।তেরো।

এই ভাবে যেন সেই কয়েক দিন আগের দুঃখ্য দুঃখ্য ভাবটা উবে যাচ্ছিল। আবার নিয়ম করে লন্ডনের নানা জায়গায় ওদের দেখা হতে লাগলো। সৌগতর ভালো লাগছিল যে মেয়েটা অন্তত নিজের জীবনের অন্ধকার দিক গুলোকে মাথার ওপর চড়তে দেয়নি।

তার ওপর আজকে এই চিঠি। বেশী দেরি না করে ঝট করে চিঠিটা খুলে ফেললো। বেশি বড় নয়, ছোট্ট চিঠি –

আজকে আর ফোন করলাম না, মোবাইলটা কোথায় যেন একটা ট্রাবল দিচ্ছে তাই দোকানে নিয়ে যাবার পথে চিঠিটা পোস্ট করছি। নিশ্চয়ই কালকে পেয়ে যাবেন। বিশেষ কিছু নয়, এই শনিবার বাড়ীতে চলে আসুন। আমার হাসব্যান্ড অনেকদিন পর হয়তো একটা শনিবার বাড়ীতে থাকবে, কাজেই আপনার সাথে আলাপটা করিয়ে দেব। আর ভাবছি এক রকম ফ্রেঞ্চ স্যালাড প্রিপেয়ার করবো … চিকেন লিভার দিয়ে, ভালোই লাগবে … সেই সঙ্গে আপনার প্রিয় মাংসের শিঙাড়া। শুভব্রতও খুব ভালোবাসে। আসছেন তো? আমার ফোন কিন্তু দু-তিন দিন দোকানে থাকবে কাজেই যোগাযোগ করতে পারবো না। ভালো থাকবেন। – মোনালিসা।

চিঠিটা পড়ে সৌগতর বেশ ভালো লাগলো। লন্ডনের এই একাকিত্বে মোনালিসা তার বিরাট এক সহায়। ভিষণ কালচার্ড বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে যার সাথে সময় কাটাতে সৌগতর দারুণ ভালো লাগে। মোনালিসা বিবাহিত হতেই পারে কিন্তু তাতে তার চার্ম একদম কমে নি। সৌগত কাজের বাইরে ভিষণ একা আর মোনালিসা তো বিবাহিত হওয়া সত্যেও কারো কম্পানি পায় না কাজেই তাদের বন্ধুত্ব বেশ গভীর হয়ে গেছে। মোনালিসার দিকে কি ব্যাপার সে জানে না, কিন্তু সৌগত মোনালিসাকে মনে মনে ভিষণ পছন্দ করে, হয়তো কোন ভাবে ভালোও বাসে। ওর মতো মেয়েকে পছন্দ না করে পারা যায় না। ওর মধ্যে নানা রকম ব্যাপারে নিজস্ব ওপিনিয়ন আছে কিন্তু বুদ্ধির দর্প একদম নেই। নিজেদের স্বচ্ছল জীবন নিয়ে অ্যাপ্রিশিয়েশান আছে কিন্তু গর্ব ব্যাপারটা একদম নেই। জীবন যাত্রায় স্বাচ্ছন্দ আছে কিন্তু বাহুল্য একদম নেই … ওর এই সব গুণ গুলো সৌগতর মন সর্বদাই ভরে রাখে। ওর হাসব্যন্ডের সাথে আলাপ হওয়াটা বাকি ছিল, মনে হয় এই শনিবার সেটাও হয়ে যাবে। বিদেশে এসে এই রকম কালচার্ড বাঙালী ফ্যামিলীর সাথে পরিচিত হতে পারা বেশ সৌভাগ্যের ব্যাপার।

সৌগত সেই মুহুর্তে শনিবারের প্রোগ্রামটা ছকে ফেললো।

********

একটা ডার্ক ব্লু জিনস আর সাদার ওপর কালো চেকের ফুল হাতা সার্ট পরে সৌগত হাতে একটা দামি রেড ওয়াইনের বোতল নিয়ে মোনালিসাদের বাড়ীতে হাজির। ও শুনেছে যে শুভব্রত ওয়াইন খুব ভালোবাসে, আর আজকে প্রথম দেখা বলে কথা। মোনালিসা যথারীতি দরজা খুললো …

মোনালিসা। হাই … এসে গেছেন দেখছি। আসুন আসুন, আমি তো ভাবলাম আজকে এলেন না। আর ফোনটাও এখনও দিল না যে ডাইরেক্ট কথা বলবো।

সৌগত। এসে তো গেলাম, কিন্তু শুভব্রতদা কই? ওনার সাথে তো আজ দেখা হবার কথা।

মোনালিসা। এতোক্ষণ তো ছিল … এই মাত্র একটা ফোন পেয়ে কোথায় বেরুল, তবে বললো মিনিট পনেরর মধ্যেই আসছে। আপনি ভিতরে এসে একটু ঠান্ডা কিছু খান তার মধ্যেই এসে যাবে।

সৌগত ভিতরে ঢুকলো, তারপর হাতের বোতলটা মোনালিসার হাতে দিল। মোনালিসা একটু হাসলো …

মোনালিসা। শুভর জন্য …? ভালোই করেছেন, ওর আবার এই সব ভিষণ ফেভারিট। অবশ্য সকালেই খানিকটা শ্যাম্পেন টেনে দিয়েছে … তবে রেড ওয়াইন ওর দারুণ প্রিয়। দাঁড়ান … এটাকে ফ্রিজারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিই …।

সৌগত হাতে একটা কোলার গ্লাস নিয়ে আবার ওর প্রিয় জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল, মোনালিসা রান্না ঘরে কিছু একটা করছে … মাঝে মাঝে ছুরির ঠক ঠক আওয়াজ হচ্ছে, বোধহয় স্যালাডের জন্য তরকারি কাটছে। মোনালিসাদের অ্যাপার্টমেন্টে বিয়ার বা ওয়াইনের বিরাট আয়োজন কারণ ড্রিঙ্কস শুভব্রতর ভিষণ প্রিয় এবং রোজ রাতেই কিছুটা দরকার হয়। মোনালিসা অনেকবার সৌগতকে অফারও করেছে কিন্তু সৌগতর কেমন যেন ভালো লাগে না, বিয়ারটা কেমন তেতো লাগে। তার পক্ষে এই কোলা বা ফ্যান্টাই ভালো, তবে হোয়াইট ওয়াইনটা চলে, তবে খুবই মাঝে সাঝে। আর মোনালিসা? সে তো প্রায় নিরামিষের দিকেই চলে গেছে, এখনও মাটনটা খায়, চিকেনটায় কেমন গন্ধ পায়, খুব সাধলে একটু নেয় আর অ্যালকোহলিক ড্রিঙ্কসের মধ্যে খুব রেয়ারলি কোন পার্টিতে একটু ওয়াইন সিপ করে। ওর সব কিছুতেই ভয় যদি মোটা হয়ে যায় … মাই গড, সত্যি সত্যি মোটা হতে শুরু করলে না জানি কি করবে …!

মিনিট পনের কুড়ি বোধহয় গেছে … আবার দরজায় বেল বেজে উঠলো, আওয়াজটা অনেকটা কোন অর্কেস্ট্রার সুরের মতো। দরজা খোলার শব্দ আর মিনিট তিনেক পরেই শুভব্রত নিজের বেড রুমেই দরজায় নক করে প্রবেশ করলো।

সৌগত জানলার দিক থেকে ফিরে তাকাল … দরজায় একজন স্বাস্থ্যবান লম্বা মতো ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে, বয়স হয়তো মোনালিসা বা সৌগতর থেকে একটু বেশি। মাথার চুল বেশ ঘন কিন্তু কিছুটা এলোমেলো। চোখ দুটো একটু ক্লান্ত কিন্তু বুদ্ধির দ্যূতিতে ঝিকমিক করছে। গায়ে একটা হাতকাটা ব্র্যান্ডেড টি সার্ট আর ছাই ছাই রঙের জিনস। সৌগতর দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক একটা সুন্দর হাঁসি হাসলেন, সাদা দাঁতগুলো ঝকমক করে উঠলো। এই হাসি মুখটা সৌগত মোনালিসাদের অ্যালবামে অনেক দেখেছে। শুভব্রত হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো …

শুভব্রত। হ্যালো সৌগত, তোমার কথা অনেক শুনেছি মোনার কাছে … দেখা করার আর সময় হচ্ছিল না। জানতো, ব্যাঙ্কারদের অফিস টাইম বড় বেয়ারা … সারা দিন ভিষণ ব্যাস্ত যায়, তার ওপর মাঝে মাঝেই ট্যুর। নাইস টু মিট ইউ, সৌগত … আমাদের ফ্যামিলীতে ওয়েলকাম।

শুভব্রত তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে সৌগতর হাতটা নারিয়ে দিল। সৌগত একটু লাজুক হেসে বললো …

সৌগত। থ্যাঙ্ক ইউ অ্যান্ড নাইস টু মিট ইউ টু, স্যার।

শুভব্রত। ও সব স্যার ট্যার বাদ দাও ভাই, আমাকে শুভদা বলেই ডেকো …।

 

।চোদ্দ।

ততক্ষনে ঘরের ভিতর আর একজন ভদ্রমহিলা ঢুকে পরেছেন … একজন ব্রিটিশ মহিলা। খুব ডিসেন্ট পোশাক পরা … কালো ডিসাইন করা একটা টপ আর জিনস। মাথার চুলটা হাল্কা ব্লন্ড। ফর্সা হাত পায়ের সাথে পোশাকটা দারুণ মানিয়েছে। ভদ্র মহিলা বেশ লম্বা, চোখ মুখ ভিষণ সার্প আর চোখ দুটো যেন ছোটবেলায় খেলা মার্বেলের মতো সবুজ আর নীলের মিশেল। সৌগত তার সাথেও গিয়ে হ্যান্ড শেক করলো।

শুভব্রত পরিচয় করিয়ে দিল – অ্যান মার্গারেট, আমাদের সিটি ব্যাঙ্কের অফিসে ভিষণ ইম্পর্ট্যান্ট একজন বিজনেস ম্যানেজার, আমরা প্রায় বছর দেরেক একসাথে কাজ করছি। অ্যান্ড আওয়ার কোলাবরেশান ইজ ফ্যানটাস্টিক … ইস নট ইট ট্রু, অ্যান?

অ্যান মাথা নাড়ল – অ্যাবসলিউটলি ডিয়ার, অ্যান্ড উই গট আওয়ার প্রোমোশান টুগেদার … ইস নট ইট গ্রেট?

শুভব্রত মাথা নারলো – নো কোয়েশ্চেন …। অ্যান, ডু ইউ লাইক টু হ্যাভ আ ড্রিঙ্ক?

অ্যান। সিওর … বাট নট আ বিগ ওয়ান প্লিজ।

শুভব্রত। সৌগত, হোয়াট অ্যাবাউট ইউ?

সৌগত। ও নো নো … এখন লাঞ্চ হয়নি … তাছাড়া বাড়ীতেও ফিরতে হবে … আমি বরঞ্চ পরে কোনদিন নেব, আজকে বাদ দিন।

শুভব্রত। আরে আজকে কি প্রবলেম? ওসব ওজর শুনছি না। একটু কিছু নাও। কি নেবে … বিয়ার না ওয়াইন?

সৌগত কেমন যেন একটু মিইয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, এই সময় রান্না ঘর থেকে মোনালিসা বেরিয়ে এলো …

মোনালিসা। আচ্ছা তোমরা নেবে নাও, ওকে জোর করছো কেন? সবার কি সমান হ্যাবিট হয় নাকি?

শুভব্রত। ও মোনা ডারলিং … দিস ইস নাথিং বাট এ ড্রিঙ্কস … এগুলোতে ইভেন টেন পারসেন্ট অ্যালকোহলও থাকে না। এগুলো নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না ডারলিং … ওকেই ডিসিশান নিতে দাও।

মোনালিসা। যা করার কর কিন্তু ও নিতে না চাইলে জোর কোর না। আমার রান্না প্রায় শেষ, স্যালাড রেডি, সিঙারার পুর রেডি … শুধু ভাজতে হবে। আমি মিনিট দশেকের মধ্যেই আসছি।

 

***

খাওয়াটা বেশ জব্বরই হোল। ফ্রেঞ্চ ড্রেসিং দিয়ে ফ্রেঞ্চ স্যালাড উইথ চিকেন লিভার আর প্রন আর মাংসের শিঙাড়া। শুভব্রতর রিকোয়েস্টে খানিকটা হোয়াইট ওয়াইনও নিতে হোল, সেটাও মন্দ নয়। কিন্তু আনন্দটা বেশিক্ষণ থাকলো না, খাওয়ার শেষের দিকে শুভব্রত শুরু করলো …

শুভব্রত। মোনা ডারলিং, আজকে জেরির বাড়ীতে একটা ছোট্ট গ্রিল পার্টি আছে, হয়তো একটু আধটু পোকারও খেলা হবে … আই উড ভেরি মাচ লাইক ইউ টু অ্যাকমপ্যানি মি।

মোনালিসা ঝাঁঝিয়ে উঠলো – জাস্ট ফরগেট দ্যাট। ইউ এনজয় ইন ইওর ওউন ওয়ে, প্লিজ ডোন্ট বদার মি। আমাকে তোমাদের ক্রেজি গ্যাদারিং-য়ের মধ্যে ডেক না।

শুভব্রত এই কথায় বেশ আহত হোল, ওর মুখটা কেমন লাল হয়ে গেল, তার ওপর বাইরের ছেলে সৌগত সামনেই বসে আছে। ও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, বোধহয় ওর চোখ দুটো ছল ছলও করছিল, খুব আস্তে আস্তে বললো …

শুভব্রত। মোনা ডারলিং, দিস ইস দি লাইফ অফ লন্ডন, ও.কে.! ইউ হ্যাভ টু এনজয় লাইফ দি ওয়ে এভরিবডি এনজয়েস লাইফ হিয়ার… ইউ ক্যান নট থিংক অ্যাবাউট হাউ ইওর লাইফ ওয়াজ ইন ক্যালকাটা … ডারলিং।

মোনালিসা। বাট … দি মিনিং অফ দি ওয়ার্ড “ডিসেন্সি” ইস দি সেম এভরিহোয়ার … ইস ইনট ইট?

শুভব্রত। শোন ডার্লিং, হয়তো আমরা কেউ কেউ একটু বেশি ড্রিঙ্ক করে ফেলি, একটু বেশি কথা বলি বা হাঁসি … কিন্তু সেরকম অ্যাবনর্ম্যাল কেউ তো হই না, হই কি?

মোনালিসা। অফ কোর্স ইউ ডু। ইউ ডোন্ট সি ইওরসেলফ ইন দি মিরর … হাউ ডু ইউ স্পিক অর হাউ ডু ইউ লুক লাইক, … সেমফুল।

অ্যান এর মাঝে কিছু বলার চেস্টা করলো – বাট মোনা, জাস্ট হ্যাভ ইওর ফান ইন ইওর ওউন ওয়ে। ইউ ডোন্ট হ্যাভ টু ড্রিঙ্ক ইফ ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু… জাস্ট গিভ আস ইওর কোম্পানি, প্লিজ।

খাওয়া দাওয়া তখন শেষ, মোনালিসা কোন উত্তর না দিয়ে টেবিলের প্লেট ডিস গুলো হাত দিয়ে জড় করছিল, অ্যান এগিয়ে এসে হাত লাগাল, ওরা দুজনে হাতে প্লেট আর বাকি খাবার নিয়ে কিচেনে চলে গেল। সৌগত কেমন বোকার মতো সোফায় বসেছিল, অন্য ফ্যামিলির হাসব্যান্ড ওয়াইফের ঝগড়ার মধ্যে থাকাটা বেশ এমব্যারাসিং, তাই ঠিক কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। শুভব্রত ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো …

শুভব্রত। প্লিজ ডোন্ট ফিল ব্যাড সৌগত, বিয়ে হলে কিছু ঝগড়া তো হবেই। তবে তোমার যদি কিছু করার না থাকে, দেন আই উড লাইক টু ইনভাইট ইউ ইন আওয়ার পার্টি টুডে। ইউ উইল লাইক ইট ভেরি মাচ, ম্যান। এই সব পার্টি তো তোমাদের মতো ইয়াংদেরই জন্য। জাস্ট অ্যাকসেপ্ট দি ইনভাইটেশান অ্যান্ড জয়েন আস।

 

।পনেরো।

সৌগতর আবার একটা বিপদ। আজকে একের পর এক বিপদের ঢেউ আসছে। এই সব ড্রিঙ্কিং পার্টিগুলো সম্পর্কে ও ভালোই জানে। প্রথমে এগুলো বেশ ভালোই শুরু হয়, বেশ গল্প, জোকস, অল্প স্বল্প ড্রিঙ্কস, কিন্তু ঘন্টা দেরেক কাটতে না কাটতেই কারোর কারোর মধ্যে অ্যালকোহলের এফেক্ট শুরু হয়ে যায় আর ব্যাস, পুরনো রাগ, কথা কাটাকাটি, কারোর কমেন্টের জন্য রাগারাগি বা অনেক সময় মারামারিও ঘটে যায়। তাদের গ্রুপ পার্টিতে খুব অল্প হলেও এরকম ঘটেছে। সৌগত না বলতেই চায় কিন্তু কিভাবে বলা যায়। শুভব্রত খুবই সিরিয়াস এবং আর্নেস্ট। কিন্তু আবার সেই মোনালিসাই বাচিয়ে দিল …, কোথা থেকে আবার ঘরে ঢুকে পরে বললো …

মোনালিসা। শোন শুভ, ও সবে ইম্পিরিয়াল কলেজে ওর ক্যারিয়ার শুরু করেছে, ওকে আর এর মধ্যে টেন না। লন্ডনের লাইফ ওকে বুঝতে দাও আর নিজের ডিসিশান নিতে দাও। পরে ওর যদি মনে হয়, ও তোমাকে কন্ট্যাক্ট করবে। আজকে ওর সাথে আমার একটু বেরুতে হবে।

শুভব্রতর মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেল, সে কিছুই বললো না। তারপর একটু চুপ করে থেকে সে পকেট থেকে একটা কার্ড বার করলো আর সৌগতর দিকে তাকিয়ে বললো …

শুভব্রত। ডোন্ট ওরি সৌগত, আমি তোমাকে যাবার জন্য জোর করবো না। আমার কার্ডটা রেখে দাও। হঠাৎ যদি কোন দরকার হয়, আমাকে উইদাউট হেসিটেশান ফোন কোর। লন্ডনে আমি বেশ হাইলি কানেক্টেড, অনেক ব্যাপারেই হেল্প করতে পারবো। আমার লন্ডনের হাই সোসাইটিতে ভালো জানাশোনা আছে।

সৌগত হাত বারিয়ে কার্ডটা নিল, তার বেশ খারাপ লাগছিল, শুভদাকে তার কিন্তু বেশ পছন্দই হচ্ছিল। সে নম্র গলায় বললো – থ্যাঙ্ক ইউ শুভদা। আমি নিশ্চয়ই পরে আপনাকে ফোন করবো।

শুভব্রত ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে মাথা নারলো, তারপর রান্না ঘরের দিকে হাঁক পারলো – হাই অ্যান, আর ইউ রেডি? শ্যাল উই মুভ নাউ? উই আর গেটিং লেট হানি …।

মিনিট কয়েক বাদেই অ্যান রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো – লেট্‌স গো, আই অ্যাম রেডি।

ওরা দুজনে সৌগত আর মোনালিসাকে বাই জানিয়ে বেরিয়ে গেল। সৌগত একাই ঘরের মধ্যে বসে অ্যাকোয়েরিয়ামের মাছগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। মোনালিসা ঘরে ঢুকলো আর কোন ভনিতা না করেই বললো …

মোনালিসা। কি … আমার বরের গার্ল ফ্রেন্ডকে কেমন লাগলো?

সৌগত ঝাঁঝিয়ে উঠল – দূর, একসাথে পার্টিতে গেলেই আবার গার্ল ফ্রেন্ড হয় নাকি? তাছাড়া আপনাকেও তো কত করে যেতে বললো, গেলেন না কেন?

মোনালিসা টেবিলটা হাত দিয়ে একটু ঠিক করে সোফায় এসে বসলো – আরে আগে ওসব পার্টিতে আমি অনেক গিয়েছি। প্রথম প্রথম লন্ডনে এসে আমিও যেতাম। শুভর ভালো ইনকাম কাজেই সোসালাইজিং করতে ভালোই লাগতো। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই বোর হয়ে গেলাম … ওই সব জায়গায় শুধুই অ্যালকোহল আর কোকেন। পোকার খেলার নাম করে টাকা ওড়াচ্ছে, রীতিমতো গোছা গোছা পাউন্ড। ওই সব দেখে আর যাই না। ওখানে কথা বলার কেউ নেই … মেয়েরা ওখানে যায় নতুন পয়সা ওয়ালা প্রেমিক খুঁজতে আর ছেলেরা ড্রিঙ্ক করতে আর মেয়েদের নিজের পার্সে কত টাকা আছে সেটা দেখাতে। পার্সে টাকা থাকলে এখানে অনেক মেয়ে পাওয়া যায়।

সৌগত। কিন্তু সব পার্টি এরকম হয় না। আমাদের বন্ধুদের মধ্যেও আমরা পার্টি করি। সেখানে তো অনেক ব্রিটিশ আসে যারা ড্রিঙ্কই করে না। মোনালিসা আপনি বোধহয় ভুল করছেন কোথাও …।

মোনালিসা। আমি জানি। লন্ডনে আমার বহু লোক চেনা, বহু ব্রিটিশকে আমি খুব ভালোমতো চিনি আর তাদের বাড়ীতে আমি যাই-ও। বহু পাওয়ারফুল ব্রিটিশ ফ্যামিলীর সাথে আমার জানাশোনা … আমার এক আত্মীয়ের সুবাদে। শুভ আসলে একটা বাজে গ্রুপে ঢুকে গেছে … ওখান থেকে বের হওয়া মুশকিল। তবে চেস্টা করছি, আশা ছারিনি।

সৌগতর একটু লজ্জা লজ্জা করছিল, কিন্তু সে অনেকক্ষণ ধরেই কথা ঘোরাবার চেস্টা করছিল, এবার সুযোগ পেয়ে একটানে পকেটের ভাঁজকরা কাগজটা বার করে মোনালিসার দিকে এগিয়ে ধরলো – আমি একটু লেখা প্র্যাকিটিস করি। এটা আপনি পড়ে বলুন কেমন লাগলো।

মোনালিসা মুচকি হেসে কাগজটা খুললো, কিছুক্ষণ ধরে পরলো, তারপর সে একটু জোরে জোরে কবিতাটা পড়লো …

ধরো, যদি আমরা দুজন একসাথে আজ হাঁটি,

দূরে ওই সবুজ বনে যাই ।

ধরো, যদি তোমার চুলে একটি লাল দোপাটি

দুহাত দিয়ে গুঁজে দিতে চাই …।

রাজি হবে…?

ধরো, যদি হলুদ গাঁদা ফুলের মালা

তোমার গলায় পরিয়ে দিতে চাই ।

ধরো, যদি তোমার মিস্টি হাসি ঠোঁটে

চুমুর পরশ বুলিয়ে দিতে চাই ।

সঙ্গে রবে…?

দূরে কোন পাখীর ঝাঁকের ডাকে

হয়তো কোথাও যেতেই যদি হয়।

জীবনে যে বড়ই যাবার তাড়া …।

অজানা সেই জগৎ থেকে তোমায়

ডাকলে কি আর আমায় দেবে সারা…।

এই জীবনের সব ঝড়েই তো ঝরে না গাছের পাতা

এই জীবনের সব ঝড়েই তো ভাঙে না পাখীর বাসা

এই জীবনের সব ঝড়েই তো হারে না ব্যাকুল আশা

হঠাৎ যদি গো সে ঝড়ই আজ আসে …।

থাকবে কি তুমি এমনি আমার পাশে…।

তারপর অনেকক্ষণ বাদে বেশ ফিক ফিক করে একটু হাসলো – হু … প্রেমের কবিতা। কার জন্য লিখেছেন বলুন তো?

সৌগত একটু হেঁসে বললো – আরে বেশীর ভাগ কবিতাই তো প্রেমের কবিতা … এটা জানেন না? আর অবিবাহিত ছেলে, প্রেমের কবিতাই তো লিখবো, নাকি?

মোনালিসা। হ্যাঁ … কিন্তু কার উদ্দেশ্যে? মানে মেয়েটা কে? আমি না তো?

সৌগতর হার্টটা হঠাৎ খুব তাড়াতাড়ি চলতে লাগলো, কানের পাশটা কেমন যেন গরম হয়ে গেল, সে একটু কেশে গলাটা পরিস্কার করে বললো – এই, আপনার ইয়ার্কি শুরু হোল। আপনি সুন্দরী বলে আপনার কিন্তু একটু নাক উঁচু আছে, সে আপনি যাই বলুন।

মোনালিসা এবার হো হো করে হেসে উঠলো – আচ্ছা, আপনি একা থাকেন বলে ডেকে ডেকে এতো খাওয়াই, মাঝে মাঝেই টেমসের ধারে গিয়ে আপনাকে কম্পানি দিই, তার পরেও আমাকে আপনি নাক উচু বললেন … কি আনগ্রেটফুল। আপনাকে কিন্তু আমি ফ্রেন্ড হিসাবে নিয়েছিলাম।

সৌগত একটু থতমত খেয়ে গিয়ে বললো – আরে না না, সিরিয়াসলি নেবেন না। কিন্তু আপনি একজন ম্যারেড লেডি, আপনাকে নিয়ে কবিতা লিখবো … ?

মোনালিসা। লিখতেই পারেন, এর আগে তো অনেকেই লিখেছে। আর আপনি তো আমার বয় ফ্রেন্ডও বটে।

সৌগত এবার ইয়ার্কিটা বুঝতে পারলো – এই … আবার শুরু হোল।

মোনালিসা। আরে আবার কি হোল … বুঝলেন না। আপনি তো একজন বয়, আবার ফ্রেন্ডও বটে। তাহলে কি হোল? বয় ফ্রেন্ড তো, নাকি? তাছাড়া আমার বরের যদি ঐ রকম হট একজন গার্ল ফ্রেন্ড থাকে তাহলে আমার একজন মিস্ট্রি বয় ফ্রেন্ড থাকতেই পারে।

সৌগত এবার আর ঘাবড়াল না – ও.কে., ডান। তাহলে আর আজ থেকে আমি আপনি বলবো না। শুধু মোনালিসা, চলবে?

মোনালিসা। পাক্কা, আমার আপত্তি নেই। তবে ফর দি টাইম বিয়িং, আমি “আপনিতেই” থাকছি, আর কিছুদিন পরে ভেবে দেখবো। যাক, এবার উঠুন, আমরা কোথাও শপিং-য়ে যাব। আর কবিতাটা আমার কাছেই রইল।

সৌগত উঠে দাঁড়িয়ে বললো – আমি রেডি, কোথায় যাবে বল।

মোনালিসা আবার সোফাটা দেখিয়ে বললো – আরে এতো ধড়ফড় করবেন না। আমার এই রান্নার শাড়িটা ছাড়তে দেবেন তো। আমি একটু ভেতর থেকে আসছি, আপনি আর একটু সোফায় বসে মাছের খেলা দেখুন।

মোনালিসা ভেতরে চলে গেল।

।ষোল।

সৌগতর কিন্তু বেশ ভালোই লাগছিল। তার সাথে মোনালিসার যে দূরত্বটা ছিল তা উধাও। সে “তুমি”তেই রয়ে গেল। এটাই ভালো, কেমন আপন আপন লাগে, আর মোনালিসার মতো মেয়ের সাথে দূরত্ব রাখতে একদম ভালো লাগে না। বাঙালী মেয়ে কিন্তু দারুণ মডার্ন আর স্মার্ট, ভালো রুচি, কথা বললেই বোঝা যায় যে পড়াশুনোয় বেশ ভালো ছিল কিন্তু মনে মনে একদম মাটির মানুষ। বরের এতো বড় চাকরী কিন্তু স্বচ্ছন্দে আইসক্রীম চুসতে চুসতে রাস্তায় হাঁটতে পারে। ওরা বহুবার হেঁটেছেও … টেমসের ধারে বি.এফ.আই.-য়ের সামনে দিয়ে আরো পিছনে … টেট মডার্নের দিকে। সেদিন হঠাৎ ওকে অক্সফোর্ড সার্কাসের মোরে ডেকে পাঠাল, তারপর একটা ভালো দোকান থেকে একটা জ্যাকেট কিনে দিল, দিয়ে বললো …

মোনালিসা। লন্ডনে শীতের সময়ও বেশ বৃষ্টি হয়, তাই এই জ্যাকেটটা শীত আসলেই পরে নেবেন। আপনি একা থাকেন, একটু সাবধানে থাকাই ভালো।

সৌগত। কেন, তুমি তো লন্ডনেই আছো … নাকি?

মোনালিসা। আরে … মানুষ কি আর ভবিষ্যৎ বলতে পারে…! যদি না থাকি … আমার বরের তো আবার ট্রান্সফারের চাকরী, যদি কোথাও পাঠিয়ে দেয়। ওদের তো সব হঠাৎ হঠাৎ-ই হয় … পনের দিন আগেও জানা যায় না।

সৌগত। দূর, সবে তো এখনও দু বছরও পুরো হয়নি লন্ডনে … তাই তো? এর মধ্যে কেউ ট্রান্সফার পায় নাকি?

মোনালিসা হঠাৎ কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল, দূরে কথাও তাকিয়ে থাকতে থাকতে বললো – জানি না কখন হঠাৎ কি হয়। ব্যাঙ্কিং বিজনেসটাই তো লাভ আর ক্ষতির ওপর দাঁড়িয়ে, কোথায় কাকে ভিষণ জরুরি দরকার আবার কোথাও কারুর কোন দাম নেই … দাও অন্য জায়গায় পাঠিয়ে। এরকম তো চলতেই থাকে এই সব চাকরীতে।

সৌগত। আরে তুমি বড় বেশী অনুমান করছ আর টেনসড হচ্ছো। ওসব ভবিষ্যতের কথা বাদ দাও। এই যে দামি একটা জ্যাকেট উপহার দিলে, এবার আমি তোমায় কি দেব? আমার স্যালারী তো তোমায় বলেছি…!

