আজ শনিবার। সপ্তাহের শেষ দুটো ছুটির আজ প্রথম দিন। হ্যাঁ, আমার শনি আর রবি দুদিনই ছুটি থাকে। অনেকের মতোই বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা গেছে কমে। তাই ছুটির দিনে নির্ভেজাল আড্ডা বলতে যা বোঝায় তা আমার জীবন থেকে একরকম বিদায় নিয়েছে। ছুটির দিনে বাড়িতে অফিসের কাজ নিয়ে আসি। আপন মনে নাড়াচাড়া করে ভালই কাটে দুটো দিন কারণ কাজটা আমার মনের মতো। কথা আমি কমই বলি আর সেই সুবাদে শুনি অনেক বেশী। আমার স্ত্রীর এই ব্যপারে অন্ততঃ, আমার সঙ্গে কোন মিল নেই। যতোক্ষণ জেগে থাকেন নিজের মুখকে অথবা অপরের কানকে বিরাম দেওয়ার মতো ক্লান্তি তাঁর কখন আসে না। সভ্য সমাজে বিষয় বৈচিত্রের যে কোন সীমা-পরিসীমা আসলে নেই সেটা তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ থাকলে উপলুব্ধ হবে। এখন তিনি শ্রোতা হিসেবে আমাকে যথেষ্ট রসিক গন্য না করে মোবাইল ফোনকে মাধ্যম করে তাঁর শ্রোতার ব্যাপ্তি দিকে দিকে বিস্তৃত করে চলেছেন। মাসের শেষে টেলিফোন বিল যাই আসুক না কেন, তাঁকে ভয় দেখায় এমন অঙ্কের বিল টেলিফোন কোম্পানীর অফিস থেকে বেরোয়নি আজও, আমি স্বয়ং গৌরীবাবু রয়েছি তো তাঁর পাশে। এহেন দুজন শ্রোতার সঙ্গে ঘন্টা খানেক দুটি বিষয় নিয়ে নাতিদীর্ঘ আলোচনার পর্ব শেষ করে আমার সঙ্গে একটি নতুন বিষয় নিয়ে আলোচনা মাত্র শুরু করে ছিলেন, এমন সময় আমার ফোনটা বেজে উঠলো…

হ্যালো!

ওপার থেকে একটি ভারী অচেনা গলা ভেসে এলো, “আমি কি নীলাদ্রিশেখর রায়ের সঙ্গে কথা বলছি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, নীলাদ্রিশেখর বলছি।”

“বিরূপাক্ষ সেনগুপ্ত কথা বলছি। নাম শুনে কি চেনা যাচ্ছে নাকি আরো পরিচয় দিতে হবে?”

আমি বললাম, “আর একটু পরিচয় দিলে ভাল হতো। ঠিক মনে করতে…”

বিরুকে মনে পড়ে? সেই হেয়ার স্কুল, মির্জ্জাপুর ষ্ট্রীটের পাড়া।

“আরে বিরু, কি খবর তোর, এতদিন পরে মনে পড়লো?”

“চিনতে পেরেছিস তাহলে।” বলল বিরু।

কি বলছিস চিনতে পারবো না।

পারিসনি কিন্তু প্রথমে।

কতোদিন পরে বলতো, কম করেও চল্লিশ বছর, একটু সময় লাগবে না?

হ্যাঁ তা হবে। তখন স্কুলের গোন্ডীপার হয়েছি মাত্র। তোকে এখন দেখলে চিনতে পারবো কিনা কে জানে।

আমার টেলিফোন নম্বর পেলি কি করে?

সব কথা বলবো সাক্ষাতে। আগে বল আজকে ফ্রি আছিস কিনা।

আজ আমার ছুটি, বাড়িতেই আছি।

বাড়ির ঠিকানা আর লোকেশানটা বল চট করে। তোর সঙ্গে খুব দরকার আমার। আর আজই দেখা হওয়াটা জরুরী, নইলে দেরী হয়ে যাবে।

দরকারটা কি বল না, হেঁয়ালি করছিস কেন?

বললাম তো সাক্ষাতে বলবো।

বাড়ির ঠিকানা আর লোকেশানটা বলে দিলাম বিরূকে।

বিকেলে কখন গেলে তোর বউ বিরক্ত হবে না বল।

বিরক্ত হওয়ার কোন কথাই নেই, আয় না পাঁচটা নাগাত। চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে।

বিরূ টেলিফোন ছাড়লো। যতো সময় কাটতে থাকলো বিরূর হঠাৎ টেলিফোন, তারপর সরাসরি বাড়িতে আসতে চাওয়া এবং সেটা আজকেই, এই ব্যপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুললো। কলেজে পড়তে দুজনেই রাজনীতি করতাম। প্রথম দিকে না হলেও পরে মতাদর্শের বিরোধ দেখা দিলো। সেই বিরোধ এক সময় চরমে উঠেছিল। এরপর বিরূ কলেজ ছেড়ে চলে গেল আর চলে গেল তার সঙ্গে আমার সব যোগাযোগ।

বিরূ আর আমি মির্জ্জাপুর স্ট্রীটের এক নাম-গোত্রহীন গোলিতে পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। পাড়ায় আমরা ছিলাম খুব পরিচিত মুখ আর ক্লাবের ছিলাম পান্ডা। আমাদের নাটকের একটা দল ছিল। আমার যেমন নাটক, গান, বাজনার দিকে ঝোঁক ছিল, বিরূর ছিল খেলাধুলোয়। কিন্তু দুজনে বন্ধু ছিলাম হলায়-গলায়। একদিনও একজন আর একজনকে ছেড়ে থাকতাম না। বিরূর চেহারাটা ছিল ভারী সুন্দর আর বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার কন্ঠস্বর হয়ে উঠল সুগম্ভীর। সেবারে সরস্বতী পুজোর পরে পাড়ায় অনুষ্ঠান হবে, পরিচালনার       ভার পড়ল আমার ওপর। মনে মনে। ঠিক করলাম বিরূকে দিয়ে রবি ঠাকুরের আফ্রিকা আবৃত্তি করাবো। বিরূকে প্রস্তাবটা দিলাম। ও আমার প্রস্তাব শুনে কিছুতেই রাজী হল না, বললো, “ওরে বাবা, পাড়া ঝেঁটিয়ে লোক আসবে, তার ওপর অতো বড় কবিতা। তুই ক্ষেপেছিস, মাঝপথে অতো লোকের মাঝখানে সব ভুলে যাবো। তারপরের ব্যপারটা ভেবেছিস কি একবারও? ছেলেমেয়েরা উঠতে বসতে প্যাঁক দেবে। তখন আমাকে কে বাঁচাবে চাঁদু…রবি ঠাকুর?”

অগত্যা, আবৃত্তি ছেড়ে নাটকের একটা গুরুত্বপুর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের ব্যপারে বিরূ রাজী হয়ে গেল। আমার একটা ধারনা, কেন জানিনা, ক্রমশঃ বদ্ধমুল হচ্ছিল বিরূ এই চরিত্রের জন্যে আদর্শ অভিনেতা হতে পারবে। এক মাস রিহার্সাল চললো চুটিয়ে। প্রথম দিকে অভিনয় ব্যপারটাই বিরূর আসছিল না কিছুতেই। ও ছিল ভিষণ আড়ষ্ট এবং হাত-পায়ের জড়তা থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছিল না। তাছাড়া পাঠ মুখস্থর ঝামেলা তো ছিলই। আমারও ছিল গোঁ, কারণ বিরূকে ঠিক মতো মেকআপ করতে পারলে সেই চেহারা আর গলা আমার নাটকের চরিত্রকে ঠিক ফুটিয়ে তুলতে পারবে। একটা কথা এখানে প্রাসঙ্গিক যে নাটকের রচয়িতা আমি নিজেই। দিন পনেরো কাটার পর একটু একটু করে অভিনয়টা আসতে শুরু করলো, বিশেষ করে পাঠ পুরোপুরি মুখস্ত করানোর পর। বিরূর জন্যে রিহার্সালের সময়ও আমি কিছু দর্শকের ব্যবস্থা রাখতাম যাতে ওর নার্ভাসনেসটা কেটে যায়। নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দু-তিন দিন আগে বুঝতে পারলাম বিরূ নাটকটা উৎরে দেবে। দেখলাম বিরূকে দিয়ে যা করাতে চাইছিলাম তার পঁচাত্তর ভাগ পেতে আমার তালিমের পদ্ধতি কাজ করেছে। অনুষ্ঠানের পরে দর্শকদের প্রশংসা কুড়োল বিরূ। তারপরের তিন বছর আমাদের ফিরে তাকাতে হয়নি। তিন বছরে তিনটে নাটকে বিরূ অভিনয় করলো রীতিমতো পাকা অভিনেতার মতো। বিরূ আমাকে ওর গুরু বলে মানতো আর আমার প্রতি ওর কৃতজ্ঞতা বোধটা ছিল একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশী। এক বয়সী জেনেও মঞ্চে নামার আগে আমাকে ভয়নক অস্বস্তিতে ফেলে প্রণাম করতো প্রত্যেকবার। বেশ গোটা কতোক কল শো করেছিলাম আমরা।

তারপরে এলো দুঃসময়ের দিন। রাজনৈতিক মতমতের চরম বিরোধের জেরে বিরূ আর আমার মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকলো। এক সময় বিরূ হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে।

আজ প্রায় চল্লিশ বছর পরে, আমার জীবন থেকে যার অস্তিত্ব সম্পুর্ণ মুছে গিয়েছিল, সেই বিরূ হঠাৎ ফিরে এসেছে। ছবির মতো একের পর এক, আমার ছেলেবেলা, আমার পুরণ পাড়া, কতো অসংখ্য রাগ অভিমান, সেকালের গান আর সব সঙ্গী-সাথীরা এসে ভীড় করছে। পুরণ পাড়ায় ছেলেবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার সুবাদে প্রতিবেশীরা আর প্রতিবেশী ছিলেন না, হয়ে উঠেছিলেন একান্ত ঘরের মানুষ। তাঁদের সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম অজান্তে আর তার বদলে পেয়েছিলাম নির্ভেজাল, অপরিসীম বিশ্বাস আর ভালবাসা।

আমাকে একটু অবাক করে ঠিক কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটার সময় বেল বেজে উঠলো। দরজার বাইরে যে ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে আছেন, একটু অসুবিধে হলেও, তাঁকে বিরূ বলে চিনতে অসুবিধে হলো না। মাথায় এলোমেলো কাঁচাপাকা চুল, দীর্ঘ চেহারায় মানানসই পাঞ্জাবী-পাজামা, চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা আর কাঁধে একটা ঝোলানো ব্যাগ।

“কে নীলু তো? নাকি চালসে চোখে ভুল দেখছি।”

আগন্তুকের গুরু-গম্ভীর গলায় আমার বহুপরিচিত নাম শুনে বিরূর হাত ধরে ভিতরে নিয়ে এলাম।

“আয় বিরূ আয়, কতোকাল পরে দেখা হলো। সময়ের ব্যপারে আশ্চর্য রকম পার্টিকুলার তুই। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় পাঁচটায় পৌঁছেছিস।” বললাম আমি।

“সে তো আমার গুরুর শিক্ষা। সময় মতো রিহার্সালে বা মিটিঙে না পৌঁছলে যে গালাালি জুটতো কপালে সেটা ভুলে গেছিস নাকি? অভ্যেসটা রয়ে গেছে। খানিকটা তোকে আদর্শ করেও বলতে পারিস।” এক নাগাড়ে বলে গেল বিরূ।

“আমি আদর্শ…বলিস কিরে! ঠিক ভাবতে পারছি না।” দেখলাম বিরূর অস্বস্তিতে ফেলে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের সেই পুরণ অভ্যেসটি আজও রয়ে গেছে।

“ও ব্যপারটা তুই ঠিক বুঝবি না। যাকগে ওসব কথা পরে হবে। তোর বউ, ছেলে-মেয়েরা কোথায়…চা খাওয়াবি না?”

আমার স্ত্রীকে বিরূ ছোটবেলা থেকে চেনে কারণ সে ছিল আমাদের পাড়ারই মেয়ে। আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় বিয়ের সাত বছর আগে থেকে। ছেলে-মেয়ের সঙ্গে আলাপের পর্ব শেষ হলো। বিরূ আগের মতোই প্রাণখোলা…আলাপ জমিয়ে ফেললো সবার সঙ্গে। চা খেতে খেতে না না স্মৃতি রোমন্থনের পর বিরূকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন কি করছিস?”

“আমি তো ব্যাঙ্কের কেরানী, একদম ছাপোষা মানুষ। জানিস কিনা জানিনা, আমি তো ব্যততীকে বিয়ে করেছি। তালতলার ব্রততীকে মনে আছে তো তোর?”

আমি  মাথা নেড়ে জানালাম, মনে আছে আমার।

“আমার একটি মেয়ে, কলেজে পড়ছে।” বলে চলে বিরূ, “তবে নাটকে অভিনয় আমি ছাড়িনি। তোর দেখানো মঞ্চে অভিনয় এখন আমার নেশা এবং পেশা। নাটক-টাটক তুই খুব একটা দেখিস-টেখিস বলে মনে হয় না, তাই না?”

 

“না রে খুব একটা দেখা-টেখা হয় না। তাছাড়া, উৎপল দত্ত চলে যাওয়ার পর নাটক দেখার উৎসাহটা কেমন যেন মরে গেছে। সব সময় মনে হয় বক্তব্য বিষয়ে বা অভিনয়ে কোথায় যেন একটা ফাঁক যা পুরণ হবার নয়। তাছাড়া আমার তো তোর মতো দশটা-পাঁচটার সুখের চাকরী নয় বাছাধন। ব্যবসায় সেইভাবে নিজের জন্যে কোন সময় বার করা কঠিন কারণ ব্যবসাটাই তো নিজের জন্যে।”

“তোর ব্যবসাটা কি?” জিজ্ঞেস করলো বিরূ।

যতোটা পারলাম আমার কাজের জায়গাটা বিরূকে অল্প কথায় বুঝিয়ে ওর অভিনয়ের পেশার প্রসঙ্গটা আবার টেনে আনলাম।

“কিন্তু তোর কথা বল, নাটকে অভিনয় তোর পেশা বলছিলি…ব্যপারটা একটু খুলে বল না।”

বিরূ শুরু করে, “পেশাদারি মঞ্চে অভিনয় করছি আজ প্রায় পনেরো বছর। একটু-আধটু নাম ডাকও হয়েছে আমার। আজকের কাগজেও আমাদের নাটকের বিজ্ঞাপণ আছে। আমার নাম ছাপা হয় প্রধান চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে। কি্ন্তু নাটকের জগতে যদি কিছু করে থাকি তাতে তোর অবদান প্রায় সবটাই। তুই সেদিন জোর করে আমাকে মঞ্চে নামিয়েছিলি অভিনয় করতে। চার বছর ধরে প্রত্যেকটা পদক্ষেপ পরম ধৈর্যে আমাকে শিখিয়েছিলি তোর মতো করে। কতো বকুনি খেয়েছি তোর কাছে তার ঠিক নেই। সব সময় বলতিস, তোর মধ্যে জিনিস আছে বিরূ, মেলে ধর দর্শকের মাঝখানে।”

এতো প্রশংসায় অস্বস্তিতে পড়ে গিয়ে বললাম, “আরে দুর ওসব কথা বাদ দে। তোর কতো নাম ডাক আর আমি কোন খবর রাখি না। দেখ তো নাটক-টাটক থেকে কতো দূরে চলে গেছি আমি।”

আমার কথাটা চট করে ধরে নিয়ে বিরূ বললো, “আর এই ব্যপারেই তো তোর কাছে আসা। তোর ভাই শিলুর সঙ্গে দেখা হলো একদিন একাডেমিতে। ও এসেছিল একটা গ্রুপ থিয়েটারের নাটক দেখতে। আর আমি ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলাম। শিলুকে দূর থেকে চিনেছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না ও আমাকে রেকগনাইজ করতে পারবে কিনা। শিলু নিজেই এগিয়ে এসেছিল, কথা হলো অনেক, ওইটুকু সময়ের মধ্যে। ওর কাছেই তোর টেলিফোন নম্বর পেলাম।”

এই রে, বিরূ বলছে নাটকের ব্যপারে আমার কাছে এসেছে। কি দরকার থাকতে পারে আমার কাছে ওর? নিশ্চয়ই শিলুর কাছে আগেই শুনেছে আমার ব্যবসার কথা। কোন স্পন্সরের আশায় এসে হাজির হয়নি তো। কিচ্ছু বলা যায় না, এইসব পেশাদারি নাটকের দলের অবস্থা মোটেই ভাল থাকে না। নিশ্চয়ই টাকা-পয়সা চাইবে। আমার এতো প্রশংসার কারণ কি তাহলে টাকা?

ইতি মধ্যে বিরূ তার ঝোলানো ব্যাগ থেকে মাঝারি আকারের একটা খাম বার করলো। আমি নিঃসন্দেহ হলাম, এবার বিরূ স্পন্সরের কথাটা তুলবে আর খামের মধ্যেই এই সংক্রান্ত কাগজপত্র আছে। খাম থেকে বেরিয়ে এলো দুখানা কার্ড। বিরূ কার্ডের পিছনে কি সব লিখলো। তারপরে কার্ড দুখানা আমার দিকে এগিয়ে দিলো।

শোন, আগামী শনিবার মিনার্ভাতে আমাদের একটা শো আছে। এই নাটকে আমার একশো অভিনয় পূর্ণ হবে ওই দিন। সবাইকে নিয়ে তোর আসা চাই। আমি কিন্তু কোন কথা শুনবো না। সস্ত্রিক তোকে ছেলে, মেয়েদের নিয়ে আসতে হবে। আমার ছেলে ও মেয়েকে আলাদা করে ও আমন্ত্রণ জানালো। বিরূর অনুরোধের মধ্যে এমন একটা আপন করে নেওয়া ছিল যে আমরা সবাই কথা দিলাম –যাবো। এর পরে বিরূ আর বেশীক্ষণ বসেনি। চলে গেল বিরূ কিন্তু ওর গাঢ় বন্ধুত্বের রেশ রেখে গেল আমাদের সকলের মনে। রাতে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত আমরা এইসব নিয়েই আলোচনায় ব্যস্ত থাকলাম। আমার মনে কিন্তু একটা সন্দেহ থেকেই গেল। বিরূ কিন্তু আমার কাছে টাকা চাইবে আর সেই জন্যেই ওর এত ঘটা করে কার্ড দিতে আসা।

শুক্রবার বিরূ আবার ফোন করলো নিশ্চিত হতে যে আমরা মিনার্ভায় শনিবার বিকেলে যাচ্ছি। শনিবার দুপুরে আমাদের মিনার্ভার উদ্দেশে রওনা হওয়ার ঘন্টা খানেক আগে বিরূ শেষ বারের জন্যে ফোন করলো, “কিরে নীলু, কখন পৌঁছচ্ছিস? তোকে থিয়েটারে না দেখে আমি কিন্তু মেক-আপই নেবো না।”

“তুই এই রকম ছেলেমানুষি করছিস কেন বলতো? আমরা কথা যখন দিয়েছি তখন যাবোই। একটু পরে তোকে পারফর্ম করতে হবে মঞ্চে, তাতে মন দে। ওটা অনেক বেশী জরুরী। বাকী সব ঝেড়ে ফেলে দে আপাতত।”

“আজ মিনার্ভায় তোর উপস্থিতি আমার কাছে কম জরুরী নয় নীলু।” উত্তর দিলো বিরূ।

একটু ধমক ছিল আমার ভাষায়। অনেকদিন পরে হলেও, আমি জানি, বিরূ আমার এই রকম ধমক খেতে অভ্যস্ত। কিন্তু টেলিফোনে ওর শেষ উত্তর আমার সন্দেহ আরও বাড়িয়ে তুললো।

শনিবারে একটু আগেই পৌঁছে গেলাম সবাই মিনর্ভায়। কার্ড দুখানা বার করতেই প্রবেশ পথে একটা সাড়া পড়ে গেল আমাকে নিয়ে। দু-তিন জন ভদ্রলোক ছুটে এসে আমাদেরকে একদম সামনের সারিতে নিয়ে গিয়ে বসালেন। এই সব ঘটনা আমার মনের মধ্যে সন্দেহটা আরো দৃঢ় করে তুললো। এই সবের মানে হলো বিরূ অনুষ্ঠানের শেষে টাকা চাইবে। হঠাৎ একজন ভদ্রলোক এসে আমাকে নীচু গলায় বললেন, “বিরুপাক্ষদা আপনাকে একবার গ্রীণরুমে ডাকছেন।”

ভদ্রলোকের সঙ্গে ভেতরে গেলাম। মেকআপ নিতে নিতে বিরূ বাইরে এসে বললো, “নাটকের শেষ পর্যন্ত থাকবি, পালাবি না কিন্তু…দরকার আছে।”

দরকার তো আমি বুঝতেই পারছি। এত ঘটা করে আপ্যায়ন মানে তো টাকা দিতে হবে। আমি ঠিক কাটিয়ে দেবো। টাকা কি এতো সস্তা।

নাটক শুরু হলো। হল ছিল কানায় কানায় পুর্ণ। নাটক শুরুর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম এ নাটক আমার ভিষণ পরিচিত। সময় যতো এগোল আমি অবাক হয়ে দেখলাম বহুকাল আগে আমার লেখা যে নাটকে বিরূর অভিনয়ে হাতে খড়ি হয়েছিল এ নাটক সেই নাটক। প্রয়োজনে নাটকের যে রদবদল করা হয়েছে তা প্রশংসার দাবী রাখে। বিরূ অভাবনীয় সুন্দর অভিনয় করছে। হলে বসে বুঝলাম, যাঁরা নিয়মিত নাটকের দর্শক তাঁদের কাছে বিরূ দক্ষ অভিনেতা হিসেবে একটি নাম।

নাটকের শেষে পর্দা নেমে এলো। দর্শকের করতালিতে মিনার্ভা তখন মুখর। পর্দা আবার উঠলো। দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানালেন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কলা-কুশলীদের। নাটকের মধ্যমণী বিরূ একটু এগিয়ে এলো মাইক্রোফোনের সামনে। বলতে শুরু করলো, “আজ এই নাটকের একশ দিন অতিবাহিত হলো। এই একশ দিনে দর্শক এবং সংবাদ মাধ্যমের সহায়তায় শুধু অর্থালাভ নয়, যে সম্মান আর প্রশংসা আমরা পেয়েছি তা আমাদের আশাতীত। আজ এই আনন্দের দিনে আমাদের মধ্যে এমন একজন উপস্থিত আছেন যিনি রচনা করেছিলেন এই নাটক। শুধু তাই নয়, যাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা না থাকলে আমরা আজ আপনাদের এই আশীর্বাদ আর সম্মান অর্জ্জন করতে পারতাম না। ইনি সেই ব্যক্তিত্ব যিনি আমার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষকে মঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন আর শিখিয়েছিলেন অভিনয় করতে। অভিনয় যতোটুকু পেরেছি তার সবটুকু যিনি দান করেছেন আর গ্রহন করে আরো ঋণি হয়েছি যাঁর কাছে সেই নীলাদ্রিশেখর রায়, যিনি সামনের সারিতে বসে আছেন, তাঁকে অনুরোধ করবো মঞ্চে উঠে আসার জন্যে।

শেষ অঙ্কের নাটকের আমি তখন এক হতবাক মধ্যমণী। ঘটনা ঘটতে থাকলো দ্রুত। আমি মঞ্চে উঠে গেলাম। বিরূ এগিয়ে এলো জড়িয়ে ধরলো তার বুকে। হল তখন ফেটে পড়ছিল হাততালিতে। আমি এক অতি নিকৃষ্ট মনের মানুষ হারিয়ে গেলাম…বিরূর বিশাল বক্ষে ।

আমার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল একটা বিশাল ফুলের তোড়া আর সরু একটা লম্বা বাক্স। বাক্সটা মোড়া ছিল সুন্দর রঙিন কাগজে। বিরূ বললো, “আমাদের এই সামান্য উপহারে তোর ঋণ শোধ হতে পারে না। বাড়ি গিয়ে বাক্সটা খুলিস।” এমন কি. একটা বড় মিষ্টির বাক্স উপহার স্বরূপ আমার হাতে এসেছিল।

বাড়ি এসে আমার স্ত্রীর হাতে পাতলা লম্বা বাক্সটা দিয়ে বললাম, “দেখ হয়তো একজোড়া পেন-টেন দিয়েছে।”

বিরূ আজ আমাকে অবাক করেছে। ওর অভিনয় আজ এতো উন্নত যে সেখানে আমার কোন দান আছে এটা ভাবতে আমি কুন্ঠা বোধ করছি বার বার। আমাকে যে সম্মান আজ বিরূ দিয়েছে সেটার আমি যোগ্য কিনা এ প্রশ্ন আমাকে ভাবাচ্ছে।

হঠাৎ আমার স্ত্রীর উত্তেজিত কন্ঠস্বরে সজাগ হলাম, “একবার দেখ,  এই বাক্সর মধ্যে কি ছিল।”

যা ছিল তা দেখে আমার চক্ষু স্থির। দেখলাম…আমার নামে স্টেট ব্যাঙ্কের একটা চেক…পঞ্চাশ হাজার টাকার।

 

~ শেষ দৃশ্য ~

 

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleকোকিলের কান্না
Next articleসেতার
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments