আকাশের নীল বুকে খেলে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা পেঁজা তুলোর মত মেঘ।প্রকৃতি তার পসরা সাজিয়ে বহুরূপে আমাদের সামনে ফিরে ফিরে আসে। বর্ষার কালো মেঘের ঘনঘটা পার করে শরৎ-এর হাসিখুশি ভাব ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরছে চারিদিকে। বাতাসে কেমন একটা উৎসবের গন্ধ ভেসে আসে। কিন্তু মানুষের ব্যস্ত জীবন থেমে থাকে না। ক্ষুধার পেট বোঝেনা শিউলি ফুলের গন্ধ, কাশ বনের নির্মল আন্দোলন। তাই এই সৌন্দর্যের মাঝেও জেগে থাকে বেঁচে থাকার লড়াই।
রাস্তার পাশে ফুটপাতে অবহেলায় পড়ে আছে একটা বছর তিনের শিশু। উদোম গা, অপরিষ্কার হাত-পা। ত্রুটিহীন অযত্নে কোনরকম ভাবে বেড়ে ওঠা এই শিশুটির কান্না কিসের প্রতিবাদের ভাষা তা কেউ বোঝে না। আশেপাশে আগোছালো তার ফুটপাত-বাড়ি। একপাশে চাটাই দিয়ে মোড়া সামান্য কিছু চাদর-জামাকাপড়।তার পাশে রাখা হাড়ি-কড়াই-বাসনপত্র। চার দেওয়ালের বাঁধনহীন খোলা আকাশের নিচে এই ছোট্ট আস্তানা তার জন্মগত অধিকার। অগণিত ব্যস্ত পা পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে নির্দ্বিধায়। কেউ প্রয়োজন বোধ করছে না বাচ্চা শিশুটার দিকে নজর দেবার।
সামান্য দূরেই একটি ময়লা ফেলার ভ্যাট। অপ্রয়োজনীয় আবর্জনার ভারে সেটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। তার ধারণ ক্ষমতা অতিক্রান্ত হওয়ায় আশেপাশে ছড়িয়ে গেছে কিছু আবর্জনা। সেখানে খাবারের খোঁজে আশা নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে বেশ কিছু কাক আর কুকুর। তাদের সন্ধানী চোখ খুঁজে বের করছে বেঁচে থাকার রসদ। একটি কাক তার মজবুত ঠোঁটের সাহায্যে খুঁটে খুঁটে যা কিছু পাচ্ছে তা গলার কাছে দলা করে জমিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর উড়ে গেল কাকটি। একটি বাড়ির কার্নিশে গিয়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে একটি বাচ্চা কাক কা-কা করতে করতে ছুটে এলো। তার মায়ের জন্যই বোধহয় অপেক্ষা করছিল এতক্ষণ। মা-কাক তার ঠোঁটটি কিছুটা ঢুকিয়ে দিল ক্ষুধার্ত সন্তানের হাঁ করা মুখের মধ্যে এবং উপুড় করে দিল তার কষ্টের সংগ্রহের সবটা। বাচ্চা কাকের ঠোঁটের ভিতরের লাল অংশ বলে দিচ্ছে তার শৈশব এখনও কাটেনি। খাদ্য সংগ্রহের ব্যাপারে সে এখনও স্বাবলম্বী হয়নি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে উড়ে এসেছে আরেকটি বাচ্চা কাক। সেও নিশ্চয়ই তার মার কাছে খাবারের দাবী রাখবে। কিন্তু না এখানে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা তো কাক নয়! একটা বাচ্চা কোকিল। তার লম্বা লেজ তাকে চিনিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। একটা বাচ্চা কোকিল হঠাৎ একটি কাকের কাছে কেন ছুটে এসেছে?ওঃ, আসলে সে তো জন্ম থেকেই এই কাকটিকে মা বলে জেনে এসেছে। তাই সেও ভেবেছে মা তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। কিন্তু না। মা-কাক সোজা উড়ে চলে গেল আরেকটি বাড়ির ছাদে। সে তো জেনে গেছে এটি তার সন্তান নয়। এতদিন যাকে সে আশ্রয় দিয়েছে, খাবার দিয়েছে, মমতা দিয়েছে তার আসল রূপ যখন প্রকাশ পেল তখন কাক-মায়ের হৃদয় ব্যথিত হয়েছে। সে আর কোন দায়িত্ব নিতে অপারগ। তাই কোকিল ছানার সাথে সৎ-মায়ের মতই ব্যবহার করল সে।
ফুটপাতের বাচ্চা শিশুটির কান্না এতক্ষণে শুনতে পেয়েছে তার মা। হাতে খাবারের থালা নিয়ে ছুটে এসেছে সে। সামান্য কটি ভাত আর আলুসেদ্ধ মেখে তার সন্তানের মুখে তুলে দিতে পারার থেকে বেশী ক্ষমতা তার নেই। পরম যত্নে নিজের কোলে টেনে ক্ষুন্নিবারণের সেই সামান্যটুকু সামগ্রী নিজের সন্তানের মুখে তুলে দিয়ে তার হৃদয়ের প্রশান্তি চোখে-মুখে প্রকাশ পেল। শিশুটির অশ্রুসজল চোখ মায়ের লালিত্যে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করতে উচ্ছ্বসিত। ঘর-সংসার যেখানেই হোক না কেন সমগ্র বিশ্বের যে কোন শিশু তার মায়ের বুকে স্নেহের আদর পেলে তার থেকে সুখী কেউ হয় না। আর এই ভালোবাসার মূল্য পরিমাপ করার বৃথা চেষ্টা যারা করে তাতে তাদের হৃদয়ের সংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ পায় না।
কোকিল-ছানা কি করবে! সে তো চেনে না তার মা কে? তাই সে আবার ছুটে যায় কাক-মায়ের কাছে। যদি মা-কাক আবার তাকে নিজের সন্তানের মতই খাইয়ে দেয়। কিন্তু এ তো বৃথা আশা।মা-কাক আবার তার সঙ্গ ছেড়ে উড়ে যায়। প্রকৃতির নিয়মেই আজ সে মাতৃহারা। ভগবান তাকে মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন নিজের নিয়মেই। তার মাতৃহারা শৈশবের সেই কান্নাই কি একসময় তার গলার মধুর সুর হিসেবে ফুটে উঠবে। ঈশ্বর কি তার ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কোকিলের কন্ঠে ঢেলে দেবেন সুরমূর্ছনা যা যুগে যুগে সকলের মনে আনন্দ সঞ্চার করে বেঁচে থাকবে। আমরা কোকিলের এই অসাধারণ কন্ঠস্বর কে হিংসা করা ছাড়া আর কোন উপায় খুঁজে পাই না। কিন্তু তার পিছনে যে কত কান্নার অবদান রয়েছে সে কথা কি কখনও বুঝতে পারব।পারব না! পারব না! দুঃখের মর্মান্তিক যাতনার মধ্যে দিয়ে হৃদয়ের যে সুর ধরা দেয় তা সত্যিই ঈশ্বরের আশীর্বাদ।