মৃত আত্মার মতো চীনেপাড়ায় সন্ধ্যা নামে ইউকেলেলের ধুনে। দানবীয় এই শহরের ঊষর জমির মাঝে লুকিয়ে থাকা এই চিলতে পথটার হদিশ জানেনা সবাই। অনেকে ঘুরে মরে কানাগলির জটিল গোলকধাঁধায়, তবু পায় না বোধিবৃক্ষের নীচে পাতা শীতলপাটির সন্ধান। ঘুণ ধরা গলিগুলোয় আজ নক্ষত্রের রাত নেমে এসেছে নিদারুণ পেলবতায়, যেমন করে অনাবৃত নখের ওপর এসে পড়ে একফোঁটা বাদামী নেলপলিশ। সকাল থেকে নেড়ি কুকুরদুটো দাঁতে ধার দিয়েছে সস-লাগা বাজে কাগজের স্তুপে,এবার ল্যাজ নাড়তে নাড়তে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ফেলে দেওয়া হাড়গোড়ের মরূদ্যানে।মদ্দা আর মাদীর মাঝে বাচ্চাটা তেমন সুবিধা করতে পারছেনা,এখনো দুপায়ে জোর নেই তেমন,তবে চেষ্টাটা আছে আপ্রাণ।তবে ওই নরম চোখেই তো একদিন জ্বলে উঠবে প্রতিহিংসার বারুদ।
চলো,পাশের ওই গলিটা ধরে হাঁটা যাক।
বাষ্প উঠছে লোহার পাত্র থেকে,কানায় কানায় বুদবুদ লেগে ঝিকমিক করছে জলতারকা।ভিতরের তপ্ত জমিতে ঘাপটি মেরে বসে মোমোর দল,ঠিক যেন দূরের হংসবলাকা।সংখ্যালঘু স্প্রিং রোলেরা আলাদা গোষ্ঠী তৈরী করেছে অন্য কোণে,আর মাঝে নির্দল হয়ে নো ম্যানস ল্যাণ্ডে খাবি খাচ্ছে একপিস চিকেন সসেজ।কিছুক্ষণ পরেই একটা হাতা নেমে এলো,লিফটের মতো তাতে উঠে গেল সসেজটা।ওর মেদময় দেহে লেগে গেল খানিকটা টোম্যাটো সস বীর্যের মতো, আর তারপর দাঁত,মুখ,ঠোঁটের সাথে জঘন্য সঙ্গম।
ওই দোকানটা দেখছ?কত শতাব্দী আগে খিদিরপুরের কুয়াশায় নোঙর ফেলেছিল যে রহস্যময় বাণিজ্যতরী,তার উত্তরাধিকার বহন করছে এই দশ ফুট বাই দশ ফুট চৌখুপ্পী ঘরখানা।বেঁটে যে বৃদ্ধা হাসিহাসি মুখে অন্ধকার কাউন্টারে বসে,ওনার জন্মদিনেই নাকি প্রথম বীজ থেকে মাথা তুলেছিল শিবপুরের আদিম বটগাছটা।মুখময় বটের ঝুরির মতো জরা তার আদরের বিস্তার ঘটিয়েছে,অন্ধকার গহ্বরের একপ্রান্তে চিকচিক করছে সোনার একপিস দাঁত।তুমি কাছে যেতেই একগাল হেসে বলবেন,”কাম,কাম,ডিয়ার গার্ল!”তুমি হাতে তুলে নেবে একটা চিংড়ির পাঁপড়ের প্যাকেট,গোলাপী আভায় সিক্ত তার সীমানা,আর আঙুল উঁচিয়ে শুধাবে,”ওইটা কিসের শিশি,গ্রানি?”তারপর জুরাসিক যুগের একটা চীনা আচারের শিশি,যার মধ্যে ডাইনোসরের গোড়ালির হাড় খুঁজলে এখনো পাওয়া যাবে, নিজের হ্যান্ডব্যাগে পুরে বিল মিটিয়ে ফের পথে নামবে।
বড় বেসামাল আজ লালচে আলোর অবস্থা,যা ধুয়ে দিচ্ছে এই গলির প্রতিটা জরাজীর্ণ কোণ।কাগজলণ্ঠনে সোহাগ দুলে দুলে উঠছে জীর্ণ দরজাগুলোতে।রক্তিম আভায় তোমার মুখে যেন হাজার জোনাকি ভিড় করেছে,ধকধক করে জ্বলছে তাদের ফসফরাসী পাখনাগুলো।দুগুচ্ছ অলকের নিবিড় মায়ায় অনুপমা তুমি,লালচে স্বপ্নের নকশা বিছোনো পারস্যদেবী যেন।যুগযুগান্ত ধরে তাকিয়ে থাকার ইচ্ছায় বাধ সাধে তোমার সলজ্জ কণ্ঠস্বর,”এই,কি দেখছ হাঁ করে?চলো!”
দুধারে ইতিহাসের বিবর্ণ সাক্ষী যে বাড়িগুলো,তারই মাঝে পশরা জমিয়েছে দোকানের ভাগীরথী।শিকারার মতো তার গা বেয়ে ভেসে চলেছে মানুষের ঢল,আর আমরা দুজন।উদ্ভাসিত মুখে তুলে নাও ফিশ মোমোর একটা খণ্ড,আজিনামোটোর ক্লান্ত আমেজে মুড়ে।ছোট ছোট কেরোসিন স্টোভের তৈল দৌরাত্ম্যে হাত পা সেঁকে নেয় যে পর্ক চপস,হাত বাড়িয়ে তা কাগজের প্লেটে নাও।আমাকে ছোট্ট ছেলের মতো ভেবে মুখে পুরে দাও তারই এক খণ্ড,আদুরে গলায় বলো,”ভালো না খেতে?”আমি ব্যস্ত হয়ে উঠি ন্যাপকিনের সন্ধানে।তোমার স্টোলটা দিয়ে সবে মুছতে যাবো চীনে ময়দার গুঁড়োগুলো,তুমি চোখ পাকিয়ে তাকাও।তারপর আর সাহস করে ও পথে পা বাড়াইনা। নরম ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির আভা জাগে,তুমি এগিয়ে দাও তোমার সুগন্ধি রুমালখানা,যাতে এখনো লেগে আছে গত সন্ধ্যার চুম্বনের সলজ্জ আঁচড়।
ঘোলাটে স্ট্রীট লাইটের নির্জন আলোয়,গায়ে চীনা লণ্ঠনের গন্ধ মেখে এসে দাঁড়াই দুজনে।অঘ্রাণের হিমেল চাদরে হারিয়ে হারিয়ে যাই দুজনে,ক্ষণে ক্ষণে।আলো আর নির্জনতার সরণী বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে কানে ভেসে আসে দূরের বৈঠকখানা থেকে উৎসারিত পিয়ানোর সুর।মুনলাইট সোনাটা।বৃথা রোম্যান্টিকতা আমার আসেনা,এ হৃদয় কেবল ঝাউগাছের দীর্ঘ ঘনত্ব দিয়ে গড়া,তবু মনে হল হাতে হাত রাখি তোমার,নিবিড়ভাবে পরখ করে দেখি তোমার দুচোখের দেদীপ্যমান তারাদের,যেখানে ধ্বংস হয়ে লুটিয়ে পড়ছে একের পর এক পলাতকা ধূমকেতু।
গহন গলির মাঝে তেমনি করেই লালচে আলোর স্রোতে পড়ে আছে একটা বেওয়ারিশ লাশ,বুকে বুলেটের ক্ষত।দুচোখ আকাশপানে নিক্ষেপিত বিদ্রূপাত্মক ভঙ্গিতে।পাশে লুটোচ্ছে কয়েকটা বেলোয়ারি কাগজ,বিবর্ণ হয়ে গেছে তার কালো কালিতে লেখা অক্ষরগুলো। নিষ্ঠুর সে ভয়াল চাহনি যেন পিষে মেরে ফেলবে আমাদের এই নির্জন জনশূন্য গহ্বরে। ভয়ের প্রথম চকিত স্রোত মিলিয়ে যেতে তুমি আর্তনাদ করে ওঠো পাগলের মতো,দুচোখ ঢেকে ফেলো স্নায়ুছেঁড়া অসহ্যতায়।