু মেঘলা, একটু হাওয়াও আছে। তবে রাত্রে খাওয়ার পর হয়তো কেটেও যেতে পারে, আর এইটুকু বাচ্চাকে কি আর না বলা যায়…আর তাছাড়া ঝুম তো একটু পরেই ঘুমিয়ে পরবে।
অধীর। হ্যাঁ হ্যাঁ, রাত্রে খাওয়ার পর আমরা যাব।
এর পর অধীর রোজ যা করে, আজও তাই করলো। বাথরুমে হাত পা ধুয়ে এসে রান্না ঘরে গিয়ে পেঁয়াজ আর লঙ্কা দিয়ে মুরি মাখলো আর একটা পটে এক কাপ চা নিয়ে ঘরে এলো। ঝুম তার পায়ে পায়ে রান্না ঘরে ঘুর ঘুর করছিল, মুরিটা দু ভাগ করে দুজনে এবার বিছানায় বসে খেতে লাগলো। মাসের প্রথম দিক হলে অধীর বাদাম ভাজা কিনে আনে, এই মুরির সাথে মিশিয়ে বেশ জমপেশ করে খাওয়া যায়… অবশ্য নুন তেল লঙ্কা দিয়ে মাখা মুরিও বেশ ভালো, অন্তত খিদের মুখে আজ দুজনেই তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেয়ে নিল।
এখনই প্রায় পনে সাতটা বাজে। আর ঘণ্টা খানিক বাদে অধীরকে রাত্রের রান্না করতে হবে। বিশেষ কিছুই নয় … ভাতটা করতে হবে, তারকারি সকালে করাই থাকে। অধীর উঠে মুরির বাটি আর চায়ের কাপটা ধুয়ে ফেললো, তারপর ঝুমুরকে নিয়ে বড় বেডরুমটায় এলো। এখানে মা আর বাবা সন্ধ্যে বেলায় বসে টিভি দেখতেন, সেই থেকে টিভি সেটটা এখানেই রয়ে গেছে। অধীর ঝুমকে হাত ধরে পাশে বসিয়ে দিল … তারপর টিভিটা খুলে দিয়ে খাটের ওপর পা লম্বা করে ছড়িয়ে বসলো, পাশে ঝুম। বাচ্চা মেয়ে … কি বা দেখবে আর কি বা বুঝবে তবু ওর কতো উৎসাহ এই সন্ধ্যেটুকু বাবার সাথে কাটানোয়।
খানিক্ষন এই ভাবেই কাটলো … সাড়ে সাতটায় বাংলা খবর। এটা অধীরের প্রিয় … রোজ সে মন দিয়ে খবর শোনে। সে সেরকম কোন পলিটিক্স করে না, কিন্তু এই খবর তার কাছে একটা বাইরের দুনিয়ার জানলা … সারা পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে যায়, সেই সব খবর তার জানতে খুব ইচ্ছে করে। অধীর বাড়ীতে কেবল কানেকশান নেয় নি, বাবা মা থাকার সময় ছিল। পড়ে অপরাজিতা থাকার সময়ও ছিল কারণ সে নানা রকম মুভি দেখতে খুব ভালোবাসতো। পড়ে অপু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলো আর তারপর তো মাত্র তিন দিনের জ্বরে চলে গেলো। তারপর অধীর কেবল কাটিয়ে দিয়েছে … সারাদিন সে বাইরে বাইরে থাকে আর ঝুম থাকে ক্রেসে, কে আর টিভি দেখে। তবে পুরনো একটা নেশা অধীর ছারেনি … একটু রাত্রে ঝুম ঘুমিয়ে পরলে অধীর বই পড়ে … রোজই। এটাই তার নেশা … সেই ছোটবেলায় বাবা বই কিনে দিতেন …সেই কবে নেশা তৈরী হয়েছিল তারপর আর সেটা ছারেনি।
খবর শেষ হোল, দারুণ কোন নতুন খবর নেই। সেই একই রকম চলছে … উত্তরপ্রদেশে হিন্দু মুসলিম টেনসান … সত্যম সফটওয়্যার কোম্পানির ফাইনানসিয়াল কেলেঙ্কারি … ভারতের আবার অস্ট্রেলিয়ার কাছে টেস্টে হার … এই সব। অধীর একটা হাঁই তুলে টিভির ভলিউমটা আস্তে করে দিয়ে খবরের কাগজটা খুললো … এটাও আজ ভালো করে দেখা হয়নি।
ঝুম যা প্রতিদিন করে, বাবা কাগজ খুললেই সে বাবার কাঁধের অপর দিয়ে মাথা বাড়িয়ে কাগজের লেখা পড়তে চেস্টা করে, আর তাই অধীর খুঁজে খুঁজে ওর পক্ষে মজার কিছু একটু জোরে পড়ে। আজও পেয়ে গেলো …
অধীর। ঝুম শোন … এই দ্যাখ, হিমাচল প্রদেশের একটা গ্রামে একটা বাড়ীর মধ্যে একটা চিতা বাঘ ঢুকে পরেছিল … কি বুঝলি …।
ঝুম। তারপর কি হোল?
অধীর। তারপর আবার কি, অনেক কষ্টে গ্রামবাসীরা বাঘটাকে তারিয়ে দিয়েছে , ওটা আবার জঙ্গলে পালিয়ে গেছে।
ঝুম। বাবা, বাঘটা কেন গ্রামে ঢুকলো?
অধীর। কেন আবার, খিদে পেয়েছিল, বোধহয় ছাগল বা মুরগি মারতে রাতের দিকে চলে এসেছিল, তারপর কোন ভাবে একজনের ফাঁকা ঘরে ঢুকেছিল … গ্রামের দিকে প্রায়ই এরকম ব্যাপার হয়।
ঝুম। আরো কিছু পড় …।
অধীর। আর একটা শোন … সুন্দরবনের কিছু জেলে সমুদ্রের মোহানায় মাছ ধরতে গিয়েছিল। রাত্রে জাল বিছিয়ে শুয়েছিল, সকালে জাল তুলতে গিয়ে দেখে ভীষণ ভাড়ি… তারপর কি হোল বলতো?
ঝুম। কি বাবা?
অধীর। জালটা জল থেকে তুলে দেখে একটা বিরাট হাঙর জালে আটকে আছে … তখনও বেঁচে। তারপর অনেক কষ্টে জাল কেটে হাঙরটাকে ওরা ছেড়ে দিল।
ঝুম। হাঙর কি বাবা? এক ধরনের মাছ?
অধীর। হ্যাঁ … তবে বিরাট বড় হয়, কখন কখন দশ কি বারো ফিট পর্যন্ত। মানে কত বড় জানিস … এই খাটের থেকেও লম্বা। মাঝে মাঝে ওরা সমুদ্রে বাগে পেলে মানুষকেও মেরে ফেলে।
ঝুম। ওরে বাবা … সে কি গো … এতো বড়। আচ্ছা, হাঙর আমাকে খেতে পারে?
অধীর। কি বলছিস … তোকে … হুঃ… শুধু তোকে কেন, সেরকম বড় হাঙর হোলে আমাকেও স্বচ্ছন্দে জলের মধ্যে মেরে দেবে …।
ঝুম মুখ দিয়ে একটা ঊউউউ শব্দ করে মুখটা বাবার কাঁধের মধ্যে রেখে দুটো ছোট্ট হাত দিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরলো। খানিক্ষন চুপচাপ, অধীর কাগজটা দেখতে দেখতে বাঁ হাত দিয়ে মেয়ের মাথার চুলে একটু হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। ঝুম আবার হঠাৎ বলে উঠলো …
ঝুম। বাবা, তুমি হাঙর দেখেছ?
অধীর একটু থমকে গেলো, যখন ছোট ছিল তখন তার একটা কল্পনার দূনিয়া ছিল আর ছিল নানা রকম স্বপ্ন। সে কতোবার চিন্তা করেছে যে সে নিজে ফ্লোরিডার সমুদ্র সৈকতে বা মিয়ামির বিচে গিয়ে সত্যি সত্যি হাঙর দেখবে। অথবা অ্যাটলান্টা বা লন্ডনের অ্যাকুরিয়ামে গিয়ে কাঁচের মধ্যে দিয়ে হাঙর দেখবে। এসব কিছুই অবশ্য পরে আর সত্যি হয়নি। যখন কেবল ছিল, তখন সে প্রত্যেকদিন কিছুটা সময় করে ডিসকভারি চ্যানেল আর ন্যাশানাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল দেখতো। সেখানে দেখা নানান ডকুমেন্টারি তার স্মৃতিতে আজো জ্বলজ্বল করছে। সেই সব ডিপ সি অ্যাডভেঞ্চার, আফ্রিকার গভীর জঙ্গল আর ব্রাজিলের রেইন ফরেস্টের ওপর দুর্ধর্ষ সব ডকুমেন্টারি তার চিরকালের প্রিয়। বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড় তার ছোটবেলার সব থেকে প্রিয় উপন্যাস। নিজেই যেন অ্যাডভেঞ্চারার শঙ্কর হয়ে বহুবার সে কল্পনার স্বপ্নে মাসাইমারা ন্যাশানাল পার্ক বা ক্রুগার ন্যাশানাল পার্কের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেছে।
সে অল্প করে মাথা নেরে বললো – অনেক আগে টিভিতে দেখেছি।
ঝুম। বাবা, আমারও ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে। আমাকে দেখাবে?
অধীরের মাথাটা আপনিই ডান দিকে ঘুরে গেল। বিছানার পাশে একটু ওপরে একটা তাক, সেখানে তিনটে ফটো টাঙানো … বাবা, মা আর অপরাজিতার। ফটোগুলোয় বেশ ধুলো পরেছে… ফটোর ওপরের কাচগুলো একটু যেন আবছা হয়ে গেছে, বেশ পুরনো গাঁদার মালা পরানো … ফুলগুলো শুকিয়ে পাঁপড়ের মতো খড়মড়ে হয়ে আছে হাত লাগালেই হলুদ পাপড়িগুলো ঝুরঝুর করে ঝরে যাবে। বাবা মায়ের ফটোগুলো বেশ পুরনো, একটু একটু সাদা হয়ে এসেছে, অপরাজিতার ফটোটা তাও একটু নতুন। অধীর খানিক্ষণ অপুর ফটোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু যেন অভিমান মনে, সবাই কেমন চলে গেলো … অপুর ব্যাপারটা তো মাত্র কয়েক বছর আগের … প্রথম সন্তান হবার পর কতো আহ্লাদ, মেয়েকে নিয়ে কতো স্বপ্ন। কিন্তু সেই যে মনে একটা আঘাত পেলো, সেটা আর সামলাতে পারলো না … তাও তারপরে মাস ছয়েক বেঁচে ছিল, কেমন একটা আত্মার মতো, মানসিক ভাবে সে যেন অনেক দূরের কেউ, সারা দিনে বোধহয় গুটিকয়েক কথা বলতো। হঠাৎ একবার জ্বর হলো, একটু হাই ফিভার … ব্যাস, দুদিন পড়ে ডাক্তার ডেকেও বিশেষ কিছু করা গেলো না। যার সংসার করার কি আকুল উৎসাহ, সে কেমন নিশ্চুপে প্রদীপের মত নিভে গেলো।
অধীর আলতো করে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
অধীর। নিশ্চয় ঝুম। আর একটু বড় হ, তোকে একটা দামি চশমা করে দেবো, তুই পরিস্কার দেখতে পাবি। আমি আবার কেবল কানেকশান নেবো, শুধু তুই একটু বড় হ আগে…না হলে একা থাকবি কি করে। ডাক্তার রায় তো সেদিন বললেন যে তুই স্কুলেও যেতে পারবি।
ঝুম একটু মাথা নারলো – বাবা তুমি জান আজকাল আমি অনেক কিছু পারি। বড় মা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।
ঝুমের এই কথায় অধীরের বুকের মধ্যের কোথায় একটা দলা পাকিয়ে গলা দিয়ে উঠে আসছিল। এই ছোট্ট জীবনে ঝুম কোথায় যেন বুঝে গিয়েছে যে তার জীবনে এখন বাবাই সব। তাই বোধহয় বাবাকে একটু সাহস দেবার চেষ্টা করছে … না হলে এতো অল্প বয়সে কেউ কাজ পারার কথা বলে না, সবাই খেলা আর আনন্দের কথা বলে।
নয়নতারাকে বাচ্চারা সবাই বড় মা বলে। এই ভদ্রমহিলার কাছে অধীর বড় ৠণী।
অধীর এবার একবার আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় উঠে বসলো, তারপর মাথার চুলটা একটু হাত দিয়ে ঠিক করে নিয়ে বললো – চল ঝুম, এবার আমরা কিছু রান্না করবো, তারপর খেয়ে আমরা ওপরে তারা দেখতে যাব।
ঝুমুর এই কথায় সোজা হয়ে উঠে বসল। অধীর বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুল … তারপর রান্না ঘরে ঢুকলো। এগুলো বাবার শিক্ষা … খাবার জিনিসে হাত দিতে গেলেই আগে ভালো করে হাত ধুতে হয়। এই নিয়ে অবশ্য মিনতির সাথে মাঝে মাঝে লাগতো … মিনতি মাঝে মাঝে হাতে একটু জল দিয়েই খাবার বারতে যেতো … আর অনলবাবু রেগে যেতেন … ওটা নাকি হাত ধোয়াই নয়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত মিনতিরই জয় হোতো কারণ রান্না বান্নায় অনলবাবু একদম গোল্লা, কাজেই ঝগড়া আর জেদ করে বউকে একদম রাগাতেন না। তবে নিজের ছেলেকে একদম মনের মত করেই তৈরী করেছিলেন।
রান্না ঘরেও বিশেষ কিছু বড় কাজ নেই। অধীর অফিস থেকে এসে বিশেষ কিছু করতে পারে না। হাঁড়িতে দুজনের মত মাপা চাল বসিয়ে দিলেন, তার সাথে দুটো ডিম আর গোটা তিনেক আলু। আজকে রাতের মেনু ভাত আর মাখন, ডিম সেদ্ধ, পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে মাখা আলু ভাতে আর সকালের তৈরী পোস্ত। সকালের রান্নাটা কাজের লোকই করে দিয়ে যায়। দুজনের জন্য এইই যথেষ্ট আর ঝুম খাবার ব্যাপারে ভীষণ বাধ্য, একদম ঝামেলা করে না।
খাওয়া হয়ে গেলে বাসন গুলো রান্নাঘরে বেসিনের পাশে রেখে দিয়ে অধীর ঘরে গেলো। বিছানা পাতার মত কিছুই নেই, শুধু দুটো মাথার বালিশ পাশাপাশি রেখে খাটের পাশের জানালাটা বন্ধ করে দিলেন। ততোক্ষণে ঝুম পায়ে চটি পড়ে রেডি। বসার ঘরের দরজাটা খুলতেই বাইরে থেকে একটা ঠাণ্ডা হাওয়ার ঢেউ ঘরে ঢুকে এলো। ছাতে যাওয়ার সিঁড়িটা বাড়ীর বাইরে দিয়ে। ঝুমের উৎসাহ খুব বেশী এই ব্যাপারে, সে দৌড়ে সিড়ির দিকে গেলো কিন্তু প্রথম সিঁড়িতে উঠতে গিয়েই একটা হোঁচট খেলো। অধীর পিছনে আসছিলো ঘরের তালাটা লাগিয়ে, সময় মত এসে কাঁধটা না ধরলে মেয়েটা হয়তো পরেই যেতো।
দরজার বাইরে খানিকটা জায়গা বাঁধানো যেখানে অনল আর মিনতি বিকেলে বসে চা খেতেন, এটাই ছিল তাঁদের বারান্দা। আজ সেই জায়গাটা অন্ধকার, দরজার বাইরের আলোটা জ্বালানো হয়নি … আলো অবশ্য এরকম বহুদিনই জ্বালানো হয়না, এই কাজগুলো বিয়ের পর অপরাজিতাই করতো …তা সে আর এখন কোথায়। আজকে তার ওপর আবার রাস্তার আলোটাও কোন কারণে জ্বলছে না। আকাশটা বেশ থমথমে, সন্ধ্যার কালো মেঘগুলো একটু ফিকে হয়ে এসেছে ঠিকই কিন্তু পুরোটা এখনো যায় নি।
ছাদে একটা দুটো চেয়ার সব সময় পাতাই থাকে, আজও রয়েছে। খুব সস্তা টিনের চেয়ার। পাতা চেয়ারে হাল্কা একটু ধুলোর ছাপ রয়েছে, চেয়ারের কোনায় কোনায় সবুজ শ্যাওলার ছোপ, অবশ্য রাত্রের অন্ধকারে সেরকম কিছু চোখে পরছে না। বাবা আর মেয়ে পাশাপাশি দুটো চেয়ারে এসে বসলো।
আকাশটা আজ একটু অপরিষ্কার, একটু যেন থমথমে … তবু ছোট ছোট কালো মেঘের টুকরোর ফাঁক দিয়ে তারার মালা দেখা যাচ্ছে, ঠিক মাথার ওপর এক টুকরো কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঁকি মারছে। বেশ কিছুদিন পর আজ আবার অধীর একটু খুশী হয়ে উঠলো … অনেক দিন পর আজ আবার রাতে অবারিত উন্মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে তার নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেলো। তারা যখন এই বাড়ীতে পাকাপাকি এলো তখন অধীর সবে হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা শেষ করেছে … তারপর আস্তে আস্তে সে কলেজে ভর্তি হোল। তখন অনলের আর কয়েক বছর বাকি রিটায়ারের। রাত্রে খাওয়ার পর উনি আর মিনতি প্রায় রোজই ছাতে চলে আসতেন, সময় পেলেই অধীরও আসতো। তখন আশে পাশে কোন হাই রাইজ বাড়ী ছিল না, কাজেই যেদিন বেশ অন্ধকার থাকতো সেদিন আকাশের বাহার আরো খোলতাই হোত। অনল বা মিনতি কারোরই অবশ্য আকাশের ব্যাপারে কোন উৎসাহ ছিল না … ওনারা নানা টুকিটাকি সাংসারিক কথায় ব্যস্ত থাকতেন … শুধু অধীর অবাক চোখে এক বিশাল ব্যাপ্তির দিকে মোহময় চোখে তাকিয়ে থাকতো। আকাশের ব্যাপক বিস্তার তাকে মুগ্ধ করতো, আর লাখ লাখ তারা যা গোনা যায় না … কোনটা একটু বেশী জ্বলজ্বলে কোনটা আবার একদম স্তিমিত, মিটমিট করছে। সে বই পড়ে জেনেছে যে এই আকাশ যা সে খালি চোখে দেখছে তা সামান্যই, মানুষের চোখের দৃষ্টি খুবই লিমিটেড। ইউনিভার্স হচ্ছে ইনফাইনাইট … অসীম … তার সীমা বা বাউন্ডারী নির্ধারন করা যায় না। পৃথিবী যে গ্যালাক্সিতে রয়েছে তার নাম মিল্কিওয়ে, কিন্তু এ ছাড়াও আরো অসংখ্য গ্যালাক্সি আছে যার সংখ্যা বিলিয়ন ছাড়াতে পারে … কিন্তু খালি চোখে অন্য কোন গ্যালাক্সি দেখা সম্ভব নয়, তার জন্য পাওয়ারফুল টেলিস্কোপ দরকার। প্রত্যেক গ্যালাক্সিতে অন্তত কয়েক বিলিয়ন করে তারা রয়েছে … সমস্ত ইউনিভার্সে তারার সংখ্যা বেশ কয়েক ট্রিলিয়ন তো হবেই। আমাদের সোলার সিস্টেমের মত এই রকম একটা স্টারের চারিদিকে কিছু প্ল্যানেট ঘুরছে এই রকম সিস্টেমই হয়তো কয়েকশো মিলিয়ন আছে। কাজেই হয়তো কোনদিন এমন কোন গ্রহ খুজে পাওয়া যাবে যেখানে প্রানের চিহ্ন রয়েছে।
ঝুমুর বাবার পাশে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, এবার সে ওপর দিকে তাকালো। এখনো আকাশে সেরকম মেঘ নেই কাজেই তারার মালা পরিস্কার দেখা যাচ্ছে … চাঁদ এখনো পুরোপুরি ওঠেনি, ছোট্ট একদলা কালো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে মুখটা একটু বার করে। অধীর পাশ ফিরে মেয়ের দিকে দেখলো … মেয়েটা কিরকম সতৃষ্ণ নয়নে ওপর দিকে তাকিয়ে আছে, কি যে দেখছে কে জানে। সে আলতো করে বাঁ হাতটা মেয়ের মাথায় রাখলো।
ঝুমুর। বাবা, আকাশটা কি সুন্দর … না?
অধীরের বুকের ভেতর থেকে একটা কিসের দলা যেন গলার কাছে উঠে আসছিল। সে একা, বড় একা … এই বাচ্চাটাকে সব কিছু বলাও যায় না … এই সময় অপরাজিতাও যদি পাশে থাকতো … কিন্তু সেও তো ফাঁক বুঝে কেমন কেটে পরলো। গলাটা বোধহয় একটু কেঁপে গেলো তবু সে বললো …
অধীর। হ্যাঁ রে … আকাশটা খুব সুন্দর … ভীষণ সুন্দর।
ঝুমুর। আচ্ছা বাবা, চাঁদটা এখন কোথায়?
অধীর। ঐ তো … তোর থেকে একটু ডান দিকে … এই মেঘের মধ্যে থেকে বার হোল বলে।
ঝুমুর। আচ্ছা বাবা, চাঁদের মধ্যে সেই কালো কালো দাগ গুলো আজও দেখা যাচ্ছে?
অধীর। হ্যাঁ … তাও যাচ্ছে।
ঝুমুর। ওগুলো কিসের দাগ?
অধীর একটু কাশল, গলাটা পরিস্কার করে বললো …
অধীর। ওগুলো চাঁদের পাহাড়, ঝুম … সেই পাহাড়ে অনেক গর্ত আছে। সেই পাহাড় আর গর্তগুলো আমরা ঐরকম কালো দাগের মত দেখি।
ঝুমুর। বাবা, চাঁদে কি সত্যি একটা বুড়ি আছে যে সারাদিন চড়কা কাটে?
অধীর এতো ব্যাথায়ও হেঁসে ফেললো – না ঝুম … না। ওগুলো একদম বিশ্বাস করবি না … চাঁদে কেউ থাকে না … একদম ফাঁকা।
ঝুমুর। কিন্তু মা যে বলেছিল …!
অধীর একটু থমকালো … অপু মেয়েকে ঘুম পারাবার জন্য হয়তো অনেক কিছু গল্প করেছিল….. একটা বাচ্চা মেয়ের মনে সেটাই গভীর হয়ে বসে গেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে ঠিক কি উত্তর দেবে তা ভেবে পেল না।
অধীর। ঝুম, তোর মা তো তোর সাথে স্বপ্নে কথা বলে … তাই না? তুই তখন মাকে জিজ্ঞাসা করিস, ঠিক আছে?
ঝুমুর। মা এখন কোথায় বাবা? মা কেন শুধু স্বপ্নে আসে, অন্য সময় নয় কেন? মা কি সত্যিই স্টার হয়ে আকাশে চলে গেছে?
অধীর চুপ করে থাকলো, কি উত্তর দেবে … কি উত্তর দেবার আছে? মুখটা একটু ওপরে তুলতেই সুন্দর ঝকঝকে আকাশ … কালো মেঘের দলটা বোধহয় একটু সরে গেছে … আকাশে থই থই জ্যোৎস্না … আর খানিকটা খেয়ে যাওয়া চাঁদ গায়ে কিছু কালো দাগ নিয়ে একটা কাঁদা ভাঙা থালার মতো একটু হেলে আকাশের একটা ছোট্ট জায়গা উজ্জ্বল করে রেখেছে। আর তারা …। আজ যেন আকাশে তারার বন্যা … অনেক দিন পর অধীরকে দেখে ওরা সবাই যেন দেখা করতে এসেছে। অধীর খানিক্ষন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। কতদিন সে রাত্রির এই উজ্জ্বল নিস্তব্ধতাকে অনুভব করে নি। অপরাজিতা চলে যাবার পর অধীর ঝুমকে নিয়েই বড় বিব্রত ছিল … রাত্রে ছাদে বসে আকাশ দেখার মত বিলাসিতা বা মানসিক সুস্থিরতা তার ছিল না। অপু চলে যাবার পর বেশ কয়েক মাস সে মানসিক অবসাদে আচ্ছন্য ছিল … বেশ সিরিয়াস, অফিস যাওয়াও এক সময় বেশ কঠিন হচ্ছিল … সেই মুহুর্তে নয়নতারা আর পরাগবাবু ঝুমকে কোলে তুলে নিয়ে বড়ই উপকার করেছিলেন। আজকে মেয়েকে পাশে বসিয়ে অধীর আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে সেই ছোটবেলার শিশুর মত মনটা অনুভব করলো। আজ আকাশের সে কি মাধুরী … কত লক্ষ্য তারার মেলা … কোনটা বেশ উজ্জ্বল, কোনটা আবার একটা জোনাকির মতো ছোট্ট, কোন এক অকল্পনীয় দূর থেকে যেন শুধু অধীরকেই একটু আনন্দ দেবার চেস্টা করছে। এ জীবনে তারারাই তার বন্ধু … সে ক্ষুদ্র এক মানুষ আর ঐ দূর আকাশের তারা … কত সহস্র লক্ষ কোটি বছর ধরে ওরা মানুষের সাথে বন্ধুত্বের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে আসছে … সব মানুষ তা বোঝে না। অধীর বোধহয় ওদের একটু বুঝেছিল তাই সেই ছোটবেলার স্মৃতি মনে করে ওরা আজও এসেছে। মানুষ অকৃতজ্ঞ হয়, ছোটবেলার বন্ধুত্বকে অনেকেই ভুলে যায় কিন্তু আকাশের তারারা কিছুই ভোলে না, সহস্র কোটি বছরের স্মৃতি হৃদয়ে নিয়ে ওরা আজও অধীরের বন্ধু, আজও রাত্রে ছাদে এলে ওরা কোটি লাইট ইয়ারের দূরত্ব তুচ্ছ করে অধীরের ভালো মন্দের খোঁজ নেয়। মানুষের জীবন বড় ছোট … দূর আকাশের তারারা তাদের দীর্ঘ জীবন নিয়ে মানুষের পাশে থেকে যায়। অধীর জানে যে তার চলে যাবার বহুবছর পরও তার আকাশের বন্ধুরা বহুদিন থেকে যাবে আর হয়তো এই পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে তাকে খুজে যাবে…।
অধীর একটু আনমনা হয়ে পরেছিল, ঝুম একটু অধৈর্য হয়ে আবার বললো …
ঝুম। বাবা, মা কি সত্যি আকাশের স্টার হয়ে গেছে? না হলে আর আমার কাছে আসে না কেন?
অধীর। আমিও আর তোর মাকে খুঁজে পাই না ঝুম। হয়তো সে আমার ওপর রাগ করে আকাশের তারার মাঝে হারিয়ে গেছে … আমি ঠিক জানি না।
ঝুম। বাবা, আমিও কি একদিন আকাশের স্টার হতে পারি? যদি পারতাম তাহলে হয়তো মাকে খুঁজে পেতাম।
ঝুম। কেন ঝুম … তোর বাবার সাথে থাকতে ভালো লাগে না?
ঝুম কিছু না বলে ওপর দিকে তাকিয়ে বসে রইল। অধীর ওর দিকে তাকালো … মেয়েটা কি অসম্ভব উৎসাহে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু খুঁজছে। অন্ধকার রাত্রে নক্ষত্র খচিত আকাশের এই অপরূপ মাধুরী যে না দেখে সে বড়ই অভাগা … তার মানব জন্ম বোধহয় সম্পূর্ন হয় না। অধীর নিজের মেয়ের জন্য এক গভীর বেদনা অনুভব করলো … তার মেয়ের জীবনের অসম্পূর্নতা এ যেন তারই অপরাধ, তারই পরাজয়। যা জগতের সব বাবা মাই নিজের সন্তানের মধ্যে দিয়ে যায় তা অধীর ঝুমকে দিতে পারে নি। ঝুম পায়নি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের অধিকার যা সব বাচ্চাই পেয়ে থাকে। আর যার সাথে এই দুঃখ শেয়ার করা যেত সেও বহুদিন আগেই নিজের হিসাব বুঝে নিজের ঠিকানা পাল্টেছে …। ঝুম তো না জেনেই প্রায়ই বলে যে মা ঐ আকাশের কোথাও তারা হয়ে লুকিয়ে আছে। অধীর এসব বিশ্বাস করে না, কিন্তু আজ এই অপরূপ জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে তারও মনে হোল যে এই বিশ্বের সব থেকে ভালো ঠিকানা বোধহয় আকাশ যেখানে সবার জন্য কিছু না কিছু জায়গা পাওয়া যাবেই … সত্যি সত্যিই হয়তো অপু একটা ছোট্ট তারা হয়ে কোথাও লুকিয়ে আছে … কিন্তু এই অগুন্তি তারার ভিড়ে তাকে সে আর ঝুম খুঁজে পাচ্ছে না।
ঝুমের কাঁপা কাঁপা গলা অন্ধকার থেকে আবার ভেসে আসে – বাবা, সপ্তর্ষী মন্ডল আজকে আকাশের কোথায় উঠেছে …?
অধীর বাঁ দিকে মাথাটা ঘোড়াল, কিন্তু সেদিকে সাততলা একটা হাই রাইজ আকাশকে ঢেকে রেখেছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না, শুধু বড় বড় অ্যাপার্টমেন্টের আলোকোজ্জ্বল জানলা আর কারো কারো ব্যালকনি। অধীর ডান দিকে মাথা ঘোড়াল, সেখানেও একটা পাঁচতলা অট্টালিকা।
অধীর। সপ্তর্ষী যেখানে ওঠার আজও উঠেছে ঝুম, তবে আমাদের ছাদ থেকে আর দেখা যায় না … তোর গোকুলকাকুরা একটা পেল্লাই বাড়ী বানিয়েছে যে।
ঝুম। বাবা, তাহলে আমি যখন বড় হবো, তখন আর সপ্তর্ষী মন্ডল দেখতে পাবো না?
অধীর একটু হাসলো – দূর পাগল, সবই পাবি। এই ছাদ থেকে না হলে তোকে পরাগ জ্যাঠার বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে দেখাবো।
অধীর বললো বটে কিন্তু তার চোখ দুটো অন্ধকারে একটু ছলছল করে উঠলো, সব সত্যি কথা সবাইকে বলা যায় না, নিজের বাচ্চাকে তো নয়ই। বাবা হয়েও অধীরকে বারবার ঝুমকে মিথ্যে কথা বলতে হয় …।
ঝুম ডান হাত দিয়ে বাবার হাতটা ধরলো, তারপর একটা হাই তুলে বললো – বাবা, ধ্রুব তারাটা আজ কেমন লাগছে?
অধীর। বেশ বড়, জ্বলজ্বল করছে।
ঝুম। বাবা, চাঁদ বড় না ধ্রুব তারা বড়?
অধীর। না না ঝুম, ধ্রুব তারা অনেক বড়।
ঝুম। তাহলে চাঁদটা অত বড় দেখায় কেন?
অধীর। চাঁদটা পৃথিবীর অনেক কাছে আছে তাই বড় দেখায় ঝুম।
ঝুম। বাবা, তুমি কি চাঁদে যেতে পার?
বাচ্চার কথা শুনে অধীর আবার একটু হাসলো – আমি না গেলেও লোকে যায় ঝুম।
ঝুম। তুমি কেন যাওনা বাবা?
অধীর। ঝুম, হঠাৎ কাউকে চাঁদে পাঠান যায় না, বুঝলি। অনেক দিন ধরে ট্রেনিং নিতে হয় তারপর কাউকে কাউকে পাঠান যায়। তাও আমাদের দেশ তো এখনো কাউকে পাঠাতে পারেনি … বাইরের অন্যান্য দেশ পাঠায়। তোর বাবা তো সেরকম দেশে জন্মায় নি আর সেরকম ট্রেনিং ও পায় নি।
ঝুম কি বুঝলো কে জানে, চুপ করে থাকলো। তারপর একটু পাশে সরে এসে বাবার কোলের ওপর শুয়ে পরলো, তারপর সোজা ওপর দিকে তাকিয়ে বললো – বাবা, আমি কোনদিন তারায় যেতে পারবো?
অধীর মেয়ের চুলে একটু হাত রাখলো – তারায় কোন মানুষ যেতে পারে না ঝুম। সে অনেক দূরের ব্যাপার …।
ঝুমের বোধহয় একটু ঘুম আসছিল, হাত দিয়ে চোখটা একটু ঘসে নিয়ে বললো – সে কি … কত দূর? বড় মা সেদিন বলছিল ওদের কে যেন অনেক দূর থেকে আসে, দের দিন সময় লাগে … তার থেকেও দূর?
অধীর এবার একটু জোরে হাসলো, তারপর আবার ওপরের দিকে তাকাল … অসংখ্য তারারা সেখানে কোন এক দারুণ রহস্যে মুচকি হাসছে … ওদের কার কাছে কি আছে তা আজও কোন মানুষ জানে না … ওদের রহস্য ওদের মুঠির মধ্যেই রয়েছে আর সেই রহস্য উজার করে দেবার জন্য ওরা পরম সমাদরে বহু দূরের কোন এক ছোট্ট নীল গ্রহের জীবনকে বহু সহস্র বছর ধরে ডেকেই চলেছে। সে ডাকে আজও মানুষের সারা দেবার যোগ্যতা হয়নি।
অধীর জানে যে বিজ্ঞানীরা আজকাল সারা ইউনিভার্স ধরে অন্য গ্রহে প্রানের খোঁজ করে চলেছেন। হয়তো কোথাও আছেও … এমন কোন গ্যালাক্সিতে যা খালি চোখে দেখাই যায় না। ছোটবেলায় অধীরের একটা কথা প্রায়ই মনে হোত … সেই কথাটা হঠাৎ এখন মনে পরে গেলো। এই পৃথিবীতে জনসংখ্যা কতো? প্রায় সাত বিলিয়ন …। আর ইউনিভার্সে তারার সংখ্য কতো? কেউ সঠিক জানে না কিন্তু আনুমানিক কয়েক ট্রিলিয়ন তো বটেই। তার মানে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ স্বছন্দে একটা করে আকাশের তারা পেতে পারে …। ঠিক কিনা? তখন বাবাকে প্রশ্ন করেছিল, স্কুলের ফিজিক্স টীচার তুষারবাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিল … সবাই হেসেছিল, পড়ে বলেছিল – শোন অধীর, এখন বুঝবি না, পরে বড় হলে দেখবি যে ওরকম ভাবে চিন্তা করে লাভ নেই, ওরকম জিনিস ঘটে না। আজ অবশ্য বোঝে কেন ওটা হয় না, যেখানে মানুষ যেতেই পারে না সেটা পেয়ে আর লাভ কি। আর যদি কোনদিন যাওয়াও যায়, তাতেই বা কি… সেই গ্রহের অ্যাটমস্ফিয়ারে মানুষ বাঁচবে কিনা তার তো ঠিক নেই। এই একটা ছোট্ট গ্রহেই একটু জায়গা পাবার জন্য সবাই যুদ্ধ করছে … দু দুটো বিশ্ব যুদ্ধ হয়ে গেলো শুধু একটু বেশী জায়গা পাবার জন্য।
আরো কিছু আগডুম বাগডুম ভাবছিল অধীর … অনেকদিন পর ছাদে এসে এ যেন তার কাছে বাস্তবতা থেকে একটু মুক্তি। দূরে গোপালদের তিনতলার ফ্ল্যাট থেকে শচীনদেব বর্মনের একটার পর একটা গান ভেসে আসছে … তুমি আর নেই সে তুমি … আমি ছিনু একা … ঘুম ভুলেছি … আজো আলাশের পথ বাহি …। অধীর জানে গোপালের বাবা পরিতোষবাবু, রাত্রে তাঁর ঘুম আসে না তাই একের পর এক পছন্দের গান বাজিয়ে জান নিজের ঘরে বসে। এর আগেও সে শুনেছে, আজও বেশ ভালো লাগছিল … হঠাৎ গায়ে একটা ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা লাগলো। অধীর আবার ওপর দিকে তাকাল … কয়েক মুহুর্ত আগের পরিস্কার আকাশ এখন যেন একটু থমথমে, চাঁদটা একটা কালো মেঘের তলায় চাপা পরেছে, সেই সন্ধ্যার মেঘগুলো আবার ফিরে এসেছে। ঝুম বোধহয় ঘুমিয়ে পরেছে … কোন সাড়াশব্দ নেই … বাবার কোলে পা দুটো গুটিয়ে শুয়ে আছে।
অধীর উঠে পরতে চাইল … আর নয়, এবার শুতে যেতে হবে, কাল আবার অফিস আছে। সে একটু নড়তেই ঝুম উঠে বসলো – বাবা, এখন কি নিচে যাবে?
অধীর। হ্যাঁ রে, এবার চল গিয়ে শুয়ে পরি, তোর তো ঘুম এসে গেছে … আমারও কাল আবার অফিস।
ঝুম মাথা নেরে আচ্ছা বলে দৌড়ে নিচে যাবার চেস্টা করলো। কিন্তু ছাদেই পড়ে থাকা একটা খালি টিনের গায়ে বেশ জোরে ধাক্কা খেয়ে পা চেপে ধরে বসে পরলো। ছাদে এই রকম কিছু বহু পুরনো অদরকারী ভাঙা জিনিস অনেক দিনই পড়ে আছে … এই সব টিন গুলো বহুদিন আগের কেনা রঙের টিন। এমন কিছু ভারি জিনিস নয় কিন্তু বাচ্চা মেয়ের পায়ে লাগতেই পারে।
অধীর। কিরে ঝুম, পায়ে লাগলো নাকি …?
ঝুম। না … এই একটু…।
বলে সে উঠে দাঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দু এক পা এগিয়ে গেলো। এই অন্ধকারে ঝুম কি আর ভালো দেখতে পায়, আবার হয়তো পরবে। অধীর এগিয়ে এসে ওকে কোলে নিয়ে বললো – চল, আজ আমি তোকে নিয়ে যাচ্ছি। ঘরে গিয়ে দেখি পা-টা কাটল কিনা।
অধীর আর ঝুম ঘরে ঢুকলো … ঝুমের বোধহয় ঘুম এসে গেছে। বাথরুম থেকে হাত পা ধুয়ে এসে অধীর ঝুমকে একটু জল খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। পাশের জানলাটা খুলে দিয়ে নিজেও বালিশটা তুলে দিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসলো। এখনই ঘুম আসবে না। পাশে ঝুম কেমন পা টা দুমরে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে … ও এভাবেই শোয়। হঠাৎ ঘুম জড়ান গলায় ঝুম বলে উঠলো – বাবা, আজকের আকাশটা খুব সুন্দর ছিল, না?
অধীর। হ্যাঁ রে…।
ঝুম। বাবা, গড়িয়া আমার একদম ভালো লাগে না, তুমি জান কবে আমি তারা হয়ে যাবো?
অধীর চুপ, এ কথার কোন উত্তর নেই। পাশের জানলা দিয়ে একটু ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়া আসছে … ঠিক পাশেই উচু মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং গুলোয় এখন গান আনন্দ হাঁসির আওয়াজ, রাত্রি এগারটা সেখানে এমন কিছু রাত নয়। ঝুম আবার কথা বলে উঠলো …
ঝুম। বাবা, আমি স্টার হয়ে গেলে মার সাথে দেখা হবে? মা আবার আমায় হাতে করে খাইয়ে দেবে?
অধীর অসহায় ভাবে একবার সেই পুরনো ফটোগুলোর দিকে তাকাল, অপু কিন্তু সেখান থেকেই তার দিকে হাঁসি মুখে তাকিয়ে আছে। তার মুখেও যেন কতো না বলা কথা। যে মেয়েটা মাত্র চার বছর সংসার করে চলে গেছে তার তো না বলা কথা থাকতেই পারে… কত অপূর্ন আশা মনের মধ্যে নিয়েই মেয়েটা চলে গেছে।
ঝুম বাবার কাছে সরে এলো, এসে অধীরের গেঞ্জীটা হাতের মুঠোয় নিয়ে পাশ ফিরে শুলো। তারপর চোখ বন্ধ করেই বললো – বাবা, একদিন তুমিও চলে এসো … আমরা সবাই ঐ আকাশে স্টার হয়ে থাকবো। ওখানে অনেক জায়গা বাবা, আমি তুমি আর মা অনেক ঘুরে বেড়াব।
অধীর অত্যন্ত সন্তর্পনে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। জানলার বাইরে তখন কোন কোন বাড়ীতে আনন্দের উচ্ছাস আর এই ঘরের মধ্যে বাবা আর মেয়ে একা …। অধীর ভালো মত জানে যে ঝুম কোনদিনই এই বিশাল আকাশের সৌন্দর্য দেখবে না। চোখের এক রেয়ার অসুখ নিয়েই ঝুমের জন্ম … জন্মের প্রথম বছরেও ঝুম কিছুটা দেখতে পেতো। বাচ্চা বলে প্রথমে কিছু বোঝা না গেলেও পরে ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানা গেলো যে ঝুমের চোখের নার্ভ শুকিয়ে আসছে … ঝুম যত বড় হবে তার দৃস্টি শক্তি ততই কমে আসবে। এই পাঁচ বছর বয়সে ঝুমের দৃশ্যমান জগত অনেকটা ঘষা কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখার মতোই … সেখানে কিছু ছায়া আর আলো আঁধারি ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। অপরাজিতা তাও সহ্য করেছিল, পরম স্নেহে অসুস্থ মেয়েকে কোলে করে সারা বাড়ী দৌড়ে বেড়াতো। যখন ঝুমের বয়স তিনের একটু কম তখন এলো সত্যিকারের শক্তিশেল। ঝুমের একটা শ্বাসকষ্ট শুরু হোল … কিছুতেই কমছে না। আবার চাইল্ড স্পেশালিস্টের কাছে যাওয়া হোল। নানা রকম ব্লাড টেস্ট, এক্স রে আর আর এম. আর. আই. টেস্টে ধরা পরলো … ঝুমের হার্ট অশক্ত। শরীরের সাথে সাথে হার্ট শক্তিশালী হচ্ছে না … ফলে ঝুম যত বড় হবে ততই তার হার্ট শরীরের পক্ষে প্রয়োজনিয় রক্ত পাম্প করতে অপারগ হবে। ধীরে ধীরে ঝুম বেশী করে ক্লান্ত হয়ে পরবে … তার শরীরের পেশীগুলোয় আর ব্রেনে যথেষ্ট অক্সিজেন থাকবে না। ডাক্তারবাবু বলেই দিয়েছেন যে ঝুম হয়তো তার দশ বছরের জন্মদিন পালন করতে পারবে না। অপরাজিতা এই আঘাত আর সহ্য করতে পারেনি … ডাক্তারের কাছ থেকে সেই খবর আসার পর অপু আর ছ-মাস সুস্থ ছিল। অপুর আঘাত ছিল মনে … । সব মায়েরই স্বপ্ন থাকে একটা সুস্থ্য সবল সন্তান … কিন্তু তার সন্তান তার চোখের সামনে ধীরে ধীরে প্রথমে চুপচাপ হয়ে যাবে, তারপর তার হাত পায়ের সমস্ত শক্তি আস্তে আস্তে চলে যাবে … তার চোখের দৃষ্টিশক্তি নস্ট হয়ে সে অন্ধ হয়ে যাবে … তারপর একদিন আসবে জখন সে আর বিছানা থেকে উঠতে পারবে না … তার সন্তানের এই ভবিষ্যাত অপুর মনে যে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল তা কোন ডাক্তারের পক্ষেই সারান সম্ভব ছিল না। নিজের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা … খাওয়া দাওয়ার প্রতি অনিহা … এই ভাবেই কাটছিল। অধীরের হাজার অনুরোধ বা উপরোধেও কোন ফল হয়নি … শেষে মাত্র তিনদিনের জ্বরে অনেক অভিমান নিয়ে তরুণী অপু চলে গেল।
এই তো মাত্র কিছুদিন আগের কথা। অধীরের বিবাহিত জীবন মাত্র চার বছরের মধ্যেই শেষ হোল। বাবা মা তো আগেই গিয়েছেন … সঙ্গে রইল অসুস্থ্য ঝুম। এই ভাবেই চলছে … অধীরের অবশ্য কোন অভিযোগ নেই কারো প্রতি। তার ছোটবেলা কেটেছিল বড়ই আনন্দে … স্নেহময় পিতা আর মমতাময়ী মার সাথে … ছোট্ট একটা পরিবারে যেখানে খুব বেশী টাকা পয়সা ছিল না কিন্তু হাঁসি আনন্দ আর ভালোবাসা ছিল। বাবার রিটায়ারমেন্টের পর অধীরের একটা সরকারি চাকরীও জুটে গিয়েছিল … ওনারা পরম স্নেহে আলহাদে ছেলের বিয়েও দিয়েছিলেন … তারপর অবশ্য তাঁরা বেশীদিন আর থাকেন নি আর তাই তারপরে তাঁদের একমাত্র ছেলের জীবনের ক্লাইম্যাক্স তাঁরা দেখেনও নি।
ঝুম তার ঠিক পাশেই শুয়ে ঘুমিয়ে পরেছে … হাত দিয়ে বাবার গেঞ্জীটা শক্ত করে ধরা। মেয়েটা এখনও একা শুতে বড় ভয় পায়। অধীর তার শক্ত হাত দিয়ে তার মেয়েকে আগলে রেখেছে বিপদের হাত থেকে … কিন্তু কিছু কিছু বিপদ অনিবার্য যা কোন পিতাই আটকাতে পারে না। অধীর খুব ভালোই জানে একদিন ঝুম চলে যাবে … অধীরের ভীষণ ভীষণ ভালোবাসাকে হেলায় সরিয়ে এই নীল গ্রহের অপরাজিতা বা গাঁদা ফুল, সুন্দর পাতাবাহার গাছ, রামধনু রঙা প্রজাপতি, সবুজ গঙ্গা ফড়িং… সূর্যাস্তের গেরুয়া রঙ সমস্ত ফেলে রেখে সে যাবে … কোন এক অজানা ভবিষ্যতে … হয়তো সত্যি সত্যিই কোন তারার দলে মিশে যাবে যা এই পৃথিবীর কেউ আজও বোঝে না। মেয়েটা যে বড় ভীষণ ভাবে আকাশের তারা হতে চায় … আবার তার মাকে কাছে পেতে চায়।
সে দিনটা আসবে … কিন্তু কবে আসবে তা অধীর জানে না। সে অসহায় ভাবে বিছানায় শুয়ে আছে … পাশে তার অসুস্থ্য মেয়ে ঘুমে অচেতন। পাশের বাড়ী থেকে এখনও ডিস্কো দিওয়ানের সুর ভেসে আসছে। অধীর আনমনা ভাবে জানলার বাইরে অন্ধকারে তাকিয়ে আছে আর দু একটা জোনাকির এদিক ওদিক ওরা দেখছিল… দূরে কোথায় জর্জ বিশ্বাসের উদাত্ত গলায় গান ভেসে আসছে – আকাশ ভরা, সূর্য তারা, বিশ্ব ভরা প্রাণ …তাহারই মাঝখানে… পেয়েছি মোর স্থান …।
-০-০-শেষ-০-০-
~ তারার মালায় ঠিকানা আমার লিখো ~