যখন আমার বয়স হবে আশির থেকেও বেশী,
আমায় দেখে খোকনসোনা হোস নে রে অখুশী।
আগেও ছেড়ে যেতে পারি এই ধরণীর বাসা,
বিধাতার ইশারাতেই মোদের যাওয়া আসা।
কিন্তু যদি বেঁচে থাকি তুই কি থাকবি দূরে !
আমার যতেক স্বপ্ন আজও তোকেই খোকা ঘিরে।
আমার খোকন কষ্ট দিলে ভাবব জীবন ব্যর্থ,
বদলে যাবে তখন আমার বেঁচে থাকার অর্থ।
হয়ত তখন লাগব না আর সংসারের কাজে,
ভাবিস নে রে আমায় বোঝা বাকী সবার মাঝে।
থাকবে না আর শক্তি তখন হাত পা বুঝি কাঁপে,
শরীরটা মোর জীর্ণ হবে অসুখে উত্তাপে।
কাঁচের বাসন ছিল কেনা বাজার থেকে দামী,
কাঁপা হাতে হয়ত সে সব ধরতে গিয়ে আমি,
ফেলেই দিলেম মেঝের পরে–বাসন খানখান,
খোকা তখন করবি কি তুই আমায় অপমান !
তরকারীর বাটি ফেলে যদি রে করি নষ্ট,
তুই আমায় বকলে খোকা পাব ভীষণ কষ্ট।
চোখে তখন দেখব কম–যদি রে লাগে ধাক্কা,
থাকিস আমার পাশে পাশে–করিস আমায় রক্ষা।
বুড়ো বয়সে তোর কাছে পেলে রে অবহেলা,
সে কষ্ট পরপারেও যাবে না হায় ভোলা।
কানেও কম শুনতে পারি–কিন্তু খোকনসোনা,
বলিস না তুই অন্ধ কালা– পাব যে যন্ত্রণা।
ভাববি নাকি আমার জন্যে তোর যতেক জ্বালা !
প্রকৃতির নিয়মেই ত’ বুড়িয়ে যাওয়ার পালা।
কাঁপবে যখন আমার হাঁটু বইতে দেহের ভার,
চলবে না আর পা দুটি মোর কেবল রোগা হাড়।
পড়ে গেলে আমায় খোকন দিস বিছানায় তুলে,
তোর কাঁধেই ভরটি দিয়ে যাব রে হেঁটে চলে,
যেমন করে ছোটবেলায় হাতটি রেখে হাতে,
হাঁটতে তুই শিখেছিলিস খোকা আমার সাথে।
স্মৃতির খাতায় সেসব আছে সযতনেই তোলা,
বুড়ো বয়সে মানুষ ফিরে পায় যে ছোটবেলা।
বকবক করছি নাকি–করছি সময় নষ্ট !
অধৈর্য্য হোস নে খোকা–হোক না যতই কষ্ট।
মনে পড়ে তোর কি সেই ছেলেবেলার কথা !
খেলনা গাড়ি কেনার তরে আমার কানে ব্যাথা।
“গাড়ি কিনে দাও না আমায়”-দুচোখ ভরা জল,
হাতে পেলেই মুক্তো হাসি–ভুলতে পারি বল !
আমার গায়ের গন্ধটাকেও পারলে করিস ক্ষমা,
বুড়ো হলেই কেমন যেন গন্ধ দেহে জমা !
স্নান করার জন্য তুই করিস না জোরাজুরি,
শরীরটা যে তখন আমার রুগ্ন হবে ভারী,
সামান্য জল তাতেও বুঝি ঠাণ্ডা যাবে লেগে,
লক্ষ্মীসোনা আমার ওপর যাসনে রে তুই রেগে।
ছোটবেলায় তোরও ছিল বায়না অনর্গল,
স্নান করার সময় এলেই কতরকম ছল।
তোর পিছনে ছুটতে গিয়ে বেদম হতেম রোজ,
লুকিয়ে যেতিস খাটের নীচে–কতশতই খোঁজ।
বয়স হলেও এমনই হয়–জলকে করে ভয়,
তবে ছুটবো আমি কেমন করে–আমি ত’ ছোট নয়।
সারাদিন থাকবো যখন ঘরের মাঝে একা,
তোর সঙ্গে হয়ত খোকা হবে কমই দেখা,
তবুও যদি ছুটির দিনে বসে আমার পাশে,
একটু আধটু গল্প করিস–মনটা যাবে ভেসে।
জানি আমি তুই তখন ব্যস্ত নিজের কাজে,
বুড়ো হওয়ার গল্প তোর লাগতে পারে বাজে।
ছেলেবেলার কথা তখন ভাবিস আমার খোকা,
একই গল্প শোনার তরে কি জেদ ছিল বোকা।
বলতে হতো রোজই আমায় ক্ষীর পুতুলের গল্প,
ভুলিস না রে সেসব কথা–নয় কিছুই কল্প।
হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার আওয়াজ শুনে শুনে,
তালাই বুঝি লেগেছিল আমার খোকার কানে।
বুড়ো হলেও যে সব স্মৃতি যাবে না কভু ভোলা !
তখন জানবি আমায় তোর গল্প বলার পালা।
হয়ত সেদিন আসবে যেদিন হবো শয্যাশায়ী,
তার জন্যে আমায় তুই করিস না রে দায়ী।
চাদরখানা যাবে ভিজে–নোংরা হতে পারে,
জীবনের ধর্ম ভেবে ক্ষমা করিস মোরে।
শেষ সময়ে আমায় ছেড়ে থাকিস না তুই দূরে,
মোর হাতটা তোর মুঠিতে রাখিস খোকা ভরে।
শ্যাম সমান মরণকে যেন নির্ভয়েতেই আমি
আলিঙ্গন করতে পারি–তোর সাহসই দামী।
তিন ভুবনের স্রষ্টা সাথে হবে যখন দেখা,
তোর নামটি বলবো তাঁরে কথা দিলেম খোকা।
ফিসফিসিয়ে বলবো আমি ভগবানের কানে,
মঙ্গলময় করো শুভ মোর খোকনের সনে।
যত্ন আমায় করেছিলিস–বেসেছিলিস ভাল,
তোর জীবনে যেন তিনি জ্বালান অনেক আলো।
অপার স্নেহ করি তোরে ভালো থাকিস খোকা,
সন্তানের মাঝেই ধরায় মায়ের বেঁচে থাকা।
মোর ইষ্টে ডাকি আমি সকাল থেকে রাতে,
আমার খোকা যেন থাকে সদাই দুধে ভাতে।
আর্তি
Subscribe
Login
0 Comments
Oldest