র্তমানে বাউল তথাপি বাংলার লোকজ সংস্কৃতির যে প্রসার ঘটেছে সেটাকে কেন্দ্র করে বহু লোক শিল্পীরাই লাভবান হচ্ছে। বিশেষ করে এই লোক সংস্কৃতির অন্যতম বাউল সম্প্রদায় এক অনবদ্য স্থান পেয়েছে। বহু সংস্থাইবর্তমানেএসেছে তাদের পাশে দাঁড়াতে।এই বাউল শিল্পীদের এখন প্রসারের নমুনা দেখা যায় বিভিন্নরূপে যেমন কখন‌ও শহরের পূজা মণ্ডপের অনুষ্ঠান বা কখন‌ও ফোকফেস্টিভ্যালে আবার কখনও ঘরোয়া আসরে বা মানুষের ঢোল নামে পরিচিত বাউলের আখড়া গুলোয়। এ ছাড়া রয়েছে কেঁদুলির জয়দেবের মেলা, শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা, সেই সাথে নতুন প্রজন্মের প্রচেষ্টায় শহরের বুকে জেগে উঠা বাউল মেলা।

এই সকল মেলা প্রাঙ্গণে দেখা মেলে বহু প্রবীণ ও নবীন বাউল -বাউলানিদের। শহরের মানুষদের উচ্ছ্বাসে মেলা প্রাঙ্গণ গুলি গম্ গম্ করে। মেলা প্রাঙ্গণে ছোট ছোট দলে বাউলদের ঘিরে বসে থাকে বেশিরভাগ নতুন প্রজন্মের মানুষ। সেখানে কখনো চলে গান,কখনো বাউল দর্শন নিয়ে আলোচনা,আবার কোথায়ও মেজাজে চলে তামাক ইত্যাদি সেবন। লক্ষ্যকরলে দেখা যায় শহরের মানুষের পোশাকেও ধরা পড়ছে বাউল প্রভাব। তাপ্পি আলখাল্লা, তাপ্পি জ্যাকেট,বড় চুল দাড়ি,গলায় হাতে বেশ কয়েকটা মালা ,আবার কারো মাথায় ফেট্টি বাঁধা,কাঁধে কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ। বলা বাহুল্য এগুলো সবই বাউলদের দেখে অনুকরণ করা ….”দি বাউল ফ্যাশন”। সেই সাথে চলে অত্যাধুনিক মোবাইল ফোনের সাহায্যে একের পর এক সেলফি ক্লিককিং এন্ড ফেইসবুকে বিভিন্ন স্টেটাসে দিয়ে পোস্টিং। সঙ্গে সঙ্গে কমেন্টসের ঝুড়িতে জমা হয় ” জয় গুরু”,”জয় রাধে”;আর প্রতি উত্তর স্বরূপ আবারো লেখা হয় “জয় গুরু”। এক কথায় বাউল সংস্কৃতি একটা অনন্য রূপে বেশ কিছু মানুষের জীবনে ঢুকে পরে নাড়া দিয়েছে মানুষের মনের সুপ্ত চিন্তা গুলোকে।

বর্তমানে দেখা যায় যে সকল সঙ্গীত শিক্ষার প্রচলন আছে বাংলায়; তারমধ্যে অন‍্যতম বাংলার ঐতিহ্যপূর্ণ বাউল সঙ্গীত যার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন তত্ত্বমূলক গান যথা: দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব ,ঈশ্বরতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব ,প্রেমতত্ত্ব, মানবতত্ত্ব, সৃষ্টি তত্ত্ব ইত্যাদি।

কিন্তু প্রশ্ন এটাই বাউল কি শুধু সঙ্গীতের একটা ধারা নাকি সংগীতের মাধ্যমে কোনো অন্তর্নিহিত গভীর দর্শন কে তুলে ধরা? এই উত্তরটা আমরা অনেকেই হয়তো জানি ; বাউল গান দর্শন মূলক। বাউল গান শেখা বা গাওয়া সম্ভব কিন্তু তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা অতীব গভীরতম রহস্যাবৃত দর্শন যা বাউলের মূল কাঠামো সেটা শেখা ব জানা কতটা সম্ভব?

বাউল সহজিয়া ও বর্তমান প্রজন্ম

নবীন বাউল শিল্পীদের কাছে আমরা অনেক সময় দেহ তত্ত্ব বা সহজিয়া সাধনার কিছু কিছু কথা শুনি ! বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে সহজিয়া দর্শন যে রূপে বর্ণিত হচ্ছে তা সব ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য নয় বলেই আমার মনে হয়। কারণযিনিসহজিয়া সাধনের ব্যাখা দিচ্ছেন বা বলছেনতিনি কি নিজে সহজিয়া সাধন করেছেন ? অথবা যিনি শুনছেনতিনিকি মানসিক ভাবে এতোটা পোক্ত ও প্রস্তুত সহজিয়ার এই গভীরতাকে অনুধাবন করার জন্য ?

সহজিয়া শুধু মাত্র রতি ধারণের পদ্ধতি বা সাধনার পন্থা নয়।এই সাধনা প্রাথমিক স্তরে সহজ হওয়ার বার্তা দেয়।জটিলতার মাধ্যমে মনের মানুষকে খোঁজা এক দূরহ ব্যাপার। ঈশ্বরসহজ‌ ও সরল, তাই তার অনুসন্ধানকারীকেও হতে হবে সরল শিশুর মত।

বাউল সহজিয়ার ইতিহাস দেখলে অনেক গুলো ধর্ম যথা সনাতন হিন্দু ,ইসলাম ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব দেখা যায়।অর্থাৎ বাউল সহজিয়া সম্মত সাধন ক্রিয়ার মধ্যে এই সকল ধর্মের সাধনার পথ ও দর্শনের বেশ কিছু অংশ মিশ্রিত হয়ে আছে। বৈষ্ণব সহজিয়ার মধ্যে আছে বামাচারী তন্ত্রের বেশ কিছু ক্রিয়া পদ্ধতি। এই ঘরাণার উচ্চ মার্গিক সাধকগণ পঞ্চম‌আকারে সাধন করে অন্তর্মুখী স্বরূপে।

রবার্ট মেঙ্গের (MENGER )এর একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ২৮ নভেম্বর ২০০০ সালে ইনস্টিটিউট অফ ফিজিক্স ভুবনেশ্বর থেকে “THE BAULS OF BENGAL“। তিনি লিখেছেন বাউল সর্ব জাতি, সর্বধর্ম নির্বিশেষে একটি গোষ্ঠী,যারা মনে করে এই মন্দির স্বরূপ দেহে ঈশ্বরের নিবাস। আধ্যাত্মিক মুক্তি বা মোক্ষ লাভের এক মাত্র উপায় এই দেহের মধ্যে ঈশ্বর তথাপি মনের মানুষের অনুসন্ধান দ্বারা।এই সত্যের পথ কে অবগহন করে মোক্ষলাভই বাউল সম্প্রদায়ের  একমাত্র লক্ষ্য। এই অনুসন্ধানের পথে  আছে যোগ এবং তন্ত্রের মিশ্রিত ক্রিয়াকান্ড।এসকল ক্রিয়া ও গুপ্ত বিদ্যা রপ্ত করতে প্রয়োজন সদ্ গুরুর নিকট কট্টর অধ্যায়ন ও সাধনা।বাউল সাধুগণ ও সদ্ গুরু যারা এই  মার্গ দর্শনে উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন,তাঁরা তাদের শিষ্যদের কাছে এসকল সাধন ক্রিয়া ও তত্ত্বের নির্দেশ দেন সেই দেহতত্ত্ব বা গুরুতত্ত্ব ইত্যাদি গানের মাধ্যমে।

বাউল সম্প্রদায়ের সকল সহজিয়া ক্রিয়া সংরক্ষিত আছে যৌগিক শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়া, ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্নার ভিতর,বাউলেরা বলে থাকে দমের খেলা ! তাই লালন সাঁইজি বলছেন-

“সপ্ত   তোলা  ভেদ  করিলে  হাওয়ার  ঘরে  যাওয়া  যায়,

হাওয়ার  ঘরে  গেলে  পরে  অধর  মানুষ  ধরা  যায় ….!!”

বাউলেরা বলেন সপ্ত তলার কথা,যোগ মার্গে এই সপ্ত তলাই ষটচক্র ও তার উপরে সহস্রার কে বোঝানো হয়। কুণ্ডলিনী শক্তি ভেদ করলে দেখা মেলে আলেক মানুষের ;অর্থাৎ চেতনার চৈতন্য হয়, জীবআত্মা মিলিত হয় পরমাত্মার সাথে ও সদা ভাসমান হয় সচ্চিদানন্দ সাগরে।

বাউল সাধনার অপর এক অংশ হল “রতি সাধনা”। রতি সাধনার মাধ্যমে কাম ও মনকে নিয়ন্ত্রণ করে আধ‍্যাত্মিক উন্নতি অর্জন এবং দেহকে স্হির ও শক্তিশালী করে রাখার এক দেহ সাধনা।এটা “দম সাধনার” অন‍্যতম অংশ।”দম” তথা শ্বাস প্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই কাম ও মন নিয়ন্ত্রণে আসে। বাউলগণ দমের সাধনা করেন যৌগিক ক্রিয়া ও প্রাণায়াম দ্বারা। তার মধ্যে কুম্ভক সাধনাই প্রধান। এছাড়াও আছে রেচক,পূরক, কপালভাতী ইত‍্যাদি। ষটচক্র কে জেনে ও কর্ম করে দেহকে অটল রাখাও রতি সাধনার অংশ।

উর্ধ্বরতিকে শ্বাসের দ্বারা ষটচক্রে প্রবাহিত করে কুন্ডলীনি শক্তিকে জাগ্রত করা হল কাম সাধনা। শুদ্ধ ও সূক্ষ প্রেম বিনা রতি সাধনা হয়না। কামরূপ থেকে প্রেমরূপে জাগরণ হল রতি সাধনায় সিদ্ধিলাভ। সহজ, শান্ত, শুদ্ধ চিত্তে মহাপ্রেম অর্থাৎ ঈশ্বরপ্রেম জাগৃত হয়।

বাউল সহজিয়া ও বর্তমান প্রজন্ম

সাধন সঙ্গিনী বাউল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সাধন সঙ্গিনী রতি সাধনার মাধ্যম। সহজ, শান্ত ও সুন্দর মনে ষাটচক্র ধ‍্যানের মাধ‍্যমে চলে রতি সাধনা। আধুনিক সমাজ রতি সাধনাকে শুধুমাত্র যৌন মিলনের সাথে এক করে ফেলেছে। বর্তমান সমাজে বাউল বেশ ধারণ করে নিত্যানতুন সঙ্গিনীর সাথে যৌনসম্পর্ক করে নিজেকে বাউল নাম দেয়। এরা কেবল মাত্র বাউল ভেকধারী তথাকথিত বাউল গানের গায়ক বা শিল্পী। ইচ্ছে মত অবাধ ও অবৈধ যৌন জীবন যাপন বাউল তত্ত্ব নয়।রতি সাধনা কাম নিয়ন্ত্রণ শেখায় যা মনকে শান্ত করে। আর শান্ত মনে ঈশ্বর বাস করেন।

বর্তমান সমাজ “বাউল” কি, “বাউল দর্শন” কি কতটুকু জানে সেটাই মূল প্রশ্ন। তথাকথিত সুশীল সমাজের তৈরি নিয়মের বেড়াজালে বাঁধা যায় না বাউল সমাজকে। লোক দেখানো বাউল বেশ ধারণ করে, কিছু গান গেয়ে,অবাধ যৌনাচার করে কেউ বাউল হতে পারে না। বাউল একটা দর্শন, একটা সাধনা। পরম ব্রহ্মকে পাওয়ার সাধনা। শুভ-অশুভের উর্ধ্বে গিয়ে শুদ্ধ ও পূর্ণ হৃদয়ে ঈশ্বর প্রেমে মগ্ন হবার সাধনা। বাউল দর্শনে জীবাত্মা রহস্যময়, অজানা এবং অস্পৃশ্য এক সত্তা স্বরূপ।

“ কোন রসে কোন রতির খেলা।

জানতে হয় এই বেলা।।

সাড়ে তিন রতি বটে

লেখা যায় শাস্ত্রপাটে

সাধ্যের মূল তিন রস ঘটে

   তিনশ’ ষাট রসের বালা।“

 

সম্পাদনা ও অলংকরণঈশিতা প্রীতম

 

~ বাউল সহজিয়া ও বর্তমান প্রজন্ম ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleইচ্ছাপূরণ
Next articleদাস্তান এ ইঞ্জিনিয়ারিং
Supratim Chowdhury.CMT
HR Expert, Researcher, Social Activist, Speaker, Musician
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments