অনেক অনেক বছর আগের কথা। সাভানায় জিরাফদের তখন বড্ড মন খারাপ । উটপাখির দলের এক ব্যস্ত সদস্য, যার নাম টিটাং, সে মাথা উঁচু করে চলতে চলতে লক্ষ্য করে জিরাফরা কেমন যেন সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। প্রথমে সে তার পরিচিত অন্য উটপাখিদের এই কথা জানায় এবং তারপর এক সকালে দুজন বন্ধু কে সাথে নিয়ে দূরের এক জোড়া জিরাফের দিকে লক্ষ্য করে চলতে শুরু করে। সেই দুজন জিরাফ, নাম তাদের কেফ্রা আর কিংফ্রা, তাদের লম্বা গলার উপর থাকা মাথা গুলিকে একদিকের থেকে অন্য দিকে আলতো ভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুব শান্ত ভাবে বাবলা গাছের এক্কেবারে মগডালের পাতাগুলো মুখ দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে আর চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। কোন কথাবার্তাই বলছে না। দুজনাই এক্কেবারে চুপচাপ।
তখন সকাল বেলা। টিটাং আর তার দুই বন্ধু উটপাখি, যাদের নাম উখটি আর উংগটি, তারা খুব মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পা নাচিয়ে নাচিয়ে চলেছে দূরের দুই জিরাফ, কেফ্রা আর কিংফ্রার কাছে। সেই তিন জনকে একসাথে দেখতে পেয়ে মস্ত বড় সসেজ গাছের উপরে বসে থাকা বাঁদরের দল তাদেরকে খুব ডাকা-ডাকি করে। বাঁদরদের সর্দার, ভক্কা, তাদেরকে দেখে হুফ হুফ করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে, “একসাথে তিন জনা তোমরা কোথায় চলেছ?” প্রথমটা টিটাং তা ভাল করে বুঝতেই পারেনি। তখন উংগটি মাথা তুলে দুই পা নামিয়ে উঠিয়ে তার বন্ধু টিটাংকে জানায় যে গাছের উপর থেকে ভক্কা তাদেরকে কিছু বলছে। টিটাং তখন ভক্কাকে জিজ্ঞাসা করে, “তোমরা কি জান জিরাফরা সবাই কেন এত মন খারাপ করে থাকে?” ভক্কা বলে, “দাঁড়াও দাঁড়াও আমাদের সব সাথিদের জিজ্ঞাসা করি তারপর তোমাদের বলছি।” সসেজ গাছের কাছেই তিন উটপাখি তখন ধীরে ধীরে স্কিপিং করার মত করে, উপর-নিচে পা নাচাতে থাকে, কারণ ভক্কা আগে তার সাথিদের সাথে কথা বলে তারপর তো তাদেরকে জানাবে বলেছে। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। ওদিকে বিশাল বড় সসেজ গাছের অনেক ডালপালা, বিভিন্ন দিকে, সেই সব ডালগুলোতে বসে ছিল বাঁদরদের পুরো দল । ভক্কা সবার সাথে এই কথা আলোচনা করে । তারপর শেষমেশ যা বোঝা গেল তা মোটামুটি এই রকম, ছোট বাচ্চা বাঁদরদের মাথায় তো কিছুই ঢুকে নাই, মাঝ বয়েসি যারা তারা নিজেরা একে অপরের সংগে বিভিন্ন কথাবার্তায় এতো মশগুল যে, লম্বা লম্বা পা আবার তার উপর বিশাল লম্বা গলার উপর থাকা জিরাফদের মাথার মধ্যে কি চলছে তার খবর তাদের মোটেও জানা নেই, আর বাকি যারা বুড়ো, তারা ছোট-দের কে ‘এটা কর না’ ‘ও দিকে যেতে নেই’ ‘ওখানে সাবধানে যেও’ এই সবের মধ্যেই সব সময় মাথা এত ঘামায় যে তারাও এই বিষয়ে কিছু বলতে পারলো না।
টিটাং এর ছোট্ট মাথা তখন চটাং করে গরম হয়ে গেল, “তোমরা সবাই যদি কিছুই জান না তাহলে আমাদের সময়টা শুধু শুধু নষ্ট করলে কেন?” বড় বড় গোল চোখ বের করে তাদের দিকে কটমট করে তাকিয়ে খুব রেগে গটমট করে চলতে থাকে আবার।
এক-দল জেব্রা তাদেরকে ওই ভাবে যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করে, “কোথায় চললে তোমরা, কোন জরুরি কাজ আছে বুঝি?” টিটাং এর মাথা তো গরম হয়েই ছিল, সে বিরক্ত হয়ে বলে উঠে, “তোমরা একে অন্যের সাদা কালো দাগ গুলোকে গোনা ছাড়া আর কিছুতে লক্ষ্য কর কি?” উখটি মাথা তুলে একটু শান্ত ভাবে জেব্রাদের বলল, “আমার বন্ধু টিটাং কে ওই মস্ত-বড় সসেজ গাছের উপর বসে থাকা বাঁদরের দল চটিয়ে দিয়েছে তাই সে বেশ রেগে আছে, আসলে আমরা চলেছি ওই যে দূরের দুই জিরাফ, কেফ্রা আর কিংফ্রার কাছে।” জেব্রাদের একজন ছটফটে কিশোর চটপট বলে উঠে, “কেন জিরাফদের কি কোন বিশেষ কিছু হয়েছে না কি?” এই কথা শোনা মাত্রই টিটাং মাথা ঘুরিয়ে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “কেন তোমরা দেখনি ওরা সব সময় কেমন মন খারাপ করে আছে” জেব্রাদের সেই ছটফটে কিশোর, যার নাম মিংগমিংগ, সে বলে উঠে, “ওরা তো বরাবরই খুব চুপচাপ, তাই আমরা, তেমন বিশেষ কিছু লক্ষ্য করিনি।” টিটাং আবার গটগট করে চলতে চলতে গজগজ করে উঠে, “যাও যাও তোমরা অন্যের চোখে ধুলো দাও, আর হিজিবিজি সাদাকালো দাগের দুনিয়াতেই থাক, এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।”
এমন সময় হায়েনার এক দল বিচ্ছিরি রকম খনা গলায় উৎকট হাসির শব্দ আর খ্যাঁক খ্যাঁক করতে থাকে। সেই দলের এক বদমাশ ছোকরা যার নাম কিম্ভুক সে বলে উঠে, “ওই, ওই যে, টিটাং পটাং, চিৎপটাং, কোথায় যাচ্ছিস, চটাং পটাং?” টিটাং এর মাথা তো একেই গরম, সে চোখ পাকিয়ে চোঁচের তীক্ষ্ণ ধার দেখিয়ে বলে উঠে, “বেশি কাছে আসিস না, তোদের ওই ঘোলাটে মার্কা চোখ গুলো এক এক করে উপড়ে ফেলবো, তখন বুঝবি, আমার সঙ্গে মশকরা করার ফল” উখটি আর উংগটিও মাউন্টেন পুলিশের মতো পা তুলে তুলে তাদের দিকে তাড়া করে। অমনি সেই বিচ্ছিরি হায়েনার দল উটপাখির লাথির ভয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করতে করতে লেজ গুটিয়ে পালায়।
তিন জন উটপাখিরই তখন মাথা গরম । লম্বা লম্বা ঘাসের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ওরা এক বুড়ি উটপাখি যার নাম ঝিংটি তাকে ঘাসের ভিতরে বসে থাকতে দেখে। সেই জায়গাটাতে মাটির উপর ছিল একটি অন্য কোন উটপাখির বাসা, গোল করে পরিষ্কার করা আর ঠিক মাঝখানে কিছুটা গর্ত করা। যাদের বাসা, তারা এই বুড়ি উটপাখি, ঝিংটিকে বলে গেছিল সেটিকে দেখাশুনা করার জন্য। টিটাং তাকেও জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কি জান, জিরাফদের কেন এতো মন খারাপ?” ঝিংটি তখন একটু ভেবে চোখ খোলা বন্ধ করে নেয় কয়েক বার। আর তারপর বলে, “যদি তোমরা আয়ুষ্মান নামের কচ্ছপের দেখা পাও, সে তোমাদের ঠিক বলতে পারবে এর উত্তর, আয়ুষ্মান সব কিছুর ঠিক ঠিক খবর রাখে। সে খুব ধীর-স্থির আর বেশ বিচক্ষণ, কতই না পুরানো কথা সে মনে রাখতে পারে। তার কাছে তোমরা নিশ্চয়ই সঠিক উত্তর পাবে। কিন্তু ঠিক এই সময়, সে কোথায় আছে, কি ভাবে তাকে খুঁজবে, তা আমি জানিনা।”
এই সব কথাবার্তা যখন চলছে ঠিক তখনই পাশ দিয়ে এক বিশাল অজগর ধীরে ধীরে এঁকে বেঁকে যাচ্ছিলো। ছোট পাখিরা তখন ঝোপের উপর ওড়তে ওড়তে কিচির মিচির শব্দ করে উঠে। নিচে বসে থাকা ঝিংটি ঘাসের ভিতর দিয়ে তাকে ঠিক দেখতে পায়। ঝিংটি সেই অজগরকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কি জান আয়ুষ্মানকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে?” সেই অজগর, যার নাম বিকরাল, সে গস গস করে তার নিজের শুকনো চামড়ার উপর খসখস করে মাথা ঘসে ঘসে তাদের জানায়, “এই মাত্র তো আয়ুষ্মানকে এদিকেই আসতে দেখলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো, সে এখুনি এসে পড়বে। আমি যাই ঝিলের দিকে, অনেক দিন জলের নিচে কালো নরম কাদার ভেতরে আরাম করে বিশ্রাম নিই নি, আমি চললাম” এই বলে সে সর সর করে চলে যায়।
আরো পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেল। টিটাং অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে উঠে। ঝিংটি বলে, “একটু অপেক্ষা তো করতেই হবে, কারণ আয়ুষ্মান একটু বেশিই ধীর-স্থির। একটু সময় তো লাগবেই।” আরও পাঁচ পাঁচটা মিনিট পার হয়ে গেল। ঝিংটি ছাড়া বাকি তিন জন উটপাখিই তখন অধৈর্য হয়ে পড়ে। এরপর ‘সরর ঢুপ, সরর ঢুপ’ ঠিক এই রকম শব্দ এলো কানে। ঝিংটি বলে উঠে, “ওই দ্যাখো আয়ুষ্মান আসছে, একটু পরেই সে এসে পড়বে, তখন আমরা সব কথা তাকে বুঝিয়ে বলবো। ঠিক আছে? হড়বড় কর না যেন, শান্ত ভাবে বেশ বসিয়ে বসিয়ে তাকে সব জিজ্ঞাসা করবে, কেমন”। এই কথা কটি বলে, ঝিংটি তার মাথা এক্কেবারে মাটির কাছে এনে ঝুপ করে নামিয়ে নিয়ে পর, চুপচাপ বসে পড়ল, আর তারপর চোখ দুটিও ধীরে ধীরে বন্ধ কোরে ফেলে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে আয়ুষ্মান এসে পৌঁছায় আর টিটাং যখন তাকে সবকিছু জিজ্ঞাসা করে, সে তাকে ধীর-স্থির ভাবে জানায় যে বহু বছর আগে ১৮৫৯ সালে মহান বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের সময়ের থেকে এমন কি তার আগেও লামার্ক বলে আর এক বিজ্ঞানীর সময় থেকেই জিরাফ হয়ে উঠেছিল গবেষণার রোচক বিষয়, কিন্তু তারপর থেকে আর কখনও কোন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা জিরাফদের কে নিয়ে ভাবাই হয়নি, এটা তাদের একটা দুঃখ, আর তাছাড়াও জিরাফদের নিজেদেরকে বড্ড একা, সঙ্গিহীন মনে হয়। কেননা প্রায় সব বন্য প্রাণীরই কোন না কোন ঘনিষ্ঠ-জ্ঞাতি আছে, কিন্তু তাদের নেই। এর জন্যই এত মন খারাপ। টিটাং তখন বলে উঠে, “তাহলে এর উপায় ?”
আয়ুষ্মান উত্তরে বলে, “যদিও প্রায় সবাই মনে করে বিশাল লম্বা গলার জিরাফের মত এমন-ধারা প্রাণীর বোধ হয় আর কোন ঘনিষ্ঠ-জ্ঞাতি নেই এই সারা পৃথিবীতে, তবে তোমরা কি জান যে বর্ষা-বনে থাকে ‘ওকাপি’ নামের প্রাণী, তারাই হল জিরাফ-কুলের এক্কেবারে ঘনিষ্ঠ এক-মাত্র জ্ঞাতি। জিরাফরা একা, বা সঙ্গিহীন মোটেও নয়।”
টিটাং আর তার দুই বন্ধু উটপাখি, উখটি আর উংগটি, একথা শুনে খুব খুশি । তারা ঠিক করে তাড়াতাড়ি জিরাফদের সব কথা জানাতে, যাতে তারা, আর কক্ষনো মন খারাপ না করে।
তারা চায় তাদের সাভানায় কেওই যেন কখনো মন খারাপ না করে।