সকালে উঠেই আজ রাজকিশোরবাবু কাঁপাকাঁপা হাতে তাঁর BOLSEY C22 ক্যামেরাটা তুলে নিলেন।আজকের তারিখটা বড়ই বেদনাদায়ক, 20 বছর আগের এই দিনটায় মন চলে যায়।কত বছর আগের এই world photography day তে স্ত্রী রমলাকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন নিজের স্ত্রীর কিছু একক ফটো তুলতে, হবে নাই বা কেন রাজ্কিশোর বাবুর জীবনের দুটি ভালোলাগার মধ্যে এটি একটি, অপর টি তার স্ত্রী।আর রমলাদেবীর ও বড়ই শখ ছিল একক ফটো তোলানোর। তাদের প্রথম দেখাও তো এরকম এক world photography day তেই । তো সেই ২০ বছর আগে স্ত্রী কে নিয়ে বেরিয়েছিলেন ময়দানের রাস্তাতে রাজি ছিলেন না কিশোর বাবু নিজেই কারন রমলার হার্টের সমস্যা বেড়েই উঠছে।কিন্ত এই দিনটার গুরুত্ব একজন ফটোগ্রাফার এর কাছে অনেকটা আলাদা।তাই স্ত্রীর আব্দার মত একটা ট্রামকে ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে ফটো তুলতে শুরু করেছিলেন তিনিঽ কিন্ত ভাবতে পারেননি যে এই ছবি তার জীবনের শেষ ছবি হবে। সেদিন হঠাৎ দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকটাই ওনার জীবনের ধারাটাই পাল্টে দিল,এরপর থেকে আর কোনোদিন আর ফটো তোলেননি উনি।
এরপর নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। তার একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়েছেন তার অমতে আনা এক অন্য জাতের মেয়ের সাথে।তার মেনে না নেয়ার কথা জানতে পেরে বউমা একমাসের মধ্যেই স্বামীকে নিয়ে মানিকতলার পুরানো বাড়ি ছেড়ে সাউথ কলকাতা তে ফ্লাটে বসবাস শুরু করে।ছেলে আগে আসত মাঝে মাঝে যতদিন কিশোরবাবুর চাকরি ছিল কিন্ত সেটাও হয়ে গেল প্রায় ৫ বছর আগের কথা। এখ্ন পাশের বাড়ির বখাটে ছেলে রাজুর স্ত্রী তাকে ভাত দেয় রোজ ।পেনশনের কটা টাকায় কোনরকমে চলে যায় তার । লোকমুখে শুনেছিলেন তার নাকি এক ফুটফুটে নাতি হয়েছে। মুখ যদিও দেখেননি তবু পুরানো ক্যালেন্ডার দাগ দেখে বুঝ্তে পারেন তার নাতি প্রায় কিশোর বয়সে পা রেখেছে। পাশের বাড়ির রাজু নাকি তার নাতিকে চেনে। তার ছেলের ফটোর নেশা না থাকলেও তার নাতির নাকি খুব শখ। এই দিকে নাকি বেশ কয়েক বার এসেছিলো street photography করতে। শুনে মনে মনে তিনি বেশ আনন্দ পান ।
আজ ১৯ শে আগষ্ট, আবার এক world photography day, ক্যামেরাটা খুঁজতে বেশ বেগ পেতে হল। সামনে পুরানো (antique) জিনিস বিক্রির দোকানটায় নিয়ে যেতে হবে এটাকে বিক্রি করতে নয়তো পরের মাসের সুগার এর ওষুধটা কেনা যাবে না, তাই সকালবেলা এটাকে নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা।|দোকানটায় একটু ফাঁকা দেখে ঢুকতে হবে কারণ এখন আর বেশিক্ষন দাড়িয়ে থাকার ক্ষমতা নেই।
কোনোরকমে দোকানে এসে দেখলেন ভিড় বেশ কম । দোকানদার কে ক্যামেরা তা দেখাতেই বুঝে নিলেন এটার antique value কত হতে পারে, তবু মনের ভাব প্রকাশ না করেই অনেক কম দামেই কিনে নিলেন। বাড়ি ফিরে এসে কিশোর বাবু মনমরা হয়ে বসে বসে ক্যামেরাটার সমস্ত স্মৃতিরোমন্তন করতে লাগলেন । হঠাৎ তার ধ্যান ভাঙল যখন দুপুরবেলা রাজু এসে বলল তার জন্য বাইরে সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। বাইরে এসে দেখলেন একটা ফিয়াট গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, যেটা তার এককালের স্বপ্ন ছিল। রাজু তাকে টেনে গাড়িতে ওঠালেন, আর তিনিও রাজুর ওপর বিশ্বাসে গাড়িতে উঠলেন্। বেশ জোরেই চল্ছিল গাড়ি, বছর আঠারোর একটা ছেলে চালাচ্ছে গাড়িটা। হঠাৎ দেখলেন সামনের সিটে একটা নরম তোয়ালের ওপর রাখা তার সদ্য বিক্রিত ক্যামেরা, আশ্চর্যের অন্ত রইল না। চশমাটা ঠিক করে rear view mirror এ দেখলেন গাড়ি চালাচ্ছে তারই ছেলের মুখাবয়বের আদলে একটি ছেলে। বাকিটা বুঝ্তে বাকি রইল না কিশোর বাবুর। সারাজিবন ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রাখা মানুষের এত বড় ভুল হতে পারে না।
সাউথ ক্যালকাটার এক আবাসনের সামনে এসে দাড়াল গাড়িটা। সামনে পুত্রবধুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে তার একমাত্র ছেলে। রাজু ফিকফিক করে হাসছে। কিশোরবাবু বুঝে ফেললেন মেঘের পিছনে থেকে পরিকল্পনাটা কার । নাতি গৌরকিশোরের হাতে উঠে এল নতুন কেনা CANON 200D। সেটা রাজকিশোরবাবুর হাতে দিয়ে গৌর তার অ্যাসিস্টান্ট রাজু কে নির্দেশ দিল মাকে মেকাপটা ঠিকভাবে করে দিতে। মেকাপের শেষে পুত্রবধু কিশোরবাবুকে বললেন ” HAPPY WORLD PHOTGRAPHY DAY, শ্বাশুড়িমার মত আমার ও একটা একক ফটো তুলে দেবেন ?” অজানা এক কারণে জল মুছে চোখ রাখলেন ভিউফাইন্ডারে, তুললেন এক অপূর্ব ছবি যা মুগ্ধ করে দিল তার international level এ photography award পাওয়া নাতিকেও। কান্না জড়ানো গলায় উচ্চস্বরে বলে উঠলেন “HAPPY WORLD PHOTOGRAPHY DAY”……….