তিন
সে বেশ মিস্টি করে হাসলো – “বাঃ, ভালোই তো চিনে গেছেন, লোকে আমার ফেসবুকের ফটোর সাথে আসল মুখের মিল পায় না, আপনি পেলেন?”।
ভদ্রলোক হাসলেন – একটু আলাদা তো বটেই। তবে, আমার লোক চেনার চোখ আছে।
তারপর দাড়িওয়ালা গালটা একটু চুলকে বললো – হ্যাঁ, তাহলে কোথায় গিয়ে বসবেন? আমি আবার সোজা অফিস থেকে আসছি।
সুচরিতা গালে টোল ফেলে আবার হাসলো – আমিও। চলুন, আমি নিয়ে যাচ্ছি।
ওরা বালিগঞ্জ ব্রীজের দিকে হাঁটতে শুরু করলো, অবশ্য একটু যেতেই বাঁ দিকে হকার্স কর্নারের ওপরে দোতলায় একটা বেশ বড় রেস্তোরাঁ, নামটা বেশ মজার “চার্লিস এঞ্জেলস”।
এখানেও বেশ ভিড় তবে জায়গা পাওয়া গেল। সুচরিতা লক্ষ্য করছিল যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটা, মানে প্রতিক, বেশ কয়েকবার গাল চুলকেছে, কি রে বাবা, নতুন দাড়ি রাখছে নাকি, না দাড়িতে উকুন?
মুখোমুখি একটা ছোট্ট টেবিলে বসেই প্রতিক ওয়েটারকে ডাকলো – “একটা কিংফিশার বিয়ার”। তারপর সুচরিতার দিকে চেয়ে বললো – আপনার জন্য কি বলবো?
সুচরিতাও মাথা নারলো অর্থাৎ ওরও চলবে। ওয়েটার বিয়ার আনতে চলে গেল, প্রতিকের একটু অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে সুচরিতা নিজের মনে একটু মুচকি হাসলো। সে ডেটিং নতুন করছে না, কলকাতায় তার বছর পাঁচেক হয়ে গেছে, ঘাঁতঘোত বেশ ভালোই জানে। আগেও সে বিয়ার খেয়েছে, আর নিজের পয়সায় তো এসব খাওয়া যায় না, কাজেই কেউ খাওয়ালে তার সবই চলে, তবে বেশি না খেলেই হোল। দুই পায়ে হেটে দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে তো…।
বিয়ার এসে গেলো, ঠান্ডা চিলড বিয়ার, আর্দ্ধেকটা গ্লাসে ঢেলে পাশে বোতলটা রেখে গেছে। প্রথম চুমুকটা দিয়ে সুচরিতা একটা আরামের শ্বাস ফেললো, একটু তিতকুটে কিন্তু বেশ রিফ্রেসিং একটা ব্যাপার আছে। প্রতিক বোধহয় ড্রিঙ্কিং একটু বেশিই পছন্দ করে, এক নিঃশ্বাসে দু তিনটে বড় চুমুক মেরে গেলাসটা নামিয়ে রেখে মুখ দিয়ে একটা তৃপ্তির আওয়াজ করলো। তারপর ছোটখাট কথা বার্তা শুরু হোল, আজকে অবশ্য আর জেনারেল নলেজের কুইজ নয়। “কলকাতায় এবার খুব গরম” বা “কলকাতায় যেন আরো লোক বেড়ে যাচ্ছে, রাস্তায় হাঁটাই মুস্কিল, পূজোর সময় কি যে হবে” … এই ধরনের কথা। সুচরিতা আজকে বেশ কনফিডেন্ট ফিল করছে, আগের দিনের মতো ভয় ভয় ব্যাপারটা আর নেই। মনে কেমন একটা উত্তেজনা, তবে কি এতোদিনে ঠিকঠাক মিললো? প্রতিক কেমন যেন তার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে, সেটা আবার একটু কেমন যেন। তবে ছেলেটা মনে হয় বেশ ঘরোয়া, মাঝে মাঝে মজার কথা বলে সুচরিতাকে হাসাচ্ছে। এইভাবে মিনিট পনেরো গেল, দুজনেরই কথা বলতে বলতে বিয়ারের প্রথম গ্লাস শেষ হয়েছে, দুজনেই বোতলের বাকিটা গ্লাসে নিয়ে আবার কথায় মগ্ন। এর মধ্যে মাটন বিরিয়ানি আর স্যালাডের অর্ডার চলে গেছে। বর্ষার সময়ে কলকাতার রাস্তায় জল জমার কথা হতে হতেই ধোঁয়া ওঠা বিরিয়ানি আর ওপরে সাদা ড্রেসিং দেওয়া “ভেজিটেবল উইথ প্রণ” স্যালাড চলে এলো। সুচরিতার তো আর তর সয় না, সে কাঁটা চামচ দিয়ে স্যালাডের ওপরের একটা প্রণ তুলে মুখে পুরে দিল।
এই সময় প্রতিক তার পাতলা ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বললো – “আপনি শুরু করুন, আমি টয়লেট থেকে এখুনি আসছি”।
তারপর নিজের হাত দুটো দেখিয়ে সে চলে গেল। সুচরিতা অতটা ধরতে পারলো না, কি জানি, হয়তো হাত টাত ধোবে, ব্যাগে স্পেশ্যাল সাবান টাবান কিছু আছে। কিন্তু খাওয়া তো চলে না, যে হোস্ট সে টেবিলে না থাকলে গেস্ট খায় কি করে। সুচরিতা বিয়ারে ছোট ছোট চুমুক মারতে মারতে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো … আর সামলাতে না পেরে কাঁটা চামচ দিয়ে বিরিয়ানি থেকে বোনলেস একটা মাটনের টুকরো মুখে দিয়ে একটু চিবিয়েই কোঁত করে গিলে ফেললো, যদি প্রতিক হঠাৎ এসে পরে, দেখে খারাপ ভাববে।
মিনিট পাঁচেকও কাটেনি, সুচরিতা বাঁ দিকে কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে দেখছিল, এমন সময় টেবিলে কেউ এসে বসলো। ব্যাগ আর একটা পলিথিনের প্যাকেট রাখার শব্দে সে সামনের দিকে তাকাল। সেই রামকৃষ্ণের মতো ঘন দাড়ি আর রামদেবের মতো লম্বা চুলের বদলে খোঁচা খোঁচা কয়েকদিনের না কাটা দাড়ি আর পরিপাটি করে কাটা একটু ব্লিচ করা চুল-ওয়ালা এ আবার কে? নাদুস নুদুস ভুড়িটাই বা কই? বেশ টান টান পেটের ওপর সার্ট আর প্যান্টটা একটু ঢলঢল করছে …।
মুখটা কি চেনা? ছেলেটা তার দিকে উজ্জ্বল চোখ মেলে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটের কোনায় সামান্য একটা রহস্যময় হাসি …। কতক্ষণ আর, সেকেন্ড দশেকও নয়, সুচরিতা চোখ তুলে কয়েকবার ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই … চোখের সামনে একটা হিরোশিমার বিস্ফোরণ। সে হতাশার একটা নিঃশ্বাস ছেরে হাল ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে এলিয়ে পরলো। কোথায় দাড়ি গোঁফ ওয়ালা হিপি টাইপের একজন ছিল, কোথাথেকে সেই নাকউচু অনুপম এসে হাজির, লোকটাকে তো সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল।
