সমুদ্র,আমার সবচেয়ে প্রিয়।সবচেয়ে কাছের বলতে দীঘার সৈকত। তাও অনেক বছর পর এলাম,সমুদ্রের চঞ্চল জলরাশির মতো চঞ্চল ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে।আমার এক বন্ধুও এসেছে সাথে।প্রকৃতি পড়ন্ত বিকেলের সূর্যের আভা আকাশ জুড়ে রঙের খেলায় ব্যস্ত,তার নিচে উত্তাল সমুদ্রের নীল জলরাশি।মন উদাস করে দেয় আমার,ফেলে আশা দিনগুলি স্মৃতির পাতা থেকে উঠে আসে।সমুদ্রতীরে বসে আছি,ছোট বড় ঢেউ গুলি আছড়ে পড়ছে তটে। আমার বন্ধুটি বাচ্চাদের সাথে খেলায় ব্যস্ত।তাদের থেকে একটু দূরেই বসেছি আমি,একটু একা থাকার অভিলাষে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ, চোখে physics নিয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন।কয়েক মাস পরেই দেখা তার সাথে,তৃষা।প্রেমে পড়েছিলাম প্রথম দর্শনেই।আমার বিভাগের না হলেও বন্ধুত্ত্ব করেছিলাম,প্রেমের সম্পর্ক গভীর হতে সময় লাগেনি।বড়লোক বাড়ির মেয়ে,আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের।গানের গলা ছিল তার।রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার প্রিয়,আমায় শোনাত গেয়ে।দিনগুলো স্বপ্নের মতো কাটছিল,হয়ত স্বপ্ন হলেই ভালোহত।না।তাহলে আজ আমি এখানে থাকতে পারতামনা।
পড়া শেষ হওয়ার পর আমি আরো উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়ার জন্য পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি।আমায় একদিন তৃষা দেখা করে বলল তার বিয়ের জন্য তার বাবা উঠেপড়ে লেগেছেন,উপযুক্ত পাত্র পেলে এই বছরই বিয়ে দেবেন।আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।আমি তৃষাকে বোঝালাম ,আমায় একটু সময় দিতে,অবশ্যই কোনো কাজ ঠিক জোগাড় করে নেব।আস্বস্ত করতে পারিনি হয়ত তাকে।কয়েকদিন পর রাস্তায় হঠাৎ তৃষার সাথে দেখা,সঙ্গে তার একটি ছেলে।অপ্রস্তুতে পড়েগেছিল আমায় দেখে,চিনেও না চেনার অভিনয় করেছিলাম সেদিন।ওই ফোন করেছিল কিছুক্ষণ পরে।ঐ ছেলেটির সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে ওর,ব্যাঙ্কে চাকরি করে,নভেম্বরে বিয়ে,আরো কিছু বলছিল আমি শুনিনি,শুধু বলেছিলাম,”ভালোথেকো”,ফোন রেখে দিয়েছিলাম।কলকাতায় মেসে থাকতাম।খাইনি,ঘুমোইনি সেদিন।সন্ধে থেকে ঘরে ঢুকিনি,সব কিরকম ঝাপ্সা,ভিতরটা এক অজানা যন্ত্রনায় মুচড়ে উঠছিল,চোখের জল পড়েনি এক ফোঁটাও।রাত কত হিসেব রাখিনি, জীবনের সময় থমকে গিয়েছিল যেন।এগিয়ে গেলাম তীব্র গতিতে ছুটে আসা লরির দিকে,চোখ ধাঁধিয়ে গেল আলোয়,আর কিছু মনে নেই।
চোখ খুলল যখন প্রথমে বুঝতে পারিনি কোথায়।হাতে সেলাইনের নল আর চারপাশের পরিবেশ দেখে বুঝলাম নার্সিংহোমে আমি।আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল।বেঁচে আছি বলে রাগ হল।কে বাঁচাল?কেন বাঁচাল আমায়?এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম,অসহ্য লাগছিল নিজেকে,একটা কাজও ঠিকমতো হয়না।এমন সময় একজন ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন।ভদ্রমহিলা ছাড়াও মেয়েও বলা যায়,বয়স ২৫ এর বেশি হবেনা।আমি রাগে উত্তেজিত হয়ে বসতে যাচ্ছিলাম,মেয়েটি ধরে শুইয়ে দিল।”আপনি কি পাগল?এভাবে কেউ ..”,তাকে থামিয়ে আমি রাগত স্বরে বললাম,”আপনি কেন বাঁচালেন আমায়?কে আপনি আমায় বাঁচানোর?কিছু জানেন কেন মরতে গেছিলাম?কিছু জানেননা,তবে পরোপকার করতে কে বলেছে আপনাকে?”কথাগুলো ঝড়ের বেগে বলে হাঁপাতে লাগলাম।
সে স্মিত হেসে বলল,”শান্ত হোন,শান্ত হোন।”একটু থেমে বলল,”আমি মানুষ।তাই মানুষের প্রাণ বাঁচানো আমার কর্তব্য,তাই করেছি।আমি চিনিনা,জানিনা আপনার সম্পর্কে,তবুও এটুকু বুঝি নিশ্চয় কোনো কষ্ট আপনি পেয়েছেন আর তাই পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন।” কিছুক্ষণ চুপচাপ।”আপনি এরকম আহাম্মকের মতো কাজ করতে যাচ্ছিলেন কেন?”কথাটা বলেই সে অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে রইল।আমি নির্বাক।”ক্ষমা করবেন।আপনাকে ঐ ভাবে বলা উচিত হয়নি।”কিছু বললাম না।”আপনার বাড়িতে খবর দিয়েছি।ওনারা এলে আমি চলে যাব।”আমার গলা কান্নায় ভারী হয়ে আসছে।”কিভাবে কি নিয়ে বাঁচতে পারব বলবেন?আমার সব স্বপ্ন তার যাওয়ার সাথে ভেঙে গেছে,অর্থহীন লাগছে সব।”ধরা গলায় কথা কটি বলাম কোনরকমে।
সে হাসল।তার সেই হাস্যজ্জ্বল মুখটির দিকে নির্নিমেষ চেয়ে রইলাম।”আপনাকে একজন ছেড়ে গেছে বলে আপনি তাদেরও ছেড়ে যাবেন?মা-বাবার মুখও মনে পড়লনা?” আমি লজ্জিত হলাম,ধিক্বার,আমি মা-বাবাকে ভুলেগেলাম! নিরবতা ভেঙে সে বলে উঠল,”তাদের হাত ধরুন যাদের কেউ নেই,তাদের পথ দেখান যাদের জীবনে অন্ধকার,তাদের স্বপ্ন সত্যি করতে সাহায্য করুন,..”তাকে থামিয়ে অবাক হয়ে বললাম,” ‘তারা’কে?” হেসে উঠল;”আপনি বুঝতে পারেননি!’তারা’দেশের ভবিষ্যৎ,ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা,পথে পথে ঘোরে,কাজ করে,তাদের চোখের জল মোছানোর কাজ করুন;তাদের জন্য বাঁচুন।আপনাকে সবার প্রয়োজন,নিজেকে ছোট ভাববেননা।”
অভিভূত হয়ে শুনছিলাম তার কথা।আমার সমবয়সী বা ছোট হয়েও তার সমাজের প্রতি কর্তব্য বোধ প্রসংশনীয়।হঠাৎ পায়ের শব্দে দেখি মা,বাবা,কাকু,দিদি সবাই এসেছে।মা আমায় জড়িয়ে কাঁদছে,আমিও পারলামনা চোখের জল আটকাতে।একটু পরে ধাতস্থ হয়ে মা,বাবা মেয়েটিকে অনেক ধন্যবাদ দিল,আশীর্বাদ করল।কিছুক্ষণ কথা বলার পর সে যেতে চাইল তার পরিচয়ই জানা হয়নি! চলে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বললাম,”আপনার নামটাই তো জানা হয়নি!”আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল,”রাগ দেখাতেই তো ব্যস্ত ছিলেন।পরিচয় কখন করবেন!”বলেই হাসতে লাগল।যতক্ষণ দেখলাম তার মুখে হাসির অভাব দেখিনি,অদ্ভুত মেয়ে!
“আমি অনামিকা, ব্যানার্জী।ভালো থাকবেন।আপনি পারবেন।তখন আমার কথা একবার হলেও মনে পড়বে।চলি।নমস্কার।”
আমি স্তব্ধ হয়ে শুয়ে,তার পদশব্দ মিলিয়ে গেল।বুঝিনি তার ছোট্ট নমস্কারের সাথেই ছিল আমাদের শেষ দেখা।তিনদিন পর বাড়ি এলাম।উচ্চশিক্ষা শেষে সরকারি কলেজের অধ্যাপক পদে যোগ দিলাম।আর সেই সঙ্গে নতুন ভাবে বাঁচা শুরু হল আমার ছোট্ট ছোট্ট পথশিশু দের নিয়ে।সেই শুরু হয়েছিল পথচলা “আমাদের”;হ্যাঁ,আমাদের,আমার জীবন ওদের ঘিরে।ওদের সুখ-দুঃখ আমার সুখ-দুঃখের সাথে অঙ্গাঙ্গিক ভাবে জড়িত।
আজ খুব মনে পড়ছে আমার ‘গুরু’-কে।অনামিকাকে।’গুরু’ বলেই মনে করি তাকে,আমার জীবনে আলো হয়ে এসেছিল সে।তার দেখানো পথ আমায় নতুন ভাবে ভাবতে,নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।কৃতজ্ঞ আমি।তার খোঁজ পাইনি,সম্ভবও নয়।তার সম্পর্কে কিছুই জানিনি সেদিন।ক্ষণিকের অতিথি হয়ে দিয়ে গেল বড় শিক্ষা।তার সেই মায়াভরা হাসিমুখ আমার স্মৃতির পাতায় সযত্নে রয়ছে,রইবে,আমৃত্যু।
মনে মনে গেয়ে উঠলাম,
“শুধু তোমার বাণী নয়গো, হে বন্ধু,হে প্রিয়।
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও…..”