চোখ খুলেই দেখলাম একটা মেয়ে বসে চুপ করে, কান দিয়ে টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে তার আর মিলিয়ে যাচ্ছে মেঝের নীলাঞ্জনে৷ আমি তাকে আগে কখনো দেখিনি, নাকি দেখতে চাইনি?
সেও কি আমার ভিতরে লুকিয়ে থাকা পাষাণের শিকার৷ মাথার মধ্যে এত কথা-প্রশ্ন চলতে থাকার মাঝে হঠাৎ দেখলাম তার গলার একপাশে একটা কার্ড ঝুলছে৷ একটু ভাল ভাবে দেখতেই বুঝলাম সেটাতে এই মর্গেরই একটি নম্বর বসানো৷ চমকে উঠলাম, চেয়ার থেকে উঠে এগোতেই মেয়েটি উধাও৷ কিন্তু ঘরের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবেশের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলাম৷ বাঁদিকের ঢাকা পরে থাকা মৃতদেহরা যেন চিল্লিয়ে উঠল৷ তারপর আবার শান্ত চারিদিক৷
সবে রাত দুটো তখন, ভাবলাম ঘুম চোখে কি দেখতে কি দেখলাম,দিয়ে আবার চেয়ারে বসে চোখ দুটো বন্দ করলাম৷ কিছুটা অস্থিরতা মনে কাজ করলেও ,রাতের ঘুম তাকে গ্রাস করলে৷ তবে আবার সেই ফিরে আসা আর চলে যাওয়ার লড়াইয়ে জড়িয়ে পরলাম৷ চোখ খুলে চুপচাপ তাকিয়ে থাকলাম দেওয়ালের দিকে৷
বেশ কিছুদিন ধরে একটি চরিত্রের দিকে আকর্ষিত হয়ে চলেছি, এমন একজন যে কথা বলেনা, ফিরে দেখে না সে,তার সময় থমকে দাড়িয়েছে৷ আর তার সাথে থমকে দাঁড়াবার চেষ্টায় প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু বরণ করেছি আমি৷ আমি চোখের সামনে শেষ নিশ্বাস ফেলতে দেখিনি কাউকে কখনো, কিন্তু আমি বাস করেছি তাদেরই মাঝে এক নিশ্বাস- প্রশ্বাস হীন ঘরে৷ কিন্তু কখনো ভাবতে পাড়িনি যে মৃত কখনো মৃত্যুকে ভালবাসিয়ে তুলতে পারে৷
না আমি কোনো মর্গে কাজ করিনা, তবে নিজস্ব মর্গের মালিক৷ আমি খুনি, কিন্তু আমি কোনো কারনে কাউকে কখনো মাড়িনি৷ আসলে আমার এই পৃথিবীতে পা রাখা মৃত্যুরই হাত ধরে৷ যে মায়ের প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে চলা শুরু করেছিলাম এই পৃথিবীর পথে, সেই মাকে আমি কখনো দেখিনি৷ অনুভব করতে শেখার মুহূর্ত থেকেই আমায় কাছে টেনেছিল মৃতদেহের গন্ধ৷ যেন কত না পাওয়া, কত রাগ-অভিমান মিশে সেই গন্ধে৷ এই গতিশীল সমাজ আমায় অনেক আগেই ত্যাগ করেছে, তাই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছি এই মৃতদের ভিড়ে৷
আমি বেঁচে থাকতে মানুষ মারি ,
আমি জলের পিপাসায় মানুষ মারি
আমি মারব বলে মানুষ মারি৷
আমার বনলতা আমায় চেনেনা,কিন্তু আমি তার দিকে চেয়ে রই পলকহীন দৃষ্টিতে৷ আর শুধু ভাবি , কবে তাকে গিয়ে বলব,
“আমায় মৃতসঞ্জীবনী বশ করতে ব্যর্থ শুধু তোমারই কারণে…”. তার চোখে আমি কখনো একফোটা ভালবাসার ছোঁয়া দেখিনি,তবু ভেবেছি সে ই ভালবাসার আধার৷
এত চিন্তাভাবনার মাঝে আবার দেখি চেয়ারে ফিরেছে সেই মেয়েটি৷ এখনো রক্তের ধারা একটুও কমেনি, এখনো জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা কিছুটা জমেনি মানিয়ে নেওয়ার খাতায়৷ চোখ পরলো তার হাতের দিকে, রক্ত চুইয়ে পড়ছে তার হাতের ছুরি থেকে৷ অন্যদিকে তাকাতেই দেখি আমার বনলতা বসে, আজ সে সেজেছে আমায় নিয়ে যাবে বলে তার সাথে৷ মন বললে, “তাহলে আর দেরি কিসে?…”
কিন্তু.. ছুরিকাঘাত নতুন কোথায়, আমি তো রোজ খেলেছি তাকে নিয়েই….
তবে নিষ্ঠুর কিছু?
ছুরি দিয়ে তারপর আঘাত করতে থাকলাম নিজেরই মাথায়৷ রক্ত ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে পরল সারা মেঝেতে৷ আর দূরে বাজচ্ছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের “মহিষাসুরমর্দিনী”৷
এভাবে অসুর মারা যায়, এভাবেও দেবীপক্ষের আগমনী ঘটে৷৷
শুধু মৃত মন প্রতিবাদ জানিয়ে বললে,”বনলতা, এভাবেও তোমার কাছে যাওয়া যায়, এভাবেও ঘরে ফেরা যায়।।