ভরত – “ মাতুলালয়ে গিয়েছিনু মাত্র কয়দিন তরে,
কিন্তু এ কি, অযোধ্যার রাজপুরী এই স্বল্প অবসরে হেরি নিমজ্জিত ঘোর অন্ধকারে !
কোথা মোর পিতা , কোথা মোর ভ্রাতা !
সর্বত্র বিরাজ করিছে এ কি অসীম শূন্যতা !
রাজপথে প্রজাকুল ক্রন্দনরত, হায় কি বিরস বদন,
বুঝি ঘটিয়াছে কোন ভয়ানক অঘটন।
বল, বল মাতা কৈকেয়ী–
অযোধ্যার ভাগ্যাকাশে এ কোন্ জলদ গিয়াছে ছায়ি !
কৈকেয়ী – “ পুত্র, জীবনের প্রথম সূর্যালোকে যবে দেখায়েছি তোমারে,
এক অদম্য বাসনা লালন করিনু অন্তরে,
মোর ভরতে দেখিব অযোধ্যার রাজসিংহাসন পরে।
তাই ……………………………………………………
ভরত – “ তাই ! কি মাতা , বল মাতা বল, রহিও না নির্লিপ্ত,
কি এমন ঘটিল যে আজি অযোধ্যার রাজপুরী নিশ্চুপ, নিষুপ্ত !”
কৈকেয়ী – “ পুত্র, শান্ত হও এবে। তোমারে দিতেছি এক ঘোরতর দু:সংবাদ।
তব পিতৃদেব, মোর স্বামী–অযোধ্যাপতি আজ আর নাহি ভবে। যাও পুত্র, পিতৃশব এখনো শায়িত হিমকক্ষে।
তাঁহারে দেখিয়া আইস স্বচক্ষে।
করিওনা পুত্র ক্রন্দন, যে গুরুদায়িত্ব তব স্কন্ধে পিতা করিলেন অর্পণ,
তাহারে ত’ করিতে হইবে সুসম্পাদন।
সদ্যপ্রয়াত পিতার পারলৌকিক ক্রিয়া করহ নিষ্পাদন,
অত:পর তব অভিষেক , অপেক্ষা করিতেছে অযোধ্যার সিংহাসন।
ভরত : – “ অভিষেক ! অভিষেক মোর অযোধ্যাপতি হইবার তরে ! কি বলিতেছ ! বুঝিতে পারি না জননী।
মোর প্রিয়তম জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শ্রীরাম রঘুকুল শিরোমণি–
রাজ্য অভিষেক হইবে তাঁহার।
অযোধ্যার রাজসিংহাসনে কেবল তাঁহারই অধিকার। কিভাবে লইব আমি সেই গুরুভার !
কিন্তু কোথা, কোথা মোর অগ্রজ ভ্রাতা !
বল মাতা, কোথা মোর অনুজ লক্ষণ, ভ্রাতৃজায়া সীতা !”
কৈকেয়ী – “ধীরে, পুত্র ধীরে –
যাহা কহিব, তাহা শুন সংযত অন্তরে।
পুত্র, আজি হইতে তোমারেই করিতে হইবে অযোধ্যা শাসন।
তব অগ্রজ রামচন্দ্র, সে করিতেছে পিতৃসত্য পালন।
রাজগেহ ত্যজি সে গিয়াছে বনবাসে চৌদ্দ বৎসর তরে,
বধূমাতা সীতা সাথে–
তব অনুজ লক্ষ্মণও দিয়াছে সংগ তাহারে
স্বেচ্ছায় লইয়াছে সে ক্লেশ আপনার মাথে।
ভরত – “ হায় মাতে, এ কি শুনিলাম হায় !
বিনা মেঘে বজ্রাঘাত, যেন কাননে কুসুমকলি অকালে শুকায়।
কিন্তু কি হেতু, কি হেতু এই পিতৃ–আদেশ মোর অগ্রজ ‘পরে, !
কিবা দোষে দুষ্ট তিনি যাহার কালিমা আজি রঘুপতি শিরে !”
কৈকেয়ী – “ দোষ ত’ কাহারো হয় নাই বিন্দুমাত্র,
তবে শুন বৎস, ঘটনা কি ঘটিয়াছিল সত্য ।
তব পিতা যবে শম্বরাসুর সাথে রণে হইলেন আঘাত জর্জর,
মম তনুমন এক করি’ সেবিলাম তাঁহারে আমি নিরন্তর।
প্রতিদানে কহিলেন অযোধ্যাপতি –
‘হে আর্যপুত্রী,তোমারে দুই বরে করিব সৌভাগ্যবতী’।
কিন্তু আমি কহিলেম – ‘হে আর্যপুত্র, কোনো এক শুভক্ষণে আমি মাগিয়া লইব সেই বর আপনার সনে।’
তাই যবে তব অগ্রজ রামচন্দ্রের অভিষেক লগণ হেরি সমাগতপ্রায়,
মোর দাসী মন্থরা মোরে কহিল – ‘রাণী,আজি তব সঠিক সময়।
মহারাজ সনে যাচ্ঞা কর দুই বর।’
আমিও ভাবিলাম সত্যই সুসময়, পুত্র মোর।
এমত শুভক্ষণ আর আসিবে না মোটে,
অতএব মাগিলাম দুই বর তব পিতার নিকটে–
‘এক বরে মোর পুত্র ভরত বসিবে অযোধ্যার সিংহাসন পরে,
অন্যটিতে কৌশল্যাসুত রামের হইবে বনবাস চৌদ্দ বৎসর তরে।’
বল পুত্র, যাহা করিয়াছি তাহা তোমারই মঙ্গলকামনায় করিয়াছি কিনা !
মোর চিত্তপটে কভু অন্য কিছু স্থান নাহি কেবল তব কল্যাণ চিন্তা বিনা।”
ভরত – “ ধিক মাতা ধিক, শতধিক তোমারে, আর কহিও না কোনো কথা,
এইক্ষণে সব কিছু হইল পরিস্কার মোর সনে সূর্যালোক যথা।
হে মাত, তব দুর্বুদ্ধিজাত লালসা আজি এই পুত্রকে বেদনায় ভারাক্রান্ত করে।
যাও মাতা, মোর সম্মুখ হইতে যাও এইক্ষণে দূরে, বহু দূরে।
অয়ি স্বামীঘাতিনী পাপীয়সী নারী, তোমারে মাতা সম্বোধনে হইতেছে মোর ঘৃণা,
তুমি কুলঘাতিনী, এক কুৎসিৎ নীচ তথা স্বার্থপর নারী, কুটিল হীনমনা।
আপনারে ভাবো তুমি অযোধ্যার রাণী–অনুশোচনায় কি দগ্ধ নহে তব চিত্ত !
হে কেকয় দুহিতা, কেবল আত্মহননই হইবে তোমার পাপের সঠিক প্রায়শ্চিত্ত।
জন্ম যদি তব রাজকূলে–তবে কিমতে এই চিন্তা অন্তরে দিলে স্থান !
কনিষ্ঠ হইবে নৃপ যবে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সশরীরে বিদ্যমান !
হায় বিধি, মোর সনে এ কি তব নিদারুণ পরিহাস।
ঘন তমসা যেন আজি ভরতেরে করিতেছে সম্পূর্ণ গ্রাস।
হা ঈশ্বর, এ বুঝি মোর গত জনমের অনাচার,
এমন পাপিষ্ঠা নারীর গর্ভে তাই জনম আমার।
তবে এই কথা শুন হে পাপিয়সী, তুমি রাখিও সতত স্মরণ,
দশরথ পুত্র ভরত সদা সত্যকে করিবে শিরে ধারণ।
আজি আমি এই করিলাম পণ সূর্য্যবংশ সনে,
যে রামচন্দ্রে তুমি চৌদ্দ বর্ষ তরে পাঠায়েছ বনে,
তাহারে ফিরাইয়া আনিব এই অযোধ্যা ভূমিতে সসম্মানে।
এই রাজ্যপাট তাঁহারই হস্তে আমি সমর্পণ করিব যবে,
তব পাপের প্রায়শ্চিত অন্তে চিত্ত মোর শান্ত হইবে তবে।”
কৈকেয়ী – হে ভরত, এ কি সম্বোধন আজ করিলে মাতারে !
যাহা করিয়াছি তাহার বিন্দুমাত্র করি নাই মোর হিতার্থ তরে।
মোর স্বামী যে আজি ত্যজিলেন ইহলোক,
তদ্যপিও করি নাই শোক,
অন্দরে বাহিরে আমি হইতেছি নিন্দিত,
তাহাতেও হই নাই এতটুকু বিচলিত।
কেবল একই স্বপ্ন আমি হেরি প্রতি মুহূর্ত তরে,
মোর ভরত বসিয়াছে অযোধ্যার রাজসিংহাসন পরে।
পুত্রের সমৃদ্ধি হেরিবার সাধ,
সে কি জননীর অপরাধ !”
ভরত – “ অপরাধ–কি বলিতেছ তুমি–এ ত’ ঘোরতর পাপ !
করিয়াছ স্বামীরে হত্যা তুমি – নাহি তব কোনো মনস্তাপ !
হা ঈশ্বর ! রাজমাতা হইবার লালসায় বুঝি তব শুভবুদ্ধি হইয়াছে নাশ,
দাসী মন্থরার কুমন্ত্রণা বশে আপন সংসারে সৃষ্টি করিলে কি অসীম ত্রাস।
তবে রহ, রহ এই শূন্য কক্ষে একাকিনী বসি’ ,
যবে অনুতাপানলে হইয়া দগ্ধ অশ্রুধারায় যাইবে ভাসি’,
তবেই আসিবে বাহিরে,
নতুবা হেথায় কাটাইবে কাল আমৃত্যু তরে।
পুত্র সনে কভু আর তব হইবে না সাক্ষাৎ এই কথা জানিও সুনিশ্চিত,
তুমি আজি দিয়াছ যে চরম আঘাত–দণ্ড তাহার অবশ্যই পাইবে সমুচিত।
হে কেকয় দুহিতা,
রাখ শুনি’ মোর কথা–ভরতের সনে আজ তুমি মৃতা।
কোন স্থান তোমারে দিবে না আজি ভরতের হৃদয়।
আর কিছু কহিবার নাহি অবশেষ তব সাথে,
চিরবিদায়,
অযোধ্যা রাজপুরী তথা রাজ্যবাসীর নিদারুণ অভিশাপ সহন করিয়া মাথে,
হে শত্রুঘ্ন জননী, লহ ভরতের চিরবিদায়।
———————————————————————-
স্বপন চক্রবর্তী।