অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মাঝে অফিসের সাহেবরা সামান্য যেটুকু সময় পান, সেটা অন্যদের জন্য ব্যয় করেন; এর কেতাবি নাম – ‘সাপোর্ট’| সাপোর্ট অবশ্য ভেঙে পড়া বাড়িতেও দেওয়া হয়, তবে প্রথমেই মনে পড়ে কুমোরপাড়ায় প্রতিমার কাঠামোতে বাঁশের ঠেকনা দেওয়ার কথা| কপাল খারাপ থাকলে অনেকসময় বিপদ ঘটাতে পারে ওই সাপোর্ট| অনেকদিন আগে ঠাকুর তৈরি দেখতে দেখতে বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা খাড়া বাখারির ডগায় বসে দুহাত তুলে জিভ বার করে কালি ঠাকুর হওয়ার চেষ্টা করেছিল| জিভ বিনা চেষ্টাতে তখনই বেরিয়ে পড়েছিল; ফটো হয়ে যাওয়াটা, ডাক্তার অনেক কষ্টে আটকে ছিলেন| বেচারা এখন মধ্য চল্লিশেও মিনিবাসের হেল্পারি করে যাচ্ছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকা সত্বেও পুরো ট্রিপে ড্রাইভারি করতে পারে না|

সাপোর্ট-এর সঙ্গে আসে ‘গ্রুমিং’ কথাটা; আসলে কোনও একজনকে কেবিনে ডেকে হাতে মাথা কেটে নেওয়ার হুমকি| অভিধান বলছে, কথাটার মানে ঘোড়ার বা কোনও জানোয়ারের লোম আর চামড়া পরিস্কার করা| হায় ভগবান, সহিস বা খিদমদগার মানে তাহলে রাজা নয়! দ্বিতীয় অর্থও লোম পরিষ্কার করা, তবে বাঁদরের দঙ্গলে যে লোম বাছাবাছি চলে সেটাই| লোম বাছার সময় নড়াচড়া করলে বাঁদরেরা কষে থাপ্পড় মারে বলে শোনা যায় আর ‘গ্রুমিং’ এর সময়ও পাল্টা কিছু বললে বিপদ ঘটতে পারে| আরও মানে আছে – কোনও কাজের জন্য কাউকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া| এইটাই ভাল, অন্ততঃ ভাবের ঘরে চুরি করলে মনটা ভোলানো যায়| তবে মন-ভোলানো মানে পেয়ে মন-মাতানোর খোঁজ না করাই ভাল| কারণ, চতুর্থ মানেটায় শিশুদের যৌন নিগ্রহের ব্যাপার জড়িয়ে আছে; ধরা পড়ে ধোলাই খেলে সারা জীবন বরবাদ, সে ধোলাই পুলিশের হোক বা পাবলিকের|

অফিসের পরিভাষায় সবার সামনে গালাগালি বা গলাগলি করার নাম ‘বুস্টিং’| সাদা মনে অভিধানে দেওয়া মানেগুলো মেনে নেওয়া ভাল| তবে শেষে একটা একটু গোলমেলে উদাহরণ দেওয়া আছে – কেউ ঠেলে কাউকে ফেন্সিং-এ তুলে দিচ্ছে| মনে কালো থাকলে কিন্তু মগডালে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার কথা মনে পড়বে| টিকার বুস্টার ডোজের মত সাহেবদের গলাগলিও মাঝে মধ্যে ছুঁচ ফোঁটার জ্বালা ধরায়|

সে যাকগে, সবাই জানে ‘অক্স’ মানে বলদ আর ‘ফোর্ড’ হল গাড়ি| ব্যাকডেটেড গরুর গাড়ির কথা ভুলতে গেলে ছোট্ট নদীতে বলদ নেমেছে ভেবে ঘোলা জলের আশঙ্কা হয়| তাই বাজে কথা ছেড়ে গল্পগাছা হোক|

জামশেদপুরের কাছে একটা কারখানায় নতুন একটা মেশিন বসানো হচ্ছে| তিনজন ছোকরা ইঞ্জিনিয়ার (এখনও স্বপ্ন দেখে, সাত ঘাটের জল খাওয়া ঘোড়েল নয়) ওখানে ক্যাম্প করে পুরো কাজটার দেখভাল করছে| বনোয়ারী প্রচন্ড চাপের মধ্যে দলবল নিয়ে ছবি মিলিয়ে নাট-বোল্ট-স্ক্রু-ওয়াসার লাগাতে নাকানি-চোবানি খাচ্ছে| নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শুরু করে দিয়েছে পরীক্ষিৎ| আর বরাবরের মতই গুণধর নিজের কাজটা ঠিক কি বুঝতে না পেরে বাকি দু’জনকে সাহায্য করছে| হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে করতে হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম হয়েছে কয়েকবার| দিনে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে কারখানায় কাজ, আর রাত্রে হোটেলে আহার-নিদ্রা ভুলে রিপোর্ট তৈরি করতে করতে তিন সেনাপতি পাগলপারা|

এর মাঝে একদিন কারখানার সর্বেশ্বরবাবু পরীক্ষিৎকে ডেকে পাঠালেন| পরিকল্পনা মাফিক কাজ ফেলে ওনার অফিসে যেতেই হল| ঘন্টা দুয়েক নরমে গরমে নানান ধরনের অভিযোগ করার পরে তিনি আসল কথায় এলেন| একটু অন্যরকমের কয়েকটা পরীক্ষা তিনি করতে চান মেশিনের ওপর| সেইসব পরীক্ষার মৌখিক বিবরণ তিনি দিলেন| কিন্তু তিনি কথার ভরসায় না থেকে সাদা-কালো দলিল রাখতে চান| তাই ধাপে ধাপে করণীয় কাজ আর প্রত্যাশিত ফলাফলের বিস্তারিত বিবরণ পরদিন সকালের মধ্যে তৈরি করার দায়িত্ব দিলেন পরীক্ষিৎকে| দরকার মত মেশিনের অ্যাডজাস্টমেন্ট, সেটিং ইত্যাদিও যেন করে রাখা হয়| আপত্তি প্রকাশ করার আগেই জানা গেল পরীক্ষিৎ-এর বড়সাহেবের সঙ্গে এ ব্যাপারে তাঁর কথা হয়ে গেছে|

ছোট সাহেব এদিকে ফোন করেছেন গুণধরকে| তিনি সেদিন রাত্রেই পৌঁছবেন ব্যাপারটা একটু আগেভাগে বুঝে নিতে| স্টেশনে গাড়ি আর হোটেলে ঘর রাখার জন্য বলে দিলেন| বেশ কিছুদিন ধরে সবাই খুব চাপের মধ্যে কাজ করছে; চাপমুক্তির জন্য সন্ধেবেলা একটু ‘জলবিহার’-এর ব্যবস্থা রাখতে বললেন| মেশিনের নতুন পরীক্ষাগুলোর ব্যাপারে আলোচনা তখনই করার প্রতিশ্রুতি দিলেন| পরদিন সকালে বড়সাহেবের কারখানায় আসার কথা জানিয়ে ফোন ছাড়লেন|

মেশিনটা নতুন, তাই নতুন কিছু করা নিয়ে একটু ধোঁয়াশা থাকেই| তিনজনেই লাগাতার চিন্তাভাবনা চালিয়ে গেল, কিসে কি হয়, কখন কি হতে পারে এসব নিয়ে| অল্প স্বল্প তর্কাতর্কিও হল; পূর্বপরিকল্পিত কাজগুলোতে একটু ঢিলে পড়ল; ফোনে কলকাতার অফিসে অভিজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টাও হল; কিন্তু ধোঁয়াশা পুরোপুরি কাটল না|

রাত দশটা নাগাদ হোটেলে ঢুকলেন ছোটসাহেব| ছোট্ট একটা ওয়ার্ম আপ পেগ মেরে দিয়ে স্নানে যাওয়ার আগে বলে গেলেন – “ইউ প্লিজ ক্যারী অন”| সাহেব গুছিয়ে বসলেন রাত এগারোটায়, মোচ্ছব শেষ হল প্রায় রাত আড়াইটায়| ম্যানেজমেন্ট ফান্ডা, ইনকাম ট্যাক্স, টি-টুয়েন্টি, ইউরো-ডলারের দর সব নিয়ে আলোচনা হল, শুধু মেশিন নিয়ে আলোচনা রইল বাদ| কথা উঠলে ছোটসাহেব গুণধরের পিঠে হাত রেখে বললেন – “ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট ইয়োরসেল্ফ| সমস্যাগুলোকে কখনও বড় করে দেখবে না| ইউ ক্যান ডু এভরিথিং| আর সাপোর্ট দেওয়ার জন্য আমরা তো আছি”|

কয়েক চুমুক পরে আবার আলোচনা শুরু হলে উত্তর এল –“এত চাপ নেওয়ার কি আছে! টেনসন লেনে কা নেহি, দেনে কা হ্যায়”| কয়েক পেগের পরে মেশিনের কথা তুললে বললেন – “ইউ বয়েজ আর নট গ্রুমড ওয়েল প্রফেশনালি| রিল্যাক্স ইয়ার, মনটাকে কম্পার্টমেন্টালাইজ করতে শেখ”| নজরটা আরও রঙিন হলে মেশিনের অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর কথায় গ্লাসে সোডার পরিমাণ অ্যাডজাস্ট করতে করতে আশ্বাস দিলেন ওগুলো ‘ইজিলি ম্যানেজেবল’| আসর ভাঙার সময় গুড নাইটের সঙ্গে পরামর্শ দিলেন – “ঠান্ডা মাথায় সকালে উঠে কাজে হাত দিও”|

সকাল সাতটায় উঠে গুণধর বুঝতে পারল, এদেশে তৈরি হলেও বিলিতির গুণমানে আপোষ করার চল নেই| চোখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে চা সহযোগে পরীক্ষিৎ কাগজপত্র যা বানিয়েছে, তাতে মেশিন উল্টো ঘোরাও সম্ভব| বনোয়ারী তখনও গড়াগড়ি খাচ্ছে, উঠে বসার শক্তি সে রাত্রেই হারিয়ে ছিল|

সকালের ট্রেনে বড়সাহেব এলেন| সর্বেশ্বরবাবু তাঁর দলবল নিয়ে মেশিনের কাছে হাজির হলেন| আলোচনা হল, জ্ঞান তথ্য ইত্যাদি বিনিময় হল, উপস্থিত প্রত্যেকের অভিজ্ঞতার নিরিখে মন্তব্য ছোড়াছুড়ি হল, সবশেষে পরীক্ষানিরীক্ষা হল| মেশিন একটু গড়বড় করল, কিছু কাজ ঠিকঠাক হল| মেশিনের বে-আক্কেলপনা শুরু হলেই তিন সেনাপতির মধ্যে চোখাচোখি হল| ওই বিশেষ পরীক্ষাগুলোর জন্য কি ধরনের প্রস্তুতি দরকার ছিল, ফাঁক বুঝে চা খেতে গিয়ে তিনজনের মধ্যে আলোচনা হল| সর্বেশ্বরবাবু ‘কিচ্ছু হচ্ছেনা’ বলে চেঁচামেচি করলেন| ছোটসাহেব অল্প একটু বকাবকি করলেন অ্যাডজাস্টমেন্টগুলো করে রাখা হয়নি বলে|  প্রস্তুতির অভাব নিয়ে বড়সাহেব গম্ভীর ভাবে দুএকটা কথা বললেন| অবশ্য, গোলমালগুলো ব্যাখ্যা করার নামে সর্বেশ্বরবাবুকে পুরোপুরি গুলিয়ে দেওয়া গেল|

অনেক অনুরোধের পরে বড়সাহেবের দেওয়া ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’র প্রতিশ্রুতি পেয়ে, আরও কয়েকদিন সময় দিলেন সর্বেশ্বরবাবু| অন্য একটা কারখানায় দেখানোর জন্য তিনি সেদিনই একটা প্রসংশাপত্র দিতে রাজি হলেন| পেমেন্টের প্রতিশ্রুতিও আদায় হল সর্বেশ্বরবাবুর কাছ থেকে| সবাই মিলে তিন সেনাপতিকে সাতদিনের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক করার কথা পইপই করে বলে দিলেন| তারপরে ঠান্ডা ঘরে সাহেবদের গম্ভীর আলোচনা, প্রসংশাপত্রের মুসাবিদা, কেজো দুপুরের খাওয়া হল| খেতে খেতে ছেলে-ছোকরাদের কাজ পাগলামি, জ্ঞান-পিপাসা, লড়াকু মানসিকতা ইত্যাদির অভাব আর তার কার্যকারণ সম্পর্ক নিয়ে উদাহরণ সহ আলোচনা হল| সবশেষে হাত মেলান হল, পিঠ চাপড়ানো হল, আবার একপ্রস্থ প্রতিশ্রুতিময় বিদায় পর্বের মধ্যে দিয়ে আজকের মত দিনের শেষ ঘোষণা করা হল|

হাসিমুখে বড়সাহেব গাড়িতে উঠে হাত নেড়ে কাঁচ তুলে দিলেন, গাড়ি এগোতে শুরু করেও থেমে গেল| ছোটসাহেব এগিয়ে গেলে অর্ধেক কাঁচ নামিয়ে বড়সাহেব বললেন – “তুমিকাল দুপুর অব্দি থাকছ এখানে; দিজ বয়েজ আর ওয়ার্কিং ভেরি হার্ড| একটু দেখে নাও এদের কি সাপোর্ট লাগবে|”

ছোটসাহেব বললেন – “দ্যাট’স হোয়াই আই কেম ইয়েসটারডে| কালকে একটু লাইট মুডে গল্পগাছা, খাওয়া দাওয়া করে রিলিফ দেওয়ার চেষ্টা করেছি| দেখলেননা কেমন রিলাক্সড ওয়েতে সব সুন্দর ভাবে করে গেল| ডোন্ট ওরি স্যার, আই’ল টেক কেয়ার|”

ছোটসাহেবের হাতটা আলতো ধরে বড়সাহেব বললেন – “আই নো; দে গ্রুমড ভেরি ওয়েল আন্ডার য়োর গাইডেন্স| বুস্ট দেম আপ ফর নেক্সট প্রজেক্ট”| কালো কাঁচ তুলে সাহেবের গাড়ি এগোতে লাগল|

কিন্তু তিনজনেরই গলার কাছে একটা দলা পাকানো ভাব রয়ে গেল সারাদিন, বুকের কাছে একটা চাপ আর চোখে একটা করকরে অনুভূতি – আগের দিনের হ্যাং-ওভার বলেই মনে হয়| বুস্টার ডোজ হিসেবে সন্ধ্যে থেকে আবার মোচ্ছব শুরু হল সেদিন; আগের দিনের মত শুকনো বাদাম আর চিপস নয়, হাতে সময় থাকায় গরমাগরম পকোড়া আর তন্দুরি সহ|

 

~ মানুষ – মেশিন – মোচ্ছব ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleইচ্ছে অধীন
Next articleপ্রবাহিনী
SUBHAMOY MISRA
জন্ম আর বড় হওয়া অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় হলেও কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া আর চাকরির সুবাদে এখন হাওড়ার বাসিন্দা। দেওয়াল পত্রিকায় লেখা শুরুর পরে স্কুল কলেজের পত্রিকা ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বই পড়া, নাটক দেখা, গান শোনারও নেশা আছে। পেশাসূত্রে লব্ধ অভিজ্ঞতা লেখার মধ্যে দিয়ে একটু একটু করে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছে আছে মনের মধ্যে।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments