Continue to Part 1
‘মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল’। ক্লাস নিচ্ছেন শিক্ষক হেমচন্দ্র কানুঙ্গ। ‘শুধু এই পুঁথিগত বিদ্যায় আজ আর কাজ চলবে না। দেশকে স্বাধীন করা, অত্যাচারী ইংরেজদের হাত থেকে রক্ষা করাই আমাদের মুল উদ্দেশ্য। তার জন্য প্রয়োজন হলে হাতে অস্ত্র তুলতে হবে’। দ্বিতীয় বেঞ্চে বসে এক কিশোর তখন টগবগ করে ফুটছে। মাস্টারমশাই এর কথা শেষ হওয়ার আগেই দাঁড়িয়ে পড়ে সেই কিশোরটি, ‘মাস্টারমশাই, আমায় একটা রিভালবার দেবেন?’। বিপ্লবী শিক্ষক হেমচন্দ্রের চোখ এড়িয়ে যায়নি সেই কিশোরের দুচোখের দীপ্তি, উনি জানতেন নিজেরই অজান্তে এই কিশোর নিজেকে দেশমাতার জন্য আত্মবলিদান দিতে প্রস্তুত করে তুলেছে। অত্যন্ত গম্ভীরভাবে তিনি সেই কিশোরকে স্কুলের টিফিনের সময় দেখা করতে বলেন।
দূরে পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে ক্ষুদিরাম। হথাত পেছন থেকে কাঁধে একটা ভারী হাতের স্পর্শ। পেছন ঘুরে দেখে ক্ষুদিরাম, একহাত দূরে দাঁড়িয়ে ওর শিক্ষক হেমচন্দ্র কানুঙ্গ। ‘তুমি বিপ্লবী সংগঠনের ব্যপারে কিছু জানো?’ ক্ষুদিরাম হয়ত এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল। ‘আমি অরবিন্দবাবু ও সিস্টার নিবেদিতার সভায় গিয়েছিলাম। সেখানেই আমার কয়েকজনের সাথে পরিচয় হয়’। ১৬ বছরের সেই কিশোরটিকে অবাক হয়ে দেখেন হেমচন্দ্র বাবু। ‘আজ বিকেলে একবার কলেজ মাঠে আসবে। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে’।
আমি প্রায় হারিয়ে গেছিলাম আজ থেকে ১০০ বছর আগের এই মেদিনীপুর শহরে। আমার বাড়ি খড়গপুরে হলেও মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল, কলেজ মাঠ সমস্তকিছুই আমার অতি পরিচিত। বহুবার এসেছি এইসব স্থানে। আমার পিঠে অসিত কাকুর হাতের স্পর্শে আমার হুঁশ ফেরে। ‘কেমন লাগছে মৃন্ময়?’ কাকুর প্রশ্নের জবাবে আমি কিছুটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বলে উঠেছিলাম ‘দারুন কাকু দারুন। সত্যি ইতিহাস যে এভাবেও পড়া যায় তা ভাবতেই পারিনি। যেন সব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। সত্যি সমস্ত ঘটনা আমার জানা অথচ কিসুন্দর লাগছে পড়তে’। আবার পিঠটা চাপড়ে দিয়ে কাকু বলে উঠলেন ‘তুমি পড়ছনা মৃন্ময়, তোমার সাথে হাজার হাজার ক্ষুদিরামের পরিচয় হচ্ছে। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম মৃন্ময়। তোমার মত কিশোররা ক্ষুদিরামকে চিনুক জানুক। কিন্তু ওই জানোয়ারগুলো আমাকে আমার কাজ করতে দিলনা’। দূর থেকে ‘কাহো না পেয়ার হ্যায়’ গানটা ভেসে আসছিল, বুঝলাম কাকুর ইঙ্গিত ওইদিকেই। আমি একটু মুচকি হাসলাম আড় কাকুর দিকে তাকালাম। দেখি কাকু বেশ উদাস হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওইভাবেই আমাকে বললেন ‘মৃন্ময়, আমার খুব ইচ্ছে ছিল তোমার মত কিশোরদের ক্ষুদিরামের সাথে পরিচয় করানো। আজ তো ১৫ই আগস্ট, স্বাধীনতা দিবস। তাই তোমাকে ক্ষুদিরামের সাথে দেখা করালাম। কিন্তু আরো অনেকে আছে। আমার কাজটা তুমি করো’। কাকুর কথাটা ছিল প্রচণ্ড ধোঁয়াশাময়। তখন আমার বয়েস সবে ১৫, তাই কিছুই বুঝিনি। আমি আবার ডুব দিলাম বইয়ের মধ্যে।
কলেজ মাঠে ১৫-১৮ বছর বয়সী প্রায় জনা দশেক ছেলে, তাদের মধ্যে ক্ষুদিরামও উপস্থিত। সকলে গোল করে ঘিরে রেখেছে এবং মাঝে সেই মাস্টারমশাই হেমচন্দ্র কানুঙ্গ। ‘তোমরা প্রত্যেকে আজ থেকে বিপ্লবী দলের অংশীদার হলে। আমাদের মুল লক্ষ্য মোট দুটি; সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করা ও স্কুলের ছাত্রদের অনুপ্রানিত করে বিপ্লবী দলে অংশীদার করা’। এই ব্যাপারে তোমাদের কারুর কোন মতামত আছে। বেষ্টনীর মাঝ হতে ক্ষুদিরাম বলে ওঠে ‘মাস্টারমশাই, শুধু বক্তৃতার মাধ্যমে ছাত্রদের দলে টানা যাবেনা। ওদেরকে লিফলেট দেওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে। যেন ওরা লুকিয়ে বাড়িতে আমাদের সমস্ত ভাবনা পড়ে বুঝতে পারে’।
কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ক্ষুদিরাম ও আরও তিন কিশোর, হাতে প্রায় ২০০-৩০০ লিফলেট, সবই হাতে লেখা। একেকজন করে এগিয়ে আসছে, আর তার হাতে চলে যাচ্ছে লিফলেট ও ভবিষ্যতের বিপ্লবী হওয়ার অঙ্গীকার। হথাত একটা পুলিশ ভ্যানের আওয়াজ। ছাত্ররা সব এলোমেলো হয়ে যায় কিন্তু দৃঢ়চেতা ক্ষুদিরাম হাতে লিফলেট নিয়ে নির্বিকারের মত কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। দুজন হাবিলদার মারতে মারতে গাড়িতে তোলে।
কলেজ মাঠের এক কোনে বসেছে গুপ্ত সমিতির বৈঠক। ‘ক্ষুদিরামকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে, হয়ত এতক্ষনে ও সকলের নাম বলে ফেলেছে, সুতরাং আমাদের সতর্ক হয়ে যাওয়া প্রয়োজন’। হেমচন্দ্রবাবুর সাথে সকলেই একমত, ঠিক এমনসময় পেছন থেকে হাঁসতে হাঁসতে ক্ষুদিরাম এসে হাজির। সুমিষ্ট হাঁসির সাথে বলে ওঠে ‘আপনারা কোন চিন্তা করবেন না, ওরা একটাও কথা বার করতে পারেনি। কমবয়সী ছেলে বলে ছেড়ে দিয়েছে’। অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে থাকে ক্ষুদিরামের দিকে, সারা শরীরজুড়ে আঘাতের ক্ষতবিক্ষত চিহ্ন। হেমচন্দ্র বাবু পিঠ চাপড়ে নিজের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রকে বাহবা জানান ও বলেন ‘ক্ষুদিরাম, তোমার ওপর নতুন এক দায়িত্ব অর্পণ করা হোল। ইদানিং স্কুল কলেজের কিছু ছাত্র নরমপন্থীদের বিভ্রান্তনীতিতে আকর্ষিত হয়ে উঠছে। ওরা জানেনা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির মত নরমপন্থীরা আসলে ব্রিটিশদেরই সুবিধা করে দিচ্ছে। অনুনয় বিনয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা কখনো অর্জিত হয়না। স্বাধীনতা অর্জিত হয় রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে। তুমি ছাত্রদের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয়। আগামী শনিবার কলেজে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। সেখানে তুমি সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির বিরুদ্ধে ও নরমপন্থীদের বিরুদ্ধে বলবে। এরজন্য তোমায় পড়াশুনা করতে হবে, এই কাগজগুলো তুমি রাখো ও সময় করে এগুলো পড়ে নিয়ো। বক্তৃতা দিতে কাজে আসবে’।
কলেজের মধ্যে একটি রোগা ছিপছিপে শরীরের তরুন আর তাকে ঘিরে হাজার হাজার ছাত্র। ক্ষুদিরামের প্রতিটা শব্দে উপস্থিত ছাত্রদের মধ্যে দেশপ্রেমের আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে। ‘ভিক্ষা করে কখনো স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব নয়। এই অত্যাচারী ব্রিটিশরা প্রথমে আমাদের সংস্কৃতি তারপর আমাদের সভ্যতা, এক এক করে সমস্তকিছুকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ব্রিটিশদের আমদানি করা বিদেশী বস্ত্র আমরা পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শুধু বর্জন করাই নয় মেদিনীপুর শহরে সমস্ত বিদেশী বস্ত্র পুড়িয়ে ফেলা হবে। কিছু নরমপন্থী মানুষ নিজেদের ভ্রান্ত নীতির মাধ্যমে যুবসমাজকে ভুল পথে চালিত করছেন। ওনাদের জন্য ইংরেজরা আরও সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। সুরেন্দ্রনাথ বাবুকে আমি সম্মান করি কিন্তু তার নীতিকে নয়’। সভায় উপস্থিত ছাত্রদের মধ্যে করতালি দেওয়ার হুল্লোড় পড়ে যায়।
‘ক্ষুদিরাম তোমায় নতুন একটি দায়িত্ব দেওয়া হোল। অত্যাচারী শাসক কিংসফোর্ডকে হত্যা করে আপামর ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতার আশার আলো জ্বালিয়ে দিতে হবে। এই ব্যাপারে তোমার সঙ্গী হবে গুপ্ত সমিতির প্রফুল্ল চাকী। তোমরা দুজন আজই মজফরপুর রওনা হয়ে যাও। ওখানে কিশোরমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় এর ধর্মশালায় তোমাদের থাকার ব্যাবস্থা হয়েছে। সন্ধ্যের সময় নিজের লিটন গাড়ি চেপে কিংসফোর্ড ক্লাবে যাবে, সেইসময়ই তোমরা ব্যোম ছুঁড়বে’।
‘কতটা পড়লে মৃন্ময়’। অসিতকাকুর কথায় আমি প্রায় চমকে উঠলাম। সত্যি কি অপূর্ব। আমি যেন টাইম মেশিনে চড়ে আজ থেকে ১০০ বছর আগের মেদিনীপুরে পৌঁছে গেছি। ‘প্রায় ১ টা ঘণ্টা কেটে গেছে। তোমাদের গাড়িটা হয়ত এক্ষুনি এসে যাবে। আর বরং পড়তে হবেনা, তুমি আমার কথাটা মন দিয়ে শোন’। আমি চুপ করে অসিতকাকুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ‘ক্ষুদিরাম একা নয়, এরকম কোটি কোটি তরুন স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রানত্যাগ করেছে। জানো ফাঁসির দড়ি গলায় ঝোলানোর সময় ক্ষুদিরাম কি ভেবেছিল?’। আমি নির্বাক হয়ে কাকুর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ‘ওর প্রচণ্ড আফসোস হয়েছিল, নিজের কাজটা সঠিকভাবে করতে না পারার জন্য। গুপ্ত সমিতিতে কিভাবে আরও তরুন ছাত্রদের যুক্ত করা যায় সেই নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা ছিল। একটা পাপবোধ ছিল কিংসফোর্ডকে না মেরে তিনজন নিরপরাধ মানুষকে খুন করায়’। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম কাকুর দিকে। ‘যখন ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়েছিল ও তোমার চেয়ে মাত্র ৩ বছরের বড় ছিল। তুমি পারবে এরকম নির্ভীক হতে? আমি তো পারবো না। আমরা কেন ওদের মত হতে পারিনা? উত্তর একটাই; যথার্থ আদর্শের অভাব’।
কাকুর কথাগুলো আমার শরীরে রক্ত সঞ্চালন তীব্রতর করে তুলেছিল। ‘আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। আমি শুধু এটাই চাই যে আজ থেকে তোমার আদর্শ বিগ বি রা নয় ক্ষুদিরামরা হোক’। কাকুর কথায় আমার কেমন একটা খটকা লাগে। আমি কখনোই সেভাবে অমিতাভের ফ্যান নই, কিন্তু এটা সত্যি যে গাড়িতে ওই চাঁদা পার্টিদের কাকু যখন তাড়িয়ে দিলেন আমার অমিতাভের কথাই মনে পড়েছিল। আবার একটা মিষ্টি হাঁসির সাথে কাকু বলে উঠলেন ‘কি অবাক হয়ে যাচ্ছ বুঝি! গাড়িতে তুমি এটাই তো ভেবেছিলে ‘পুরো অ্যাংরি ইয়ংম্যান লুক’। এটাই ভাবছ তো আমি কিকরে জানলাম? আমরা যে অন্তর্যামী, মৃন্ময়’। আমার গাটা ক্রমশ ছমছম করতে শুরু করল। কাকুর সেই বরফশীতল হাতটা আবার আমার হাতটা স্পর্শ করল। ‘চল, মৃন্ময়, আর একটা কাজ বাকি আছে। ব্যাস তারপরেই আমার ছুটি’। কিছুটা নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই আমি দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সেই ইঁদুর মরে যাওয়ার মত পচা দুর্গন্ধটা ক্রমশ তীব্রতম হতে লাগলো। আর একপাও সামনে এগোতে ইচ্ছে হচ্ছিলনা আমার। কিন্তু কিছুটা মোহের মধ্যে পড়ে যাওয়া মানুষের মত আমি সামনে এগিয়ে চলছিলাম।
‘কাল রাতে আমি এখানেই এসেছিলাম। উল্টোদিকে একটা ক্লাব আছে, তার ছেলেরা আসে আমার কাছে। বলে দাদা, ১০০ টাকা চাঁদা দিন, স্বাধীনতা দিবস পালন করব। ওরা ১৫ই আগস্টকে পাড়ার কালীপূজার পর্যায়ে ফেলে দিয়েছে। প্রথমে আমি তর্ক করলাম। মৃন্ময়, অশিক্ষিত মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কি জানো?’ আমার গাটা প্রচণ্ড ছমছম করছিল। কোন উত্তর দেওয়ার মত অবস্থায় আমি ছিলাম না। কিছুটা দূরে একটা ছোট মত ঘর, সেদিকেই আমরা এগিয়ে চলছিলাম। কাকুই উত্তর দিলেন, ‘অশিক্ষিত মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ওদের যুক্তিহীনতা’। আমি একবার কাকুর দিকে তাকালাম। কাকুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। যেন সারা জীবনের সমস্ত হতাশা একসাথে কাকুকে গ্রাস করেছে। ‘কতকিছু ভেবে রেখেছিলাম। তোমাদের মত ছেলেদের জন্য বই লিখবো। নীতি আদর্শের কথা তোমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবো’। আমি শুধুই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম কাকুর মুখের দিকে।
‘প্রথমে কথা কাটাকাটি হোল আর তারপর ওদের মধ্যে একজন সজোরে আমার মাথার পেছনে আঘাত করল। বুঝতে পারিনি এতটুকু আঘাতেই এই অবস্থা হয়ে যাবে’। ততক্ষনে আমি পাশের ঘরটার দরজার কাছে এসে গেছি। দরজাটা বাইরে থেকে ভেজানো। ভীষণ বিশ্রীরকম একটা দুর্গন্ধ আসছে ঘরটার মধ্যে থেকে। ‘এক্ষুনি হয়ত তোমার গাড়িটা এসে যাবে। আমার একটা কথা সারাজীবন মনে রেখো, নীতি আদর্শের পথটা প্রচণ্ড কঠিন কিন্তু প্রচণ্ড সুখের, মরেও তৃপ্তি পাওয়া যায়’। কাকু প্রচণ্ড জোরে দরজায় একটা ধাক্কা মারলেন সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা দুফাক হয়ে খুলে গেলো। চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখেছিলাম তারপর ওখানে আর এক মুহূর্তও থাকা সম্ভব ছিলনা। আমার চোখের সামনে পড়ে রয়েছে অসিত কর্মকারের ক্ষতবিক্ষত দেহ। শরীরের বিভিন্ন স্থানে খুবলানো। মৃতদেহটার ওপর মাছি ভনভন করছে। ভয়ভয় চোখে একবার ডানদিকে তাকালাম, যে মানুষটা এতক্ষন আমার সাথে দাঁড়িয়েছিল সে নেই। চোখদুটো বুজে নিয়ে আমি পেছনদিকে দৌড় লাগালাম। জানিনা কি হয়েছিল, তবে যখন জ্ঞান ফিরল দেখি আমি এক বাড়ির মধ্যে। আমার একদিকে বাবা, প্রতীকদা আড় অন্যদিকে বাকি সবাই বসে আছে। ওদেরও মুখে চিন্তার ছাপ। জানি চিন্তাটা শুধু আমায় নিয়ে নয়, ভরদুপুরে তাও আবার স্বাধীনতা দিবসে ভূতদর্শন করায় ওরাও একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে।
বাবা আর প্রতীকদা আমায় ধরে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে ভালো করে জল দিলো। আমিও কিছুটা শান্ত হলাম। বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম ‘বাবা, তুমি জানো অসিত কাকু…’। আমার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই বাবা উত্তর দিলেন ‘হ্যাঁ বাবা, এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু ঘটে যা নিজের চোখকেই বিশ্বাস করানো যায়না’। এক এক করে প্রতীকদার হবু শ্বশুরবাড়ির প্রত্যেকে এসে আমার সাথে কথা বললেন, কিন্তু আমার দুচোখ জুড়ে শুধুই অসিত কাকু আর শহীদ ক্ষুদিরাম। খাবার টেবিলে বাবার মুখ থেকেই জানতে পারলাম আমাদের ড্রাইভারই পুলিশে খবর দিয়েছে ও অচৈতন্য অবস্থায় আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। পুলিশ নাকি ক্লাবের দুজন সন্দেহভাজন সদস্যকেও গ্রেফতার করেছে। আমি আনমনেই ছিলাম, এক ভদ্রমহিলা আমার উদ্দেশ্যে বললেন ‘তোমার হবু বৌদিকে তুমি কোন প্রশ্ন করবেনা? সবাই তো কিছুনা কিছু প্রশ্ন করল’। আমি কিছু বলার আগেই বাবা বলে উঠলেন ‘ও বাচ্চা ছেলে ও কি প্রশ্ন করবে?’ তাও দেখলাম সবাই একি কথা বলে গেলেন ‘না, কিছু হলেও প্রশ্ন করতে হবে’। সেই লাজুক মেয়েটির মুখের দিকে আমি তাকালাম। নিজের অজান্তেই আমার মুখ থেকে একটা প্রশ্ন বেরোল; ‘তুমি শহীদ ক্ষুদিরামকে চেন?’
জানিনা, কেন সেদিন এই প্রশ্নটা করেছিলাম। সত্যি বলতে ইতিহাসের বইতে ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়-বাদল-দীনেশদের সম্বন্ধে প্রচুর পড়লেও ওদের চিনতে কখনো পারিনি। স্কুলে বহুবার ১৫ই আগস্ট উদযাপন করলেও কখনো স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বুঝিনি। আজ থেকে ঠিক ১০ বছর আগের সেই ১৫ই আগস্ট আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছিল। আজ এই গল্পটা লেখার সময়ও আমার বাড়ির পাশে তারস্বরে মাইকে হিন্দি গান বেজে চলেছে এবং আজ ১৫ই আগস্ট।