“আকাশী”

‌সত‍্যি কি শেষ বলে কিছু আছে ? নাকি রাজীব নতুন ভাবে বাঁচতে পারছে না বলে শেষ হয়ে যাচ্ছে ! যদি সত‍্যিই ভালোবাসার শেষ বলে কিছু থাকে তাহলে আজ সেই ভালোবাসা সব শেষ হয়েগেছে । তবে এই শেষের পিছনের ইতিহাসটা কিছু একটা ঘটনা দিয়েই শুরু হয়েছিল । আজ যখন হসপিটালের বেডে শুয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগের অপেক্ষা করছে , তখন রাজীবের জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু স্মৃতির কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়ছে তার । হ‍্যাঁ রাজীব এ গল্পের নায়ক । আর সব গল্পের মতো এ গল্পেও একটি নায়িকা আছে তবে তার কথায় পরে আসছি ।

‌রাজীব তখন সবে মাত্র এইচ এস পরীক্ষা শেষ করেছে , বাড়ীতে অনেক কাকুতি-মিনতি করেই সে তার প্রথম মোবাইল ফোন পেয়েছিল । তবে সেই মোবাইল এখনকার মতো কোনো স্মার্ট ফোন নয় , খুবই সামান‍্য কি-প‍্যাড ওয়ালা মোবাইল । সে যাই হোক হাতে নতুন মোবাইল পেয়েছে সে ওটা দিয়েই তার সারাদিন কেটে যেত ।

‌এই সুযোগে সে ইন্টারনেটর ব‍্যবহার ও শিখে গেলো এবং রাজীব একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ও খুলে ফেললো । এরপর থেকে সারাদিন শুধু ফেসবুক আর ফেসবুক ; শুরুর দিকে তার কোনো ফ্রেন্ড ছিল না , তাই সে বিভিন্ন চেনা অচেনা মানুষকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতে থাকতো । অব‍্যশি বলে রাখা ভালো ছোট বেলা থেকেই বিদেশীদের প্রতি তার একটা টান ছিল । এর কারণ অবশ‍্য একটু অন‍্যরকমই ছিল ।

‌ছোট বেলায় সে সানডে স্কুল নামে একটি স্কুলের একজন ছাত্র ছিল । তবে এই স্কুলটা একটু অন‍্য রকমের স্কুল ছিল , এখানে কোনো পড়াশোনা কিংবা কোনো পরীক্ষা হত না । এখানে বিভিন্ন রকমের ক্রিয়েটিভ কাজ কর্ম হত । যেমন কেউ যদি ছবি আঁকতে পচ্ছন্দ করতো তবে তাকে সেটাই শেখানো হত , কিংবা নাচ,গান , নাটক , আবৃত্তি ইত্যাদি ইত্যাদি । এবং এই স্কুলটা কেবলমাত্র রবিবার করেই হতো , আর যার থেকেই নাম হয়েছিল সানডে স্কুল । রাজীব অবশ‍্য সব কিছুতেই যোগ দিত , যদিও কোনোটাই ভালো পারতো না সে , তাও সে সবই করার চেষ্টা করত । আর বলাবাহুল‍্য যে প্রতিমাসের শেষ রবিবার করে দু-তিন জন বিদেশীরা আসতেন যারা এই স্কুলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন , এবং ওনারা যখন আসতেন তখন রাজীব ও অন‍্যান‍্য বাচ্চাদের জন‍্য বিভিন্ন খেলনা ,বই , নামি দামি বিভিন্ন ট্রফি চকোলেট আনতেন ।

‌আর তাদের বলত তারা যদি ভালো করে সানডে স্কুল করে , তহলে তাদেরকেও ওনাদের সাথে বিদেশে নিয়ে যাবে । সেই তখন থেকেই রাজীবের মনের মধ‍্যে বিদেশী ও বিদেশ যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে জন্মাতে থাকে দিনের পর দিন । তাই আজ যখন ফেসবুক ব‍্যবহার করছে তখন দেশীর থেকে বিদেশীদেরই সে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠাতো । বেশ কিছু বিদেশী ফ্রেন্ডও হয়েছিল , তাদের মধ‍্যে দু-এক জনের সঙ্গে কথাও হতো রাজীবের ।

‌একদিন একটি মেয়েকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায় রাজীব । নাম ছিল আকাশী ( এ গল্পের নায়িকা ) । যদিও সে রাজীবের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট অনেকদিন পর একসেপ্ট করেছিল । আকাশী থাকতো বাংলাদেশের পাহাড়টলী নামে কোনো একটি শহরে ।

‌শুরুর দিকে খুবই সাধারণ কথবো-কথন হতো । এই যেমন হায় , হ‍্যালো , গুড মর্নিং ,গুডনাইট এইসব । বলতে গেলে তাদের মধ‍্যে প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো । আর যেহেতু আকাশী বাংলাদেশে থাকতো তাই তাদের মধ‍্যে বাংলাতেই কথা হতো । প্রায় এক বছর ধরে এইভিবেই তাদের মধ‍্যে কথাবার্তা চলতে লাগলো । আর এই এক বছরের মধ‍্যে দুজনের ভালো লাগা খারাপ লাগা , নিত‍্য দিনের অভ‍্যাস প্রায় সবই জানা হয়ে গেছে , অজানা বলতে গেলে আর কিছুই রইলো না ।

‌মাঝে মধ‍্যে ফোনেও কথা হতো তাদের ,তবে এক্ষেত্রে সব সময় আকাশীই ফোন করতো । দিন যত যায় তাদের মধ‍্যে সম্পর্ক আরো যেন গভীর হতে থাকে । দুজন দুজনকে পচ্ছন্দও করতে শুরু করে । রাজীবের আজও মনে আছে সেই দিনের কথা যেদিন সে আকাশীকে প্রেম নিবেদন করেছিল । দিনটা ছিল ১৩ই ফেব্রুয়ারি , রাজীব অপেক্ষা করতে লাগলো যে কখন রাত ১২টা বাজবে ; মানে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভ‍্যালেন্টাইন্স ডে ।

‌অবশেষে রাত ১২টা বাজলে রাজীব আকাশীকে তার মনের কথা জানালো । কতগুলো ম‍্যাসেজ করেছিল রাজীব সেটা তার ঠিক মনে নেই । সে যাই হোক ম‍্যাসেজ তো করে দিল এরার হলো অপেক্ষার পালা । সে সারারাত ধরে অপেক্ষা করতে লাগলো । কখন আকাশী ম‍্যাসেজগুলো দেখবে ! কখন আকাশী তাকে উওর দেবে ! ও কি রাজীবের মনের কথাগুলো বুঝবে ! যদি তাকে না বলে দেয় ! তাহলে সে কি করব ! আর যদি হ‍্যাঁ বলে তাহলে আকাশীর সাথে সে কী করে দেখা করবে !

‌ এই সমস্ত চিন্তা করতে করতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতে পারেনি রাজীব । পরের দিন একটু বেলা করেই ঘুম ভাঙলো । ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই মোবাইলটা নিয়ে ম‍্যাসেজ চেক করতে লাগলো সে । কিন্তু না আকাশী তো কোনো রিপ্লাই করেনি ! ভাবলো হয়ত আকাশী কোনো কাজে ব‍্যস্ত আছে তাই তার ম‍্যাসেজের রিপ্লাই করতে পারছে না । রাজীব চাতক পাখির মতো সারাদিন অপেক্ষা করতে থাকলো । ক্রমেই বেলা গড়িয়ে দুপুর , দুপুর গড়িয়ে রাত , কিন্ত না এখনো আকাশীর কোনো ম‍্যাসেজ নেই ।

‌শেষে আর থাকতে না পেরে রাজীব আকাশীকে ফোন করলো , কিন্ত ফোনও সুইচ অফ বলছে । রাজীব ভাবলো আকাশী হয়ত তার উপর রাগ করেছে , রাজীবের হয়ত এই কাজ করা উচিত হয় নি । মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল রাজীবের । রাজীব মনে মনে প্রশ্ন করতে লাগলো ‘আমায় যদি তার পচ্ছন্দ না হয় তাহলে তো পরিষ্কার বলে দিতেই পারে , কিন্ত এভাবে আমার সাথে কথা না বলার তো কিছু নেই ।

‌এইভাবে একদিন , দুদিন কেটে গেলো । ঠিক তিনদিন পর রাজীব আকাশীর ফোন পায় ; প্রথমেই রাজীব কেমন আছে সেটা জিজ্ঞাসা করলো আকাশী । প্রশ্নটা শুনে রাজীব একটু অবাকই হলো । রাজীব একটু অভিমানের সঙ্গেই আকাশীকে বললো “আমার ম‍্যাসেজগুলো পাওনি ? তোমার ফোন কোথায় আমি কতবার তোমায় ফোন করেছি ? আর তুমি এতদিন কোথায়ইবা লুকিয়ে ছিলে ? আকাশী বললো সে দুদিনের জন‍্য নেপালে গিয়েছিল ওর দুই কাজিনের সঙ্গে ।

‌ তারপর আর কিছু বললো না । বুঝলো আকাশী বিষয়টা একপ্রকার গুরুত্বই দিচ্ছে না , তারপর বাধ‍্য হয়েই রাজীব আকাশীকে জিজ্ঞাসা করলো ‘তাহলে আমার প্রস্তাবে তুমি কী রাজি আছো ! তুমি কী আমায় ভালোবাসো !’ জবাবে আকাশী বললো “আমি তোমাকে পচ্ছন্দ করি , তোমাকে হয়ত ভালোও বাসি , কিন্ত এই ভালোবিসার কোনো ভবিষ‍্যৎ নেই ।

‌আমি হয়ত ভালোবাসি বললাম তার কারণ আমরা কেবল ফোনের মধ‍্যমেই একে অপরকে চিনি , কিন্ত এর বাইরেও আর একটা জগৎ আছে , সেখানে তুমি আমায় পচ্ছন্দ নাও করতে পারো ; ” তখন রাজীব আকাশীর ওইসব কথাগুলোর মানে বুঝতে পারেনি । রাজীব আকাশীকে জিজ্ঞাসা করলো “তুমি হঠাৎ নেপালে কি করতে গিয়েছিলে ?” প্রশ্ন শুনে আকাশী কান্নাভরা গলায় বললো “রাজীব তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো, তুমি আমাকে যেমনভাবে রাখবে খমি তেমন ভাবেই থাকবো । ”

‌রাজীব আকাশীর কথাগুলো শুনে কিছুটা ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল । বুঝলো আকাশীর নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে । রাজীব আকাশীকে জিজ্ঞাসা করলো “কী হয়েছে ? তুমি এমন কেন ক‍রছো ? ” তারপর আকাশী রাজীবকে যা বললো তা শোনার পর রাজীব সত‍্যই কি ক‍রবে কিছুই বুঝতে পারলো না । আকাশী রাজীবকে যা বললো তা হলো এই ,

‌’কিছুদিন যাবত ওর বাবার ব‍্যবসাটা ভালো যাচ্ছিল না , এবং বাজার থেকে ওর বাবা অনেক ধার দেনাও করেছিল । প্রতিদিনই ওদের বাড়িতে পাওনাদারেরা এসে অনেক অপমান জনক কথা বলে যেতো এমন কি তার বাবাকে প্রাণে মারার হুমকিও দিয়ে যেত । এরকম অবস্থায় ওর বাবার এক বন্ধু তাদের সাহায‍্য করে । এরপর থেকে ওর বাবার বন্ধুটা প্রায়-সই তাদের বাড়ি আসতো ।

‌আকাশীর কাছ থেকে যা জেনেছিল রাজীব , তা হলো লোকটা বেশ ধনী লোক , বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে । রিয়েল এস্টেটের ব‍্যবসা করে । আত্মীয় স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই । লোকটা বিবাহীত ছিল কিন্ত অনেক বছর আগেই ওনার স্ত্রী কোন একটা অসুখের কারণে গত হয়েছেন । লোকটা যখনই তাদের বাড়ি আসত তখনই সবার জন‍্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতো । আকাশীর জন‍্যও অনেক দামী দামী উপহার আনতো । কিছুদিন আগে যখন লোকটা আবারও তাদের বাড়ি আসে , তখন তিনি আকাশীর বাবাকে একটি অনুরোধ করে ।

‌তারা যেন স-প‍রিবার মিলে ওনার নেপালের বাংলো বাড়ি থেকে কিছুদিনের জন‍্য ঘুরে আসুক । উনি নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন বললেন । বাবা ওনার প্রস্তাব শুনে বললেন ‘আমি তো যেতে পারবো না , বুঝতেই পারছো নতুন করে ব‍্যবসাটা আবার শুরু করেছি , তাই এখন তো তার পক্ষে যাওয়াটা সম্ভব নয় , আকাশী আর আকাশীর মা যদি যেতে চায় তাহলে ওদের তুমি নিয়ে যেতে পারো । কিন্ত আকাশীর মা আকাশীর বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাইলো না । বললো ‘আমি চলে গেলে তোমার দেখা শোনা কে করবে !’ অবশেষে আকাশী আর ওর দুই কাজিন যেতে রাজি হলো । আকাশী সেই সময় ওখানেই উপস্থিত ছিল ।

‌সে যে বাবার মুখের উপর না বলবে সেটা সম্ভব ছিল না । আর যে লোকটা তার বাবা ও তাদের পরিবারকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে , দুঃসময়ে তাদের পাসে এসে দাঁড়িয়েছিল , সেই লোকটার এই প্রস্তাবকে সে কি করে না বলতে পারে ! যাইহোক ওরা ঠিক তার পরদিন সকালের ফ্লাইটে করে নেপালে পৌঁছে গেলো । সেখান থেকে তারা সোজা ওনার বাংলোতে উঠলো ।

‌আর সেখানেই আকাশীর সাথে এমন কিছু ঘটলো যা সে স্বপ্নেও কখনো কল্পনা করেনি । কথায় বলে একটি নাড়ী তার সম্রম রক্ষা করার জন‍্য সে সবসময়ই চেষ্টা করে , এবং যখন সে সেটা করতে ব‍্যর্থ হয় তখন সে নিজের চোখেই অপরাধী হয়ে যায় । আকাশীর ক্ষেত্রেও কিছুটা এমনটাই ঘটে ছিল । আসলে ওর বাবার বন্ধু ভালো মানুষের মুখোশ পড়া একটি পৈশাচিক পশু ছিল । আসলে তার উদ্দেশ‍্য ছিল আকাশীকে আপন করে নেওয়া । রাজীবের আজও মনে আছে আকাশী সেদিন খুব কেঁদেছিল । আকাশী ওনাকে অনেক কাকুতি মিনতি করে যে তার এত বড় সর্বনাশটা উনি যেন না করেন , আকাশী আরো বলেছিল যে সে রাজীব নামে একটি ছেলেকে ভালোবাসে তার সত্ত্বেও উনি আকাশীর কোনো কথা শোনেনি । এবং লোকটা আকাশীকে ভয়ও দেখিয়েছিল যে যদি সে তার কথা না শোনে তাহলে সে তাকে ও তার পরিবারের অনেক ক্ষতি করবে ।

‌ পাছে তার পরিবারের কোনো ক্ষতি হয় এই কথা চিন্তা করেই সে মুখ বুজে সব কিছু মেনে নিয়েছিল । এইসব কিছু শোনার পর যেন রাজীবের মাথা সহ পুরো পৃথিবীটা ঘুরতে লাগলো , মনে হচ্ছে কে যেন পায়ের নীচ থেকে মাটিটা সরে নিয়েছে । শুধু ফোনের ওপার থেকে আকাশীর গুঙ্গিয়ে গুঙ্গিয়ে কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে । আর শুধুই বলতে লাগলো “রাজীব আমাকে তুমি এখান থেকে নিয়ে চল, এখান থেকে নিয়ে চল ।” ভাগ‍্যের কি পরিহাস যে ছেলেটা জীবনে কখনো প্রেম ভালোবাসার চক্করে পরে নি , কোনো মেয়ের দিকে কখনো কু-দৃষ্টিতে তাকায় নি , এমনকি কোনো মেয়ের সাথে কথা পর্যন্ত বলেনি তার জীবনে ভালোবাসা এসে এমন ভাবে ধরা দেবে এবং তার পরিনাম এমন হবে সে কোনোদিন ভাবেনি ।

‌নিজেকে খুবই অসহায় মনে হচ্ছিল রাজীবের , আসলে সেও তো এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি । তার তো এখনো পড়াশোনাই শেষ হয়নি । সে এই অবস্থায় একজনের দায়িত্ব ভার কিভাবে নেবে ! রাজীব আকাশীকে তার এই কঠিন সত‍্যতার কথাগুলো জানালো , আকাশীকে অনেক বোঝায় এবং তাকে বলেছিল “তুমি আমাকে যদি পাঁচ বছর সময় দাও , তাহলে সে এই পাঁচ বছরের মধ‍্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারবে । তখন আর কোনো সমস‍্যা থাকবে না । ” কিন্ত আকাশী হয়ত রাজীবের কাছ থেকে সহানুভূতিশীল কথা ছাড়াও আরো বেশী কিছু আশা করেছিল যা সে তাকে দিতে পারেনি । তারপর কিছুক্ষণের জন‍্য সব নিশ্চুপ । যেমন ঝড়ের পর সবকিছু থেমে যায় ঠিক তেমনই শান্ত সবকিছু , ফোনের ওপার থেকেও আকাশীর আর কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না ।

‌রাজীব : “হ‍্যালো ..! হ‍্যালো আকাশী …! হ‍্যালো শুনতে পাচ্ছো ..! ” কোনো উওর নেই , আকাশী ফোনটা কেটে দিল । তারপর থেকে রাজীব যে কতবার আকাশীকে ফোন করেছিল তার আর বলার অপেক্ষা রাখে না । শুধু সেই দিন নয় তারপ‍র থেকে টানা একমাস ধরে রাজীব হাজার বার ফোন , ম‍্যাসেজ করেছিল , কিন্ত না ওপার থেকে কোনো উওরই পাইনি সে । যতবারই সে ভেবেছে এই বুঝি আকাশী তার ফোন ধরবে ততবারই সে নিরাশ হয়েছে । এক নিমিষে যেন সব কিছু শেষ । তার ভালোবাসার মানুষটিকে কেউ যেন পাতালপুড়িতে লুকিয়ে রেখেছে , সেখান থেকে সে খর কখনোই ফেরত আনতে পারবে না তার আকাশীকে ।

‌এই ঘটনার ঠিক দেড় বছর পর একদিন সকালে রাজীবের ফোনে একটা ম‍্যাসেজ আসে । রাজীব : “আকাশী ..! আকাশীর ম‍্যাসেজ ..! এতদিনে তাহলে আকাশীর অভিমান গলে জল হয়েছে .; রাজীব খুবই উত্তেজিত হয়ে পরে , তার মনে এত দিনে যা যা প্রশ্ন জমাট বেঁধেছিল সে যেন সবকিছু একসাথে বের করে দিতে চাইলো । আকাশী একটা প্রশ্ন করলে তার পরিপেক্ষিতে রাজীব দশটা প্রশ্ন করে । অবশেষে অভিমানের পালা শেষ হলে পরে আকাশী বলতে শুরু করে , যে সে এতদিন কোথায় ছিল ; কি করছিল ।

‌আকাশী রাজীবকে বললো ” তোমার সাথে আমার যেদিন শেষ কথা হয়েছিল , সেদিন আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি । অবশেষে কিছু না ভেবেই আত্মহত‍্যা করবো বলে স্থির করি । কিন্ত পরমূহুর্তেই বাবা মার কথা ভেবে পিছিয়ে আসি । আমি ছাড়া যে বাবা মা-র এর কেউ নেই ; তারপর নিজেকে শক্ত করে মনে একটু সাহস নিয়ে আমি বাবাকে সবকিছু বলে দি । বাবা সবকিছু শোনার পর ভীষণই রেগে গিয়েছিল , এবং ফোন করে বাবা তার বন্ধুকে অনেক উল্টো পাল্টা কথা শোনায় এবং সাতদিনের মধ‍্যে তার দেওয়া সব টাকা ফেরত দিয়ে দেবে জানালো । কিন্ত আমি জানতাম বাবার পক্ষে এতগুলো টাকা সাতদিনের মধ্যে ফেরত দেওয়া কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না । অবশেষে বাবা আমাদের ভিটেমাটি ব্রিক্রি করে দেয় । এবং তার বন্ধুর দেওয়া সমস্ত টাকা শোধ করে দেয় ।

‌তারপর আমরা একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম । এদিকে আমিও আর কলেজের পড়া শেষ করতে পারলাম না । অন্যদিকে বাবাও নিজের সব ব‍্যবসা বন্ধ করেদিয়ে বাড়ি বসে গেলো । এবং বাড়ি ঘর ব্রিক্রি করে আর ধার দেনা যা ছিল সব শোধ করে যেটুকু যা টাকা বেঁচে ছিল তা দিয়েই কোনোরকম ভাবে সংসার চলতে থাকলো । এরপর আমি একটা হোটেলের রিসেপশনিস্ট এর কাজ করতে শুরু করি । মাসে ছয় হাজার টাকা মাইনে পেতাম । আর আমি মাঝে মধ‍্যে যারা হোটেলে থাকার জন‍্য আসতো তাদের রুম দেখিয়ে দিতাম যার ফলে কিছু এক্সট্রা উপার্জনও হতো ।

‌এইভাবে মোটামুটি আমাদের দিন কাটে যাচ্ছিল । এরপর আমরা যে বাড়িটাতে ভাড়া থাকতাম সেই বাড়িওয়ালার বড় ছেলের আমাকে পচ্ছন্দ হয়ে যায় , এবং আমার বাবা মার কাছে এসে আমায় বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় । ছেলেটা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ছিল তাই আমার বাবা মা এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায় । কিন্ত এত সুখ আমার ভাগ‍্যে সহ‍্য হলো না , তাই তো একদিন যখন ছেলেটির সাথে ঘুরতে যাই তখন সে আমায় ঘোরার নাম করে একটি গেস্ট হাউসে নিয়ে যায় এবং আমার দুর্বলতার আবাও কেউ সুযোগ নেয় । এরপর যখন ছেলেটা কোনো কারণে বুঝতে পারে যে এঘটনা আমার সাথে আগেও ঘটেছে , এবং আমাকে প্রশ্ন করাতে আমি সব কিছু তাকে জানাই । তারপর সে আমায় বিয়ে করতে অস্বীকার করে । আসলে এই পুরুষ-তান্ত্রিক সমাজে আমাদের মতো মেয়েদের সবাই আগে শরীরটাকেই চায় ওটাকেই সবাই ভালোবাসে । কিন্ত এই শরীরের মধ্যে যে একটা মনও আছে সেটাকে কেউ দেখে না । ”

‌কথাগুলো শোনার পর রাজীবের জমানো যত রাগ অভিমান যেন এক নিমিষে ধুয়ে গেলো । রাজীব আকাশীকে জিজ্ঞাসা করলো “তাহলে এখন, এখন তুমি কি করছো ! তুমি কি এখনো আমায় ভালোবাসো ! ” আকাশী বললো ” হ‍্যাঁ , আমি এখনো তোমায় ভালোবাসি , আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালোবেসে যাবো ” রাজীব একপ্রকার উৎসাহের সাথেই জিজ্ঞাসা করলো “তাহলে এখন কি তুমি আমার কাছে আসতে পারো না !” জবাবে আকাশী একটু হাঁসলো , তারপর বললো ” তোমায় আমি মিথ‍্যে আশা দেবে না , হ‍্যাঁ আমি চাইলেই তোমার কাছে খুব সহজেই আসতে পারি , কিন্ত আমি এখন যে পথ বেছে নিয়েছি সেখানে এই নংরা শরীর নিয়ে আমি তোমার সামনে দাঁড়াতে পারবো না ।

‌আমি চাই না আমার জন‍্য তোমার জীবনটা খারাপ হোক , আমার সঙ্গে তোমার জীবনটা দয়াকরে জড়াও না ।” রাজীব অনেক রকম ভাবে আকাশীকে বোঝানোর চেষ্টা করল কিন্ত আকাশী তার কোনো কথাই শুনলো না । আকাশী আর সেই আগের আকাশী নেই , এখন সে অন‍্য জগতে বিচরণ করে । এখন সে অনেক সাবলম্বী , এখন সে আর ভয়ে ভয়ে থাকে না । এখন সে অনেক বড় হয়েগেছে , তার শরীর মন যেন কঠিন পাথরে পরিনত হয়েছে । এটাই আকাশীর সাথে রাজীবের শেষ কথা ছিল ।

‌তবে যেতে যেতে আকাশী রাজীবকে একটা কথা বলে গিয়েছিল , ” যে টাকা তোমাকে আমার থেকে আলাদা করেছে সেই টাকাকে আমি একদিন আমার পায়ের তলায় আনবোই এবং তার জন‍্য আমায় যত নংরা কাজই করতে হোক না কেন আমি করবো । আর পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও এবং আমায় ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো । ” এর পর রাজীবের সাথে আকাশীর আর কোনোদিন যোগাযোগ হয়নি । সত‍্যই ভাগ‍্য যে কখন কাকে কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন করাবে তা কেউ জানে না । আমাদের দেশে এইরকম কত যে আকাশী আছে তা কে জানে ? যারা কেবলমাত্র অভাব, দ্রারিদ্রতার কারণে এইরকম পথ বেছে নিচ্ছে রোজ ।

‌আজ রাজীবের দেওয়া সেই পাঁচ বছরের সময় পূর্ণ‍্য হয়ে আরো চল্লিশটা বছর পেরিয়ে গেছে , এই চল্লিশ বছরে সে অনেক টাকা পয়সাও করেছিল । রাজীব সারা জীবন একাই থেকে গেলো , হয়তো সে অন‍্য কাউকে ভালোবাসতে পারবে না বলেই একা জীবন কাটালো । আজ তার কাছে সবই আছে শুধু নেই বলতে সময় । জীবনের শেষ সময়ে এসেও তাই সে তার আকাশীকে ভুলতে পারছে না । তার মনে আজও বিশ্বাস এই বুঝি ফোনের ওপার থেকে কেউ বলবে “রাজীব তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো ।। ”

‌ ।।।ধন্যবাদ।।।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articlePhilosophy of Me
Next articleখেয়ালি
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments