করোনা শেষের কথা

জুলাই ২০২১
করোনা কয়েক মাস আগে বিদায় নিয়েছে। শেষ দিকটা বেশ দু্র্বল হয়ে পরেছিল। তবে মাস্ক আর স্যানিটাইজার এখনো আছে। সামাজিক দূরত্ব রাখার নিয়মটা আর অবশ্য কেউ মানে না। মেট্রো আর মলে লোকজন আগের মতোই। একই অবস্থা বাজারে কি রেস্টোবারে। ২০২০ র দুরাবস্থার কথা মানুযের আর মনে নেই। তবে জমিয়ে আড্ডার সময় মদের গ্লাস কি চায়ের কাপ হাতে অনেক মানুষ তাদের লক ডাউন অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছে হয়তো একটু বাড়িয়ে চাড়িয়ে।

কভিড যখন যাব যাব কোরছিল তখনই তার প্রতিষেধক টিকা গুলো বেরোতে লাগলো প্রায় হুরমুর কোরে । প্রথমে রাশিয়ার এলো। পশ্চিমি অপপ্রচারে ভারতের বাজারে তেমন চলে নি প্রথমের দিকে। তবে একটা সাবমেরিনের কেনাবেচা সংক্রান্ত ব্যাপারে ভারতের শর্ত মেনে রাশিয়া ভারতে টিকা বানানোর লাইসেন্স দেওয়ায় বিক্রিবাটা বাড়লো মোটামুটি। চিনের টিকাও এলো রাশিয়ার পিছু পিছু তবে ভারতে নয় , পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর নেপাল সমেত দক্ষিন এশিয়ার বাকি দেশ গুলোতে। লাদাখ নিয়ে মন কষাকষি এখনও চোলছে। দাম শস্তা আর অঢেল সাপ্লাই এই চিনা টিকার। ভারত সরকার অবশ্য একটু গাঁইগুঁই কোরছিল। তবে চিনকে বেশী দিন অপেক্ষা কোরতে হয় নি। ডব্লু এচ ও র অনুমোদন আর ডব্লু টি ওতে নানা প্রশ্ন ওঠায় ভারত সরকার আর আপত্তি করে নি। তারপর একে একে ইংরেজ, আমেরিকান, ইউরোপীয় আর ইসরাইলের টিকায় ভারতের বাজার উপছে পোড়লো। স্বাভাবিক। ভারত তার বিপুল জনসংখ্যার কারণে টিকার বিশাল খরিদ্দার। টিকার আবিষ্কর্তা বিদেশী ব্হূজাতিক সংস্থা গুলোর লাইসেন্স নিয়ে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানরাই ভারতের জন্য টিকা বানাচ্ছে। আবার সেই টিকার ইম্পোর্টেড ভারসনও ভারতে পাওয়া যাচ্ছে। অবশ্য দামে অনেক তফাৎ। ভারতের গোটা দুয়েক কোম্পানি নিজেদের উদ্ভাবিত টিকা বাজারে এনেছে। বিক্রি খুব ভালো।

গত বছরের শেয দিকে ভারতে উদ্ভাবিত টিকা বাজারে আসার পর পরিস্থিতি একটু নতুন মোড় নিয়েছিলো। কিছুলোক এই উদ্ভাবনকে ভারতীয় আত্মনির্ভরতা আর সাংস্কৃতিক বিজয় ঘোষণা কোরেছিলো, আর তাদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হোয়ে হাজার হাজার মানুষ মন্দিরে পুজো দিয়ে কপালে চন্দনের টিকা দেওয়ার পর এই টিকা লাগিয়েছিলো। কেউ কেউ আবার আর এক ধাপ ওপরে উঠে টিকা নেবার পর মাথা কামিয়ে টিকি রেখেছিলো। অনেকে এসব মানে নি। টিকা লাগিয়ে আলুর টিক্বি কি চিকেন টিক্বা খেয়ে সেলিব্রেট কোরেছিলো।

দাবী উঠেছিলো আত্মনির্ভর ভারতে শুধু ভারতে তৈরি টিকাই বিক্রি হবে। বিদেশী টিকার আমদানি যদি বন্ধ না করা যায় তবে প্রতিবন্ধক শুল্ক লাগানো হোক । খবর কানাকানি হোতেই পশ্চিমি দেশ গুলো প্রচন্ড ঝামেলা বাধালো। আমেরিকার রীতিমতো হুমকি । আন্দমানের আশেপাশে প্রস্তাবিত ভারত মার্কিন দ্বৈত নৌমহড়াতে তাদের নাকি আর উৎসাহ নেই। সুযোগ বুঝে প্রথমে চিনের বিদেশ মন্ত্রী আর ঠিক পরেই ভারতের প্রমুখ বিরোধী নেতার মন্তব্য, অহেতুক হঠকারিতার পরিণাময়ের দায়িত্ব ভারতকে নিতে হবে। প্রমাদ গুনলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। টিকা নিয়ে কূটনৈতিক বিপর্যয় ভারতের কাম্য নয়। একটা টিভি চ্যানেল ব্রেকিং নিউজ দেখিয়েছিলো যে চিন নাকি দারিদ্র্য সীমার নীচের মানুষদের অর্ধেক দামে টিকা দেবার প্রস্তাব পাঠিয়েছে । ভারত সরকার নাকি সম্মত হয় নি কারণ এই গরীবদের তথ্য চিনা সার্ভারে চলে যেত।

প্রধানমন্ত্রী নতুন স্লোগান দিলেন। বোললেন, আত্মহিতে আত্মনির্ভর। এই নতুন চিন্তাধারা যে আসলে নতুন কিছু নয় , বরং স্বাভাবিক বিবর্তন সেটা বোঝালেন ৬৪ মিনিটের সুদীর্ঘ ভাষণে। যদিও মোদ্দা কথাটা ছিল বেশ সোজা। স্বার্থ বুঝে আত্মনির্ভরতা। বিরোধীরা বোললো আন্তর্জাতিক চাপে ভারতের আত্মসমর্পণ।

সামাজিক স্তরে টিকার ব্যবহারের প্রভাব ছিল অন্য। দারিদ্র সীমার নিচের মানুষদের জন্য ভারতীয় টিকা প্রস্তুতকারকদের সরকারি আদেশ ,ভর্তুকি দিতে হবে। দাম বেধে দেওয়া হোলো। ওদের যুক্তি খয়রাতি কোরতে ওরা নিবেশ করে নি। শেষ অবধি সুপ্রিম কোর্টের আদেশে দাম কম হোলো না। ভর্তুকির টাকা সরকার সরাসরি পাঠালো গ্ৰাহকদের ব্যাংক খাতায় , তবে কেন্দ্র আর রাজ্য গুলোর মধ্যে মাস দুয়েক টানা পোড়েনের পর।

দারিদ্র সীমার ওপড়ে নিম্ন মধ্যবিত্তরা চিনের টিকা লাগালো মহানন্দে, আত্মহিতে আত্মনির্ভর এই জ্ঞান তারা অর্জন কোরেছে বৈকি। মধ্যবিত্তরা চিন, রাশিয়া, ইসরাইল ছেড়ে ভারতীয় টিকা ,তবে স্ট্যাটাস দেখাতে বোললো নিয়েছে ভারতে তৈরি আমেরিকান ব্রান্ড। মাঝবয়সী মিস্টার কুন্ডুর অন্য সমস্যা। ইদানিং ফ্ল্যাট কিনেছেন। গাড়ি , বাড়ির কিস্তি , ক্রেডিট কার্ডের বিল , দুই ছেলে মেয়ের পড়ার খরচ চালিয়ে হাতে কিছু থাকে না। উনি চেয়ে ছিলেন ভারতীয় টিকা লাগিয়ে কাজ সারবেন। বাধ সাধলেন মিসেস কুন্ডু । ভারতীয় পন্যের গুণমানের ওপড় কোনো আস্থা নেই। তারপর জানাজানি হোলে নাকি সোসাইটিতে মুখ দেখানো যাবে না। অগত্যা তিনি ভারতে তৈরি ব্রিটিশ ব্রান্ড নিলেন। উচ্চ মধ্যবিত্তরা বিশেষত যারা করপোরেট খরচে টিকা লাগালেন তাদের অবশ্য নিজেদের এনটাইটেলমেন্ট হিসেবে আমেরিকা কি ইউরোপের ইম্পোর্টেড ব্রান্ড গুলোই পছন্দ ছিলো।

উচ্চবিত্ত মানে হাই নেটওয়ার্থ লোকজন চিরদিনই দাম দেখে মান নির্ণয় করেন। ওঁরা ইমপোর্টেড পশ্চিমি টিকা কিনে লাগালেন সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে গিয়ে। ব্যয়বহুল বটে কিন্ত্ত তাতে কি, উচ্চপদস্থ করপোরেট এক্সিকিউটিভদের খরচ বহন কোরলো তাদের কর্মপ্রতিস্থান। ব্যবসায়ীরা দেখালো ট্যাক্স ডিডাক্তিবল এক্সপেন্সেস।

” ভারত কা টিকা আগে সব ফিকা” চ্যানেল গুলোতে এক বিখ্যাত ক্রিকেটার বোলছেন। সবাইএর মুখে মুখে এই ক্যাচ লাইন। ভারতীয় প্রস্তুতকারক ভারত বায়োটেকের টিকার বিজ্ঞাপন। এই ক্রিকেটার নাকি ভারতীয় টিকা না লাগিয়ে লন্ডনে খেলতে গিয়ে সেন্ট থমাস হসপিটালে ব্রিটিশ টিকা লাগিয়েছেন।

পশ্চিমি দুনিয়ায় বহু জাগতিক সংস্থা গুলো টিকার উদ্ভাবনে অনেক অর্থ বিনিয়োগ কোরেছে। ওদের দেশে টিকার উৎপাদন কম। দুনিয়ায় ব্যবহৃত সমস্ত টিকার ৬০ শতাংশ ভারতেই তৈরি হয়। ওরা টিকা শস্তায় ভারতে বানিয়ে সারা পৃথিবীতে বিক্রি করে চড়া দামে। এটাই ব্যবসা। লাভ না হোলে বিনিয়োগ কোরবেই বা কেন। ভারতের এক শীর্ষস্থানীয় সাম্যবাদী নেতা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দিলেন। বিষয় ছিল টিকার ব্যবসায় অতি মুনাফা। শোনা গেল যে আমেরিকাতেই তিনি আমেরিকার তৈরি টিকা লাগিয়েছেন। কে জানে?

এবার আমার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বোলে শেষ কোরবো। মাস দুয়েক আগে কোলকাতার এক অভিজাত ক্লাবে গিয়েছিলাম ডিনার ইনভিটিশনে। সপরিবারে বৌ, ছেলে আর আমি। পুরোনো ব্রিটিশ আমলের ক্লাব । নিয়ম মাফিক ভ্যাকসিনেশন কার্ড চাইলো। নিয়ে যাই নি তাই আধার কার্ড দেখালাম। ভ্যাকসিনেশন ডাটাবেস আধার লিংকড। আধার নম্বর দেখে যা বোললো তাতে আমি বেশ হতাশ। হোস্ট জানাতে ভুলে গেছে যে পশ্চিমি ব্রান্ডের টিকা না লাগালে ননমেম্বারদের ক্লাবে ঢোকার নিয়ম নেই। বৌ আর ছেলে দিব্বি ঢুকে গেল। ছেলে আমেরিকান কোম্পানিতে। ওরা আমাদের তিনজনেরই টিকা স্পনসর কোরেছিলো। তার আগেই ষাট পেরোনো সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে সরকারি ব্যবস্থায় অগ্ৰাধিকার পেয়ে টিকা লাগিয়েছিলাম তাতেই এই বিপত্তি।

একা কি আর করি , স্কুলের বন্ধু সুমিতকে ফোন কোরে ওর ফ্ল্যাটে যখন পৌঁছলাম , তখন সন্ধ্যে সাড়ে আটটা বেজে গেছে । ও হুইস্কি নিয়ে বোসেছে। আসা সার্থক হোয়েছে দেখে খুশি খুশি ভাবটা ফিরে এলো। একটা পেগ নিয়ে আজ আমায় ক্লাবে ঢুকতে না দেবার ঘটনাটা বিস্তারিত বোললাম। আমার শহর দিল্লিতে এই ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্য যে কেউ ভাবতেই পারে না সেটাও বোললাম বেশ জোর গলায়। সুমিত খুব একটা পাত্তা দিল না। আমার এই অভিজ্ঞতা যে কোলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই একটা অঙ্গ সেটাই বোঝাতে চাইলো।

কোলকাতার সমালোচনা আর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি শাসনের সম্ভাবনা কেন জানি না বরাবরই সুমিতের রক্তচাপ বেশ বাড়িয়ে দেয়। তাই ঐ দুটো প্রসঙ্গ বাদ দিয়েই জমিয়ে আড্ডা দিলাম। আর যাই হোক যে বন্ধুর আতিথেয়তা হুইস্কি সহযোগে, তাকে নারাজ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয়।

লেখক : প্রসূন দত্ত
সি ৬০৩. ইউনেস্কো এ্যাপার্টমেন্ট , ইন্দ্রপ্রস্থ এক্সটেন্সন , দিল্লি ১১০০৯২

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleছুটি (পর্ব ১)
Next articleভক্তির লক্ষণ (স্বামীজীর ভক্তিযোগ অবলম্বনে পুঁথি)
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments