রোজের মত বাড়ি থেকে সিপাই বিদ্রোহ করে টালিগঞ্জ আসা। সিগারেটের লাস্ট টানটা দেওয়া মাত্র ফোনটা বেজে উঠল। যথারিতি অফিস। ঘড়ি তখন বলছে সাড়ে নটা। আজও গালাগালি অনিবার্য। যদিও সব রুটিন পড়ে গেছে। তা ফোনটাকে যা হক করে সামাল দিয়ে ঢুকে পরলাম মেট্রো স্টেশানে।
দেখলাম মেট্রো আসতে এখনও তিন মিনিট বাকী। বুধবার সকালের ভিড়টাও যথারীতি অতীব। স্বভাববশত উঁকি মেরে দেখলাম মেট্রো আসছে কিনা, আমার দেখাতে ট্রেন আদেও জলদী আসবে না কিন্তু তাও, অভ্যাস। আমার উঁকি মারার সাথে সাথে খানিকটা দূরে আর একটা মুখও দেখলাম, উঁকি মারছে। বেশ চেনা মুখ। খানিকটা এগোলাম, দেখলাম মুখটা একটু না,অনেকটাই চেনা।
“মোহনা????” একটু আবেগের বশে চিৎকার করেই বললাম। দেখলাম আশে পাশে দু একজন এমন ভাবে তাকাল যেন তাদের সকলের নামও মোহনা।
চেনা মুখটা ফিরল আমার দিকে আর সাথে সাথে ভরিয়ে দিল সেই চেনা গাল ভরা হাসি। ওর গায়ে দেখলাম কমলা রঙের শারি আর পারটা ছিল কালো, চুলটা যথারীতি অর্ধেক খোপা। কি যেন নাম বলে এইসবকে। দেখতে ঠিক ততটাই ফর্সা আর সুন্দর এখনও। কিন্তু কপালের লাল রংটা আমার ব্যার্থতাকে আরও একবার বুঝিয়ে দিল কত কথা।
- “রাতুল? তুই? হোয়াট আ সারপ্রাইজ?” মোহনা বলল।
- “ তুই এখানে কোথায়?” আমি অবাক হয়েই প্রশ্নটা করলাম।
- “আমি তো গড়িয়ায় থাকি, আমার হাসব্যান্ডের এখন এখানেই পোস্টিং। এক বন্ধুর বাড়ি এসে ছিলাম। তুই চিনিস তো?’
- “ কে?”
- “ আরে, ঐশী।“
- “ হ্যাঁ হ্যাঁ, যে ‘ওয়ান’ কে ‘ওন’ বলত”
- “ইশ। এইরম বলিস না”।
একটু হেসে নিলাম আমরা। মোহনা কে এই ভাবে দেখতে পাব আমি ভাবিনি। প্রায় চারবছর পর দেখা। লাস্ট বোধহয় কোনো একটা সরস্বতী পুজোতে দেখা। যদিও আমি গেছিলাম তিরিশ মিনিটের জন্য। মোহনা হিমাদ্রিকে ভালবাসে তখন জানতে পেরেছিলাম।
- “ তুই বাড়ি যাচ্ছিস? কিন্তু গড়িয়া তো?”
- “ না না।আমি যাচ্ছি ধরমতলায়, একটা কাজ আছে। তুই?”
- “আমি তো অফিস। সেন্ট্রাল। স্ট্যাট ব্যাঙ্কে এখন আমি”
বলতে বলতে মুখপোড়া মেট্রোটা চলে এল। আমরা দুজনেই ঠেলে ঠুলে ঢুকলাম, আর দরজার সামনে দাড়ালাম।
- “ তারপর, বিয়ে থা করলি??” মোহনা ব্যাঙ্গ করে প্রশ্ন করাটা শুরু করল।
- “ আর বিয়ে থা, মাথার চুল সব পড়ে যাচ্ছেরে, আর কেউ করবে না বিয়ে, মেয়ে জুটবে না” আমি যতটা সম্ভব বোকা বোকা উত্তর দিলাম।
- “ এই জন্যই প্রেম করতে হয়, ফিজিক্স ক্লাসে ফিজিক্সটা যদি একটু কম ধ্যান দিতিস তালে আজ তোর কেমিস্ট্রি টা ভাল হত” মোহোনা বলতে বলতে হেসে ফেলল।
আমার যদিও হাসিটা পেল না। “চুপ কর আমি অনেক প্রেম করেছি। ওই করতে হয় আর কি” আর একটা বোকা উত্তর দিলাম। সব আসলে গুলিয়ে যাচ্ছিল।
- “ হ্যাঁ কবি মানুষ বলে কথা”
- “ মানে? তুই জানিস?’’
- “ ওই আমাকে ও জানতে হয়। পুরনো প্রেমিক বলে কথা। আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে”
- “ প্রেমিক?? কি সব বলছিস” আমি একটা নকল হাসি দেয়ার ফুল চেষ্টা করলাম। আসলে মোহনাকে গত দু বছরের কোচিং লাইফে এত সাচ্ছন্দে আমি দেখিনি কখনও। তালে হয়ত গল্প অন্য হত।
- “ দ্যাখ। আমার বাড়ির পাশে তুই সন্দিপনের সাথে সাইকেলে ঘুরতিস, সেটা আমি জানতে পারব না তুই ভাবলি?”
- “না তখন তো”
- “ কি তখন তো বল? ভীতুর ডিম একখানা। একদিন আমার পাশে বসে হাত পা কাপছিল তোর। আমার পাশে অব্দি দাড়াতে পারতিস না। কটা কথা বলেছিস আমার সাথে?’’
- “ তুই-ই তো ছিলিস গোমড়া মুখো”
- “আমি? গোটা কোচিং জানত তুই আমার জন্য পাগল আর উনি সাহস জোগাতে পারলেন না দু বছরে”
আমি সত্যিই বুঝতে পারছিলাম না মোহনার এই গুলো আফসোস নাকি অভিযোগ? আমি একটু চুপ থাকাই বেছে নিলাম।
নিঃশব্দতা কাটিয়ে মোহনা বলল “ জানিস, প্রত্যেক বুধবার আমি ভাবতাম আজ বোধ হয় তুই বলবি, আমি কোচিং থেকে বেরিয়ে আগেও চলে যেতাম একা, এখন ভাবলে হাসি পায়। এমন কি লাস্ট আমাদের সরস্বতী পুজোর রিইউনিয়নেও আমি ভাবলাম এইবার ব্যাটা কিছু বলবে। জন্মে এরম ভীতু দেখিনি” মোহনা বলতে বলতে হেসে ফেলল। আমার যদিও যথারীতি পেল না। পার্ক স্ট্রিট চলে এসেছিল। আমরা গ্যাঁটটা ছাড়ব বলে মোহনা একটু আমার কাছে সরে এল। একখানা সুগন্ধ অনুভব করতে পারলাম, অনেকটা পাহাড়ি। মোহনা তখন আমার থেকে অর্ধেক হাত দূরে আর ওর গালের লাল আভাটা আমায় অভদ্রের মত ওর দিকে তাকাতে বাধ্য করল। গ্যাঁটটা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে মোহনা ভ্রু দুটো উপরে তুলে আমায় সজাগ করল।
- “ আফসোস হচ্ছে?’’ মোহনা হাসতে হাসতে বলল।
- “না। আফসোস হবে কেন। কি যে বলিস’’
“ সময় কেবল বয়ে চলেছে, নদীর মত পাহাড় বেয়ে,
আকাশ কেমন গান বেধেছে, আপন মনে তারে চেয়ে,
থামলে পড়ে মোহনাতে নদীও কেমন তাকিয়ে দেখে-
আকাশ নদীর আলিঙ্গনে, ঝরল আকাশ বর্ষা হয়ে”।
জানলার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বলল মোহনা।
- “ তুই পরেছিস এটা?”
- “ ওই যে পড়তে হয়, কর্তব্যের মধ্যে পড়ে”
- “ তুই একাই পড়েছিস রে, পাবলিশারস এখনও টাকা পায় জানিস?”
- “ ভাল লিখেছিস অনেক, কিন্তু কি বলত, অনেক তো বয়ে চললি এবার তো থামতে হবে তবে তো মোহনা পাবি। সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার?”
এসপ্ল্যানেড আসছে দেখে মোহনা এগিয়ে গেল। খুব ইচ্ছা করছিল হাতটাকে ধরবার কিন্তু না, হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে বোধ হয় আসল আনন্দ। অনেক প্রশ্ন ছিল কিন্তু সব প্রশ্নের বোধ হয় ভাগ্য ছিল না মোহনার স্পর্শ পাওয়ার। সব কিছু মিলিয়ে দিলাম কিছুটা মনের ভিতর আর কিছুটা সময়ের সাথে। সত্যিতো সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার।