ফিট্বিট্ – part 1
ফিট্বিট্ – part 2
।৩।
এ কী চেহারা বানিয়েছে সমর? এ তো সাক্ষাৎ জাম্বুবান! কেবল উচ্চতায় জাম্বুবানের অর্ধেক। পরণে খাকি রঙের একটা হাফ প্যান্ট, খালি পায়ে টেনিস জুতো, আর কমলা লেবু রঙের একটা খাটো গেঞ্জি। সেই গেঞ্জি ফেটে সমরের কলসিস্বরূপ বিশাল উদর বেরিয়ে এসে ঝুলে রয়েছে হাফ প্যান্টের ওপর। সেই ছোটোবেলায় ফিজিক্সে পড়া নিউটনের গ্র্যাভিটি সঙ্ক্রান্ত কাজকর্মের কথা মনে পরে গেল গগাবাবুর। গ্র্যাভিটি যে আছে তার নিজের ছেলে তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে আজ দেখিয়ে দিল! এমনিতেই খুব পরিশ্রান্ত, তার ওপর এই সব দেখে বাক্য হারিয়ে ফ্যালফ্যাল করে শুধু চেয়ে রইলেন গগাবাবু। ছেলের ডাকে আর উত্তর দিতে পারলেন না। কোলাব্যাঙের মত থপ্থপিয়ে এগিয়ে এলো সমর।
“বাবা!” বলে নিজের পিতাকে আলিঙ্গনে বাঁধার চেষ্টা করলো। গগাবাবু একটু ভয় পেলেন। কিন্তু পাছে ছেলে মনে আঘাত পায় সেই কথা ভেবে ভয়কে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেকে ছেড়ে দিলেন ছেলের খপ্পড়ে। হারিয়ে গেলেন তার বিশাল বক্ষের মাঝে। কড়া আফটার শেভএর গন্ধের ভেতর থেকে যখন নিষ্কৃতি পেলেন, তখন তার হাঁপ ধরে গেছে। কয়েক পা পিছিয়ে এলেন। ছেলের দিকে তাকালেন আবার। দেখলেন ছেলে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মুখটা এখনো তার পরলোকগত স্ত্রী মৃনালিনীর কার্বন কপি। হাসিটা দেখে মনে হচ্ছে যে বাবাকে এতদিন পর দেখে সত্যিসত্যিই খুশী। গগাবাবুও খুশী হলেন। যতই হোক, নিজের সন্তান। চেহারাটা না হয় ওরকম একটু হয়েছে, কাউকে খুন তো করেনি!
কয়েক মূহুর্ত পর ছেলের বৃহৎ আড়াল থেকে আবির্ভুত হোলো টিয়া। ছিপছিপে চেহারা। সুশ্রী মুখে সুন্দর হাসি। চুল পরিপাটি করে বাঁধা। “হাই ড্যাড্” বলে ঝুঁকে প্রনাম করতে যাচ্ছিলো। তড়িঘড়ি করে আটকে দিলেন গগাবাবু “আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে, পরে করিস”। টিয়ার কোলে একজন শিশু। ঠিক যেন এক দেবদূত। ফটফটে গায়ের রঙ। মাথায় একরাশ ঘন চুল। গাল, হাত, পা সব গোলগোল। দেখলেই চট্কে দিতে ইচ্ছা করে। নাতিকে ছবিতে দেখেছেন গগাবাবু কিন্তু সে যে এতোটা সুন্দর ফুটফুটে তা তার ধারনাতেই ছিলো না। “এই যে দাদু, তুমি কি সুইট। বলতো আমি কে?” বলে নাতিকে কোলে নাওয়ার জন্য হাত বাড়ালেন। নাতি কোনো উৎসাহই দেখালো না। ভুঁড়ু কুঁচকে বলল “নো”। বলে কান্নাকান্না মুখ করে পেছন ফিরে মায়ের ঘাড়ে মুখ লুকালো। “ওর কদিন একটু সময় লাগবে, তারপর দেখবে তোমার গায়ে লেগে থাকবে সারাদিন,” ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলল টিয়া।
গগাবাবুর বেশ লাগে টিয়ার এই বাংলা। বেশ একটা আদুরে ভাব আছে। “তোমার ফ্লাইট ঠিক ছিলো? কোনো অসুবিধা হয়নি তো?” প্রশ্ন করলো টিয়া। “হ্যাঁ ফ্লাইট ঠিকই ছিলো, তবে…” বলতে গিয়েও আর বললেন না কিছু গগাবাবু। বললেই আবার হাজারটা ফ্যাচাং। ডাক্তারকে ফোন, এই টেস্ট, ওই টেস্ট। কি দরকার ওসবে যাওয়ার? দিব্বি আছেন তো এখন। আর তাছাড়া ওসব প্রাইভেট কথা কি বৌমাকে বলা যায়? ছেলে হলে আলাদা কথা ছিলো। কিন্তু ছেলে তো গড়গড়িয়ে আগে আগে চলেছে। অবশ্য মালপত্র গুলো সব ওই কার্টএ তুলেছে, আর ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। কাজের হয়েছে তাহলে, খুশী মনে ভাবলেন গগাবাবু।
“ওর এখন কত বয়েস?” নাতিকে দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন। গগাবাবুর এই প্রশ্নের উত্তর জানার কথা, কিন্তু উনি জানেন না। লজ্জার মাথা খেয়ে জিগ্যেশ করে ফেললেন। টিয়া একটু অবাক হোলো “লাস্ট মান্থএ ওর সেকেন্ড বার্থডে হোলো তোমার মনে নেই”। ও হ্যাঁ, তাই তো, ছিছিছি, মনে রাখা উচিত ছিলো। নিজের ওপর বিরক্ত হলেন গগাবাবু। মুখে বললেন “সেটা লাস্ট মান্থ ছিলো? কিছুই মনে থাকে না আজকাল!”
ইতিমধ্যে অনেকগুলো চলন্ত বেল্ট ও লিফট্ এ ওঠানামার পর ওরা এসে পৌঁছালো একটা বিশাল পার্কিং গ্যারেজের ৮ তলায়। সেখানে সারিসারি বিভিন্ন মডেলের সব গাড়ী। গগাবাবু আমেরিকায় আগে থেকেছেন, তবুও একটু চমকিত হলেন। এত গাড়ি কে চালায়! নিজেদের গাড়ীতে পৌঁছে টিয়া ব্যাগ থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মত একটা জিনিষ বার করে গাড়ীর দরজা খুলে দিল। গগাবাবু দেখলেন যে তার নাতির বসার জন্য আবার সিটের ওপর আর একটা সিট। সেখানে তাকে বেঁধে দাওয়া হোলো। যখন বাঁধাছাঁদা চলছে, তখন ওনার খুব কৌতুহল হল জানবার যে তাদের গাড়ির মডেলটার কি নাম। অবশ্য গগাবাবু জানেন না এটা তার ছেলের গাড়ি না বউমার। তবে অনুমান করলেন যে বউমা যখন দরজা খুলল, তখন ওরই হবে। গাড়ির পেছনে সরে গিয়ে দেখলেন সেখানে কেবল লেখা রয়েছে “GLC” আর “4-MATIC”। ছাত্রাবস্থায় শেভী, টয়োটা, ফোর্ড এই সব গাড়ি দেখে গিয়েছিলেন, কিন্তু এ আবার কি গাড়ি? “ড্যাড্, তুমি পেছনে জয়এর পাশে বসে পরো,” টিয়ার গলা শোনা গেল।
চিন্তাকে ঝেরে ফেলে তড়িঘড়ি গাড়ির ভেতর ঢুকলেন গগাবাবু। নিজেই সিটবেল্ট বেঁধে নিলেন। এটুকু তিনি জানেন। জয় ততক্ষনে ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করেছে। কিছু একটা চায় সে। টিয়া ড্রাইভারএর সিটে। নিজের সিট বেল্ট আঁটতে আঁটতে সে বলল “জাস্ট গিভ মি আ মোমেন্ট বাবা, ইট’ল স্টার্ট সুন”। কাকে উদ্দেশ্য করে বলল এবং কেন বলল, গগাবাবুর কিছুই বোধগম্য হোলো না। জয় ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকলো। গগাবাবুর ছেলে ততক্ষনে বউমার পাশে তার সিংহাসনে চড়ে বসেছে। তার হাতে একটা স্মার্টফোন। সে সেটা নিয়েই ব্যাস্ত। নিজের সন্তানের কান্নাকে কোনো আমলই দিচ্ছে না। টিয়া গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলো। গাড়ি চালু হওয়া মাত্র জয়এর সামনে একটা ছোট্ট টিভি স্ক্রীনে কার্টুন জাতীয় একটা কিছু হতে শুরু করলো। জয় চুপ হয়ে গেল।
গগাবাবু দেখলেন যে প্লেনের মত এ গাড়িতেও টিভি স্ক্রীন। তার সিটের সামনেও একটা। সেখানেও ওই একি কার্টুন। একটা পেটমোটা বেগুনী রঙের জন্তু নাকি সুরে গান করছে আর এক পাল বাচ্চাকে নিয়ে ক্রমাগত নেচে চলেছে। জয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে তার চোখের পাতার পলক পর্জন্ত্য পরছে না। সামনে তাকিয়ে দেখলেন যে টিয়া মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। এরি মধ্যে তারা রাস্তায় নেমে এসেছে। চারিপাশে সারিসারি গাড়ি। কিন্তু কোনো শব্দ নেই। এত গাড়ির মাঝেও তাদের গাড়ি সাঁসাঁ করে এগিয়ে চলেছে। ঠিক একটা দক্ষ্য সাঁতারুর মত, যাদের সাঁতারে বিশেষ শব্দ হয় না। সত্যি তার বউমা মেয়েটা কি স্মার্ট! চোখে সান্গ্লাস, ডান হাতে গোলাপি রঙের একটা ঘড়ির মত কি পরেছে, কিন্তু সেটাকে ঘড়ি বলে মনে হচ্ছে না।
কে জানে কি? আজকাল কতরকম স্টাইল, ভাবলেন গগাবাবু। ছেলের দিকে দেখলেন একবার। তার কোনোদিকেই কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সেই ফোন নিয়েই আছে। “তুই গাড়ি চালাস না?” প্রশ্নটা করেই মনে হল বোকা বোকা প্রশ্ন হয়ে গেল। এত বছর আমেরিকায় আছে, গাড়ি চালায় না সে আবার হয় নাকি? “না,” উত্তর দিল সমর। শুনে একটু অবাক হলেন গগাবাবু। “কেন?” “চালাই না। এমনি,” বলে সমর একদম চুপ। আর ঘাঁটালেন না গগাবাবু। শুনেছেন ছেলে খুব বড় চাকরি করে। নিশ্চয়ই ড্রাইভার আছে।
গত ২৪ ঘন্টার বিভিন্ন ঘটনার চিন্তায় মশগুল ছিলেন গগাবাবু। লক্ষ করেননি কখন তাদের গাড়ি মাটির তলায় একটা গ্যারেজে ঢুকে পরেছে। ঘোড় কাটতে দেখলেন যে গাড়ি থেমে গেছে, আর টিয়া নেমে গাড়ির ওপাশে গিয়ে জয়কে ওর সিট থেকে নামাচ্ছে। সমরও চটপট নেমে বাবার সুটকেস দুটো গাড়ি থেকে বার করে ফেলেছে। সমরের তৎপরতায় গগাবাবু একটু অবাকই হলেন। ছেলেটা সত্যিই কাজের আছে! “এলিভেটরটা ওইদিকে ড্যাড্” টিয়া আঙ্গুল তুলে দেখালো। গগাবাবু প্রথমে কিছুই বুঝলেন না।
তারপর হঠাৎ মনে পরলো যে আমেরিকায় লিফট্ কে এলিভেটর বলে। “ও হ্যাঁ হ্যাঁ” বলে এগোলেন। পেছনে জয়কে কোলে নিয়ে টিয়া। সবশেষে দুটো সুটকেস গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে আসছে সমর। সবার শেষে এলিভেটরএ উঠে সমর বলল “বাবা, ২৪ লেখা বোতামটা টেপো তো! তোমার কনুই এর পাসে।” গগাবাবু একটু ইতস্তত করে ২৪ টিপলেন। বাব্বা! এরা চব্বিশ তলায় থাকে! অত ওপরে তো শুনেছেন বায়ু নাকি পাতলা। শ্বাসকষ্ট হয় না? কলকাতায় উনি থাকেন তিন তলায়। সেটাই মনে হয় কত উঁচু। পার্ডুতে যখন পড়তেন তখন চারজন ছেলে মিলে একটা বাড়ী ভাড়া করে থাকতেন। তার ভাগ্যে যে ঘরটা পরেছিলো, সেটা মাটির তলায়। বেসমেন্টএ।
সমর আর টিয়ার ফ্ল্যাটে ঢুকে গগাবাবুর চক্ষু একেবারে ছানাবড়া। বিশাল বড়। চকচকে মেঝে। ওনেক নামজাদা বন্ধুবান্ধব আছে গগাবাবুর। দক্ষিন কলকাতায় তাদের বড় বড় ফ্ল্যাটে গগাবাবুর নিয়মিত যাতায়াত। কিন্তু এমন ফ্ল্যাট উনি কখনো দেখেন নি। ছেলে যে বড় চাকরি করে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই রইল না গগাবাবুর। টিয়া জয়কে কোল থেকে নামিয়ে বসার ঘরের একটা পর্দা টেনে খুলে দিল। কাঁচের দেয়াল দিয়ে আলো ঠিকরে প্রবেশ করলো ঘরে। বাইরে খোলা আকাশ। অনেক দূরে ক্ষুদে ক্ষুদে গাড়ির সারি দেখা যাচ্ছে। গগাবাবুর মনে হল উনি যেন সত্যি সত্যিই স্বর্গে পৌঁছে গেছেন।
“ড্যাড্, ওইটা সেন্ট্রাল পার্ক”। অদূরের এক সবুজ গালিচার দিকে ইশারা করে বলল টিয়া। সেন্টাল পার্ক! এই পার্কের কথা গগাবাবু জানেন। বইয়ে ছবি দেখেছেন। শুনেছেন যে শহরের মদ্দিখানে অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম পার্ক। এই তাহলে সেই বিশ্ববিখ্যাত সেন্ট্রাল পার্ক। তবে তো তার হাঁটার আর কোনো সমস্যাই রইল না! খুশীতে মনটা ভরে উঠলো গগাবাবুর। আমেরিকায় জোর করে নিয়ে আসার জন্য ছেলে বউমাকে তিনি মনে মনে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালেন।
To be continued…