।৬।
দেখতে দেখতে মে মাস এসে গেল। শীত আর নেই বললেই চলে তবে মাঝেসাঝে হঠাৎ করে তাপমাত্রা নেমে যায়। বিশেষত সন্ধ্যার পর। তখন আবার জ্যাকেট্ পরতে হয়। দিন এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। প্রায় রাত সাড়ে ন’টা অবধি দিনের আলো থাকে। গগাবাবু খুব একটা বেরোনোর সুযোগ পান না। তবে দিন বড় হয়ে যাওয়াতে এক আধ দিন কাজ থেকে ফিরে টিয়া বলে “ড্যাড্, সেন্ট্রাল পার্কে হাঁটতে যাবে?” গগাবাবু এক কথায় রাজী। এই তো তার মুক্তির সুযোগ। জয়কে স্ট্রলারে বসিয়ে দুজনে মিলে সেন্ট্রাল পার্কে চক্কর দেয়। ওদের বাড়ি থেকে যেতে মিনিট দশেকের বেশি লাগে না, তবে দুটো বড়সড় রাস্তা পার হতে হয়। কলকাতায় থাকা গগাবাবুর কাছে অবশ্যি সেটা কিছুই নয়।
এখানে সব কিছু নিয়ম মাফিক। পথচারীদের রাস্তা পাড়াপাড় হবার জন্যও সিগনাল আছে। সেন্ট্রাল পার্কের ছকটা গগাবাবু এখন মোটামুটি আয়ত্ত করে ফেলেছেন। পার্কটা প্রায় তিন মাইলের মত লম্বা আর আধ মাইলটাক চওড়া। ভেতরে কত কিই না আছে—একটা ছোটখাট চিরিয়াখানা, অনেকগুলো জলাশয়, ঘোড়ার গাড়ি, আর অফুরন্ত হাঁটার বা সাইকেল চালানোর পথ আর খেলার মাঠ। বড়বড় গাছগুলো এখন বসন্তের সদ্য জন্মানো কচি সবুজ পাতায় ঢাকা। কি যে ভালো লাগে জায়গাটা গগাবাবুর! একদিন টিয়ার পাশে হাঁটতে হাঁটতে বলেই ফেললেন “হ্যা রে, আমি এখানে রোজ একা আসতে পারি না? তাহলে আমার রোজ হাঁটাটাও হয়, তোর ওপরও আর ভরসা করতে হয় না। যার জন্য তোরা আমাকে এখানে নিয়ে এলি, সেই হাঁটাটাই আমার ঠিক মত হচ্ছে না”।
আশা করেছিলেন যে টিয়া সঙ্গেসঙ্গে রাজী হয়ে যাবে। “না ড্যাড্, এখানে অত সেফ্ নয়। অনেক হোমলেস লোক। তাদের মধ্যে অনেকেই ক্রিমিনাল। ওরা লোক বুঝে টার্গেট করে। আর তাছাড়া তোমার সেলফোনও তো নেই। কিছু হোলে একটা ফোনও করতে পারবে না। দেখি সমরকে বলে। ওর বোধহয় একটা স্পেয়ার সেলফোন আছে”। ছেঁড়া জামাকাপড় পরা, কাঁধে প্লাস্টিকের বোচ্কা নিয়ে কিছু লোককে তিনি ঘুড়তে দেখেছেন বটে। ভেবেছিলেন ভিকিরি গোছের কিছু হবে, কিন্তু এদের মধ্যে যে চোর জোচ্চর আছে তা তিনি জানতেন না। গগাবাবু আর কথা বাড়ালেন না। ছেলে বৌমার তার দরুণ কোনরকম হয়রানি হয় তা তিনি একেবারেই চান না।
পরদিন সকালে গগাবাবু সবে বাথরুম থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে ঢুকেছেন। সমর তার গাড়ি আসার জন্য অপেক্ষা করছে। গগাবাবুকে দেখামাত্র টিয়া সমরকে বলল “ড্যাড ইস নট এবেল টু গেট এনাফ্ ওয়াক। হি নিডস আ সেলফোন”। সমর একটু অবাক হোলো। “হাঁটার সাথে সেলফোনের কি সম্পর্ক?” “দ্যাট ওয়ে, ড্যাড্ একা সেন্ট্রাল পার্কে হাঁটতে পারবে” টিয়া বুঝিয়ে বলল। “ওহ, নো নো, সেন্ট্রাল পার্কে বাবা একা মোটেই যাবে না। ইটস নট সেফ্” কথাটা বলে সমর বাবার দিকে তাকালো। দেখলো যে বাবা একটু হতাশ হয়েছে। “গেট হিম আ ফিট্বিট্। ডেইলি কতটা হাঁটা হচ্ছে তাহলে বুঝতে পারবে। ডেফিসিট্ হোলে উইকএন্ডএ পার্কে হাঁটিয়ে আনবে” বলে সমর বেরিয়ে গেল। তার গাড়ি এসে গেছে। সিরিয়ালের বাটিতে দুধ ঢালতে ঢালতে টিয়া বলল “ড্যাড্, বোসো, খেয়ে নাও”। “ওইটা কি?” প্রশ্ন করলেন গগাবাবু। “কোনটা?” “ওই যে সমর বলে গেলো ফিট্ না কি যেন?” টিয়া মিষ্টি করে হাসল। কোনো কথা বলল না। তারপর নিজের ডান হাতটা গগাবাবুর চোখের সমান্তরাল ধরলো। গগাবাবু কিছুই বুঝলেন না, কেবল বোকার মত তাকিয়ে রইলেন। টিয়া তার নিজের ডান হাতে বাঁধা গোলাপী একটা ব্যান্ডএর সাথে লাগানো একটা ছোট্ট কালো ক্যাপ্সুলের মত টুকরো দেখিয়ে বলল “এটাকে বলে ফিট্বিট্”।
এতদিনে রহস্যের সমাধান হোলো! সেই প্রথম দিন থেকে এই ঘড়ির মত দেখতে জিনিষটা লক্ষ্য করে আসছেন গগাবাবু। এও লক্ষ্য করেছেন যে টিয়া ওটা ছাড়া হাতে আর আলাদা করে ঘড়ি পরে না। “ওটা কি ঘড়ি?” প্রশ্ন করলেন। টিয়া একটু সময় নিল। তারপর বলল “হ্যাঁ ঘড়িও আছে। তবে আরো অনেক কিছু করে এটা। সারাদিনে কটা স্টেপ হাঁটলে, কতটা ঘুমোলে, কত মাইল হাঁটা হোলো, কত ক্যালোরি বার্ন হোলো, হার্ট রেট, এই সব এটা রেকর্ড করে”। শুনে গগাবাবু স্তম্ভিত। “এইটুকু জিনিষ, এতোকিছু করে? কই দেখা তো আমায়?” যেন না দেখলে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। টিয়া একে একে সব দেখালো।
কি কান্ড! ওইটুকু জিনিষ, তার এত ক্ষমতা? গগাবাবু আনমনা হয়ে ভাবতে লাগলেন। হাবভাবটা এমন যেন কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি যন্ত্রটার ভেতরকার কারসাজী সব ধরে ফেলবেন। “তোমার জন্য আজ রাতেই আমি অরডার দিয়ে দেবো। ড্যাড্, আমি এবারে বেরোই, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে” বলে টিয়া বেরিয়ে গেলো। দরজা থেকে যখন গগাবাবু ঘুরলেন, দেখলেন জয় তার দিকে গোলগোল চোখে চেয়ে আছে। তাকে দেখে বলল “ডুডা, ফিট্বিট্”। গগাবাবু আর হাসি ধরে রাখতে পারলেন না। নাতিকে জরিয়ে ধরে অট্টহাসি দিয়ে বললেন “ফিট্বিট্ ই বটে! কি কান্ড বলো দিকিনি দাদু’!
তিনদিনের মাথায় ফিট্বিট্ এসে গেলো। প্যাকেট খোলার সময় গগাবাবু দম বন্ধ করে রইলেন। তিন দিন আগে প্রাথমিক উত্তেজনায় তাঁর ব্যাপারটা খেয়াল হয়নি। পরশু রাতে শোবার পর হঠাৎ গগাবাবুর মনে পরলো যে ঘড়িটার রঙ গোলাপী। ওই রঙের ঘড়ি তিনি কি করে পরবেন? অসম্ভব! বাড়ির ভেতর যদিও বা পরা যায়, বাড়ির বাইরে মড়ে গেলেও নয়। টেনশনে গগাবাবুর ঘুম গেল চট্কে। একবার ভাবলেন টিয়াকে জিগ্যেশ করবেন যে তাঁরটাও গোলাপী কিনা, কিন্তু জিগ্যেশ করতে লজ্জা পেলেন। টিয়া আবার তা নিয়ে ঠাট্টা করবে। এখানে তো ছেলে মেয়ে সবাই সব রঙ পরে। প্রথম দিনই তো সমর একটা কমলা রঙের গেঞ্জি পরে এয়ারপর্টে এলো। দেশেও অবশ্যি আজকাল লক্ষ্য করেছেন ছেলেদের ক্যাটক্যাটে রঙের পাঞ্জাবী পরে ঘুরে বেরাতে। তবে তাদের সকলেরই তাঁর থেকে বয়েস অনেক কম।
প্যাকেট কেটে যখন টিয়া ফিট্বিট্ টা বার করছে, গগাবাবু চোখ বন্ধ করে ফেললেন। টেনশনে আর তাকানো যাচ্ছে না। যখন চোখটা অল্প অল্প করে খুললেন, দেখলেন গোলাপীর চিহ্নমাত্র কোথাও নে। পুরোটাই কালো। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তাঁর বুক থেকে। টিয়া মুখ তুলে চাইলো। “ইউ লাইক ইট ড্যাড্?” মিষ্টি হেসে টিয়া গগাবাবুর হাতে ফিট্বিট্ টা পরিয়ে দিল। আহা! কি হাল্কা যন্ত্রটা। কি মসৃণ! গগাবাবু ফিট্বিট্’টার গায়ে আলতো করে আদরের মত হাত বুলাতে থাকলেন। যেন ফিট্বিট্ টা একটা সদ্যজাত শিশু। দূর দিগন্তে তাঁর চোখ। মুখে স্মিত হাসি।
এর পরের সাতদিন গগাবাবু একটা অন্য জগতে চলে গেলেন। সে জগতের সর্বত্র কেবল ফিট্বিট্। উঠতে, বসতে, খেতে, পটি করতে, শুতে, জাগতে, সব জায়গায় ফিট্বিট্। যেন নতুন বিয়ে করে বৌ নিয়ে এসেছেন বাড়িতে। দুর্নিবার আকর্ষন। এমন কি নাতিকেও ভুলে গেলেন। সারাদিন পায়চারি করেন আর কয়েক মিনিট অন্তর অন্তর ফিট্বিট্এ দেখেন কটা পদক্ষেপ হোলো। প্রথমে ঘোর সংশয় নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন। ওরা বললেই হোলো? অত সহজ নাকি পদক্ষেপ ঠিকঠাক গোনা? কিন্তু নানা রকম ভাবে দশ’টি পদক্ষেপ হেঁটে পরীক্ষা করে দেখলেন যে প্রতিবারই ফিট্বিট্ ১০ দেখাচ্ছে? কয়েকবার ৯ দেখিয়েছিলো বটে তবে গগাবাবু জানেন যে সেই কয়েকটা ক্ষেত্রে তিনি হঠকারিতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইচ্ছা করে একটু কেতরে হেঁটেছিলেন। একদিন দুপুর বেলা মার্থা যখন রান্নাঘরে কাজে ব্যাস্ত, তখন নিজের বিছানার ওপর একটা ডিগ্বাজি খেয়েও দেখলেন। ফিট্বিট্ জানালো যে একটা ডিগ্বাজি তিনটে পদক্ষেপের সমসমান। মনে মনে হাসলেন গগাবাবু।
যাইহোক, এখন মেনে নিয়েছেন যে যন্ত্রটা সত্যিই চমকপ্রদ। যন্ত্রের সমস্ত কারুকার্জও ওনার রপ্ত হয়ে গেছে। একদিন জয়কে পরাতে গেছিলেন। জয় কিছুতেই পরবে না। অনেক কষ্টে পরানোর পর সে যখন হাত সোজা করলো, দেখা গেল ফিট্বিট্ তার হাতের পক্ষে অনেক বড়। গলে পড়ে গেল মাটিতে। গগাবাবু স্লিপ ফিল্ডারদের মত মাটিতে ডাইভ মেরে লুফে নাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। সক্ষম হন নি। সঙ্গেসঙ্গে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। দেখলেন যে সব ঠিকই আছে। তবে এই ঘটনার পর একটা নতুন খুঁতখুতানি জন্ম নিল তার মাথায়। একদিন জলখাবার খেতে খেতে টিয়াকে বললেন “হ্যা রে, তুই যে বললি সারা সপ্তাহে কতটা হেঁটেছি তা দেখা যায়? কই আমি তো দেখতে পাচ্ছি না? সেদিন দাদুকে পরাতে গিয়ে মাটিতে পরে গিয়েছিল ওটা। তার জন্য কি ওটা খারাপ হয়ে গেল?” ভবেছিলেন টিয়া ফিট্বিট্ টা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখবে সব ঠিক আছে কিনা, কিন্তু টিয়া তার ধার দিয়ে গেল না। “সারা সপ্তাহের টা দেখতে গেলে সেলফোনের সাথে ব্লুটুথ দিয়ে সিঙ্ক্রনাইজ করতে হয়। সেলফোনে একটা অ্যাপ্ আছে, ওটা ইউস করতে হবে”। এই তো সমর এটা কিনে দিতে বলল মোবাইল ফোন যাতে ব্যাবহার করতে না লাগে। এখন আবার বলছে মোবাইল ফোন লাগবে? এ তো মহা ফাঁপরে পরা গেল!
“ঠিক আছে, দাঁড়াও। সমর ফিরুক আজ। ওর স্পেয়ার সেলফোনটার সাথে আমি ওটা সিঙ্ক্রনাইজ করে দেবো” টিয়া হেসে বলল। “কিন্তু ও তো বলল মোবাইল ফোন দিতে চায় না?” “না না তা নয়। ও তোমাকে সেন্ট্রাল পার্কে একা যেতে দিতে চায় না। সেলফোন দিতে ও আপত্তি করবে না”। সারাদিন গগাবাবু উদবিঘ্ন হয়ে রইলেন। এই বোকা বোকা একটা ব্যাপারের জন্য সমর কি মোবাইল ফোনের মত একটা দরকারি জিনিষ দিতে চাইবে? অবশ্যি বৌমা তো বলল ওটা স্পেয়ার। তাহলে তো অসুবিধা হবার কথা নয়! এই সব নানান চিন্তা তাঁর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলো। সমর ফেরার পর ওঁত পেতে রইলেন, কিন্তু দেখলেন যে কিছুই হচ্ছে না। হয়ত ভুলে গেছে বৌমা। সারাদিন খাটাখাটনি করে এসেছে মেয়েটা। ওকে দোষ দেওয়া যায় না। কি আর করবেন? বিমর্ষ মনে শোবার প্রস্তুতি করতে লাগলেন।
শুতে যাবেন, ঠিক সেই সময় তার ঘরের দরজায় টোকা। টিয়া ঢুকে বলল “ড্যাড্, তোমার ফিট্বিট্ টা দাও তো। আমি সিঙ্ক্রনাইজ করে দি”। গগাবাবু হাত থেকে ফিট্বিট্ খুলে দিলেন বৌমার হাতে। “রাজী হয়েছে মোবাইল ফোন দিতে?” “হবে না কেন? বললাম না তোমায়, ওর আপত্তি হবে না” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল “কাল থেকে সব কিছু দেখতে পাবে”। গগাবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ডান হাত দিয়ে একবার বাঁ হাতে হাত বোলালেন। সাত দিন ক্রমাগত ওটা পরে থাকার পর আজ হাতটা কেমন যেন খালি খালি লাগছে। মৃনালিণি গত হবার পর তার অনেকটা এরকমই লেগেছিলো।
To be continued…