অনুপম আরাম করে বিরিয়ানিতে চামচ ডুবিয়ে মুখে বিরিয়ানি ঢেলে বললো – ওফ্, অনেক খোঁজাখুঁজি করে আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটা আবার খুঁজে পেয়েছি। আপনি তো আবার আপনার নামটাও চেঞ্জ করে দিয়েছেন, অবশ্য আমার কয়েকজন বন্ধুও বেশ হেল্প করেছে।
খানিক্ষণ আরাম করে চিবিয়ে নিয়ে অনুপম আবার বললো – আমি অবশ্য এই সব খোঁজ খবরের কাজগুলো ভালোই পারি। আমার চাকরীটা লালবাজারের সাইবার সেলে, আমার কলীগরাও বেশ পোক্ত লোক।
তারপর সুচরিতার দিকে তাকিয়ে বললো – আরে, আপনি বসে কেন, খান, আপনাকে জিজ্ঞাসা করেই তো আনালাম।
তারপর খেতে খেতেই যেন টেবিলকে শোনাচ্ছে এরকম ভাবে বললো – “আমাদের কাজে উইগ টুইগ পরে ছদ্মবেশ মাঝে মাঝে নিতে হয়, যদিও ব্যাপারটা বেশ গল্পের মতো। নিশ্চয়ই ধরে ফেলেছেন পেটেও একটা প্রস্থেটিক ছিল, এখন সেটা এই প্যাকেটের মধ্যে”। বলে পাশের প্যাকেটটা দেখিয়ে দিল।
সুচরিতার পেটের মধ্যে একটা ভয়ের গুরুগুরানি শুরু হয়েছে … কি কান্ড, পুলিশের সঙ্গে পেঁয়াজি। ধরে তুলে নিয়ে গেলেই হোল, কোলকাতায় সুচরিতার মতো মেয়েদের আর কে বাঁচায়। খাওয়ার কথা ভুলে সে হাত গুটিয়ে বসেছিল। সেই মাস দেরেক আগের পার্সের ব্যাপারটা ব্যাটা জানে কিনা কে জানে … ওই শ পাঁচেক তো টাকা। সেই ব্যাপারে যে এতদিন পরে কেস খেয়ে যেতে হবে তা কে ভেবেছিল।
অনুপম বেশ আরাম করে খাচ্ছিল, বিরিয়ানি খেতে খেতে সে হঠাৎ প্রণ স্যালাডের প্লেটে চামচ ডুবিয়ে বললো – বাই দি ওয়ে, ওই পবন মেহতার ভিসিটিং কার্ডটা আমার খুব দরকার। ওটা যদি ফেরত পাওয়া যেত …।
সুচরিতা যেন ধরমর করে ঘুম থেকে উঠে বসলো। এই রে, শয়তানটা সব ধরে ফেলেছে। ওই টাকার নোটগুলোর মধ্যেই ওটা ছিল, এখনও নিশ্চয়ই ব্যাগেই আছে। ব্যাগের চেনটা খুলে একটু হাতড়াতেই বেরিয়ে এলো, একটু ভাঁজটাঁজ পরে গেছে অবশ্য। সেটা বেশ শব্দ করে টেবিলে রেখেই সুচরিতা চেয়ার সরিয়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর ঘুরে সোজা দরজার দিকে। আর এখানে দাঁড়ায়, ব্যাগে খুব জোর শ আড়াই টাকা, তাও আরো সাতদিন চালালে তবে মাইনে মিলবে, পাঁচশ টাকা ফেরত চাইলে দেওয়া অসম্ভব। রাম রাম, পুলিশের পার্সে হাত, হাজত হয়ে যেতে পারে।
দরজা দিয়ে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যেতে যেতে সুচরিতা একবার চকিতে পিছনে তাকাল … অনুপমের চোখ সাপের মতো তাকে ফলো করছে। ওই সাপ পিছনে পিছনে চলে আসার আগেই পালাও, তাছাড়া ফেসবুকটাকে তো আবার সাফ করতে হবে। ঝামেলা আর ঝামেলা, আবার ফটো তোল, আবার নতুন নাম খোঁজ … হবি চেঞ্জ করো …।
o==o==শেষ==o==o