আজ সকাল থেকেই মনটা কেমন যেন থমকে গেছে। জানি না কেন। মনে হচ্ছে কোন এক মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি কেন হয়? মেঘ কেন জমে? প্রশ্নগুলো করে বসল বিল্টু। এই হোমে ও যতদিন এসেছে, প্রথম দিন থেকে শুধু প্রশ্নই করে গেছে। উত্তর এখনো সে পায়নি। উত্তর কেনই বা দেবে কেউ। প্রশ্নগুলো বড় নিরর্থক যে। পাতা কেন নড়ে, পাতা কেন পড়ে, কেন সবাই রোজ খেলতে যায়, কেন রোজ ফুল ফোটে, ইত্যাদি ইত্যাদি। এত সব প্রশ্নের জবাব কোথায়? ও রোজ নিজেকেই প্রশ্ন করে, তাই নিজেই আর উত্তর দেয় না। সব উত্তরগুলো যেন এই মহাবিশ্বের এক গোপন সিন্দুকে শায়িত আছে।
আজ চার বছর হল বিল্টু হোমে এসেছে। ওর বয়স এখন বারো। এই চার বছরে ওর এক নিজস্ব জগৎ তৈরি হয়েছে। হোমে আরও অনেকেই থাকে। কেউ ওর থেকে একটু ছোট, কেউ একটু বড়, আবার কেউ বা ওরই বয়সী। কিন্তু বিল্টু সবার থেকে আলাদা। ও যেন সবকিছু একটু বেশী ভাবে, সবকিছুই যেন ওর আর একটু বেশী বুঝলেই বোঝা হয়ে যেত। কতবার ও চিরুনি’কে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছে, “আলোকে কেন আমরা ধরতে পারি না?”। চিরুনিও মাথা চুলকে চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা যখন ঢিল ছুঁড়ে বাগানের আমগাছ থেকে আম পাড়ার জন্য কষ্ট করে, তখন বিল্টু তড়তড়িয়ে গাছে উঠে আম পেড়ে আনে। অন্যদের জন্য গাছে উঠে আম ফেলতে থাকে। কিন্তু গাছে উঠতে ও জানলো কী করে?, সেই উত্তর কেউ জানে না। যখন সবাই পুকুরে স্নান করে, জলে ভাসে; তখন ও বহুক্ষণ ডুব সাঁতার দিয়ে জলের নীচে থাকে। মাছেদের সাথে কথা বলতে চায়, খেলতে চায়। কিন্তু ওরা কী বিল্টুর কথা বোঝে, করে কী খেলা ওর সাথে? ওর বন্ধু চিরুনি, গুলতি, ভোম্বল, পলা ওরাও মনে করে বিল্টু সব পারে কিন্তু বিল্টু সেটা মনে করে না। তাই বিল্টু কখনই ওদের সর্দার হয়ে ওঠেনি।
বিল্টুর আবছা মনে পড়ে ওর বাবা-মায়ের কথা। এক দিদুন ছিল বাড়িতে। দিদুন রোজ ওকে গল্প শোনাত। ওর বাবা অনেক রাত করে বাড়ি ফিরত, ঝগড়া হত ওর মায়ের সাথে। দিদুনের পাশে শুয়ে দরজার ফাঁক দিয়ে ও দেখেছিল। ও হয়তো আরও কিছু দেখেছিল কিন্তু সেটা ও ছাড়া আর কেউ জানে না। তারপর একদিন দিদুন ওকে ছেড়ে আকাশের তারা হয়ে চলে গেল। একা হয়ে গেছিল বিল্টু। তারপর কেমন যেন বদলে গেল ওর জীবনটা। হঠাৎ করে ওর বাবা-মা’ও কীসব যেন সেপারেশন করে নিল। ও শুনেছিল সেইসব কথা ওই কালো কাপড় পড়া লোকগুলোর ঘরে। তারপর ওকে কেউ আর বাড়ি নিয়ে যায়নি। সেদিন থেকেই কে যেন ওকে এখানে নিয়ে চলে এসেছে। আর দেখা হয়নি ওর বাবা-মায়ের সাথে।
হোমের ডান দিকের ছোট ভাঙা গেটটা পেরিয়ে রোজ ঘুরতে যায় বিল্টু। দিনের শেষে ওর অন্য বন্ধুরা সবাই যখন মাঠে খেলতে যায়, বিল্টু তখন প্রতিদিনের ওর ঘোরার জায়গায় যায়। ওখানে ওর অনেকগুলো প্রজাপতি বন্ধু আছে। ও দেখেছে কী করে শুঁয়োপোকা থেকে ওদের সৃষ্টি হয়েছে। একটু অন্ধকার নামলে সবুজ আলো ছড়িয়ে জোনাকির দল ভিড় করে ওর চারদিকে। গাছের মধ্যে পাখীদের ঘরে ফিরে আসার কিচিড়মিচিড় শুনে ও হাঁ করে তাকিয়ে থাকে, আর ভাবে ও কেন যেতে পারেনা ওদের কাছে। পুকুরের ধারে একটা গাছ আছে। সেখানে রোজ একটা করে সূর্যমুখী ফুল ফোটে। ফুলটা যেন প্রতিদিন ওর দিকেই চেয়ে থাকে। ফুলটাকে দেখলে ওর দিদুনের কথা মনে পড়ে যায়। অন্ধকার গাঢ় হলে ওকে রোজ পিছন থেকে ডেকে ওঠে মধু কাকা। মধু কাকা ওদের হোমের দেখাশুনা করে। মধু কাকা ওকে বলেছে ছিপ দিয়ে মাছ ধরা শিখিয়ে দেবে। কিন্তু বিল্টু মাছেদের ধরতে চায় না।
প্রতিদিনের মত আজও বিল্টু ওর ঘোরার জায়গায় এসেছে। আজ দুটো টিয়া পাখি ওর দিকে চেয়ে ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। কতগুলো পাথর কুঁড়িয়ে পুকুর ধারে এসে বসেছে বিল্টু। এই প্রথম বিল্টু যেন পুকুরের জলে নিজের মুখ দেখল। এর আগে কোনদিন ও যেন ঠিক করে নিজের মুখ দেখেনি। ও ভাবে কেন ও এমন দেখতে, সবার থেকে কী ও আলাদা? ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসে। জলের মধ্যে ওর আবছা মুখের প্রতিচ্ছবির সাথে তারাদের ঝিকিমিকি ফুটে উঠল এবার। কী সুন্দর লাগছে এখন ওর মুখখানি! আকাশের দিকে তাকায় বিল্টু। বাকা চাঁদটাও যেন ওকে দেখে খুশী হয়েছে আজ। সেও আজ হাসছে। হঠাৎ যেন ও শুনতে পায় কেউ ওর নাম ধরে ডাকছে। না এতো মধু কাকার গলা নয়। এটা দিদুনের গলা না? চমকে ওঠে বিল্টু। তবে কি তারাদের মধ্যে থেকে দিদুন আবার ফিরে এসেছে। মনে পড়ে যায় বিল্টুর ছোটবেলার সেই দিনগুলোর কথা। দিদুনের হাতে তৈরি পায়েস খাবার কথা। এইসব ভাবতে ভাবতে বিল্টুর চোখ পড়ে সেই সূর্যমুখী ফুলটার দিকে। ওটা আজও ফুটেছে। ফুলের মাঝখানে দিদুনের মুখটা যেন ভেসে উঠল এবার। এগিয়ে যায় বিল্টু ওটার কাছে। দিদুনের মুখটা ভাসতে ভাসতে এখন জলের উপর গিয়ে পড়েছে। চাঁদ তারার আলোয় দিদুন’কে আজ কী ভালই না লাগছে। জলের উপর দিদুনের পাশে এবার ওর মুখও ভেসে উঠল। ওর মনে পড়ে গেল সেই ছোটবেলায় দিদুনের পাশে শুয়ে ঘুমনোর কথা। কতদিন যেন ঘুময়নি বিল্টু। আজ দিদুন যেন ওকে আবার আগের মত ডাকছে, “আয়, আমার কাছে আয়।” মন্ত্রমুগ্ধের মত জলে নেমে পড়ে বিল্টু। মধু কাকা এসে আজ অনেক ডেকেও সাড়া পায়নি ওর। অন্ধকার গভীর হয়েছে। কোথাও যেন শেষ সাঁঝের শাঁখ বেজে ওঠে। বিল্টু হয়তো এতক্ষণে দিদুনের সাথে ঘরে ফিরে গেছে।