নেপালে ধুনছের হোটেলে এক প্রচন্ড শীতের রাতে ডিনার টেবিলে আমার সঙ্গে আলোচনারত মার্কিন ললনা সারা। কাঞ্ছা রাতের খাবার নিয়ে এলো। পিতলের থালা-বাটি সাজিয়ে ভাত, আচার,পেঁয়াজ , লেবু, ডাল, আলু-কপির সবজি, মুরগির মাংস। সারার জন্য চামচ এলেও সে তা পশে রেখে বললো, “লেট মি ট্রাই,” আমার দেখাদেখি সেও হাত দিয়ে খাবে ঠিক করেছে।
অনেকবছর আগেকার একটা ঘটনা মনে পরে গেলো। বন্ধুরা মিলে দার্জিলিং যাচ্ছি, কাঞ্চনজঙ্ঘা বেশ ক ঘন্টা লেট, শিলিগুড়ি পৌঁছতেই বেশ রাত হয়ে গেলো । ৮০র গোড়ায় শিলিগুড়িতে এতো হোটেলের ছড়াছড়ি ছিল না। ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডায় রাস্তা এমনিতেই সুনসান কাছেপিঠে বাজারের মধ্যে অতি সাধারণ মানের একটা হোটেল খোলা পেলাম । একেই লম্বা ট্রেন সফর তার মধ্যে হোটেলের খোঁজে এদিক সেদিক হাঁটাহাঁটি সব মিলিয়ে ক্ষিদে অত্যন্ত জোরালো।
তেলচিটে কালো বেঞ্চেই বসে পড়লাম, আগে পেটপুরে খেতে হবে। পাশে ৩-৪ স্থানীয় ব্যক্তি খাচ্ছিলেন তাদের মধ্যে দু এক জন আমাদের সঙ্গে নৈমিত্তিক কিছু কথাও বললেন। তখন বয়স অনেক কম,আমাদের পুরো মনসংযোগ ভাতের থালায়। নিমেষে ভাত, ডাল, ভাজা উড়ে গেল। আবার ভাত এলো সঙ্গে মাংস। মাংসের গন্ধে খিদেও যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল । কিন্তু একি মাংস-ভাত কয়েক গাল খেয়েই আমরা একে-ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি। গেলাসের পর গেলাস জল শেষ, পাশের লোকেরা কেউ বলে চিনি, কেউ বলে কাঁচা পেঁয়াজ খান। জিভে যেন অগ্নিবাণ বিঁধেছে।
কুকুরের মতো ঝিভ বের করে আমরা সকলে বসে । অবশেষে হোটেলের মালিকের করুণ স্বীকারোক্তি, উড়ে বাউনের আজ কোথায় যাবার তাড়া ছিল চট্জলদিতে মাংসোয় দুবার ঝাল দিয়ে ফেলেছে। আমার এই ঘটনা শুনে সারার মুখে হাঁসি, মুখে জমা কালো মেঘ খানিকটা পরিষ্কার হল।
সারা এক বোতল বিয়ার শেষ করে দ্বিতীয় বোতল থেকে গ্লাসে ঢালতে ঢালতে জানালো নেপালি খানা তার বেশ মনে ধরেছে। জিজ্ঞেস করলো আমি এগুলো রাঁধতে পারি নাকি?
বললাম, “রান্না করতে আমার ভালোই লাগে মাঝেসাঝে নেপালি পদও রাঁধি ।”
“পারেন! আমাকে বানানোর প্রণালী বলবেন,”
“বোলবো তার আগেই একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল, শুনবেন?”
“নিশ্চই, বলুন,”
আমার কলকাতার গল্প, বাবা-মায়ের বড়ো সাধ ছিলো একমাত্র ছেলে গণেশ লেখাপড়া শিখে তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। মেধাবী গনেশ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিদেশে চাকরি পেল। বাবা -মা সারাজীবন অনেক কষ্ট করেছেন। কোনরকম ব্যক্তিগত বিনোদনে অর্থব্যায় না করে গনেশের শিক্ষায় অর্থ জুগিয়েছেন । আজ তার কাছে, বাড়ি, গাড়ি আরো কত সুবিধে। খুব ইচ্ছে বাবা মা তার সঙ্গে এসে থাকুক। বিদেশে বাবার প্রেসার, সুগার ও মায়ের কম শোনার কত উন্নত চিকিৎসার সুবিধে অথচ পুরোনো জীর্ণ উত্তর কলকাতার ভিটে ছেড়ে তেনারা কোথাও নড়বেন না।
গনেশের দুঃখের কথা জেনে তার সহকর্মী এক ডাক্তারের সন্ধান দিলেন যিনি মানুষের বয়স কমানো নিয়ে গবেষণা করছেন। গণেশ ভাবলো বয়স কমলে হয়তো বাবা-মার মতের পরিবর্তন হতে পারে। সাক্ষাতে ডাক্তার জানালেন জন্তুর ওপর তার ওষুধ সফল। এখনো মানুষের ওপর পরীক্ষা হয় নি। সব শুনে উনি গণেশকে ওষুধ দিয়ে বললেন সপ্তাহে একটা মাত্র ট্যাবলেট, কতটা বয়স কমলো বুঝে পরের সপ্তাহে দ্বিতীয়টা। গনেশও বাবাকে চিঠিতে সব বুঝিয়ে ওষুধ কলকাতার বাড়িতে পাঠিয়ে দিল।
বছর চারেক পরে কলকাতা ফিরলো গণেশ। বিমানবন্দরে বাবাকে দূর থেকে দেখেই হতাশ গণেশ একি বাবাতো আরো যেন আরো বুড়িয়ে গেছে। তাহলে কি মানুষের ওপরে ওষুধ বিপরীত কাজ করে ? খানিকটা কাছে যেতে দেখলো বাবা একটা ৪/৫ বছরের মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গণেশের আর বুজতে বাকি রইলো না ওষুধের অপচয়টা কোথায় হয়েছে।
“কিরে গনেশ কেমন আছিস?” ওই একরত্তি মেয়ের মুখে ‘তুই’ শুনে গনেশের কান মাথা গরম।
কোনো কথা না বলে বাইরে এসে ট্যাক্সিতে বসে বাবাকে ঝাঁজালো সুরে বললো, “এই বয়সে মেয়ের শখ মেটাতে কি ওষুধ পাঠিয়েছিলাম?”
বাবা হতাশা চেপে রাখতে না পেরে বলেন, “বুড়ো বয়োসে আমার হয়েছে যত জালা, যেদিন ওই ওষুধটা এল তোর মাকে শিশিটা দেখিয়ে বললাম কাল সকালে দুজনে এই বয়স কমানোর ওষুধ খাবো। তোর কালা মা শুধু ঘাড় নাড়লো। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলো একটা বাচ্ছার কান্নায়। কার বাচ্ছা ? ঘরেই বা এলো কি করে? তোর মাকে ডেকেও সাড়া পাচ্ছি না। এঘর সেঘর বারান্দা কোথাও তাকে খুঁজেও পেলাম না। বাচ্চাটাকে নিয়ে কি করবো ভাবছি হঠাৎ টেবিলে চোখ যেতে দেখি ওষুধের সিসি খালি। সব ট্যাবলেট খেয়ে তোর মার এই দশা। তোকে পড়িয়ে ইঞ্জিনিয়ার করলাম এখন তোর মাকে কিন্টারগার্ডেনে ভর্তি করেছি। ”
আমার গল্প শেষ হলেও সারার মুখ চেপে হাসি থামতে চায় না। মানুষকে প্রাণ খুলে হাঁসাতে পারলে এক অদ্ভুত তৃপ্তি অন্তরকে স্পর্শ করে। কখনো এটা উপলব্ধি করেছেন? সেই রাতে প্রথম এই সরল সত্যটা বুজতে পারলাম।
শেখার ব্যাপারে সারা কতটা সিরিয়াস একটু পরেই বুঝলাম । প্রতিটা নেপালী পদ খুঁটিয়ে জেনে হাতব্যাগের ছোট নোটবইয়ে টুকে নিলো। রেসিপি বলতে গিয়ে আবার অন্য এক বিপদ। আমরা রান্না করি হাত, চোখ, স্বাদের আন্দাজে। ব্যঞ্জন পুরো রান্না ও সুস্বাদু হওয়া চাই, একি কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরী যে সব মেপে মেপে দিতে হবে? সারা চায় প্রতিটা রান্নায় মশলা, সবজি ইত্যাদির পুংখানু পুঙ্খ মাপ। আন্দাজে মাপ কে মাফ কোরো বলে ম্যানেজ করে দিলাম।
পাহাড়ে দিন শুরু হয় কাক ভোরে রাত সাড়ে নটা মানে মধ্য রাত্রী । ইতিমধ্যে দু জন কাঞ্ছা ডিইনিংরুম সাফ করতে লেগে গেছে । সারা বললো, “ওরা কি আমাদের ঘরে চলে যেতে বলছে?”
বললাম, “না। ওরা কাজ শেষ করে ঘুমোতে যাবে। কিছু লাগলে এখনই অর্ডার করুন নচেৎ কাল সকাল। ডাইনিং হলে যতক্ষণ ইচ্ছে থাকতে পারেন।”
পাশের দুটো টেবিলে এখন হৈচৈ অনেক কম, কয়েকটা চেয়ার খালি কারণ জনাকয়েক সদস্য বিছানা নিয়েছে ক্লান্তিতে ।
সারা সিগারেট ধরালো, এতক্ষন যা একবারও দেখি নি, একটু অবাক হয়ে বলি, “আপনি সিগারেট খান জানতাম না?”
মুচকি হেঁসে, “ডিনারের পরে ১/২ খাই বা কখনো খুব টেনশনও, কেন আপনার অপছন্দ?”
“নো প্রবলেম।”
“আচ্ছা আপনি জানতে চান না কেন এদেশে এলাম?”
“আপনার বলতে অসুবিধে না হলে নিশ্চই শুনব ।”
কয়েক মুহূর্ত জানালার বাইরের জমাট অন্ধকারের দিকে সে তাকিয়ে রইলো। বোধহয় কোথা থেকে শুরু করবে তাই বিবেচনা করছে।
“এক ভয়ঙ্কর পথ দুর্ঘটনায় বাবা-মাকে হারাবার পর দাদু-দিদাই আমাকে মানুষ করেছেন। তারা যেমন স্নেহশীল তেমনই সুশৃঙ্খল। নিয়মনিষ্টতার সাথে তারা শিখিয়েছেন মানুষকে ভালোবাসতে তাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে । নার্সিংএ স্নাতক হয়েই নার্সিংহোমে চাকরি পেলাম, নিজের গাড়ি হলো। সেবছর ক্রিষ্টমাসে দাদু-দিদাকে সঙ্গে করে অনেক কিছু কিনলাম, পরিপূর্ণ আনন্দে শীতের দিনগুলো কেটে গেলো ।
বসন্তে হঠাৎ দাদুর উদরে ব্যাথা শুরু হল প্রথমে ভাবলাম বুঝি বদহজম l কদিনে না কমাতে জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার পরীক্ষা করে উদর বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠালেন, তারপরে নানা পরীক্ষার। আমার পায়ের তোলার জমি নড়ে উঠলো যখন জানলাম মালিগনান্সি অ্যাডভান্সড স্টেজে। কোনই আশা নেই, আর মাত্র দুমাস অবশিষ্ট । দেড় মাসের মাথায় দাদু চলে গেলেন, তার তিন মাস পরে দিদিমা একদিন ঘুম থেকে আর উঠলেনই না। দুজন আমার অতি ভালোবাসার মানুষ আমাকে একা রেখে চলে গেলেন। আমার একঘেয়ে গল্প শুনে বোর হচ্ছেন ?”
বললাম “প্লিজ বলে যান।”
বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিয়ে সারা বলল, “যখন জীবনের অবলম্বন খুঁজছি ঠিক সেই সময় পলের সঙ্গে আমার আলাপ। প্রথমে তেমন গুরুত্ব না দিলেও ক্রমশ সে আমার জীবনে একটা অঙ্গ হয়ে উঠতে লাগলো। আমরা দেখা করতাম, গধূলি বেলায় পার্কে হাঁটতাম, রেস্তোরাঁয় ডিনার, গল্পে বেশ সময় কেটে যেত ওর সঙ্গে । ইতিমধ্যে পল একটা অন্ধদের স্কুলে ব্রেইল শেখাবার চাকরিও পেলো।
সেদিন ভ্যালেন্টাইন্স ডে, সক্কালবেলায় পলের ফোন, শুভেচ্ছা বার্তা জানাতে নয়, ভীষণ অসুস্থ আমাকে এক্ষুনি দরকার। বুঝলাম ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে । আমার স্টেথো, ব্যাথা-জ্বরের ওষুধের সঙ্গে গোটাকতক আস্পিরিন নিয়ে পড়ি কি মরি করে দৌড়লাম পলের এপার্টমেন্টে। কি জানি কি বাধিয়ে বসে আছে ?”
“শেষে কি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলো? নিমুনিয়া?” আমার মুখের থেকে কথা গুলো বেরিয়ে গেল।
মাথা নেড়ে সারা বলতে থাকলো, “পল গাড়ি চালাতে পারতো না অনেকবারই ওকে লিফ্ট দিয়েছি ওর এপার্টমেন্টের গেট পর্যন্ত। একাই থাকে, এক দূরসম্পর্কের ভাই শুনেছি মাঝে মাঝে আসে । যাইহোক প্রথমবার ওর এপার্টমেন্টে পৌঁছে, দরজায় টোকা দিলাম, কোনো শব্দ নেই। হাতল ঘোরাতেই দরজা খুলে গেলো। ভিতরে অন্ধকার গাছম্ছমে নিস্তব্ধতা, পলের নাম ধরে ডাকলাম কোনো সাড়া নেই।
ভিতরের অন্ধকারে চোখ সামান্য সইতে লাইটের সুইচ খুঁজে আলো জ্বালালাম। দেখলাম আমি ছোট্ট বসার ঘরে দাড়িয়ে, সামান্য এগোলেই একদিকে শোবার ঘর অন্য দিকে বাথরুম ও রান্নাঘর। বেডরুমের দরজা ভেজানো ছিল আমার হাতের সামান্য ঠেলাতেই তা খুলে গেলো। ঘরের একমাত্র জানলাটা মোটা পর্দায় ঢাকা, বাইরের দিনের আলো না ঢুকে তাই অন্ধকারাছন্ন। পর্দাটা সামান্য সরাতেই ঘর আলোর বন্যায় ভরে গেল।
খাটে পল ঘুমোচ্ছে সারা শরীর মুখ পর্যন্ত চাদরে ঢাকা, মাথার তলায় অন্ততঃ তিনটে বালিশ । পরীক্ষা শুরু করলাম, স্টেথোতে হার্ট, ফুসফুসের আওয়াজ স্বাভাবিক শোনালো। কপালে হাত দিয়ে জ্বর মনে হলো না। অবাক হলাম আমার উপস্থিতি, স্টেথোর স্পর্শেও পলের ঘুম ভাঙলো না। আমি চিন্তিত, ভাবছি কি করি ?হাসপাতালে ফোন করবো ?
হঠাৎ শুনলাম ফিস ফিস করে পল বলছে ‘আমি বড়ো একা, তুমি কি হবে আমার চিরসাথী’ চাদরের তলা থেকে একটা হাত বাড়ানো তাতে ধরা একটা লাল গোলাপ। পলের মুখে দুষ্টুমির হাসি। সেসময় আমার এলোপাথাড়ি হাত চালানোয় পলের কোথায় লেগেছিলো জানি না শুধু মনে আছে ওর হাত থেকে গোলাপটা নিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ চুম্বনে আবদ্ধ হয়েছিলাম।” স্মৃতিচারন করতে করতে সারার চোখমুখে খেলে গেল এক অদ্ভত আনন্দের ঝিলিক।
বাকিটা পরের পর্বে…………..