মোনালিসা একটু ভুরু নাচিয়ে বললো – তোমায় বন্ধু হিসাবে দিয়েছি, দেখো ভিষণ কাজে লাগবে। আর বন্ধুকে কি সব সময় রিটার্ন উপহার দিতেই হয়? তুমি জান এতে বন্ধুত্বের অপমান…? তবু যদি গায় লাগে, একটা মাফলার কিনে দিও … ব্যাস।

সৌগত মাথা নেরে বললো – আবার ইয়ার্কি মারছো …। মাফলার, ওই তো একটু চওড়া দড়ির মতো জিনিস, অনেকটা লম্বা রুমালের মতো … ওতে কি কাজ হয় কে জানে। সে যাক, আমি দেখে নেব।

সৌগত ম্যাকডোনাল্ডস থেকে কেনা পপকর্ন চিকেনের বাক্সটা ধরে ছিল আর দুজনে সেটাই খাচ্ছিল। কথা বলতে বলতে ওরা কাছের টিউব স্টেশনের দিকে এগিয়ে গেল। সৌগত স্টেশনে ঢুকে যাবে আর মোনালিসা পাশেই কার পার্কের দিকে যাবে।

 

।সাতেরো।

এই রকম চলছিল। এর মধ্যে আবার সৌগতর গ্রুপে একটা জরুরি প্রগ্রেস মিটিং এসে গেল। ইন্টার ইউনিভার্সিটি কনসরটিয়ামের মিটিং, কাজেই সবাই ব্যাস্ত হয়ে পরলো। সৌগতকেও এই প্রগ্রেস মিটিঙয়ে কিছু প্রেসেন্ট করতে হবে। তাছাড়া ইম্পিরিয়াল কলেজেই বসছে সেই মিটিং কাজেই সে বেশ ব্যাস্ত হয়ে পরলো। অবশ্য এর মধ্যে মনে করে সে বেশ দামি একটা কার্ডিগান মোনালিসাকে তার বাড়ীতে দিয়ে এলো … নিজের পছন্দ করে কেনা। মোনালিসা কেমন শুকনো মুখে বসে ছিল কিন্তু ওর উপহার পেয়ে দারুণ চাঙা হয়ে উঠলো। খানিক চা আর চিপস খেয়ে সৌগত উঠে পড়ল, যাবার সময় সে বলেও ফেললো তার মিটিঙের কথা। সে অন্তত দিন পনের আস্তে পারবে না। মোনালিসা বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কতদিন সে ব্যাস্ত থাকবে তা জিঞ্জাসা করে নিল, কিন্তু আর বিশেষ কিছু বললো না। শুধু যাবার সময় উপহারের জন্য সবিশেষ ধন্যবাদ জানাল আর শীতের সময় জ্যাকেটটা ব্যবহারের জন্য অনুরোধ জানাল। সৌগত কথা দিয়ে আবার এস.এম.এস. করবে জানিয়ে বেরিয়ে এলো।

প্রোগ্রেস মিটিঙটা বেশ ভালোই মিটলো, সবাই বেশ খুশী। সৌগতর প্রেসেন্টেশানটাও উৎরেছে ভালোই। যদিও খুব বড় প্রেসেন্টেশান নয় তবু সবাই বেশ প্রশংসা করলো, এতো দিনে সৌগত যেন ঠিকঠাক টিম মেম্বার হয়ে গেল।

সেটা একটা শুক্রবার, মিটিংটা শেষ হোল, সৌগত ল্যাব থেকে একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে এসে বাড়ীতে ঢুকে একটা বড় গ্লাসে কোলা আর একটা চিপসের প্যাকেট নিয়ে টিভির সামনে বসে পড়লো … বি.বি.সি. ওয়ার্ল্ড নিউজ চলছে। ঠিক এই সময় এস.এম.এস.-টা এলো – প্লিজ কাম টুমরো … সেম স্পট বিসাইডস টেমস, আফটার ফাইভ পি.এম. … ।

মোনালিসার এস.এম.এস.। সৌগতর মনটা আবার ভালো হয়ে উঠলো। যাক, এতদিন ব্যাস্ত কেটেছে, এবার একটু রিল্যাক্স করে মুভি টুভি দেখতে হবে।

********

সৌগত ঠিক পাঁচটা নাগাদ লন্ডন আইয়ের নিচে গিয়ে দাঁড়াল কিন্তু মোনালিসা আজ এখনও আসে নি। অবাক ব্যাপার, মোনালিসা কোনদিন লেট হয়নি বরঞ্চ সৌগত প্রায়ই পাঁচ দশ মিনিট লেট হোত। কোন প্রবলেম নেই, সৌগত লন্ডন আইয়ের অপোসিটে লন্ডন অ্যাকোয়ারিয়ামের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাস্তার লোক দেখতে লাগলো … সময় এমনিতেই কেটে যায়। আরো মিনিট কুড়ি কাটলো … মোনালিসার কোন পাত্তা নেই। সৌগত একটু অধৈর্য্য হয়ে নিজে পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটা একটু নাড়াচাড়া করলো, ভাবছিল মোনালিসাকে একটা ফোন করবে কিনা, ঠিক এই সময়ে টুং করে শব্দ … মানে কোন এস.এম.এস.। হয়তো মোনালিসার, ফোনটা বার করে দেখলো … ঠিক তাই, মোনালিসা এস.এম.এস. পাঠিয়েছে। সৌগত খুলে পরলো … বেশ বড় মেল। পড়তে পড়তে তার চোখটা একটু কুঁচকে গেল … সে আবার পড়লো … ঠিক বুঝলো না, আবার পড়লো। বার তিনেক পড়ার পর সে সামনের দিকে তাকাল … একটু একটু সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে, সেপ্টেম্বারের শেষের দিক, তবু আলো আছে। টেমসের ওপারে অনেক বড় বড় বাড়ী আর আরো উঁচু ব্যাঙ্কের অফিস বিল্ডিং … কালো সেই বিখ্যাত গুরকেন। তার আশ পাশ দিয়ে এই গোধূলিতে নানা অজানা পাখী উড়ে আরো দূরে চলে যাচ্ছে। এত দূর থেকে সেই পাখী গুলোকে দেখা যাচ্ছে কিন্তু কি পাখী বোঝা যাচ্ছে না। পাশেই বোধহয় কোন ইন্ডিয়ান দাঁড়িয়ে ছিল, তার ফোনটা হঠাৎ বেজে উঠলো, রিসিভিং টিউনটা আবার কিশোর কুমারের সেই বিখ্যাত গান … একদিন পাখী উড়ে যাবে যে আকাশে, রইবে না সে তো আর কারো আকাশে …।

 

।আঠেরো।

এস.এম.এস.-টা একটু বড় … মানে একটা ছোট চিঠি। সৌগতর চোখের সামনে দিয়ে ইংরাজী অক্ষরে লেখা বাংলা শব্দগুলো কেমন নেচে নেচে যাচ্ছে …

“আজকে আর আপনি নয়, তুমি করেই লিখলাম। তুমি গত সপ্তাহে ব্যাস্ত ছিলে বলে কিছু জানাই নি। সেই যে গত মাসে একদিন আমরা ঝগড়া করছিলাম তোমার জ্যাকেটটা কেনার পর, মনে আছে? ঠিক তাই হোল। শুভ হঠাৎ বদলি হয়ে গেছে। এবার লন্ডন ছেড়ে জুরিখে। বদলি অর্ডার আসার দশ দিনের মধ্যে জয়েনিং … তোমাকে জানাবার কোন উপায় ছিল না। তাছাড়া তোমাকে ব্যাস্ত করে তোমার প্রেসেনটেশান বরবাদ করতে আমি অন্তত চাইব না … এটাই তোমার প্রথম ফরেন জব। আসলে একজন ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ব্রিটিশের সাহায্যেই এই ট্রান্সফারটা হোল, কয়েক মাস ধরেই চেস্টা করছিলাম, তোমাকে অবশ্য বলা হয়নি।

তুমি নিশ্চয়ই আজ অনেকক্ষণ আমার জন্য টেমসের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলে? ছিলে তো? আমি জানি তুমি থাকবে। আসলে জানত, আমরা এখন গাড়ীতে, শুভ চালাচ্ছে আর আমি এই ফাঁকে তোমায় এই এস.এম.এস.-টা লিখছি। একটু দেরি করলাম কারণ একটু আগেই আমরা একটা টানেল পেরিয়ে এলাম, জানতো জায়গাটা ভিষণ অন্ধকার, তাই লেখা বন্ধ করে বসেছিলাম। এখন আমরা স্যুইটজারল্যান্ডের মধ্যে ঢুকে পড়েছি … তবে আরো অন্তত এক ঘন্টা লাগবে জুরিখ পৌঁছতে। একটু ক্লান্ত লাগছে, আজ সকালেই ফ্লাইটে লন্ডন থেকে মিউনিখে এসে নেমেছি, তারপর খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আবার গাড়ী ভাড়া করে জুরিখের দিকে।

সৌগত, তুমি আর আমি দুজনে দুজনাকে পছন্দ করেছি, লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় অনেক ঘুরেছি, আনন্দ করেছি। সেই বন্ধুত্বের সুবাদে একটা রিকোয়েস্ট করবো, আমার আর খোঁজ কোর না … আমায় আর ফোন কোর না, আমার নাম্বারটা তোমার মোবাইল থেকে ডিলিট করে দিও। অনেক কস্টে শুভকে ওর সেই বান্ধবী অ্যান আর অন্যান্য নেশাখোর বন্ধুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, আবার ওকে নিয়েই নতুন করে নতুন জায়গায় জীবন শুরু করতে চাই।

তোমার কাছে একটু বেশি কিছু চাইব, যদি পার আমাকে মনে রেখ। তুমি আমার মনে সর্বদাই থাকবে এটাও জানিয়ে রাখি। তোমার নিশ্চয়ই হাসি পাচ্ছে, একটু আগেই ফোন না করতে বললাম … ঠিকই। বাস্তবে একটু আলাদা হয়ে যেতে চাচ্ছি লন্ডনের মানুষের থেকে কিন্তু মনের তো কোন বাধা খাঁচা নেই, সে সব জায়গাতেই থাকতে পারে।

যাই হোক, ভেবে দেখ। আর একটা ব্যাপার, একটু সোজাসুজিই বলি, খুব তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নাও। তোমার কিন্তু বেশ প্রেমিক প্রেমিক একটা ব্যাপার আছে, সেদিন যেরকম ঝট করে আমায় “তুমি” বলতে শুরু করলে, অবশ্য আমার ভালোই লেগেছিল। যদি প্রেমে পড়, তাহলে প্রেমে পড়েই বিয়ে কোর। কবে মাইনে বারবে, কবে একটা পার্মানেন্ট চাকরী হবে এই করে বছরগুলো নষ্ট কোর না। খানিকটা বোধহয় বেশি জ্ঞ্যান দিয়ে ফেললাম, তাও ভেবে দেখ।

সব শেষে … তোমার কবিতাটা আমার কাছেই থাকলো। ভেবো না, বেশ যত্ন করেই রাখবো। আমি তো সেরকম লিখতে পারি না, তাই যেটা পারি … একটা স্কেচ করে তোমার ইমেল অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছি, একবার খুলে দেখে নিও, কেমন লাগলো অবশ্য জানা হবে না।

এটাই আমার শেষ এস.এম.এস. … ভালো থেকো। মোনালিসা।”

সৌগত ততক্ষণে তার মোবাইলে হটমেলের অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলেছে। ইমেলে শুধু লেখা – উইথ কমপ্লিমেন্টস। সে অ্যাটাচমেন্টটা খুললো, একটা মুখের স্কেচ … তার নিজের মুখের সাথে দারুণ মিল। পেন্সিলের স্কেচ কিন্তু হাতের টানগুলো চমৎকার, কিছু গাঢ় দাগ আর কিছু অত্যন্ত সুক্ষ্ম শেডিং-এর সাহায্যে মুখটাকে দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সৌগতর সৌগতকে চিনতে কোন অসুবিধাই হচ্ছে না। মোনালিসা যে এতো ভালো স্কেচ করতে পারে সে জানতো না। সৌগত পি.ডি.এফ. অ্যাটাচমেন্টটাকে মোবাইলে সেভ করে ফোন অফ করে দিল। এই মুহূর্তে কে আর ফোন করবে, তাছাড়া তার এখন ফোন টোন রিসিভ করতে ভালো লাগছে না।

সৌগত একা একাই টেমসের ধার দিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করল। একটু এগিয়ে গেলেই রেলিং … এখন বেশ অন্ধকার, সন্ধ্যা নেমে এসেছে, টেমসের মধ্যে দিয়ে বড় বড় ফেরিগুলো আলোর ফোয়ারা ছুটিয়ে রোজকার মতো এদিক ওদিক যাচ্ছে আসছে। অন্যান্য দিন মোনালিসা মাতিয়ে রাখে … দুজনে কত রকম কথাই হোত, কলকাতার কথা, মোনালিসাদের বাড়ী সল্ট লেকে, সেখানকার কথা, আবার দুজনের কলেজ জীবনের নানা মজার কথা … বেশ সময় কেটে যেত।

এখন মোনালিসা হঠাৎ অনেক দূর চলে গেছে। সৌগতর একটু আগে বুকটা একটু ভাড়ি ভাড়ি লাগছিল, গলার কাছে কেমন একটা দলা পাকানো কি একটা আটকে আছে। কিন্তু হঠাৎ তার মুখটা কেমন যেন হাসিতে ভরে গেল … সে তো একাই লন্ডনে এসেছিল, মাঝে না হয় মোনালিসা কয়েক মাস একটু কম্পানি দিয়ে গেল। কিন্তু ওদেরও তো জীবনের ব্যাপার, ট্রান্সফার হলে তো যেতেই হবে। কি আর হোল, সে আবার একা হয়ে গেলো। একাই তো ছিল, কয়েক মাস কেবল একটু অন্য রকম, একটু যেন হাসি খুশি আত্মীয় আত্মীয় ব্যাপার। আজকে হঠাৎ সেটা না হয় কেটে গেল … তো গেল। তার তো ইম্পিরিয়ালের চাকরীটা এখনও আছে, আবার হয়তো কারোর সাথে এমনি একটা সন্ধ্যায় আলাপ হয়ে যাবে, মানে যেতেই পারে। সে হয়তো মোনালিসার মতন হবে না, না হোল, সে তার মতোই হবে … তাতে সৌগতর আপত্তি নেই। মোনালিসা একদিক থেকে ঠিকই লিখেছে, সে বোধহয় প্রেমেই পড়তে চায়, আবার অন্য কোন মোনালিসা আসার পথ চেয়েই সে আছে। জীবন এই রকমই, একজন চলে গেলে তার ফাঁকা যায়গা অন্য কেউ পুরন করবেই। আবার কোন মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠলো, সেই কোন ইন্ডিয়ান, এবারও সেই কিশোর কুমারের গানের লাইন – ইয়ে শাম মস্তানি, মদহোস কিয়ে যায়, মেরে দোস্ত কোই খিঁচে তেরি ওর লিয়ে যায় …।

সৌগত নিজের মনেই আবার একটু হাসলো। নাঃ, কিছুই হারায় নি, মোনালিসা আর শুভদা ভালো থাক, সৌগত সেটাই চায়, কিন্তু তার জীবনে আবার কোন মোনালিসা আসুক, সে এটাও চায়। সৌগত এবার ঘড়ির দিকে তাকাল … প্রায় পৌনে আটটা, এখনও টিউব ধরলে সে বাড়ী পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে আটটা, তার মানে আজকে ইউ.এস. ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালটা সে দেখতে পেতেও পারে। জকোভিচ আর বারডিচের ম্যাচ, বেশ জমবে মনে হয়। হঠাৎ তার মনে হোল আজ রাত্রে ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেলে কেমন হয় … অনেক দিন খাওয়া হয়নি। মোনালিসা খুব মানা করতো, ওসব নাকি বেশী খেতে নেই, ফ্যাট আছে। যাক গে, সে তো এখন আর লন্ডনেই নেই, তার সাথে আর কোনদিন দেখা হবার পথও বন্ধ। কাজেই আবার সেই ব্যাচেলর লাইফ। ঘরে বেশ কিছু ডিম আর ব্রেড আনাই আছে। বেশ তোফা করে টিভি দেখতে দেখতে খাওয়া যাবে।

নাঃ আর দাঁড়িয়েই বা কি হবে, কেউ তো আর আসছে না, সৌগত ফোনটা পকেটে পুরে উলটো দিকে হন হন করে হাঁটা লাগাল। লন্ডন এখন জমজমাট, লন্ডন আই আর তার চারিদিকে রেস্তোরাঁ আর পাব গুলো আলোয় ঝলমল করছে, রাস্তায় নানা পোশাকের নানা দেশের মানুষের ঢল, কিন্তু সৌগত এখন বাড়ী মুখোই যেতে চায়। ওদিকে বহু দূরে, জ্যুরিখের একটা চওড়া গলি দিয়ে জিনিস পত্র ভর্তি একটা ভ্যান ভাড়া করে মোনালিসা আর শুভ ড্রাইভ করে চলেছে, তারাও নিজেদের বাড়ীর দিকেই যেতে চায় … বেশ বড় বাড়ী, থ্রি বেড রুম নির্ঘাত। মোনালিসার মনটা বেশ খুশী আজ, নতুন জায়গায় তার নতুন জীবন শুরু, কে জানে, হয়তো এই জীবনই সে পেতে চেয়েছিল। অশুভের থেকে শুভর হয়তো মুক্তি ঘটতে চলেছে … আশা নিয়েই তো মানুষ বাঁচে।

০-০-০ শেষ ০-০-০

~ মোনালিসা , শুধু তোমার জন্য (চতুর্থ এবং শেষ পর্ব) ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleভাগশেষে
Next articleপৃথিবী মথন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments