ঘটনা – ১

ইঞ্জিনিয়ারিং এ ইলেকট্রিকাল সাবজেক্টটা দেখলে আমার হাত,পা কাঁপতে শুরু করত।সফলতা সহকারে দশটা অঙ্ক করতে পেরেছিলাম কী না কে জানে।এর থিওরেম,ওর ফর্মুলা সব গুলিয়ে এক জায়গায় এসে একটা থিওরিতে এসে মিশত,যেটার নাম – “তুই ডাঁহা ফেল করবি”।

আমার যে রুমমেট ছিল,পরীক্ষায় ঐ আমার পিছনে বসত।আজও মনে মনে তাকে ফুল,বেলপাতা,ওল্ডমঙ্ক দিয়ে পুজো করি,কারণ সে না থাকলে আমি হয়ত আজও ইলেকট্রিকালের তারে আঁটকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেই থাকতাম।পাড়ার বয়স্ক ছুঁচিবাই গ্রস্ত বুড়ী আঁশবটি দেখলে যেরকম বদন বানায় বি.এল থেরেজার বইটি দেখলে আমার সে দশা হত।আমার সামনের সিটে বসত – এক বিহারী বাবু।সে আবার অন্য জিনিস।ছোটবেলায় কার্টুনে দেখেছি অস্ট্রিচ গাড়ি ধাওয়া করে দৌড় দেয়।গাড়ির সমান্তরালে গাড়ির দিকে তাকিয়ে দৌড়োয়।বা ধরুণ,ট্র্যাকে বোল্ট, গ্যাটলিনের দিকে তাকিয়ে দৌড়চ্ছে।সেমের সময় সে বিহারীচাঁদের খাতা থাকত সামনে,মাথা থাকত পেছন দিকে ঘুরে।আধিভৌতিক দৃশ্য। এক্সরসিজম পুরো।

তা বিহারী চাঁদ আমায় বলল – “ভাই হাম ইলেকট্রিকালওয়া সাম্ভাল দেগা, আইআইটিকা প্রিপেয়ার কিয়া থা,সাব জানতা হু, তুম বাকি দেখলেনা”।উফ। ইনসিওরেন্স হল।এবার রুমমেট কাম তারণহার কে জিজ্ঞেস করলাম – “ভাই ইলেকট্রিকালটা উতরে দে,তারপর ভাই,যা খেতে চাইবি খাওয়াব”।সম্মতি দিয়ে মুচকি হাসল।

পরীক্ষার আগে এক/দুদিন ছুটি ছিল।রাত নেই দিন নেই মুখস্ত করছি।সে ইলেকট্রিকাল কি আর মুখস্ত করে হয় রে পাগল।একটা গোটা চ্যাপটার পড়ে একটা বন্ধুকে গিয়ে বললাম – “ভাই এই চ্যাপটার থেকে আমায় একটা প্রশ্ন কর্ তো? সে একটা প্রশ্ন করল আমায়।খুব সোজা প্রশ্ন নাকি সেটা।আমার ঘাম ছুটে গেল।গোটা পাঁচেক বিড়ি, গোটা তিনেক ফোর স্কোয়ার সিগেরেট খেয়ে ফেললাম।সিওর হয়ে গেলাম যে – বিহারী আর রুমমেটের ডবল ইনসুরেন্স কাজ না করলে,আমি এবার সিওর সাপ্লি খাচ্ছি।অগত্যা শর্ট কোশ্চেন দশ নম্বর।কোন দুটো থিওরি, দুটো অঙ্ক করতেই হবে হলে থেকে।

পরীক্ষার আগের দিন – বিহারীকে ফোন করছি – “ভাই, বাঁচা লেগা তো?”
ও বলছে – “আবে টেনশান কাহে কারতা হ্যায় বাবুয়া,হাম হু না।”
পরীক্ষার দিন সকালে – মাকালী,লোকনাথ বাবার ফটো জাপ্টে বসে ইমোশানাল ডায়লোগ দিচ্ছি।
“প্রভু তোমার কাছে কবে আমি সিরিয়াসলি কিছু চেয়েছি বল,এ যাত্রাটা উতরে দাও প্রভু।মা ও মা,আমি তো তোর সন্তান বল..আমায় তুই পার করবি নে মা?” বলে লাল কালির পেন দিয়ে নিজেই কপালে সিঁদুরের টিপ দিয়ে বেরোলাম সেম দিতে।

হলে ঢুকে শুনলাম – সে প্রবল ধামসা মাদলের আওয়াজ।শালা এমন দিনে কে ধামসা বাজাচ্ছে?খেয়াল করে দেখলাম আমার বুকের ভেতরেই সে বাজছে।কীভাবে সময় নষ্ট করেছি সব ফ্ল্যাসব্যাক হচ্ছে।স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি – খবরের কাগজে আমার ছবি সমেত লেখা বেরিয়েছে – “কারীগরি বিদ্যা পড়েও আজ রিক্সাচালক”। কোন মতে কাঁপতে কাঁপতে সীটে গিয়ে বসলাম।মুমূর্ষু রুগীর সার্জারি হলে তার আত্মীয়রা যেরকম ঠাকুর ডাকে সেই ফ্রিকোয়েন্সি সেট করে ডাকছি ঠাকুর।কিন্তু সারা বছর না পড়লে ঠাকুর আর কী করবেন।

প্রশ্নপত্র হাতে পেলাম।একবার চোখ বুলালাম।জল শুকিয়ে গেল।আজ বিধাতাও আমার সাপ্লি খাওয়া ঠেকাতে পারবে না যদি না বিহারী আর রুমমেট বাঁচায়।৭০ এ এই ১২/১৪ মত পারব নিজে।

বিহারীকে বললাম – “আবে কিতনা কর পায়েগা?”
সে যা বলল – শুনে ইচ্ছে হল শুয়োরটাকে ওখানেই লিট্টি চোখা বানিয়ে দে।বলছে “ভাই মুস্কিল সে পাচ্চিশ তিস হো পায়েগা,কুছ ইয়াদ নাই আরাহা”।এই তোর আইআইটি শালা?পেছনে ঘুরে ফিসফিস করে রুমমেটকে শুধোলেম –
“ভাই কত পারবি?” বলল “ভাই কোশ্চেনে সিওর গড়বড় আছে – ৩০/৩৫ এর বেশী হচ্ছে না।”
“আঃ শান্তি প্র্যাক্টিকাল নিয়ে টায়টায় পাশ করে যাব হয়ত”।বলল – “না!অঙ্কর উত্তর না মিললে ফুল নম্বর কাটে,পার্ট নেই”।সর্বনাশ।

এক ঘন্টা পরীক্ষা দিচ্ছি।হঠাৎ স্যারেরা দৌড়ে এসে বলছে – “স্টপ রাইটিং!” জানতে পারলাম কোশ্চেন বিভ্রাট হয়েছে।
কম্পিউটার সায়েন্স আর আইটি ডিপার্টমেন্টকে, ইনস্ট্রুর কোশ্চেন পাঠানো হয়েছে।আঃ শান্তি,গ্রেস মার্কস পেয়ে বেরিয়ে যাব।আবার শুনলাম ইউনিভারসিটি থেকে নতুন কোশ্চেন সেট আসছে।বেশ ভাবছিলাম গ্রেস পেয়ে উতরে যাব,সেটা গেল।আনন্দের খবর – নিজেদের কোশ্চেনে হয়ত ১৪র বদলে ২০/২৫ নিজে পারব।আত্মসম্মান বোধ আমার বরাবরই বেশী।

হলে সব বসে আছি।নতুন কোশ্চেন এল ঘন্টাখানেক পরে।হায় হতোস্মি!!! নিজেদের কোশ্চেনে দেখলাম মেরে কেটে ৬/৭ পারব।পাঁকের শুয়োর সোফায় বসতে চেয়েছিল।মা কালী বাতাসা,নকুলদানা,ধুপে পটলেন না।বিহারী ও কাঁদোকাঁদো।মনে হচ্ছিল শালাকে জ্যান্ত কবর দি।রুমমেটের অবস্হাও ৯৬ ভারত শ্রীলঙ্কা সেমিফাইনালের কাম্বলির মতন।হলে ফিঁসফাঁস চলছিল।তার মধ্যে গার্ড হুঙ্কার দিল – “আমার গার্ডে এসব করলে চলবে না”।অনেক করে তাকে কনভিন্স করা হল – “ম্যাম্।আমাদের ক্লাস হয়নি বিশেষ”।তাতে সে আরও চটে গেল।তারপর বলা হল – “ম্যাম্,যা কোশ্চেন হয়েছে এমনিই কেউ পারবে না”।সবাই “হ্যাঁ ম্যাম্,প্লিজ ম্যাম” বলে উঠল।চুপিসারে সবে মিলি করি কাজ শুরু হল।

প্রথম অঙ্ক – বিহারী বলে দিল।ডায়াগ্রামের জায়গাটা ফাঁকা রাখলাম।উত্তর বের করেছে ১৯*১০^৩০ ভোল্ট গোছের কিছু একটা বদখত দেখতে,খানিক অ্যাভোগ্যাড্রো সংখ্যার মত।ইলেকট্রিকাল বদখত সাব্জেক্ট।উত্তর বদখত্ হবে স্বাভাবিক।পেছনে রুমমেটের কাছে জানতে চাইলাম – “কত বেরিয়েছে প্রথম প্রশ্নের আন্সার?” বলল – “২ অ্যাম্পিয়ার”।অ্যাম্পিয়ার বোধহয় কারেন্ট প্রবাহ মাপার একক।তা আমি শকটা খেলাম ভোল্টে।একজনের উত্তর কেষ্টপুর খাল তো একজনের থেমস্ এসেছে।আরেকজনকে জিজ্ঞেস করলাম সেও বলল উত্তর ২ অ্যাম্পিয়ার।এদিকে বিহারী সমানে বলে যাচ্ছে ওর উত্তর ঠিক।আমি কাউকেই অখুশী করতে চাই না,শুধু পাশ করতে চাই,”দাদা! আমি বাঁচতে চাই”।বিহারীর থেকে ছাপা অঙ্কে, রুমমেটের আঁকা ডায়াগ্রাম আঁকলাম।উত্তর ও বসালাম রুমমেটের।মানে “মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে” কেস।

খানিক পরে বিহারী আর রুমমেটের স্টক ফুরিয়ে গেল। গুনে দেখলাম ৩০ মত আন্সার করেছি কুড়িয়ে বাড়িয়ে। অঙ্ক ভুল হলে,সিওর ব্যাক্।

দাস্তান এ ইঞ্জিনিয়ারিং

হঠাৎ দেখলাম ক্লাসে আলো ফুটে উঠল – আমাদের সারিতেই একটা বন্ধু,আমাদের ক্রিকেট টিমের উইকেট কীপার এর মাথার চারধারে গোল করে আলো ফুটেছে।সেই ঠাকুরের সিরিয়ালে ব্রহ্মা,নারায়ণের মাথায় যেমন হয় তেমন, হ্যালো।বলছে – ওর নাকি সব কমন এসেছে।তবে শেষের বেঞ্চি থেকে রিলে হয়ে আসতে আসতে সে উত্তর যে অমিতাভ বচ্চন থেকে জনি লিভার হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই,তবুও মন্দার বাজারে মন্দ কি?

পেছনে হাল্কা ঘার কাত করে অন্যের খাতার দিকে তাকিয়ে নিজের খাতায় নিখুঁত ডায়াগ্রাম কপি করা একটা অার্ট।পিকাসো যদি একটিবার দেখতেন এটা।আহা!

হঠাৎ দেখলাম “হায় হায়” করে কান্না জুড়েছে বিহারী।পুরো ঘুরে বসে আমার খাতা দেখে ছাপছিল,ম্যাম এক ফাঁকে এসে তার খাতা তুলে নিয়ে গেছে,বেচারী বিগত দশ মিন ধরে পেন দিয়ে বেঞ্চের উপর লিখে গ্যাছে বোধহয়। হুশই নেই কোনও। যাই হোক কুড়িয়ে বাড়িয়ে আমি উত্তর দিলাম ৫০ মত। বিহারী ৫৫। রুমমেট ৬০ মত। আমার ম্যানেজমেন্ট পড়া উচিৎ ছিল।

আজও যখন রেস্যুমে তে বি.টেক টাইপ করি,এই ঘটনাটা মনে পড়ে।বুকে একটা মৃদু কাঁপুনি হয়। অবিশ্যি এখন ইলেকট্রিকাল কোন কাজে লাগে না বলে অতটা বিবেকে লাগে না।বউ যখন প্রেমিকা ছিল,তখন ওকে বলেছিলাম ঘটনাটা।হাঁ হয়ে গেছিল।বলেছিল – এই তুমি ইঞ্জিনিয়ার? বললাম – হয়ত বড় ইঞ্জিনিয়ার নই,কিন্তু গল্পের আসরে তুমি এটা শুনতে চাইবে না থেবনিন্ বস নর্টন্স থিওরেম?

অজস্র ঘটনা আছে এরকম,একে একে লিখব – দাস্তান এ ইঞ্জিনিয়ারিং ।

 

Author: Gulgulbhaja

#collected form https://www.facebook.com/Gulgulbhaja

~ দাস্তান এ ইঞ্জিনিয়ারিং ~

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleবাউল সহজিয়া ও বর্তমান প্রজন্ম
Next articleনদী
Hatpakha Magazine
Hatpakha is an online Bengali English magazine where people from all across the world can participate and share their knowledge with the people world over.
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments