সাদা কালো – সপ্তম পর্ব : click here
।৮।
কলকাতায় বছর খানেক হোলো পাতাল রেল চালু হয়েছে। কিন্তু পদার এখনো চড়া হয়ে ওঠেনি। তার বাড়ি গড়পার থেকে কলেজ স্ট্রিট সে বেশির ভাগ দিন হেঁটেই চলে যায়। হাঁটতে পদার খুব ভাল লাগে। স্বাস্থের পক্ষে তা ভালো তো বটেই, সব থেকে বড় কথা এই হাঁটার সময়টুকু পদার সম্পূর্ণ নিজের। এই সময় নানান বিষয় নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে সে। সত্যি কথা বলতে, পাতাল রেলে চড়ার প্রয়োজন সে কখনো বোধ করেনি। এক রবিবার ভোর বেলা উঠে পদা গেল ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে। সারাদিন সেখানে কাটানোর পর, বিকেল বেলা যখন বাড়ি ফিরছে তখন হঠাত তার মনে হোলো বাসে না ফিরে মেট্রোতে ফিরলে কেমন হয়? বন্ধুবান্ধবদের কাছে পদা আগেই শুনেছে যে ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির সবথেকে কাছের স্টেশান হোলো রবীন্দ্র সদন। কলকাতা শহরের দক্ষিন ভাগের রাস্তাঘাট পদা সেরকম ভালো চেনে না। রাস্তায় দু একজন ট্যাক্সি ওয়ালাকে জিগ্যাশা করে মোটামুটি একটা ধারনা করে নিয়ে পদা রবীন্দ্র সদনের দিকে হাঁটা লাগালো। দরকার হলে আবার রাস্তায় জিগ্যেশ করে নেবে। হাঁটার তো এইটাই সুবিধা। তবে সেদিন মেট্রো স্টেশান খুঁজে পেতে পদাকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। মিনিট কুড়ির মধ্যেই সে স্বচ্ছন্দে স্টেশানে পৌছে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে পাতালে নেমে পদার তাক লেগে গেল। এই ধুসর কলকাতা শহরে এ কি সৃষ্টি! সত্যি দেখার মত। ঝকঝক করছে স্টেশান। কোথাও এক ফোঁটা নোংড়া নেই। সব কিছু সাজানো গোছানো; মনে হচ্ছে যেন সে বিদেশী ম্যাগাজিনের পাতার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে মনে আজ সে ইঞ্জিনিয়ারদের সামনে মাথা নত করলো, তাদের মূল্যটা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করলো। মনে মনে ভাবলো যে মা’কে নিয়ে এসে একদিন চড়াতেই হবে। এইসব ভাবতে ভাবতেই ট্রেন এসে পরলো। রবিবার বলে ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা। পদা সিট পেয়ে গেল। জানলার বাইরে কিছু দেখার নেই, তাই পদা কম্পার্টমেন্টেরই সামনের দিকে চেয়ে রইলো। তার সমস্ত অনুভূতি দিয়ে সে ট্রেনের গতিটা মাপার চেষ্টা করছে। ময়দান স্টেশানে কয়েকজন যাত্রীর মধ্যে এক যুবক যুবতীও উঠেছে। ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে। হঠাত একটা গলার স্বরে পদার ঘোর কাটলো। প্রথমে পদা তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। আবার মনোযোগ দিয়ে শুনলো। হ্যাঁ, সে ঠিকই শুনেছে। এ গলার স্বর সে ভুল করতে পারে না। কথোপকথনটির শব্দ আসছে তারই কম্পার্টমেন্টের অন্য প্রান্ত থেকে, কম্পার্টমেন্টের পেছন দিকটায়। যুবক যুবতীর আলাপ আলোচনা। চাপা স্বরে। কিছু কিছু শব্দ ও বাক্যের অংশবিষেশ ইংরিজিতে। প্রেমালাপ না হলেও বুঝতে অসুবিধা হয়না যে এই যুবক যুবতীর নিছক বন্ধুত্বের উর্ধেও একটা সম্পর্ক আছে। পদা ভাবছে কি করবে। কানে শুনেছে ঠিকই কিন্তু চোখে না দেখলে সে নিশ্চিত হতে পারছে না যে তার আনুমান ঠিক কিনা। আবার ঘুরে তাকাতেও তার দ্বিধা হচ্ছে। যদি চিনে ফ্যালে? পার্ক স্ট্রিট স্টেশানে যখন ট্রেন থামল, পদা উঠে দাঁড়ালো। ভাবটা এমন করলো যেন সে নেমে যাবে, কিন্তু নামার বদলে সে সিট বদল করে অন্য একটা সিটে বসলো—এমন একটা সিট যেখান থেকে সে ঘাড় ঘুরিয়ে অনায়াসে যুবক যুবতীকে দেখতে পাবে, কিন্তু তারা তাকে চট করে চিনতে পারবে না। ট্রেন যখন আবার চলতে শুরু করলো, সুযোগ বুঝে পদা আস্তে আস্তে কায়দা করে তার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো। তার অনুমান সঠিক। সোনালি! পরণে পাশ্চাত্য কায়দার একটা নেভি ব্লু ব্লাউস আর জিন্স। চুল খোলা। অপূর্ব দেখাচ্ছে তাকে। তার সঙ্গের যুবকটিও যথেষ্ট সুপুরুষ। হয়ত পদার মত অতটা নয়, তাও। পদার খুব ইচ্ছা করছিলো আরো কিছুক্ষন সোনালিকে দেখতে, কিন্তু সে ঝুঁকি সে আর নিল না। যদিও তার গন্তব্য স্টেশান ছিল গিরীশ পার্ক, সে সেন্ট্রাল স্টেশানে তড়িঘরি করে নেমে গেলো। সোনালির সামনাসামনি হওয়ার ভীতি সে আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
এই ঘটনার পর বছরখানেক কেটে গেছে। পদা এখন ফাইনাল ইয়ারে। কর্নেল ইউনিভারসিটির পদার্থ বিগ্যানের এক অধ্যাপকের সাথে তার অনেকদিন যাবত চিঠি আদানপ্রদান চলছে। ভদ্রলোক এখনো কোনো কথা দেননি, তবে জানিয়েছেন যে GRE পরীক্ষায় পদার ফল যদি ভাল হয়, তাহলে তার ছাত্রবৃত্তি পাওয়ার একটা ভাল সম্ভবনা আছে। পদা শীঘ্রই GRE পরীক্ষায় বসবে। সেই পরীক্ষার জন্যই পদা এক ছুটির দিন সকালে পড়াশুনা করছিলো। মা এসে দরজায় দাঁড়ালো। “আজ সন্ধ্যেবেলায় কি তুই বাড়িতে থাকবি?” “হ্যাঁ সেরকমই তো প্ল্যান। কেন বলতো?” মা কি যেন একটু ভাবলেন। “আমাকে একটু পাশের মানুদিদের বাড়িতে নিয়ে যাবি?” পদা একটু অবাক হোলো। “সে তো তুমি একাই যেতে পারো। আমাকে কেন যেতে বলছো?” মা বেশ খানিকটা ইতস্তত করে তারপর বললেন “শুনলাম সোনালির শরীরটা খুব খারাপ। তুই গেলে ওর সাথে একটু কথা বলতে পারবি”। পদার মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তার দৌড় শুরু হোলো। সোনালির শরীর খারাপ? কিন্তু মা ব্যাপারটাকে এত সিরিয়াসলি নিচ্ছে কেন? শরীর খারাপ তো সকলেরই হয়। তাহলে কি আরো কিছু আছে এর মধ্যে যেটা মা বলতে চাইছে না? কিন্তু পদা গিয়েই বা কি করবে? তার সাথে কথা বলে সোনালির কিই বা লাভ হবে? সোনালির তো প্রেমিক আছে। সে আসে না? মা সম্ভবত এসব জানেও না। “কি হয়েছে ওর?” পদা প্রশ্ন করলো। “তা তো জানিনা। মানুদি খুব কাঁদছিলেন। বললেন মেয়েটা সারাদিন বাড়িতেই থাকে। কোত্থাও যায় না। কারো সাথে কথা বলেনা। খালি শুয়ে থাকে”। অদ্ভুত ব্যাপার! কি হয়েছে সোনালির? পদা ভাবতে থাকে। “ঠিক আছে আমি নিয়ে যাব তোমায়”। মা খুশী হলেন। একটু হেসে বললেন “সাতটা নাগাদ যাব তাহলে”। পদা ঘাড় নারলো।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে পদার বুকের ধুকপুকানিও বাড়তে থাকলো। সে সোনালিদের বাড়িতে গিয়ে কি করবে? সোনালিকে সে কি বলবে? সোনালিই বা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইবে কেন, যেখানে সে কারো সাথে কথা বলেনা? অথচ সোনালির কি হয়েছে সেটা জানারও তার প্রচন্ড কৌতুহল। একবার নিজেকে বোঝালো যে গিয়ে স্রেফ বসার ঘরে মা’র সাথে বসে থাকবে, তারপর চলে আসবে। এতে এত উদ্বিঘ্ন হবার কি আছে? কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হোলো যে ওরা যদি ওকে সোনালির ঘরে ওর সাথে একান্তে দেখা করতে পাঠিয়ে দেয় তাহলে? পদার ছটফটানি বাড়তেই থাকলো। শেষে আর না থাকতে পেরে বিকেল চারটে নাগাদ সে বেরোলো। বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। সে লক্ষ্য করেছে যে হাঁটলে তার মনটা শান্ত হয়। হাতিবাগান, শ্যামবাজা্র, সব ছাড়িয়ে অবশেষে সে পৌঁছালো গঙ্গার ধারে বাগবাজার ঘাটে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে কিন্তু গঙ্গার জলে তখনো ছোটছোট কিছু ছেলেমেয়ে দাপাদাপি করছে। সেই মুহূর্তে পদার ইচ্ছা করলো ওদের মত হয়ে যেতে। পদা ঘাটের সিঁড়ির ওপর বসলো। দূরে গঙ্গার বুকে কয়েকটা বজ্রা ভেসে রয়েছে। আর কয়েকমাস পরেই পদা বিদেশে চলে যাবে। সোনালিও তার জীবন নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পরবে। এই সময় আবার নতুন করে মনটাকে নাড়া দাওয়ার কি প্রয়োজন? সাধারন অসুখ করেছে হয়ত, নিশ্চয়ই শিজ্ঞির ঠিক হয়ে যাবে। মা হয়ত বিনা কারনেই ব্যাপারটার গুরুত্ব বাড়াচ্ছে। কিম্বা হয়তো ওর প্রেমিকের সাথে মন কষাকষি হয়েছে। সে তো আকছাড় হয়েই থাকে। এই সব ভেবে পদা ঠিক করলো যে সে আর যাবে না সোনালিদের বাড়ি। গেলেই আশা। আশা মানেই আশার মৃত্যু।
রাত দশটায় পদা বাড়ি ফিরলো। খানিক পর মা’র আবির্ভাব হোলো। পদা যে মা’কে নিয়ে যায়নি সোনালিদের বাড়ি সে নিয়ে মা কোন কথাই বলল না। শুধু বলল “খাবি না?” মা’র দিকে পদা তাকাতে পারলো না। অন্যদিকে তাকিয়েই বলল “একটু কাজে আটকে পরেছিলাম মা। আমি সরি। কাল তোমায় ঠিক নিয়ে যাব”। “তার আর দরকার হবে না। আমি একাএকাই দেখা করে এসেছি” বলে মা ঘুরে দরজার দিকে এগলো। পদা আর থাকতে পারলো না। “কেমন আছে ও?” “ভাল নেই”। ভাল নেই? ভাল নেই মানে? কি হয়েছে? পদার মনে আবার হাজার প্রশ্ন। “কি হয়েছে ওর?” প্রশ্ন করলো পদা। “তা তো জানিনা। সেরকম কিছু বলল না ও। খালি বলল ‘একটা খারাপ ছেলের পাল্লায় পড়েছিলাম মাসিমা। চিন্তা কোরো না। আস্তে আস্তে আমি ঠিক হয়ে যাব’। মেয়েটার জন্য মায়া লাগে। এত হাসিখুশি ছিল!” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা পদার ঘর ছেড়ে চলে গেল। পদা পাথর হয়ে বসে রইল।
To be continued…