কালবেলা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠতে একটু অবাকই হলাম। এত সকালে আবার কার ফোন ? অচেনা নম্বর। ফোনটা তুলেজিজ্ঞাসা করতে ওপার থেকে জবাব এলো “কিরে তপন, কেমন আছিস ?” চেনা গলা, চিনতে আমার ভুল হতেই পারে না। তবেএকেবারেই অপ্রত্যাশিত ।
বললাম “ বিশ্বজিৎ না ? তুই কোথা থেকে ? “
ও বললো “ কলকাতা থেকে। দিন কয়েক আগে দেশে ফিরেছি। তোর খবর নিতে জানলাম তুই নাকি এখন কৃষ্ণনগরে আছিস।দিন বিশেক বাদে আবার আমেরিকা ফিরে যাব। তোর সাথে মনে হয় এবারটা আর দেখা হবে না।”
একটা কাঁচা গাল দিয়ে বললাম “তবে আর ফোনটা করলি কেন ? আমেরিকা থেকে ফোন করার খরচটা বাঁচাবি বলে ?”
বিশ্বজিৎ বলল “আরে বাবা চটছিস কেন ?
ঠিক আছে, আমি আজই ট্রেন ধরে তোদের ওখানে পৌঁছে যাব সন্ধ্যা বেলার দিকে । তারপর গোটা উইক এন্ড টা তোদের ওখানেথেকে, তারপর দু দিন পর ফিরব । তাহলে হবে ? আর গাল দিবি না তো ? আর মনে রাখিস, বোতলের ব্যবস্থা করতে ভুলিস নাযেন। আমার চয়েস তো তুই জানিসই। ওটা ছাড়া চলবে না বস । “
ফোনটা ছেড়ে আমার স্ত্রী বিদিশাকে সব বললাম বুঝিয়ে। আজ রাতেই যে খাবে, সে সব বলে ওকে বললাম “ আমি চললামবাজার করতে। বাবুর অনেক বায়নাককা আছে। “ বিদিশা অবাক হয়ে বললো
“ ও বাবা, তোমার সেই brilliant, রাজপুত্রের মত চেহারার বন্ধু ? তার গল্প তো তোমার কাছে শুনেছি অনেক, কিন্তু চোখে দেখিনিআজও। আমাদের বিয়েতেও তো আসেনি। সে হঠাৎ এত বছর পর ? “
আমি বললাম “ ও ওই রকমই। নিজের মর্জির মালিক। যখন যেটা মনে হবে তার তখনই সেটা চাই। বছরের পর বছর কোন খোঁজনেবেনা, আর তার পর দেখা হলে এমন করে আপন করে নেবে যে বুঝতেই পারবেনা যে ও তোমার থেকে দুরে ছিল। আশ্চর্য ওরকপাল, না চাইতেই সব পেয়েও যায় ! তবে এবারটা আসছে আমার গালি খেয়ে। বহু বছর আমাদের দেখা না হলেও বন্ধুত্বটাকখনও চিড খায়নি।
বিশ্বজিৎ আমার প্রেসিডেনসি কলেজের বন্ধু। দুজনেই একই সঙ্গে ইকনমিক্স অনার্স নিয়ে পড়তাম। বিশ্বজিৎ পডাশুনায় শুধুভাল ছিল তাই নয়, ওর গান, কবিতা, জোকস সব নিয়ে কলেজে একেবারে মাতিয়ে রাখতো। তার ওপর তার অপুর্ব সুন্দর লম্বাচেহারার জন্য মেয়ে মহলে খাতির ছিল দারুন। কলেজে সারাক্ষণই তাকে একপাল মেয়ে ঘিরে রাখতো। আমাদের মত সাধারনছেলেরা একটু ঈর্ষাও যে তাকে করতো না তা নয় তবে সেই মেয়েদের সঙ্গ থেকে ছাড়া পেয়ে আবার আমাদের সঙ্গে যখন বসতো, দুমিনিটে সব ভুলিয়ে দিতো। কলেজে তো ওর এই সব নিয়ে কত যে ডাক নাম তৈরী হয়েছিল ! একবার সে হঠাৎ কলেজইলেকশনে নেমে বিরোধী দলের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তারা তাদের পার্টির
কলেজপাড়ার কুখ্যাত গুনডা ‘হাত কাটা নেলো’ আর তার দল বলকে নিয়ে এসেছিল বিশ্বজিৎ কে ভয় দেখিয়ে ইলেকশন থেকেসরানোর জন্য। নেলো ছুরি হাতে তেডে যেতে কলেজের এক পাল মেয়ে ঘিরে ধরেছিল বিশ্বজিৎকে “আমাদের না মেরে ওকেতোমরা ছুঁতেও পারবে না। “। ব্যাপার দেখে নেলোও হেসে খুন “এতো দেখছি শালা কলির কেষ্ট !
একে মেরে এতগুলো মেয়েকে হাফ–বিধবা করলে পার্টিও তো খুশি হবেনা। তবে তোকে সাবধান করে দিয়ে যাচ্ছি, ইলেকশন থেকেনাম না তুললে তোকে ফরসা করে দেবো। “
“কলির কেষ্ট “ আর বিশ্বজিৎ কে আরও ফরসা কি করে করবে তা নিয়ে পরে আমরা অনেক ইয়ারকি ঠাটটা করেছি। বিশ্বজিৎইলেকশন লড়েও ছিলো আর বিপুল ভোটে জিতেও ছিলো। কিন্তু তার কদিন পরেই “রাজনীতি শালা পচা জিনিষ” বলে সব ছেড়েছুডে সরে গেল।
যাই হোক বাজার সেরে বাডি ফিরে অপেক্ষা করতে লাগলাম বিশ্বজিৎ এর জন্য। সন্ধ্যবেলা সে
ঠিক পৌঁছে গেল আমার বাডি চিনে। বিদিশাকে তার আলাপ করে,সহজ হতে, দুমিনিটও লাগল না। আমার মেয়ে রিয়াকেও সেসহজেই আপন করে নিল।
দুপুর বেলা, খাওয়া দাওয়ার এমন সুখ্যাতি করতে লাগল যে বিদিশাও অবাক হয়ে গেল। প্রত্যেকটা রান্নায় কি মশলা পড়েছে এসবনিয়ে এমন সব authentic কমেনট দিতে লাগল যে বিদিশা বলেই ফেললো “আপনি সত্যিই একজন শেফের মত রান্না বোঝেন।এ তো শুধু ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে খেতেই পারে।”
খাওয়া দাওয়ার পর বেশ কটা বিয়ারের বোতল নিয়ে আমাদের ছাতের চিলে কোঠার ঘর টাতে রওনা দিলাম। বিশ্বজিৎ বললো “ বিদিশা.. ? “ বিদিশা তাড়াতাড়ি জবাব দিলো “ না না আমার মেয়েকে স্কুলের পড়া দেখাতে হবে। আপনারা এনজয় করুন “।
ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে লাগলো। চারপাশটা একেবারে শুন শান হয়ে এলো। রিক্সার প্যাক প্যাক, গাড়ির হর্ন কিছুই আরশোনা যায় না। পুরোন অনেক গল্পের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বেশ কয়েকটা বোতলও শেষ। হঠাৎ শুনি ভারী মিষ্টি গলায় কে গানধরেছে “ আমার পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই…” বিশ্বজিৎ অবাক হয়ে বলল “ভারী মিষ্টি গলাটা তো। বিদিশা ..?” আমি কার্নিশদিয়ে উঁকি মেরে দেখে বললাম “ আরে না না। হরিদার চায়ের দোকানের পাশে যে পাগলীটা বসে, সেই গাইছে। মজার মজারকথাও বলে, চুপটি করে শোন।”
পাগলী দুলাইন গেয়েই হঠাৎ চুপ করে গেল। তার পর কাকে যেন একটা উদ্দেশ্য করে বলল “ আর মনে নেই। বাকিটা ভুলে গেছি, জানো। “ উঁকি দিয়ে দেখলাম তার পোষা কুকুর ছানাটা ছাড়া কেউই নেই আসে পাশে। পাগলী আবার বলা শুরু করলো“তারচেয়ে বরং তোমায় একটা কবিতা শোনাই:
‘খোকা ঘুমলো পাড়া জুডালো, বাবলা গাছে টিয়ে,
শাশুডি বৌ পান খেলো হোলোক নোলোক দিয়ে’ ! “
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললো “ না না – এ কবিতাটা বাজে। অন্য একটা বলছি, এটা তোমার ভাল লাগবে:
‘ চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে, কদম তলায় কে?
কদম তলায় মামা শ্বশুর ঘোমটা টেনে দে ! ‘“
এটুকু বলেই হঠাৎ পাগলীটা খিল খিল করে হেসে উঠলো “ পরনে নেই কাপড় তার ঘোমটাটা দেব কি দিয়ে, শুনি ?”
আমি শুনে হো হো করে হেসে বিশ্বজিৎ এর দিকে তাকিয়ে দেখি সে ছাতে এক কোনে তাকিয়ে কি ভাবছে, হাসছে না মোটেই ! আমিঅবাক হয়ে বললাম “কিরে শুনলি পাগলীর কথা ? “ ও আমার দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে বললো, “শুনেছি বলেই তো ভাবছি! “ আমি বললাম “এতে ভাববার আবার কি পেলি ? “
বিশ্বজিৎ বললো “ আচ্ছা তপন, এই যে আমাদের কোটি কোটি টাকা খরচা করে বিদেশের কাছে ঘোমটা টানার চেষ্টা, আর তারপাশেই ধারাভীর রাস্তায় একটা রুটির টুকরো নিয়ে কুকুরে–মানুষে কাডাকাডির নগ্নতা, একি সেই ‘পরনে নেই কাপডের’ কথাইনয়?”
আমি একটু থমকে গিয়ে তারপর বললাম “ গুরু মাল খেয়ে মাতলামি করতে বলো, পারবো, কিন্তু আঁতলামি করতে পারবো না।বেশ ফুর ফুরে নেশা হয়েছে। আমি এখন শুতে চললাম।”
বিশ্বজিৎ একটা অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে বলল “বুঝেছি বুঝেছি, তোর কিসের তাড়া! আমার জন্য একটা বোতল রেখে শুতে চলে যা।কাল দেখা হবে।”
পরেরদিন চা জলখাবার খেয়ে বিশ্বজিৎ কে বললাম “চল কিছু বাজার করবার আছে, চল আমার সঙ্গে। তোকে শহরটা দেখিয়েওদেবো। “ রাস্তায় নেমে বললাম “ চল তোকে আগে রাজবাড়ির দিকটা ঘুরিয়ে আনি।” বিশ্বজিৎ বললো “ আমাকে শহর দেখানোরকোন দরকার নেই। এ শহরের অলি–গলি আমি চিনি। পাশ করবার পর তিন বছর চাকরি করেছি এই কৃষ্ণনগরে, তোর এখানেআসবার অনেক আগেই। তার চেয়ে বরং বাজারটাই সেরে নিবি চল। “ আমি অবাক হয়ে বললাম “ জানতাম নাতোএব্যাপারটা।” বিশ্বজিৎ আবার একটা অর্থপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো “ তুই আর আমার সম্বন্ধে কতটুকুই বা জানিস! পাশ করার পরআমাদের দেখাই হয়েছে কতবার ? “
বাজার সেরে ফেরার পথে বিশ্বজিৎ বায়না ধরল চা খাবার। জানি বিদিশা দুপুরের রান্না নিয়ে ব্যাস্ত থাকবে, তাই ওকে নিয়ে গেলামবাড়ির সামনেই হরিদার চা এর দোকানে। চা খেতে খেতে হরিদার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম বিশ্বজিৎ এর। বললাম গতরাতেপাগলীর গানের কথা।
হরিদা বললো “এ পাগলীটা আগে বড় ঘরের মেয়ে ছিল মনে হয়। ওর কথা শুনে বুঝতে পারি লেখাপড়া জানতো আগে। “
বললাম “ওর বাড়ির খোঁজ নিয়ে দেখেন নি ? ওর নাম কি, কোথায় বাডি, বলে কিছু ? “
হরিদা বললো “ তা আর শুধুই নি ? জিজ্ঞাসা করলে রোজ নতুন একটা নাম বলে। কখনও বলে ভুলে গেছে। বাডি বলে যে সবশহরের নাম বলে তার নাম শুনিনি কখনও। এক বাবু একদিন মনদিয়ে শুনে বললেন ও তো কখনও আমেরিকা, ইউরোপ, জাপানএসব জায়গার নাম বলছে। বুঝুন ! আর ওর বাড়ির লোক চিনতে পারবে ? চেহারা দেখেছেন ? “ সত্যিই তাকিয়ে দেখি পাগলীরমুখটা যেন কেউ ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। একটা চোখ বোঁজা। একদিকে ঠোঁট ছিডে ঝুলছে। মুখে বিশ্রী কাটা দাগ। গায়ের কাপড়কোথাও আছে, কোথাও নেই। হরিদা বলল কোন বড় একসিডেন্টে, আর তার পর বিনা চিকিৎসায়, নাকি এই অবস্থা। হরিদাবলল “ভারি শান্ত জানেন। আমার বৌএর কেমন মায়া পড়ে গেছে ওর ওপরে। দুবেলা সেই ওকে খাবার টাবার দেয়।” তারপরগলাটা খাটো করে বললে “ পাগলীর বয়েসটা তো কম, আর চার পাশে শেয়াল শকুনের অভাব নেই। তাই আমরা চিন্তায় থাকি।তবে দোকানের পাশ ছেড়ে কখনও কোথাও যায়না। এই একটা ভরসা, নজরে নজরে থাকে। তবে শুধু পুর্নিমার রাতে আর তাকেআটকানো যায়না,
সেদিন ঠিক রাত দশটায় সে যাবেই যাবে। কিছুতেই আটকানো যাবে না। আটকাতে গেলে আঁচড়ে কামড়ে একশা করে ছাড়ে, পাগলামি যায় ভয়ানক বেডে। কি করে যে কবে পুর্নিমা, রাত দশটা বাজে, এসব বোঝে তা বলতে পারবো না বাবু। “
বিশ্বজিৎ অবাক হয়ে বলল “ আচ্ছা কখনও দেখবার চেষ্টা করেন নি যে কোথায় যায় ? “
হরিদা বলল “ হ্যা করেছি তো। একটা ছোকরাকে লাগিয়েছিলাম ওর পিছনে, দেখতে। সে বললো ও নাকি কাছেই খড়ে নদীর ধারেগিয়ে কি সব পুজো আচচা এসব করে। বোধহয় কোন মানত টানত দিয়েছিলো আগে। বেশিক্ষণ থাকেনা, ঘন্টা দুয়েক বাদে ফিরেআসে। “
চা খেয়ে বাডি ফিরলাম। দুপুরে খাবার টেবিলে এ কথা সে কথার পর বিদিশা পাড়লো কথাটা, “আর কত দিন দেরি করবেন, এবার বিয়েটা সেরে ফেলুন। একটা বয়সের পর দেখবেন বড় একা লাগবে। আপনার বন্ধুর কাছে তো শুনেছি অনেক মেয়েরইআপনাকে পছন্দ ছিল, তাদের কাউকে কি মনে ধরেনি ?”
কথা শুনে বিশ্বজিৎ হেসে ফেলল “ পছন্দ হবে না কেন, অনেক কিছুই হয়েছে, তবে যে জিনিষটার খোঁজ আমি করেছি সেটা…”
বিদিশার দৃষ্টি দেখলাম তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে “ কোন জিনিষটা বলুন তো? কি বলতে চাইছেন ?”
বিশ্বজিৎ একটু হেসে বলল “ দেখুন বিয়ে যাকে করবো সে হবে সারা জীবনের সঙ্গী । সব মেয়েই আমাকে ভালবাসে আমারবাইরের চেহারা বা অন্য কিছু দেখে। কিন্তু কিছুদিন পর সে তো পুরোনো হয়ে যাবে তার চোখে। সে তখন নতুন কিছু খুঁজবে।সারাজীবন সম্পর্ক টিকে থাকে commitment এর জোরে, নয় কি ? সেই commitment, সেই একসাথে চলার প্রতিশ্রুতি, কটাসম্পর্কের মধ্যে সত্যি টিকে থাকে বলুন তো?”
আমি বললাম “ হয়েছে হয়েছে, এবার শুরু হল জ্ঞান দেওয়া। তুই থামবি ? আমার ভরা পেটে বেশ ঘুম পাচ্ছে।”
বিদিশা হেসে বললো “ তোমার শুধু খাওয়া আর ঘুম। তাই এসব চিন্তাও নেই ! “
বিকেল বেলা বিশ্বজিৎ কে বললাম “ কাল তো বিয়ার হোল। আজ তা হলে কি হুইসকিটা হবে ? “ বিশ্বজিৎ কি একটা ভেবেবললো “আচ্ছা আজ তো পুর্নিমা তাই না ? “ আমি বললাম “তা হবে, আমি এসব খবর টবর রাখি না।” বিশ্বজিৎ বললো “ নানা আমি মোবাইলে চেক করে দেখলাম। আজই।” আমি অবাক হয়ে বললাম “ চাঁদের ছবি তোলার প্ল্যান নাকি ? কিন্তু তুই তোক্যামেরা আনিস নি। মোবাইলে কি ভাল উঠবে ? “ বিশ্বজিৎ বললো “ না না সেসব কিছু নয়। ভাবছি একটা এডভেনচার করাযাক। চল আজ রাতে ঐ পাগলীটাকে ফলো করে দেখি ও খড়ে নদীর ধারে কি করতে যায়। নয়টা নাগাদ খেয়ে নিয়ে দশটার সময়ওকে ফলো করবো। কথায় বলে ‘After dinner walk a mile ‘ . সেটাও হয়ে যাবে। হুইসকি ছেড়ে আমার এসব ক্ষ্যাপামি করবারএকটুও ইচ্ছে না থাকলেও, বিশ্বজিৎ কে আমি চিনি। ওর মাথায় একবার যখন ঢুকেছে তখন তার নড়চড় হবার কোন সম্ভাবনানেই। বিদিশাকে বললাম তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বিশ্বজিৎ একটু খড়ে নদীর ধারটা দেখতে যেতে চায়। বিদিশা বললো “ এইপুর্নিমার রাতে আমারও খুব যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু রিয়ার কাল স্কুল । তোমরা দুজনই বরং ঘুরে এসো। “
খাওয়া সেরে টর্চটা নিয়ে তৈরী থাকলাম। ঠিক দশটার সময় দেখলাম পাগলীটা একটা পুটুলি নিয়ে রওনা দিলো। একটু দুরত্বরেখে আমরা দুজনও চললাম তার পিছু পিছু। চাঁদের আলোয় রাস্তা দেখতে অসুবিধা নেই । পাগলীর পিছু পিছু আমরাও পৌছেগেলাম খড়ে নদীর ধারে। ঘাটে বসে পাগলীটা দেখি তার ঝোলা থেকে খুব যত্ন নিয়ে কি একটা বার করছে। নজর করে দেখিএকটা শালপাতার তৈরী জিলিপির তিন কোনা ঠোঙা। ঘাটের ওপর সেটা পরম যত্নে নামিয়ে রেখে পাগলী কি জানি কাকে উদ্দেশ্যকরে বললো “ এই দেখো, তোমার কি সুন্দর টোপর ! পছন্দ হয়েছে তো ? “
তার পর আবার তার ঝোলা থেকে বার করলো একটা রাঙ্গতার মুকুট। নজর করে বুঝলাম ভাসানের পর খড়ে নদীর জলে ভেসেআসা মা দুর্গার মুকুট একটা। সেটা মাথায় পরে পাগলী বললো “ এই দেখো আমার কি সুন্দর মুকুট। ভাল লাগছে না ? বলো না!” তারপর দেখি আবার ঝোলা থেকে বার করলো দুটো শুকনো মালা, বুঝলাম শ্বশান থেকে জোগাড় করেছে বোধহয়। বললো “ এই দ্যাখো আমাদের মালা বদলের মালা। কেমন মিষ্টি গন্ধ, শোঁকো। “ তারপর একটা পিন্ডি দেওয়ার মালসা বার করে তাতেদুটো শুকনো কলা পাতা রেখে বললো “ কলাবৌ দেখেছো ? কি সুন্দর লাগছে না ? “। আমি আর আমার হাসি চাপতেপারছিলাম না, কিন্তু মুখ চেপে হাসতে গিয়ে চোখ পডলো বিশ্বজিৎ এর দিকে। সে দেখি এক দৃষ্টে পাগলীর দিকে তাকিয়ে আছে, চাঁদের আলোয় তার মুখটা দেখলাম অস্বাভাবিক রকম ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আমার চোখে চোখ পড়তে হঠাৎ আমার হাত চেপেধরে টান দিয়ে বললো “ আর এ পাগলামি দেখতে হবে না। চল, চল এখান থেকে। “
ফিরে আসতে আসতে পিছন থেকে ভেসে এলো পাগলীর বুকফাটা আর্তনাদ “ এই দ্যাখো, দ্যাখোনা তুমি ! আমি কিন্তু তোমারসব কথা রেখেছি ! শুনছো তুমি ? শুনতে পাচ্ছো আমার কথা…”।
~ প্রতিশ্রুতি ~