কোড নেম প্রমিথিউস

ততদিনে আমি কাসান্দ্রাকে বিয়ে করেছি। কাসান্দ্রা, এখানকার ইউনিভার্সিটিতে জুলজির মাস্টার্স করছিল। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ঝিনুক হল। আমাদের এই সাফল্যের সময় ঝিনুক তখন মাসখানেকের বড়। আমি ভাবছিলাম, আমি বোধহয় সুখের সপ্তম স্বর্গে আছি। কিন্তু হাইনরিখ যে কত বড় শয়তান, আমি সেটা তখনও জানতাম না। একদিন ল্যাবে, সমুদ্র যে ড্রয়ারটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, সেই ড্রয়ারটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে দু তিনটে চিঠি পেলাম, সবকটাই সিল করা হাইনরিখের নামে। একটা চিঠি খোলা ছিল। চিঠিটা খুলতেই কয়েকটা কাগজ নিচে পড়ে যায়। কাগজ গুলো কুড়িয়ে পড়া শুরু করি। পড়তে পড়তে আমার হাতপা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। চিঠির মূল বক্তব্য, হাইনরিখ আমার এই প্রযুক্তিকে তুলে দেবে বিদেশি রাষ্ট্রের হাতে, বিনিময়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ পাবে। সেই প্রযুক্তি সুপার সোলজার তৈরির কাজে ব্যবহার হবে।“

এখানে বর্ণালী একটা প্রশ্ন করল, “আচ্ছা স্যার, এরা সুপার সোলজার বানাতে চাইছিল কেন প্রযুক্তিটা ব্যবহার করে? এতে তো শুধুমাত্র সেলুলার রিজেনারেশন বাড়ে। এমন তো না, যে এতে কোনও মানুষ বিশাল শক্তিশালী হয়ে উঠবে বা অন্য কিছু?”

স্যার গম্ভীর মুখে বললেন, “ তুমি ব্যাপারটা তলিয়ে ভাবছ না বলে এই মন্তব্যটা করলে। তোমাকে দোষ দিই না, কারন যে প্রযুক্তি আমরা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম, হিউম্যান রিসোর্সের ওপর ব্যবহার করলে তার অ্যাঁপ্লিকেশনের কোনও সীমা পরিসীমা থাকত না।“

“কারণটা বলি। যেহেতু মানুষটার কোনও কোশই একবার নষ্ট হয়ে গেলেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ফিরে আসবে। কোনও ফেটাল ইনজুরিই আর তার কাছে ফেটাল নয়। তাই মানুষটাকে ভার্চুয়ালি ধ্বংস করা অসম্ভব। হাত পা কাটা গেলেও কয়েক মিনিট থেকে কয়েকঘণ্টার মধ্যেই তা আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। সেই মানুষের সহ্যক্ষমতাও অসীম হয়ে যাবে, দু-তিনশ কিলোমিটার হাঁটতে বললেও একটানা হেঁটে দেবে, কেননা তার পেশিকোশগুলো ল্যাকটিক অ্যাসিডে নষ্ট হয়ে গেলেও আবার আগের মত তৈরি হয়ে যাবে। একই কারনে সেই মানুষটা তার নিজের সমস্ত শক্তি একবারেই ব্যবহার করতে পারবে। আর, সে চাইলে তার শরীরের যেকোনো কোশকেই বেশি বেশি করে  তৈরি করে নিতে পারবে। ধরা যাক, সে বেশি বেশি করে কেরাটিন তৈরির কোশগুলোকে তৈরি করতে থাকল, যার ফলে তার শরীরের বাইরে এমন এক কেরাটিনের স্তর তৈরি হল, যাকে ভেদ করে বুলেট কিংবা পারমানবিক বোমার রেডিয়েশনও যেতে পারে না। জানই তো, পারমানবিক বিস্ফোরণে আরশোলা কেন মরে না? সেই এই কেরাটিনের জন্যই।“

আমরা স্তম্ভিত হয়ে শুনছি তখন। মনে মনে ভাবছি, স্যার কত বড় আবিষ্কার করে ফেলেছেন না চাইতেই। নিজের হাতেই মানবসভ্যতার হয়ত সবথেকে বড় শক্তিশেল তৈরি করে ফেলেছেন উনি।

তারপর আমিই জিজ্ঞাসা করলাম, “তারপর কি হল স্যার?”

স্যার বিষণ্ণ ভাবে বলতে থাকলেন, “আমি যে ঐ সিল করা চিঠি পড়ছিলাম। ওটা হাইনরিখ দেখে ফেলেছিল। সঙ্গে সঙ্গেই ও ছুটে চলে আসে, আমার হাত থেকে যেনতেনভাবে ঐ চিঠিগুলো কেড়ে নেবার জন্য। তারপরই ওর সাথে আমার বচসা শুরু হয়। গোলমাল শুনে কাসান্দ্রা ল্যাবে ঢোকে। ওর কোলে ঝিনুক ছিল। ঐ গোলমালের মধ্যেই হাইনরিখের হাত লেগে একটা বড় সালফিউরিক অ্যাসিডের বোতল ছিটকে গিয়ে পড়ে ওর ওপর…”

স্যার অনেক ক্ষণ ধরেই নিজের কান্নাটা চেপে রাখার চেষ্টা করছিলেন, আর পারলেন না। চোখ বেয়ে জল নামতে থাকল। আমরা স্যারকে কিভাবে সান্ত্বনা দেব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শেষে সমুদ্র আর বর্ণালী স্যারকে ধরে অনেক কষ্টে শান্ত করল। আমরা ঐ ল্যাব থেকে বেরিয়ে এলাম ল্যাবের দরজা বন্ধ করে।

ডাইনিং রুমে এসে প্রত্যেকে একটা চেয়ার দখল করে বসলাম। স্যার খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। চোখ লাল, কিছুক্ষণ আগের কান্নার জন্য। আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, “স্যার, তারপর কি হল?”

সমুদ্র আমার দিকে একবার ভুরু কুঁচকে তাকাল। ইঙ্গিতটা বুঝলাম, নিজে থেকেই তাই চুপ করে গেলাম।

স্যার ৫ মিনিট কেটে যাবার পর নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করলেন, “কিছুতেই মেয়েটাকে বাঁচাতে পারলাম না। হাইনরিখ ঐ কাণ্ডের পরপরই পালিয়েছিল। কিন্তু, জুলিয়াসের ঠিক সময়ে করা ফোনকলের জন্যই ওকে এয়ারপোর্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। যেহেতু ও জার্মানির নাগরিক, তাই দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ভাল হবার জন্য ওকে জার্মানিতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। সেখানে ওর ২০ বছরের কারাদণ্ড হল।“

“এদিকে আমার তো যা ক্ষতি আবার হয়ে গেল। আমার স্ত্রী, মেয়ের এই মৃত্যু সহ্য করতে পারল না। কাসান্দ্রাও মাসখানেকের মধ্যেই চলে গেল। আমি পড়ে রইলাম এই বিশাল বাড়ীটা আর তার নিস্তব্ধতা নিয়ে।“

স্যার চুপচাপ বসে রইলেন। ঘরে তখন পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতা। বাইরে শুধু ঝোড়ো  হাওয়া আর বৃষ্টির শব্দ।

স্যারের কথাগুলো যদিও শুনছিলাম, একটা কথা বারে বারেই খটকা লাগছিল। স্যারের মেয়ে নেই, স্যার দত্তক নিয়েছিলেন। কিন্তু দত্তক মেয়ের ও স্যারের মৃতা স্ত্রীর মত একই মুখের গড়ন? একই চোখমুখের আদল? এটা কিভাবে সম্ভব? এমনকি, কানের আকার, চুলের রং সব মিলে যায়।

একটা সম্ভাবনা বিদ্যুতের মত দ্রুত মাথায় খেলে যায়। বুড়ো জিপসির কথা মনে পড়ে আরেকবার। “ভবিষ্যৎ তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে, অসম্ভবের রূপ নিয়ে। পারবে তুমি, পারবে এই রহস্য ভেদ করতে? কারন এই পৃথিবীতে সবকিছুই সম্ভব, কারন মানুষের কাছে অসম্ভব বলে কোনও শব্দ নেই।“

তবে কি… তবে কি স্যার শেষ অসম্ভবটাও পার করতে পেরেছিলেন?

“স্যার,” আমি গলায় জোর এনে শুরু করি, “স্যার আপনি আমার আগের প্রশ্নটার উত্তর দেননি এখনও। আপনি বলেছিলেন, যে এই রিজেনারেশনের জন্য মানুষের সমস্ত কোশ পালটালেও স্মৃতি পালটায় না। কেন জিজ্ঞেস করাতে আপনি বললেন, যে এর উত্তর আপনার কাছে নেই। কিন্তু, এতটা সিওর হয়ে “স্মৃতি পালটায় না।“ এই কথাটা বলার জন্য প্রমাণ লাগে। প্রশ্ন হল, কার বা কিসের ওপর এই পরীক্ষা চালিয়ে প্রমাণ পেয়েছিলেন আপনি?”

স্যার অবাক হয়ে গিয়েছেন, আমার কথা শুনে। আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। সমুদ্র আর বর্ণালীও উঠে দাঁড়িয়েছে। তাদের চোখে আমার প্রতি অবিশ্বাস স্পষ্ট, মানে তারা ভাবতেও পারছে না, আমি দুম করে এই প্রশ্নটাও করব। কিন্তু, স্যারের মুখে কোনও উত্তর নেই। স্যার একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।

আমি তখনও বলে চলেছি, জানিনা কি ভর করেছিল তখন আমার ওপর, তবু পরের প্রশ্নটা করা থেকে নিজেকে আটকাতে পারলাম না। “ তাছাড়া, কয়েকটা জিনিস আমার অবাক লেগেছে। আপনার মেয়েকে আপনি বোর্ডিং স্কুলে রাখলেন, পড়ালেন, অথচ বছরে একবার কি দুবারের বেশি খোঁজ নিতে আসতেন না। অথচ, কিছু একটা ঘটল, যার পর থেকে আপনি এখানেই পাকাপাকি ভাবে থেকে গেলেন, আর দেশে ফিরলেন না। তার মানে, আপনি আপনার মেয়ের প্রতি হঠাৎ করেই এতটা দায়িত্বপরায়ণ হয়ে উঠলেন কেন, ভাবতে কষ্ট হয়। আর শেষ প্রশ্ন, আপনার মেয়ে তো আপনার দত্তক নেওয়া, তাই না?”

বলতে বলতেই আমার মাথায় উত্তরটা জলের মত এসে গেল। কেন উনি কাজে রিজাইন দিয়ে গ্রিসে পাকাপাকিভাবে চলে এসেছিলেন ঝিনুকের কাছে। আমি একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলাম, নিজের স্বরটা নিজের কাছেই বড্ড বেমানান শোনাল, “আপনার ফিরে আসাটা কি হাইনরিখের ফিরে আসার সাথে সম্পর্কিত?”

দেখলাম, স্যার ঢোঁক গিললেন একবার। কপালে ওনার ঘাম দেখা দিয়েছে। মাথা নাড়তেও যেন ভুলে গেছেন উনি। অতিকষ্টে মাথা নাড়লেন ওপরে নিচে একবার।

 

~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৩) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১২)
Next articleকোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ১৪)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments