হাওড়া থেকে ব্যাণ্ডেলের রেলগাড়ির ছড়া,

ছড়িয়ে গেছে চতুর্দিকেমনটাকে দেয় নাড়া।

এবার না হয় শিয়ালদহ দখিনপানে ঘুরি,

কাটবে সময়থাকলে হাতে একঠোঙা ঝালমুড়ি।

চাকুরীতে থাকাকালীন রেলের নিত্যযাত্রী,

সাত সকালে কর্মক্ষেত্রেফিরতে অনেক রাত্রী।

বাড়ী আমার মহানগর থেকে বহু দূরে,

বারুইপুর ঠিকানা যার আদিগঙ্গার ধারে।

শিয়ালদহে আছি বসে রাত আটটার গাড়ী,

কত লোকের কত কথাকি যে ঝকমারী !

আজব প্রশ্ন আসে ছুটেএটা কিসের ট্রেন,

আমি বললাম-‘ইলেকট্রিকের’-‘কুলআমারব্রেন

বলুন আমার উত্তরে ছিল কোথায় ভুল !

যে অগ্নিশর্মা প্রশ্নকর্তা টানতে এলেন চুল।

কিন্তু টাক মাথাসে যাত্রায় গিয়েছিলেম বেঁচে,

এমন কত মজার কথায় মনটা ওঠে নেচে।

শিয়ালদহে হুক্কাহুয়া রব আসে না কানে,

কাছেপিঠে শিয়াল কোথায় বামে কিম্বা ডানে !

এককালেতে অবশ্যই ছিল হেথায় জলা,

রাতেই শুধু নয়শিয়াল ঘুরত দিনের বেলা।

অশথ গাছের ছায়ায় হুঁকোয় টান দিতেন জব,

ডিহি অর্থে গ্রামের থেকেই নামটির উদ্ভব।

ছাড়ল গাড়ী বাজিয়ে বাঁশিপার্ক সার্কাস আসে,

অত রাতেও ভিড়ের চোটে ভিরমি নাভিশ্বাসে।

আশেপাশে পার্ক না থাকসার্কাস কামরাতে,

এর ঘাড়ে ওর পা উঠে যায়পকেট কারো হাতে।

এবার এল বালীগন্জবালীর নেই দেখা,

উঁচু উঁচু বাড়ীগুলো সব আকাশ ছুঁয়ে থাকা।

কোনদিন হয়ত হেথায় ছিল বালির স্তুপ,

তবে এসব নিয়ে ইতিহাস একেবারেই চুপ।

ইটকাঠের ইমারত আর চওড়া পিচের রাস্তা,

ধনীদের বাস এখানেনয় কিছুই সস্তা।

এর পরেই ঢাকুরিয়াঢাকটা বাজে কই !

ঢাকুরিয়ায় বিখ্যাত ভাই সুরেশবাবুর দই।

ঢাকুর মানে পুকুর, হ্রদতাই তো ঢাকুরিয়া,

বিখ্যাত এক হ্রদ হেথাযেথায় চলে খেয়া।

নামছে কম,উঠছে বেশীকামরা ঠাসাঠাসি,

আসছে এবার যাদবপুরশিক্ষিত হার বেশী।

যাদবপুরে কৃষ্ণ কোথাকোথায় বিনোদ রাধা !

তবুও কেন যাদবপুরশুনুন কারণ দাদা।

সোনারপুরের জমিনদার যাদব নারায়ণ,

তাঁর নামেই সরকার যে করেন নামকরণ।

আছে হেথায় বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,

দু: কেবল পড়াশুনার কমছে ক্রমেই মান।

পরের স্থান বাঘা যতীনঅমর বিপ্লবী,

আঁকা আছে মনের মাঝে আজও যাঁর ছবি !

তাঁর নামেই জায়গাটি আজনামকরণে শ্রদ্ধা,

ছুটছে গাড়িগুঁতোগুঁতিযাত্রীরা সব যোদ্ধা।

থামল গাড়ী নিউ গড়িয়াকবি সুভাষ পাশে,

পাতাল রেলের শেষ ঘাঁটিতে বসন্ত কি আর আসে !

কোথায় পাতালচলছে রেল ঊর্ধ্বে ঊর্ধ্বগতি,

নিউ গড়িয়া ছেড়েই গাড়ীর গড়িয়াতেই যতি।

গড়িয়াতে গাড়ি কিন্তু গড়ায় সামনে পিছে,

তবে সে জন্যেই নামকরণএমন ভাবনা মিছে।

কেউ বলেন গৌড়ীয় সব বাস করতেন হেথা,

তার থেকেই এমন নামবৈষ্ণবের কথা।

কারো মতে গুড়িয়া গাছের থেকেই নামকরণ,

ঝমাঝম রেলগাড়িতে করছি স্মৃতিচারণ।

ধীরে ধীরে কামরা এবার হচ্ছে ক্রমে ফাঁকা,

আমার বাড়ি বারুইপুরেশেষ অবধি থাকা।

থামল গাড়ি নরেন্দ্রপুরবিখ্যাত সেই মঠ,

আজও দেয় শীতল ছায়াযেন প্রাচীন বট।

নরেন্দ্রনাথ দত্ত তিনিরামকৃষ্ণের শিষ্য,

সেবাব্রতী বিবেকানন্দজয় করেছেন বিশ্ব।

অবশেষে সোনারপুরসোনার দোকান পাশে,

এখান থেকেই ক্যানিং যায় সুন্দরবন ঘেঁষে।

নামল অধিক যাত্রী হেথাছাড়লো গাড়ী হাঁফ,

গাড়ীর ভিতর কমল যেন খানিক উত্তাপ।

ভারত মাতার সোনার ছেলেএক নয় একাধিক,

বাস করতেন হেথায় তাই নামকরণে সঠিক।

কারো মতে দত্ত বণিক সব সোনার বেণে,

তাঁদের নামেই জায়গাটিকে আজকে সবাই চেনে।

রাজপুর নামেও জানি এই শহরের কথা,

রাজার পুরীতখন ছিল জমিদারির প্রথা।

দাপুটে সব জমিদারহেথায় ছিল বাস,

ছুটল গাড়ি তেড়েফুঁড়ে ছেড়ে দীর্ঘশ্বাস।

ছুটছে গাড়ী জোর গতিতে সুভাষগ্রামের দিকে,

অন্ধকারে আশেপাশের সব গিয়েছে ঢেকে।

ধানক্ষেত আর নেই কোথাওচতুর্দিকেই বাড়ী,

চণ্ডীতলায় দেবীর দেউলকে করেছে চুরি !

বাংলামায়ের দামাল ছেলে বীর সুভাষের নাম,

জড়িয়ে আছে চাংড়িপোতায়এখন সুভাষগ্রাম।

কোদালিয়ায় পিতার ভিটে কাছেই  আশেপাশে,

মালঞ্চ আর হরিনাভি কম যায় বা কিসে !

মনিষীদের অধ্যুষিত এহেন পূণ্যভূমি,

নবীন যুগের তরুণ প্রাণ খবর রাখে কমই।

প্রণামান্তে থামল গাড়ী সেই সুভাষগ্রামে,

অনেক যাত্রী খুশীমনে সেথায় গেলেন নেমে।

সারাদিনের লড়াই শেষে সুখী গৃহকোণে,

ছুটে চলেন সবাই বুঝি শান্তির সন্ধানে।

বারুইপুর পৌঁছতে আর নেইকো মোটে দেরী,

মাঝে কেবল মল্লিকপুর থামবে যেথা গাড়ী।

ডিহি মেদনমল্ল থেকে মল্লিকপুর নাম !

নাকি কোনো নবাবদের ছিল সেথায় ধাম।

সেসব তর্ক থাকুক তোলাগাড়ী দিয়েছে ছেড়ে,

যাত্রা এবার শেষ করবে আমার বারুইপুরে।

বারুইপুর এলেই আমার মন চলে যায় দূরে,

এক সাধকের উপন্যাস গঙ্গানদীর তীরে।

বঙ্কিম আর মধু কবিঅরবিন্দ ঋষি,

রাতভোর কীর্তনান্দে শ্রীচৈতন্য খুশী।

সবার পুণ্য পদধূলিতে পবিত্র মোর শহর,

বারুজীবির পানের বরজনামটির কি বহর !

এখান থেকে পথ গিয়েছে দুইটি ভিন্ন দিকে,

একটির শেষ নামখানা, কুলপী অন্য বাঁকে।

থামল গাড়ি বারুইপুরেঘড়ি নটার ঘরে,

ছড়াকারের বাড়ি কাছেইএস সময় করে।

জাগ্রত পীঠমা শিবাণীজগন্মাতা তিনি,

তাঁর দেউলের পাশেই এই দীনের কুঠিখানি।

আম,লিচু,আর পিয়ারাতে জানাবো স্বাগতম,

ফুলকো লুচি গরমাগরমকষা আলুরদম।

আমার ঘরে এস বন্ধুকরবো আপ্যায়ন,

এবার মোরে বিদায় দাওক্লান্ত তনুমন।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleবাংলার লক্ষ্মীবাঈ
Next articleSTEP MOTHER-THE DEMONIZED ANGEL.
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments