আজ ২৫শে বৈশাখ…

বাঙালীর তথা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক ভাগ্য পরিবর্তনকারী দিন। আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে এক মহাপুরুষ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন যিনি তার একক চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি করেছেন বাংলা সাহিত্যের রত্নপারাবার। যদিও বাংলা ভাষার জনক হিসেবে পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কেই আমরা স্মরণ করি, তবুও সেই ভাষাকে বিশ্বদরবারে যিনি পৌঁছে দিয়েছেন সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের কাছে আলাদা গর্বের বিষয়। আজ তার পূণ্য জন্মলগ্নে আমরা তার সৃষ্টি কে বারংবার স্মরণ করে তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পন করি।আজ সারাদিন নানা সমারোহে আমাদের কবিপ্রনাম অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে রাজ্যজুড়ে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন………

TV তে খবর শুনতে শুনতে কখন চোখ লেগে গিয়েছিল অমল টের পায়নি।হঠাৎ কার কন্ঠে তার চোখ খুলে গেল।

কি ভাবিতেছ অমল? আমার কথা?  

আরে! ঠাকুর আপনি! অমল নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তার সামনে স্বয়ং রবিঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন।

কি হইল অমল, ইহাতে অত্যাশ্চর্য হইতেছ কেন? তোমার অন্তরে যে প্রশ্নরাশি পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিতেছে তাহার নিবারন হেতু তোমার নিকট আসিয়াছি বত্স।তুমি অন্তরে অন্তরে যে আমার কথা দিনরাত ভাব তাহা আমি জানি।তুমি আমার মত হইতে চাহ, আমার পথ অনুসরন করিতে চাহ।

হ্যাঁ ঠাকুর। আমি ভেবে পাইনা তোমার মধ্যে কি এমন ক্ষমতা ছিল যে তুমি অনায়াসে একা বাংলা সাহিত্যের এই মহাসম্ভার গড়েছিলে। তোমার মত আর কেউ যা পারেনি, আর কেউ পারবে না। তোমাকে কে এরকম করে ভাবতে শিখিয়েছিল, কে তোমাকে অনুপ্রেরনা জুগিয়েছিল? কিসের জন্য তুমি এত সব করলে সারাজীবন ধরে? যাতে সবাই তোমাকে চিরদিন মনে রাখে।তোমার গান গায়, তোমার কবিতা পড়ে, তোমার জন্মদিন-মৃত্যুদিন পালন করে।

তুমি ভুল ভাবিতেছ অমল। আমাকে কেহ লিখিতে বলে নাই, আমি যা কিছু করিয়াছি মনের আনন্দে, বাংলা ভাষার প্রতি অমোঘ টানে। আমি যেদিন প্রথম লিখিয়াছিলাম “ জল পড়ে পাতা নড়ে…” সেদিন ত আমি ভাবি নাই যে তোমারা আমারে লইয়া এইরূপ আহ্লাদিপনা করিবে। ভগবান আমারে যেটুকু দিয়াছেন আমি সেটুকু তোমাদের বিতরণ করিয়াছি আমার গানে গানে, গল্পে, কবিতায়। আমি কোনদিন নোবেল পাইবার আশায় এইসব করি নাই।

সেটা ত ঠিক। ভালোবাসা না থাকলে ত কেউ সৃষ্টি করতে পারে না। তবে জান ত ঠাকুর আমিও না শুধু লিখে যেতে চাই। যা আমার মন চায়, কেউ বুঝুক না বুঝুক আমি আমার মনের ভাবকে প্রকাশ করতে চাই আমার লেখার মধ্যে দিয়ে। আমি বিশেষ কিছু সাহিত্য চর্চা করিনি।কিছু বই পড়েছি।ব্যাস্‌, এইটুকুই। কতটা বুঝেছি জানি না। কিভাবে লিখতে হয় তাও জানিনা। তবু আমার ইচ্ছে করে তোমার মত অনেক অনেক লিখতে, সারাজীবন ধরে লিখতে। তোমার মত হতে চাওয়া কি আমার ধৃষ্টতা?

না,না, মোটেই তাহা নহে। তুমি যদি আমার রচনায় সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত হও তাহা হইলে আমার রচনা সার্থক। তবে মনে রাখিবে কাউকে অনুসরন করা ভাল কথা, তবে অনুকরন করা মোটেও ভাল কাজ নয়। এই যে তুমি বলিলে নিজের মনের কথা লিখিতে চাহ, ইহাই সর্বোত্তম। নিজের মত হও। কবির সৃষ্টির গৌরব তাহার সৃষ্টির মধ্যে, দশজনের সম্মতিতে নয়। দশজনে যদি প্রশংসা না করে তবে বাজারে মূল্য হয় না কিন্তু সৃষ্টি কোনদিন মূল্যহীন হয় না।

আজকাল ত তোমার লেখা নিয়ে নানারকম প্রয়োগ চলছে। যে যা খুশী অনুকরন করছে, তোমার গানে নতুন সুর প্রয়োগ হচ্ছে, নতুন কথা যোগ হচ্ছে। এতে তোমার দুঃখ হয় না? মনে হয় না তোমার সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে?

হাঃ,হাঃ।তুমি মোরে হাসাইলা। সৃষ্টি কি কেহ বিনাশ করিতে পারে। লোকে আমার লেখা অনুকরন করিতেছে তা তাহাদের স্বল্পতা, তাহাদের অক্ষমতা। অপরপক্ষে যদি জনগন ইহাকে মানিয়া লয়, প্রশ্রয় দেয় তাহা সময়ের দোষমাত্র। তাহলে ঘটা করিয়া আমার জম্নদিন পালন করা অনর্থক, কালের নিয়মে আমার লেখা আজ অচল। ইহা দুঃখের কারন হইতে পারে তবে আনন্দের বিষয় যে তোমার মত আমার অনুরাগীর সংখ্যা নিতান্ত কম নহে। তোমাদের মধ্যে আমি বাঁচিয়া থাকিব।

আচ্ছা কবিগুরু, তুমি যদি আজকের কলকাতায় থাকতে তাহলে এমন সুন্দর সুন্দর লেখা লিখতে পারতে? আজকের দিনে কলকাতায় শুধু ছোটাছুটি হয়, ভোটাভুটি হয় কিন্তু সাহিত্য-সাধনা হয় না। ফি বছর বইমেলা হয়, তাতে লোকের সমাগম প্রচুর হয়, কিন্তু নতুন সাহিত্যিক কজন স্থান পায়, কজন নতুন লেখা প্রকাশ করে! চারিদিকে শুধু ইঁট-কাঠ-পাথরের জঙ্গল, বিষাক্ত বাতাস, আর শশব্যস্ত মানুষ-যানবাহন। এর মধ্যে সাহিত্যে মননিবেশ করা দূর্বাষামুনির ধ্যান করার সামিল। আর যদিও বা লেখা যায় তা পড়ার লোক কোথায়? মানুষের হাতে আজ বই পড়ার থেকে কম্প্যুটার গেম অনেক বেশী আকর্ষনীয়। তাই মনের দুঃখে চলে গিয়েছিলাম তোমার শান্তিনিকেতনে। ভেবেছিলাম এখানে নিরিবিলিতে সাহিত্যচর্চা করা যাবে।কিন্তু কি মুশকিল এখানেও যে বিষ বাতাস প্রবেশ করেছে।আজকালকার সব ছেলেমেয়েরা যারা সেখানে পড়াশুনা করছে তাদের কলাবিদ্যার প্রতি অনুরাগ যথেষ্ট সন্দেহজনক। নতুন কিছু সৃষ্টি করার মনোবাসনা চোখে কম পড়ে। আর বসন্ত উৎসব, পৌষমেলা, তোমার জন্মদিন-মৃত্যুদিন এসব নিয়ে বছরভর শোরগোল লেগেই আছে। শান্তিনিকেতনের ‘শান্তি’ বিলুপ্তপ্রায় হতে চলেছে। তোমার সাজান সংসার সব ভেঙে দিল যে!

আহা!একি কথা শুনিলাম তোমার মুখে! আমার সাধের শান্তিনিকেতন হারাইয়া যাইতে বসিয়াছে। আমার প্রানরসে সিঞ্চিত কলামন্দির তোমরা নষ্ট করিও না। তোমরা আমার স্মৃতিচিহ্নগুলি যেমন সযত্নে সংরক্ষিত করিতেছ, সেইরুপ আমার শান্তিনিকেতনের স্বরুপকেও রক্ষা করিবে এই আমার বিশ্বাস। আর অমল আমার ‘খোয়াই’ জায়গাটি দেখিয়াছ? কি অপরূপ সুন্দর! সেখানে তরুচ্ছায়াতলে বসিয়া আমার কত রচনা সার্থক হইয়াছে।    

আর কি বলব কবিগুরু! বলতে লজ্জা হয়। তোমার অমন সুন্দর ‘খোয়াই’ দিনদিন অপকর্মের আড্ডা হয়ে উঠেছে। ছেলেমেয়েরা ওখানে গিয়ে যা নয় তাই করছে। সাহিত্যচর্চা তো দূরস্থান, ভদ্রভাবে কেউ সেখানে যাতায়াত করতে লজ্জাবোধ করবে।

আঃ বুকে বড়ই বেদনা সঞ্চারিত করিতেছে তোমার কথা। আমার শান্তিনিকেতন লইয়া তোমরা ছেলেখেলা করিতেছ। বুঝিয়াছি আজ ইহার কোন প্রয়োজন নাই। মানুষের মনে যেমন সুকুমার দিকগুলি হারাইয়া যাইতে বসিয়াছে সেইরূপ আমার স্বপ্নভূমি বহিঃজগতের আক্রমনে তার নিজস্ব সত্তাকে হারাইতে বসিয়াছে। তোমরা বৃথা আমারে লইয়া হইচই করিতেছ। আমারে তোমরা ছাড়িয়া দাও। তোমরা নিজেদের মত করিয়া পুনরায় গড়িয়া লও। ইহাতেই তোমাদের মঙ্গল।

ঠাকুর তুমি কি জান তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার ‘নোবেল’ চুরি হয়ে গেছে? আমরা তোমার এই সম্মানটুকু পর্যন্ত্য রক্ষা করতে পারিনি। লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে।

ইহা বাঙালীর দুঃখের কারন অবশ্য, আমার নহে। আমার রচনার বিশ্বস্বীকৃতি এই পুরষ্কার এবং বাংলা ভাষার জয়ধ্বনি উচ্চারিত হয় ইহার মধ্যে। ইহা আমার সম্পত্তি নয়, আমার সোনার বাংলার মানুষদের, আমার ভারতবর্ষের মানুষদের। ইহার রক্ষ্মনাবেক্ষনের দায়িত্ব তাহাদের। ইহা অপেক্ষা আমার সৃষ্টিকে আগলাইয়া রাখা অত্যন্ত কঠিন কাজ। সেইটে তোমরা মনোযোগ সহকারে কর, ইহাতে আমি খুশী হইব।

হে কবিগুরু, এবার নিতান্ত আমার ব্যক্তিগত বাস্তবিক সমস্যার কথা তোমায় বলি। আমি এক সাধারন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, চাকুরিজীবি, সদ্য বিবাহিত। আমার সংসারের অনেক দায়িত্ব, দৈনন্দিন জীবনযাপনের নানা সংঘর্ষ। তাই এরমধ্যে সাহিত্যচর্চা এক ছেলেমানুষী আবদার। এতে আমার ভবিষৎ সঙ্কটে পরতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে আমার লেখার প্রতি এক অদৃশ্য টান আমার মানসিক শান্তি বিঘ্নিত করে। তার মাঝখানে কোন উপায় ঠিক খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি যদি কোন সাহায্য করতে পার।

দেখ অমল, ইহা তোমার নিতান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা বটে। ইহাতে আমার সাহায্যের হাত কতখানি জানিনা। তবে তোমার কথা শুনিয়া মনে হইতেছে তুমি দোটানায় পড়িয়াছ, একদিকে তোমার সংসার, তোমার বাস্তবিক জীবন অন্যদিকে তোমার কল্পনার জগৎ, তোমার মানসিক শান্তি। আমাকে তো আর দশটা-পাঁচটা আপিস করিতে হয় নাই, অথবা বাজারের ব্যাগ লইয়া নিত্য দরদাম করিতে হয় নাই। তাহা হইলে আজ আমি কোনখানে থাকিতাম তাহা জানিনা। জীবন সংঘর্ষ মানুষের স্বপ্নকে কাড়িয়া লয়, তাহার ভবিষৎ কে একখাত হইতে অন্যখাতে লইয়া যায়। তোমার ভবিষ্যৎ তোমাকেই স্থির করিতে হইবে। তবে শুধু এইটুকু বলিতে পারি সংসারের স্রোতে নিজেকে ভাষাইয়া না দিয়া নিজের মত করিয়া বাঁচিবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে পার। তাহাতে দুঃখ আসিতে পারে তবে  যে অপরিসীম আনন্দ পাইতে পার তাহা খুব অল্পজনেই পারে। আমার আশীর্বাদ সদাই তোমার সঙ্গে রইল।

তোমার আশীর্বাদ সঙ্গে থাকলে অবশ্যই কিছু হবে। তবে আজ আর শুধু বাংলা ভাষার জোড়ে কতদূর যাওয়া যাবে খুব সন্দেহ হয়। চারিদিকে ইংরেজী সাহিত্যের জয়জয়কার। ইংরেজীতে না লিখলে best  seller হওয়ার উপায় কোথায়? যে কোন আঞ্চলিক ভাষার প্রসার খুব কম। তাই তার ব্যাবসা কম,আমদানি কম,প্রচার কম। সর্বভারতীয় স্তরে তথা বিশ্ববাজারে পৌঁছতে হলে একমাত্র মাধ্যম সাহেবদের ভাষা। ঠাকুর তুমিও যদি সাহেবদের ভাষায় তোমার ‘গীতাঞ্জলি’ অনুবাদ না করতে তা হলে তোমায় ওরা ‘নোবেল’ দিত?

‘নোবেল’ না পাইলে সব বৃথা তাহা কেহ বলে নাই। ‘রামায়ণ-মহাভারত’ নোবেল পাইয়াছিল বুঝি? সৃষ্টির কোন তুলনা হয় না। আপন মনরসে সিঞ্চিত সাহিত্যের স্বীকৃতি একদিন মিলিবেই এই বিশ্বাস রাখা অতি আবশ্যক।

…কিগো ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?

স্ত্রীর ডাকে অমলের জাগরণ ঘটে। যাও বাজারটা করতে হবে তো।

 

~ রবিপ্রণাম ~
Print Friendly, PDF & Email
Previous articleআজব দেশ – মাঝরাতে হেসে ওঠে সুয্যিমামা
Next articleঅশ্রুভেজা স্মৃতি
Sandip kundu
I'm an Engineer by profession but very much interested in literature. Writing is one of the my best hobby. I also like photography. HATPAKHA is a very good platform for people like us and I want to share my creation among such talented friends.Hope I can give my best.
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments