প্ল্যাটফর্মের ঘড়িতে সাতটা বেজে ত্রিশ মিনিট । এখনও সাতটা পনেরো -এর ট্রেনের টিকিটুকুরও দর্শন নেই । কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে যদিও প্ল্যাটফর্মে ট্রেন পৌঁছনোর পূর্বে ট্রেনের দেখা পাওয়া বড়ই দুষ্কর , তবুও ট্রেনের কিয়দংশের দর্শনপ্রাপ্তি রোজকার যাত্রীদের মনে যে শান্তির যোগান দেয় তা লাভের জন্যই কয়েকজন প্লাটফর্মের ধার বরাবর ঝুঁকে প্রায়ই উঁকি মেরে দেখতে থাকে –ট্রেন আর কত দূরে । দেবপ্রিয়া যদিও ব্যতিক্রমী । কলেজে পরীক্ষা চলছে , তাই যতটুকু সময় পাওয়া যায় ট্রেন আসার পূর্বে তার বিন্দুমাত্র যাতে বিফলে না যায় সেজন্যই পুস্তক পাঠে গভীর মগ্ন দেবপ্রিয়া ।
প্ল্যাটফর্মের ধার থেকে একজন মহিলা যাত্রী বলে উঠলেন , ” ট্রেন ঢুকে গেছে, ট্রেন ঢুকে গেছে….বাবাঃ যা ভিঢ় দেখছি , আজ তো ট্রেনে উঠতে পারা যাবে না…।” দেবপ্রিয়া তাড়াতাড়ি করে ব্যাগে বই কোনমতে ঢুকিয়ে রেখে ভারী ব্যাগটাকে সামনে নিয়ে প্ল্যাটফর্মের ধারে এগিয়ে এল । সত্যিই যা ভিড় , দেখে মনে হচ্ছে ট্রেনটা যেন সারা বিশ্ব থেকে মানবসংগ্রহের পর এই স্টেশনে এসে একটু বিশ্রাম নিল । এবার শুরু হবে রোজকার প্রতিযোগিতা –ট্রেনে উঠতে পারার প্রতিযোগিতা । এতে কার কী হারিয়ে গেল , কে পড়ে গেল , কেইবা মারা গেল -তার খবর রাখে না কেউ , শুধু আলোচনা হয় এ নিয়ে নিজেদের সময় ব্যহত করার জন্য ।
যাইহোক , দেবপ্রিয়া কোনমতে উঠে গেল ট্রেনে । পিছনে একজন মহিলা ট্রেনের দরজা ধরে ঝুলছে দেখে দেবপ্রিয়া সামনের যাত্রীদের উপর হাল্কা চাপ প্রয়োগ করে এগিয়ে যেতে বললো । ট্রেনের ভেতর দরজার দু’ধারে একাধিক লাইনে সজ্জিত দূরযাত্রীদের মধ্য থেকে একজন বিরক্তির সুরে দেবপ্রিয়াকে জোড়ে ঠেলা দিয়ে বলে উঠলেন ,” ঠেলছ কেন বাপু , এত ঠেলছ কেন ? পুরো গা-এর উপর হেলে পড়ছ….আর ব্যাগটা তোমার মাথার উপর নাও , তোমার ব্যাগের চাপে তো আমার কোমড়-ই ভেঙে গেল — সরাও ব্যাগটা , সরাও….ভারী ভারী সব ব্যাগ নিয়ে ট্রেন এ উঠবে….কী ভরে আনে কে জানে…পড়তে যায় না ছাই…।” অথচ দেবপ্রিয়ার ব্যাগ আর তাঁর কোমড়ের মধ্যে যে দূরত্বের ব্যবধান , সেখানে জায়গা করে নিয়েছে তাঁরই প্রাণাধিকপ্রিয় বান্ধবীর ব্যাগ । দেবপ্রিয়া জানে এদের সাথে তর্কে ওর জয় অসম্ভব , কারণ এইসকল যাত্রীরা আবার নির্দিষ্ট কোনও লাইন অনুসরণ করে তর্ক চালাতে খুব একটা ভালবাসেন না । দেবপ্রিয়া তাঁদের কথায় ভ্রূক্ষেপমাত্র করল না ।
কষ্ট করে ভিড় ঠেলে দেবপ্রিয়া মুখোমুখি সিটের মাঝের প্যাসেজে(চ্যানেল) ঢুকলো । ব্যাগ রাখার জায়গা নেই কোথাও , বসে থাকা যাত্রীরা কেউ দেবপ্রিয়ার অনুরোধে কর্ণপাত পর্যন্ত করলেন না । অগত্যা ভারী ব্যাগ সাথে নিয়েই দাঁড়াতে হল । দেবপ্রিয়া একটা বই বের করে পড়ার চেষ্টা করতে লাগলো । কিন্তু সে আর সম্ভব হয় কী করে ?এখানে যে প্রচন্ড মাত্রায় আলোচনা চলছে তাতে পড়া মাথায় ঢোকার চেয়ে আলোচনার বিষয়বস্ত মাথায় ঢোকা সহজ হবে বেশি । দেবপ্রিয়া দেখল সিটের ওধার থেকে একজন মহিলা বলে চলেছেন ,”আজকাল কেউ সিট দিতে চায় না , সেই কোনদূর থেকে বসে আসবে আর উঠতেই চাইবে না….আরে , বাকিরা কি বিনা টিকিটে ট্রেনে ওঠে নাকি যে ওরা দাঁড়িয়ে যাবে ?” পাশের যাত্রী বলে উঠলেন ,”তবে দিদি যা-ই বলুন না কেন , এদিক থেকে জেনারেল কম্পার্টমেন্ট লেডিসের চেয়ে অনেক ভালো। ” দেবপ্রিয়ার সামনে যিনি বসেছিলেন তিনি আবার বললেন ,” সত্যিই যা বলেছেন , আমি তো এই দুটো স্টেশন আগে বসার জায়গা পেলাম…আমি বাবাঃ এরকম নই , দুটো-তিনটে স্টেশন বসে নিয়ে লোককে বসার জায়গা দিই।” এখানে একটু বিরতি টানা যাক্। গল্পের শেষে যদি সময় পাওয়া যায় তবে এবিষয়ে পুনরায় ফিরে আসা যাবে ।
হঠাৎ ঝগড়া শুরু হল উল্টোদিকের দরজার কাছে । দেবপ্রিয়ার একটু অর্ধেক কানে এল দুজন মহিলা নিজেদের মধ্যে দারুণ গর্ব ভরে অশ্লীল ভাষার আদানপ্রদান করে চলেছেন । বিষয়টা হল — প্রচন্ড ভিড় এর চাপে একজন মহিলা পড়ে গিয়েছিলেন উল্টোদিকের দরজার কাছে নিজেদের শয়নকক্ষ মনে করে প্রতিদিনের মত বসে থাকা কয়েকজন মহিলা যাত্রীর মধ্যে একজনের উপর । সত্যিই , এটা তো ঘোর অপরাধ । কী সুন্দর সে মহিলা সকল ভিড় এড়িয়ে নিশ্চিন্ত মনে একটু ঝিমোচ্ছিলেন বসে বসে , সেখানে কোথাকার কে এসে ঘাড়ের উপর পড়ে একেবারে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিলে — এটা কে-ই বা মেনে নেবে বলুনতো ? তাইতো বসে থাকা মহিলা উঠে অশ্রাব্য গালাগাল আর কতক চর-থাপ্পড় দিতে থাকলেন । পড়ে যাওয়া মহিলাই বা আর থেমে থাকেন কিরূপে ?
দেবপ্রিয়ার সামনে বসে থাকা মহিলা সামান্য উঠে উঁকি মেরে অনেকবার দেখার চেষ্টা করলেন কী চলছে সেখানে , কিন্তু কিছুই বোধগম্য না হওয়ায় তিনি দরজার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর এক পরিচিতা কে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন –“কী হয়েছেগো ওদিকে ?” সে পরিচিতাও চিৎকার করে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে লাগলেন। বোধকরি এ ঘটনা শোনা তাঁর জন্য খুব জরুরী ছিল , তাই হয়ত তাঁর এত চেষ্টা । সাথে সাথেই সিটে বসে থাকা মহিলাদের আলোচনার বিষয় পরিবর্তিত হয়ে নতুন বিষয় হয়ে দাঁড়ালো “দরজার কাছে ভিড় করে বসে থাকা মহিলারা ।” অথচ একজন মেয়ে ভারী ব্যাগ সাথে নিয়ে পরীক্ষার জন্য পড়ছে , তার দিকে নজর নেই কারও । যদিও নজর নেই বলাটা ভুল । ওপাশ থেকে একজনের নজরে পড়েছিল বলেই তিনি পাশেরজনকে ফিসফিস করে বলেছিলেন , “দেখুন , ভিড়ের মধ্যে পড়া দেখাচ্ছে….ট্রেনটা কি পড়ার জায়গা ?….ঢঙ যতরাজ্যের ।” কথাটা যদিও দেবপ্রিয়ার কান অবধি এসে পৌঁছায়নি , আর পৌঁছালেও যে ও বই বন্ধ করে বাকিদের মত লোকের পরনিন্দা-পরচর্চাতে যোগদান করত, তা আমার মনে হয় না।
উল্টোদিকের প্যাসেজেও কি যেন একটা নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছে । ওহ্ , এবার বোঝা গেল —ওই প্যাসেজের “লিডার” যিনি , তিনি ঠিক করে দিচ্ছেন কে কোথায় বসবে । এতে যদি দূরাগত যাত্রী বসার জায়গা নাও পায় তাতে তাঁর কিছু এসে যায় না । অনেকে মেনে নিতে পারেন না ঠিকই , কিন্তু তাঁরা সাহস করে কিছু বলতেও পারেন না । এক নবযাত্রী তাঁর প্রতিবাদ করায় অনেক বাক্যব্যয়ের পর “লিডার ” তাঁকে হুমকি দেন , “দিত্বীয়বার যদি তুই এ গলিতে ঢুকিস্ তো তোকে দেখে নেব…।”সবাই “লিডারকে” বসিয়ে জল দিয়ে শান্ত করতে লাগল , আর নবযাত্রী অবাক্ হয়ে সেই প্যাসেজ থেকে বেরিয়ে ভিড়ের মধ্যে এসে দাঁড়লো ।
ট্রেন তার গন্তব্য স্টেশনে ঢুকছে । আর দু’মিনিট পর যে যার কর্মস্থানে চলে যাবে — সকল আলোচনার সমাপ্তি ঘটবে , সকল ঝগড়া, সকল ঝামেলা , সকল বিরক্তির অবসান হবে। যে সময়টুকু একসাথে সকলে ছিল , সেই সময়টুকু একটু মানিয়ে চলা , সকলের প্রতি সহানুভূতিশীলতা এত ভিড়ের মাঝেও এই ট্রেনযাত্রাকে যে আনন্দের করে তুলতে পারত —তা এই ট্রেনযাত্রীরা কখনই বুঝল না। লোকের মুখে সহানুভূতির কথা থাকলেও বাস্তবে তার অভাব প্রতিমূহূর্তে অনুভব করতে পারল দেবপ্রিয়া। তাইতো ষষ্ঠ স্টেশন পেড়োনোর পর ট্রেন যখন গন্তব্য স্টেশনে ঢুকল তখনও দেবপ্রিয়া দাঁড়িয়ে । দেবপ্রিয়া নিঃশব্দে প্যাসেজ ছেড়ে বেরিয়ে এল ।