ফিট্বিট্ – part 1
।২।
সকাল আটটায় গগাবাবুর প্লেন নিউ ইয়র্কের যে-এফ-কে বিমানবন্দরে নামলো। ১৬ ঘন্টা আকাশে ক্রমাগত ওড়ার পর। গগাবাবুর ততক্ষনে তুমুল পটি পেয়ে গেছে। পটিটা অনেক্ষন ধরেই পাবো পাবো করছিল। একবার ভেবেওছিলেন যে যাবেন। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের বাথরুমের দিকে তাকিয়ে দেখলেন মস্ত বড় লাইন। নাহ্, অত বড় লাইনে দাঁড়ালে পটির বেগ বেড়ে যেতে পারে। খুব একটা জোর তো পায় নি। ম্যানেজ হয়ে যাবে। এই ভেবে পটি চেপে বসে রইলেন গগাবাবু। যতক্ষণ বসে ছিলেন ততক্ষন ঠিকই ছিলেন। সমস্যা শুরু হোলো যখন যে-এফ-কে তে গেটে এসে প্লেন থামল আর গগাবাবুকে সিট থেকে উঠে দাঁড়াতে হোলো।
ক্যারিঅন ব্যাগ নিয়েথুয়ে যখন এয়ারপোর্ট বিল্ডিংএ পা রাখলেন তখন পেটে ঘুর্নিঝর। আশায় আশায় ছিলেন যে এয়ারপোর্ট বিল্ডিংএ ঢুকেই বাথরুম পেয়ে যাবেন। আমেরিকার এয়ারপোর্টে তো আর দেশের মত বাথরুমের অভাব নেই। লোকের থেকে বাথরুম বেশি। ছাত্রাবস্থায় শিকাগো দিয়ে যাতায়াত করার সময় তাই দেখেছিলেন। কিন্তু এবারে দেখলেন যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্যরকম। চারিদিকে নীল-কালো ইউনিফর্ম পরা গাদা গাদা সিকুরিটি গার্ড। ভেঁড়ার পালের মত যাত্রীদের ইমিগ্রেশান কাউন্টারের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সকলেই গোমড়ামুখো। তাদের কিছু বলতে সাহস পেলেন না গগাবাবু। দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে চললেন। শেষমেশ গিয়ে দাঁড়ালেন একটা লম্বা লাইনের অন্তিম প্রান্তে। খানিক্ষন স্থির হয়ে দাঁড়ানোর পর আবার একটা প্রবল ঝড় এলো। এই বুঝি বৃষ্টি নামবে! গগাবাবুর কপালে ঘাম। চোখে ঝাপসা দেখছেন।
আর দাঁড়াতে না পেরে মাটিতেই বসে পরলেন। আশেপাশের যাত্রীরা তটস্ত হয়ে পড়লো। সিকুরিটি গার্ড ছুটে এলো। “স্যার, খ্যান ইউ হিয়ার মি?” গগাবাবু যেন ঈশ্বরের কন্ঠস্বর শুনতে পেলেন। দূর থেকে ফিকে হয়ে ভেসে আসছে। তবে কি প্লেন স্বর্গে ল্যান্ড করলো? কিন্তু ঈশ্বর তাকে স্যার বলেই বা সম্বোধন করবে কেন? আর ইংরিজিতেই বা কথা বলবেন কেন? ঈশ্বরের তো আগে থেকেই জানার কথা যে উনি বাঙালি। আশ্চর্জ! খানিক বাদে ঘোড় কাটলো গগাবাবুর। ততক্ষনে ঘামে তার জামা ভিজে গেছে। আর কিছু ভিজেছে কিনা ঠিক বুঝতে পারছেন না। সিকুরিটি গার্ড তখনো একি প্রশ্ন করে চলেছে। তার কন্ঠস্বরে উদবেগ। “বাথরুম” মিনমিন করে কোনমতে বললেন গগাবাবু। “বাথরুম? রেস্টরুম? ইউ মিন ইউ ওয়ান্ট টু গো টু দ্যা রেস্টরুম?” বাথরুম আর রেস্টরুম যে একি জিনিষ, গগাবাবু তা জানেন। চল্লিশ বছর আগে ঠেকে শিখেছেন। তড়িঘড়ি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
ততক্ষনে একটা হুইলচেয়ার নিয়ে আর একজন অ্যাটেন্ডেন্টের আবির্ভাব হয়েছে। গগাবাবুকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে সেই অ্যাটেন্ডেট প্রায় দৌড় লাগালো বাথরুমের দিকে। লোকটার অনেক বয়েস, কিন্তু অশুরের মত শক্তি।
গগাবাবু অবাক হয়ে দেখলেন যে পাশেই বাথরুম। ইশ্! কেন যে আগে জিগ্যাশা করলেন না? শুধু শুধু আবার বেইজ্জতি হোলো। কোন মানে হয়? যাইহোক, মনটাকে শান্ত করে গগাবাবু পটিতে বসলেন। এইসব হুলুস্থুলুর মধ্যে ঝড় তখন উধাও। তবে খানিক বাদেই সে ঝড় আবার ফিরে এলো। প্রবল বেগে। বৃষ্টিও নামলো। গগাবাবুর শান্ত মস্তিষ্কে তখন অনেক চিন্তার আনাগোনা। টিয়া বলেছিল “ড্যাড্, তোমার জন্য একটা হুইলচেয়ার বলবো?” প্রচন্ড চটে গিয়ে গগাবাবু উত্তর দিয়েছিলেন “তোরা কি আমাকে গাধা ভাবিস, নাকি? আরে বাবা, তোর জন্মের আগে আমি আমেরিকা চষে খেয়েছি!” টিয়া আর কথা বাড়ায় নি। চট্ করে বুঝে নিয়েছিল যে শ্বশুরের ইগোতে লেগেছে। সত্যিই বুদ্ধিমতি মেয়ে, ভাবলেন গগাবাবু। ওর কথাটা শুনলেই ভাল হোতো। এইসব ঝামেলায় পরতে হোতো না। না হয় চড়তেন হুইলচেয়ারে, কে আর দেখতে যেত? শেষ অব্ধি তো তাই করতে হোলো? উচিত শিক্ষা হয়েছে! নিজের লোভকেও অনেক ধিক্কার দিলেন গগাবাবু। প্লেনে পালক-পনির খাওয়াটা মোটেই উচিত হয়নি! যাকগে, যা হবার হয়ে গেছে।
গগাবাবু পটি থেকে উঠে, হাত ধুয়ে, আবার চড়ে বসলেন হুইলচেয়ারে। “ইউ ওখে ম্যান?” ইউনিফর্ম পরা অ্যাটেন্ডেন্ট জিগ্যাশা করলো। গগাবাবু মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বললেন। ইমিগ্রেশান কাউন্টার ততক্ষনে অনেক ফাঁকা হয়ে গেছে। তার ওপর উনি হুইলচেয়ারে বলে ওনাকে সবাই আগে যেতে দিল। পাসপোর্টে চটপট থাপ্পা লেগে গেল। এরপর সোজা ব্যাগেজ ক্লেম। সেখানে গিয়ে দেখলেন তার সুটকেস দুটো তার জন্য অপেক্ষা করছে। কনভেয়র বেল্ট থেকে কেউ একজন নামিয়ে রেখেছে। এলাকাটা মোটামুটি ফাঁকা। বাকি যাত্রীরা মালপত্র নিয়ে আগেই চলে গেছে। গগাবাবুর বলশালী অ্যাটেনডেন্ট দুটি সুটকেস সমেত গগাবাবুকে ঠেলে কাস্টমস্ পাড় করে নিয়ে এল বেরোবার দরজায়। এখানেই গগাবাবুকে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। চারিপাশ পর্জ্যবেক্ষন করে নিজের পরিবারের কাউকে দেখতে পেলেন না গগাবাবু। হয়ত ওদের দেরি হচ্ছে।
যে অ্যাটেন্ডেন্ট তার হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে এল, তাকে ডেকে বললেন “আই উইল ওয়েট হিয়ার” বলে পকেট হাথরে একটি ১০ ডলারের নোট বার করে তার দিকে এগিয়ে ধরলেন। লোকটার জন্য গগাবাবুর খুব খারাপ লাগছিল। এই বৃদ্ধ বয়সেও এত শারীরিক পরিশ্রম। কালো ভদ্রলোক শুভ্র হাসি হেসে গগাবাবুর পিঠ চাপড়ে বললেন “ইটস্ খিউল ম্যান! ইউ ডোন্ট হ্যাভ ঠু ডু দিস্”। সত্যিই, মানুষ তো এরকমই হওয়া উচিত, ভাবলেন গগাবাবু। চেনে না, জানে না, অথচ নিজের মত করে যত্ন নিল। আবেগপ্লুত গলায় বললেন “নো, নো, প্লিস!” ভদ্রলোক টাকাটা নিয়ে গগাবাবুকে একটা মৃদু আলিঙ্গন দিয়ে “ঠেইক খ্যেয়ার ম্যান!” বলে চলে গেলেন। ভালো লাগার আবেশ নিয়ে ভদ্রলোকের চলে যাওয়াটা খানিক্ষন দেখলেন গগাবাবু। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে হুইলচেয়ারটাকে ঠেলে রেখে দিয়ে এলেন এক পাশে। শরীরটা এখন বেশ হাল্কা বোধ হচ্ছে, তবে পায়ে একটু ঝিঁঝিঁ ধরেছে। অনেকগুলো দরজা। সবগুলোর দিকে নজর রাখা সম্ভব নয়, তাও যতটা সম্ভব নজর রেখে হাল্কা পায়চারি করতে লাগলেন।
মিনিট পাঁচেক পরে পেছন থেকে হঠাৎ ডাক শুনলেন “বাবা!” ঘুরেই আঁতকে উঠলেন গগাবাবু।
To be continued…