এক
সুচরিতা বেশ আগেই বাড়ী ফিরেছে। ক্লান্ত কিন্তু বাড়ীতে খাবার বিশেষ কিছুই নেই, তাই চা আর দুটো থিন অ্যারারুট বিসকুট দিয়ে সন্ধ্যের খাবারটা সেরে নিজের পুরনো ল্যাপটপটা নিয়ে ফেসবুক খুলে বসেছিল। একটু আনমনে সে নতুন পোস্টগুলো পড়ছিল, কিছু একটা দেখে সে সোজা হয়ে বসলো, একটা নতুন মেসেজ। দুতিন লাইনের কিন্তু বেশ ক্লিয়ার। পড়ে সুচরিতার মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলো, হুম … বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে একটা ডেটিং-এর রিকোয়েস্ট …।
ফেসবুক অবশ্য ধার্মিক লোকের আড্ডাখানা নয়, এখানে ভালো মন্দ সবই পাওয়া যায়। সুচরিতা দু একবার ডেটিঙে বিপদেও পরেছে, ছেলেগুলো মাঝে মাঝে এমন হ্যাংলামি যে করে। অবশ্য সে সব হ্যাং ওভার সে কাটিয়ে উঠেছে বেশ তাড়াতাড়ি। সুচরিতা মানুষকে বোঝে, বোকা হাবা নয়। তাই পুরনো কথা নিয়ে বসে থাকার মেয়ে সে নয়। জীবন সামনের দিকেই চলে, পিছনের দিকে তাকিয়ে থাকলে সব শেষ। সুচরিতা নতুন অনেক কিছু শেখে, উপভোগ করে, লাভও হয়, তার জীবনে ফেসবুক সোসাইটি জমজমাট।
এই কিছুদিন আগের কথা, মাস দেরেক হবে। সেদিন একজনের সাথে ডেটিং ছিল … তার সাথে প্রায় মাস চারেক ধরে যোগাযোগ চলছে। নানা রকম খুচখাচ, যেমন কোন গায়ককে ভালো লাগে, এই সিনেমাটা কেমন লেগেছে ইত্যাদি। সুচরিতা তেমন কালচারাল নয়, তাছাড়া ফেসবুকে তো সবাই একটু আধটু ঢপ মেরেই থাকে, তাই না? ওর ফেসবুকেও সত্যজিৎ রায়, বিভূতিভূষণ ইত্যাদির নাম লেখা ছিল, সেরকম জানা বা পড়া অবশ্যই ছিল না। তাই একে ওকে জিজ্ঞাসা করে বা ইন্টারনেট থেকে পড়ে ছেলেটার উত্তরগুলো দিচ্ছিল, তারপর এলো সেই দেখা করার রিকোয়েস্ট। এতোদিনে অবশ্য সুচরিতা বেশ পোক্ত খেলোয়াড়। ছেলেদের তাকানো দেখেই ধরতে পারে মালটা কি চায়, তাছাড়া ফেসবুকে তো তার ইমেল ছাড়া আর সবই ভুল, কেউ পিছুপিছু তার বাড়ীতে আসতে পারবে না।
রিকোয়েস্ট আসলেই যে হ্যাংলার মতো “হ্যাঁ” বলতে হয় না, তা সুচরিতা জানে, সেও নানা অছিলায় “আজ অফিস থেকে ফিরতে রাত হবে, বিজি” … কাল অমুকের জন্মদিনের পার্টি … ইত্যাদির ঝড় তোলার পর এক শনিবার সে রাজি হোল, তাও ঠিক সাড়ে নটার মধ্যে সে ফিরবে এই রকম একটা ইঙ্গিত দিয়ে। তা যেতে যখন হচ্ছেই, ভালো ভাবেই যাওয়া যাক। একটাই কাচা সালোয়ার আলমারিতে, সেটাই পরা, মাথার চুলটা কপালের ওপর থেকে টেনে বেঁধে বেশ বড় একটা খোঁপা, মুখটা ফেস ওয়াশ দিয়ে ধুয়ে সামান্য পন্ডস ক্রীম, ঠোঁটে সামান্য ন্যাচারাল কালার লিপস্টিক আর কপালে ছোট্ট একটা কালো তিলের মতো টিপ। পায়ের জুতোটা অবশ্য একটু খেলো হয়ে গেল, তা যাক, পায়ের দিকে আর কে তাকায়।
অনুপম সাড়ে ছটার একটু আগেই রাসবিহারীর মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল। এই ধরনের এক্সপেরিয়েন্স তার এই প্রথম। মনের মধ্যে একটু উত্তেজনাও রয়েছে … এ ধরনের মিটিং-এ কি এক্সপেক্টেড তা তার জানা নেই। ইমেলের কথা অনুযায়ী সে একটা সাদার ওপর নীল চেক সার্ট আর নেভি ব্লু রঙের জিনস পরে এসেছে। মেয়েটাকে কি করে এই ভিড়ের মধ্যে আলাদা করে চেনা যায় কে জানে, কিছুতেই মোবাইলের নাম্বার দিল না, ভীষণ কনসার্ভেটিভ বোধহয়, মেলা বিরক্ত করা পছন্দ করে না। সে একটু অন্যমনস্কই ছিল, হঠাৎ ঠিক কানের পাশেই একটা সুরেলা গলা শোনা গেল – “আপনি কি অনুপম?” সে একটু চমকে উঠে পাশে তাকাল আর একটা মিস্টি মুখের ওপর চোখটা আটকে গেল।
সুচরিতাকে নিয়ে আমিনিয়া রেস্তোরাঁর দিকে যেতে যেতে অনুপম ভাবছিল যে ফেসবুকের ফটোর সাথে এর মুখের অল্পই মিল আছে, কিন্তু খানিক্ষণ দেখলে একটা ছাপ পাওয়া যায়। যেতে যেতে দুজনের মধ্যে কিছু হাল্কা কথাবার্তা হচ্ছিল।
অনুপম। আপনি কি সোজা অফিস থেকেই এলেন?
সুচরিতা। হ্যাঁ, কাজের যা চাপ, অফিস থেকে বেরোতে রোজই দেরি হয়।
অনুপম। অ্যাকচুয়ালি আপনাদের অফিসটা কোথায়?
সুচরিতা প্রমাদ গুনলো, আচ্ছা ঝামেলা তো, আবার অফিসে খোঁজ নিতে যাবে নাকি? চিন্তার সময় নেই, দুম করে বলে দিল – “মল্লীক বাজার আর পার্ক স্ট্রীটের কাছে”। মনে মনে ভাবলো … “খোঁজগে, কোথায় খুঁজবি, বিরাট এলাকা, সারা জীবন খুঁজেও মিলবে না”।
কিন্তু অনুপম আর খোঁচাল না, আলতো করে বললো – আমার অফিসটা এসপ্ল্যানেডে, মিনি বাস স্ট্যান্ডের থেকে ডান হাতে একটু এগিয়ে।
সুচরিতা মাথা নারলো – ওদিকটা চেনা আছে, সিনেমা দেখতে গেলে ওখানে মাঝে মাঝে যাই।
অনুপম একটু উৎসাহ পেল, সিনেমা দেখে … তারমানে একটা সাইডে মিল আছে। একটু খুশি মুখে সে বললো – রিসেন্ট টম ক্রুজের মুভিটা দেখেছেন? মিশান ইম্পসিবল – রোগ নেশান?
আবার একটা মিসাইল, কিন্তু সুচরিতা আবার ডাক করলো – “নাঃ, ওটা দেখা হয়নি”। বলতে গিয়ে প্রায় হেঁসেই ফেলেছিল, তার বিদ্যে তো কোনোক্রমে পাস কোর্সে গ্র্যাজুয়েট, ইংরাজী ছবির ধারে কাছে ঘেঁসে না, আসলে সাহেবদের ইংলিশ ও কিছু বুঝতেই পারে না। হাতে পয়সা থাকলে খুব জোর প্রিয়া বা ভবানিপুরের কোন হলে গিয়ে দেব বা জিতের বই দেখে। তাও বোধহয় বছরে একটা কি দুটো।
অনুপম একটু দুঃখিত হোল, কিন্তু যাক, এতো হতেই পারে, সবাই তো সব মুভি দেখে না।
কথা বলতে বলতে “আমিনিয়া” এসে গেছে, চারিদিকে জনতার থইথই। ওরা ভিড় কাটিয়ে দরজা ঠেলে রেস্তোরাঁর ভেতরে ঢুকে পরলো, বিস্তর ভিড় এখানেও তবে দুজনের জায়গা হয়ে যাবে। ভিড়ের মধ্যে অনুপম একটু পিছনে পরে গিয়েছিল, সামনে দুজন ওয়েটার। তাদের কাটিয়ে আসতেই একটু আগে সুচরিতা, আলোর ঝরনার মধ্যে দাঁড়িয়ে। বেশ লম্বা দোহারা চেহারা, মাথায় বড় খোঁপা … অনুপম বেশ প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, চোখটা একটু নিচে নামতেই কেমন হোঁচট খেল। পায়ের জুতোটা এতো খেলো কেন? কোন ফুটপাথে শ দেড়েক টাকায় স্বচ্ছন্দে পাওয়া যায়, ঠিক মানাচ্ছে কি? তার ওপর বাঁ পায়ের স্ট্র্যাপটা একবার পাল্টানো মনে হয়, রঙটা কেমন আলাদা। পায়ের গোড়ালিটা নিশ্চিত ফাটা, আলোয় বেশ দাগগুলো দেখা যাচ্ছে। কোন ভালো ফ্যামিলীর মেয়ের পা ফাটা থাকে? চোখের ভুড়ুটা একটু কুঁচকে উঠতে গিয়েও অনুপম সামলে গেল।
ওরা দুজনে একটা কোনের টেবিলে বসলো, সুচরিতাই সিলেক্ট করলো, বেশ নিরিবিলি এই জায়গাটা, পাশের টেবিলে একজন শাড়ি পরা মেয়ে একা বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে কি একটা ম্যাগাজিন পড়ছে। ওরা সেদিকে আমল না দিয়ে নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বার্তা বলছিল। অনুপম আপ্রাণ চেষ্টা করছিল মেয়েটার সাথে তার কিছু কমন ইনটারেস্ট খুঁজে বার করতে। ফেসবুকে তো কত কথাই লেখাছিল, যা পড়ে অনুপম (অবশ্য ফটোটা দেখেও) ভীষণ ইনটারেস্টেড হয়ে পরেছিল এবং প্রথমে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আর তার কিছুদিন পরে এই দেখা করার ইচ্ছা। কিন্তু ফেসবুকের ডেস্ক্রিপশানের ঠিক কিছুই যেন মিলছে না, মেয়েটা শুধুই “হ্যাঁ” বা “না”-তেই চালিয়ে যাচ্ছে, আর না হয় “পড়েছিলাম, এখন ভুলে গেছি” টাইপের উত্তর আসছে।
আমিনিয়া এই সময় খুবই ব্যাস্ত রেস্তোরাঁ। প্রচুর লোক আসছে আবার একদল উঠেও যাচ্ছে। ভেতরে কনস্ট্যান্ট মিউজিক চলছে, এমন সময় পপুলার হিন্দি মিউজিক শুরু হোল, প্রথম গানই কিশোরকুমারের “পল পল দিল কে পাস তুম রহতি হো”। অনুপম এবার একটু খুশি হোল, যাক ও তো গান খুব ভালোবাসে, বিশেষ করে হিন্দিতে কিশোর আর রফি। এবার নিশ্চিত ওদের ডেটিং-টা জমে যাবে। অনুপম আর দেরি করলো না, ততক্ষণে খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়ে গেছে …
অনুপম। কি, এবার ভালো লাগছে তো, আপনার প্রিয় গায়ক, কোন ছবির বলুন তো?
সুচরিতা ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে একসা, এই ছেলেটা যে এতো আপদ তা কে জানতো। এ যেন জেনারেল নলেজের পরীক্ষা চলছে। ফেসবুকে তো ওরকম কতই লেখা থাকে, নিজেকে বিজ্ঞ দেখাতে তো সবাই চায়। ছেলেটা ডেটিঙের কিছুই বোঝে না, সারাক্ষণ নিজের জ্ঞান জাহির করছে। কোথায় একটু মজার মজার কথা বলবে তা না …। খাওয়া দাওয়া শেষ করে কখন যে মুক্তি পাওয়া যায় সেটাই ভাবার। এখন আবার এই গান, সুচরিতার গান শোনার কোন সময় নেই। সামান্য মাইনের একটা টাইপিস্টের চাকরী, খাটিয়ে মুখে রক্ত তুলে দেয়। সন্ধ্যেবেলায় বাড়ী ফিরে একটু মুরি খেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা ছাড়া সে আর কিছু ভাবতে পারে না। ওই সব ক্যাসেট বা সিডি কেনার পয়সা তার কোথায়।
অনুপমের প্রশ্নটা সে না শোনার ভান করলো, শুধু বললো – এই রেস্টুরেন্টটায় বড় ভিড়, তাই না? চারিদিকে এতো গোলমাল, কিছু শোনাই যায় না।
অনুপম ছাড়ার ছেলে না, মুখটা আর একটু এগিয়ে বললো – কি? মনে পরছে? বলুন কোন সিনেমার গান এটা?
সুচরিতা ফট করে বলে বসলো – কিছু একটা হবে। আমার অতো মনে টনে থাকে না, ছবি দেখি আর ভুলে যাই।
অনুপম হাঁ হয়ে গেল, এ কি রে ভাই, এটাও বলতে পারলো না, এ মেয়ে সেই মেয়েই তো? নাকি পালটে গেল? জমজ টমজ নয় তো? কিন্তু বেশি ভাবার সময় নেই, ঠিক এই মুহুর্তে টেবিলে খাবার এসে গেল। কুঁচকানো ভুরুটাকে আবার সমান করে অনুপম মুচকি হাসলো – ওকে, তাহলে শুরু করা যাক।
to be continued…