হঠাৎ স্নাইপার আতংক
ওয়াশিংটন ডিসিতে থাকা অবস্থায় একটি বড় রকমের ঝামেলায় পড়ে গেলাম। বিকেলে হোটেলের লবিতে মেরি সকলকে জরুরি তলব করলো। তার চোখে বিশাল দুশ্চিন্তার ছায়া দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলাম। আল কায়দা আবার এ্যাটাক করলো কিনা সেই ভাবনায় পড়ে গেলাম। আশংকা অনেকখানি সত্য হল। ওয়াশিংটন ডিসি আক্রান্ত, তবে আল কায়দা দ্বারা নয়, খোদ আমেরিকান স্নাইপার দ্বারা। হঠাৎ করেই উদয় হয়েছে ঐ ভয়ংকর স্নাইপারের। প্রতিদিন সন্ধ্যায় স্নাইপারের টার্গেট হচ্ছে নীরহ মানুষ। গত দু’দিনে গুলি করে মেরেছে ৭ জনকে, আহত করেছে প্রায় অর্ধ ডজন লোককে। স্নাইপারের ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে সারা আমেরিকায়। সিএনএনসহ সকল টিভি চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে এই সংবাদ ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। সিএনবিসি চ্যানেলে নিরাপত্তা বোদ্ধারা টকশোর টেবিলে আলোচনার ঝড় তুলে যাচ্ছেন। রাস্তা ঘাটে লোকজনের মুখে এই একই আলোচনা। সর্বত্র কেমন যেন একটি আতংক আতংক পরিবেশ।
প্রথম দিকে ঘটনার তীব্রতা আমরা বুঝতে পারেনি। ওয়াশিংটন ডিসি’র হোয়াইট হাউজের কাছাকাছি থাকি, সুতরাং স্নাইপারের মতো ঘটনা তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। মেরি ঘাতক স্নাইপারের বিষয়ে আমাদেরকে বলার পর কম বেশি ঘাবড়ে গেলাম। সে আমাদেরকে খুব কড়াভাবে সতর্ক করে দিলো। তার নির্দেশ ছিল আমরা যেন কোনভাবে হোটেলের বাইরে না যাই। মেরি হোটেলের আশেপাশের এলাকায় সমকামী এবং হিস্পানী সন্ত্রাসী লোকজন থাকে বলেও আমাদের সতর্ক করলো। সুতরাং সন্ধ্যার পর নিতান্ত প্রয়োজন না হলে ঐ সকল এলাকায় আমরা যেন ঘোরাঘুরি না করি। মেরি খুব কঠিন টাইপের মহিলা। মা যেমন সন্তানকে সকল অনিষ্ট থেকে দূরে রাখতে চান, মেরিও ঠিক তেমনটি চাইছে, নিতান্তই আমাদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য। তবে আমার কাছে ওর শাসনের মাত্রা একটু বেশি মনে হচ্ছে। হয়তো বা স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর নির্দেশনা মতে মেরি কাজ করছে আমাদের মঙ্গলের জন্যই। বিরক্তি হলেও মেরির নির্দেশনা অমান্য করার সুযোগ ছিল না।
স্নাইপার ধরার জন্য ওয়াশিংটন ডিসিসহ, ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ডের পুলিশ বাহিনী রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছে। পরদিন ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদকীয়তে ঘটনাস্থল ফেয়ার ফ্যাক্স কাউন্টির পুলিশ প্রধানের চৌদ্দ-গোষ্ঠী উদ্ধার করা হল। তাদের ভাষ্য এমন অপদার্থ পুলিশ বাহিনীর ওপর আমেরিকার জনগণ আস্থা হারিয়েছে। পুলিশের সফলতার চাইতে ব্যর্থতার ঘটনাগুলো মিডিয়া মনে হয় অনেক বেশি হাইলাইট করে মজা পায়। জনগণও এ ধরনের খবর লুফে নেয়। এটা শুধু আমেরিকা নয়, সারা বিশ্বের চিত্র। তবে কেউ কেউ আবার বলছে স্নাইপারের ঘটনাটি মিডিয়া অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করছে। এ বক্তব্য আমার কাছে হাস্যকর মনে হল। প্রতিদিন নিরীহ লোক মারা যাচ্ছে আর মিডিয়া চুপ করে বসে থাকবে এমনটি হতে পারে না। আমেরিকার মিডিয়াকে কেউ থামাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বলে মনে হয় না। এদেশের গণতন্ত্র আর মুক্ত মিডিয়া একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।
আমেরিকান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও স্নাইপারকে কোনক্রমেই নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না, সে মহা উৎসাহ নিয়ে তার কুকীর্তি চালিয়ে যাচ্ছে। আজ ওয়ালমার্ট, কাল হোমডিপো, পরশু পেট্রোল স্টেশন এভাবে ক্রমাগতভাবে সে পুলিশকে ফুলিশ বানিয়ে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোতে স্নাইপারের কল্পিত সম্ভাব্য স্কেচ এবং যে সাদা রংয়ের ভ্যান গাড়িতে বসে গুলি করে লোকজন হত্যা করছে তার এনিমেটেড ছবি প্রচার করছিলো। এ কারণে রাস্তায় সাদা রংয়ের ভ্যান দেখলেই আমরা ভীত হয়ে পড়তাম। মনে হতো এ বুঝি স্নাইপার আমাদের এ্যাটাক করে বসে।
শহীদ বলতো- ‘আর যাই হোক বউ বাচ্চা ছেড়ে হাজার কিলো দূরে স্নাইপারের হাতে জানটা দেবার কোন ইচ্ছে আমার নেই, ভাই। এর চেয়ে ঢের ভালো দেশের সন্তান দেশে ফিরে যাওয়া।’ এতো আতংকের মাঝে পার্থ আবার স্নাইপারের বিষয়ে বিশেষ ইন্টারেস্ট নিয়েছে। স্নাইপার সংক্রান্ত সকল নিউজ, ফিচার ভালো করে ও পড়ছে এবং আমাদের ব্রীফ করছে।
একদিন পার্থ আমাকে কানে কানে বলল,
-ভাই, বুঝলেন, স্নাইপার হচ্ছে একটি বাঘের বাচ্চা। কোন কিছুই সে তোয়াক্কা করছে না। কি বুঝলেন?”
ওর কথায় আমি তেমন কিছু বুঝিনি। তবে আমার মনের মধ্যে কেন জানি উঁকিঝুঁকি মারছিল যে স্নাইপার যেই হোক না কেন আমেরিকান পুলিশ একে ধরবেই। আমার কাছে আরও মনে হচ্ছিল আতংক সৃষ্টিকারী স্নাইপার মুসলিম সম্প্রদায়ের কেউ হয়তো হবে।
আমার এ ধরনের চিন্তার পিছনে কোন শক্ত যুক্তি যে ছিল বিষয়টি এরকম না। এ বিষয়টি কারো সাথে আমি শেয়ারও করেনি। বেশ কয়েকদিন পর আমরা যখন কানসাস সিটি ভ্রমণ করছিলাম তখন ঐ স্নাইপার ধরা পড়লো। ধরা তো তাকে পড়তেই হবে। আমেরিকান পুলিশ সবই পারে। কাকতালীয় ভাবে দেখা গেলো ঐ স্নাইপারের নাম জন এলেন মোহাম্মদ, একজন আফ্রিকান আমেরিকান মুসলমান সে। বয়স মাত্র ১৭ বছর হওয়াতে ওর হয়তো কোন কঠিন শাস্তি হবে না। তবে ভার্জিনিয়ার বিচার ব্যবস্থা অনেকটা কঠোর। আমেরিকার যে কয়টি স্টেটে গুরুতর অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের বিধান আছে, তার মধ্যে ভার্জিনিয়া অন্যতম।
আমেরিকার একেক স্টেটে বিচার ব্যবস্থা একেক রকমের। একই অপরাধে এক রাজ্যে কেউ হয়তো মামুলি ৩ বছরের জেল সাজা পাচ্ছেন, অন্য রাজ্যে ঐ একই অপরাধের জন্য অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে। অবাক এক দেশ এটি! মিলের চেয়ে স্টেটসগুলোর মধ্যে অমিলই বেশি। তারপর এরা একই সুতোয় বাঁধা রয়েছে অনেক বছর ধরে।
স্নাইপারের ঘটনায় আমি সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম। সারাদিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্ধারিত এপয়ন্টমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকি। নিজস্ব সময় পাই কেবলমাত্র সন্ধ্যার পর। সন্ধ্যায় আবার স্নাইপার সক্রিয় থাকে। তার কিলিংজোন আবার ওয়াশিংটন ডিসি’র চারপাশে। ইচ্ছামতো ওয়াশিংটন ডিসি এবং এর চারপাশ ঘুরে দেখা যাচ্ছে না স্নাইপারের ভয়ে। ভারী মুশকিলের ব্যাপার। এরমধ্যে আমি আর তারেক বিদ্রোহ করে বসলাম। আমরা ঠিক করলাম সন্ধ্যার পর আমরা ঘুরতে বেরুবোই। কোন বাঁধা নিষেধের ধার আমরা ধারি না। তবে বিশেষ নিরাপত্তার কারণে চলাচলের জন্য আমরা মেট্রো বা আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন বেছে নিলাম। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে সিকিউরিটি খুব শক্ত। প্রায় প্রত্যেক গেটেই বিশাল আকৃতির একজন নিগ্রো পুলিশ বসে থাকে এবং পথচারীকে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ফলো করে। স্নাইপারের পক্ষে একে ফাঁকি দেয়া মুশকিল হবে।
আমাদের হোটেলের নিকটবর্তী স্টেশন ছিল দুটি। এর একটি হচ্ছে ম্যাকপারশন, অপরটি ডুপন্ট পয়েন্ট। এ দু’স্টেশন থেকে সহজেই যে কোন জায়গায় যাওয়া যায়। হোটেল থেকে এ দুই স্টেশনের দূরত্ব মাত্র ১০০ মিটারের মতো। আমেরিকার যে শহরগুলোতে আমরা ছিলাম, তার প্রত্যেকটিতে হোটেলের অবস্থান এমন ছিল যাতে সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গার সহজে যাতায়াত করা যায়। আমাদের চলাচলের সুবিধার কারণেই হোটেলগুলো এভাবে নির্বাচন করা হয়েছিলো। আর সব জায়গাতেই হোটেলের খুব আশে পাশে ম্যাকডোনালস রেষ্টুরান্ট পেয়েছি। ফলে খাওয়া দাওয়া নিয়ে খুব বেশি একটা চিন্তা করতে হয়নি।
তারেক আর আমি ঠিক করলাম সন্ধ্যায় নিজ দায়িত্বে আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে পেন্টাগন সিটিতে যাবে। মেরিকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হল না। মেট্রোতে সারা ওয়াশিংটন ডিসি, ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ডের বিশাল এলাকার যে কোন জায়গাতে যেতে লাগে মাত্র কয়েক ডলার। তবে দূরের গন্তব্য স্থলের ক্ষেত্রে ট্রেন পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয়। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ওয়াশিংটন ডিসি’র মেট্রো ট্রেন সিস্টেম। মেরির কাছ থেকে জেনেছি ওয়াশিংটন ডিসি শহর এবং এর মেট্রো ট্রেন ব্যবস্থার ডিজাইন করেছে ফরাসি স্থপতি ও প্রকৌশলীরা। স্টেশনে পাঁচ সাত মিনিট পর পরই ট্রেন আসে। ট্রেন ধরার জন্য দীর্ঘ সময় বিরক্তি নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না।
মেট্রো ট্রেনের টিকেট ভেন্ডিং মেশিন থেকে কেনা যায়। নির্ধারিত পরিমাণ ডলার দিলে আপনার কাঙ্ক্ষিত টিকেট বের হয়ে আসবে। টিকেট ছাড়া কোন যাত্রী প্লাটফর্মে আসতে পারবে না। একবার টিকেট কিনতে গিয়ে মজার ঘটনা ঘটলো। তারেক টিকেট কিনবে দেড় ডলারের। এক ডলার আছে কিন্তু ৫০ সেন্টস এর মুদ্রা আর পাচ্ছেন না। আমাদের কারো কাছে ৫০ সেন্ট মুদ্রা না থাকায় তাকে সাহায্য করতে পারলাম না। কি মনে করে তারেক কম মানের অন্য একটি মুদ্রা ভেন্ডিং মেশিনে ছেড়ে দিলো। ধারণা ছিল টিকেট আসবে না। কিন্তু আমাদেরকে অবাক করে টিকেট চলে আসলো, সেই সাথে আবার বেশ কতকগুলো বাড়তি সেন্ট ফেরত পাওয়া গেল। একেই বলে ভাগ্য!
ট্রেনে ডুপন্ট সার্কেল থেকে পেন্টাগন সিটি মাত্র বিশ পঁচিশ মিনিটের পথ। পেন্টাগন সিটিকে মনে হয় শহরের মধ্যে আরেকটি মিনি শহর। শপিং মলগুলো অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। এখানে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত ভিড় লেগে থাকে। শপিং, আড্ডা, বার, নাচ গান সব কিছুই এখানে পাওয়া যায়। পেন্টাগন সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান সরকারের ডিফেন্স পাওয়ার হাউস পেন্টাগন অফিস। পঞ্চভুজ বিশিষ্ট এ ভবনটি ১১ সেপ্টেম্বর আক্রমণের অন্যতম টার্গেট ছিল। আমরা যে সময় আমেরিকা সফর করছিলাম, তখন ঐ বিধ্বস্ত ভবনের মেরামতের কাজ চলছিলো। স্বচক্ষে দূর থেকে সেগুলো দেখার সুযোগ হয়েছিল।
পেন্টাগন সিটির ঠিক বিপরীত দিকে পটোম্যাক নদীর তীর ঘেঁষে বিখ্যাত আরলিঙ্কটন ওয়ার সেমিটারির অবস্থান। এর বিস্তৃতি প্রায় ৬২৪ একর। এ সেমিটারিতে আমেরিকার গৃহযুদ্ধসহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত বহু আমেরিকান সৈন্যকে সমাহিত করা হয়েছে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় নিহত যোদ্ধাদের সমাহিত করার উদ্দেশ্যে মূলত এই সেমিটারিটির গোড়াপত্তন হয়। আমেরিকার জাতীয় দিবসসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে জীবন উৎসর্গকারী এসব আমেরিকান যোদ্ধাদের সম্মান জানানো হয়। এছাড়া মৃতের নিকটাত্মীয়রা কবরে ফুল দিয়ে তাদের ভালোবাসার মানুষটিকে স্মরণ করেন।
পেন্টাগন সিটিতে জিনিসপত্রের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে বলে মনে হল। তারেক এখানে শপিং এর লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি প্যান্ট (একাধিক ইউটিলিটি পকেটসহ) এবং জুতা কিনলেন। ফেরার পথে এগুলো কিনে তিনি জিতলেন বা ঠকলেন সে বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হল। পেন্টাগন থেকে হোটেলে ফেরার ট্রেন রুট ম্যাপ দেখে যথারীতি আমাকেই বের করতে হল।
আমি হোটেল থেকে বের হলেই সাথে থাকে ডিসি শহরের ম্যাপ। পথ চিনতে সঙ্গীরা আমার উপর বেশ নির্ভর করতে পারে। এ কারণে তারেক আমাকে লোকাল গাইড আর পার্থ মুভিং ম্যাপ বলে আখ্যায়িত করে। এ উপাধি আমার কাছে ভালোই লাগত।
ডিসি’র প্রধান রাস্তাগুলো প্রায় একই রকমেই। রাস্তার মোড়ে থাকবে কোন বিখ্যাত আমেরিকানের মূর্তি। শহরটি স্কয়ার ব্লকে বিভক্ত। অনেকটা নতুন দিল্লীর মতো মনে হল। অত্যন্ত পরিকল্পিত শহর এটি। শহরে গাছপালাও চোখে পড়ার মতো। অফিস আওয়ারে রাস্তায় প্রচুর গাড়ি দেখেছি কিন্তু যানজট খুব একটা চোখে পড়েনি। এখানে বলতে গেলে গাড়ির মালিক নিজেরাই ড্রাইভ করেন। গাড়ি চালানোর জন্য মাসিক বেতনে ড্রাইভার নিয়োগ করার অভ্যাস মনে হয় আমেরিকানদের নেই। শিক্ষিত এবং সচেতন লোকেরা ড্রাইভ করেন বিধায় রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণও সহজ। আমাদের দেশে অসহনীয় ট্রাফিক জ্যামের জন্য অসচেতনতা এবং হেলপার কাম ড্রাইভাররা অনেকখানি দায়ী। এদের কারণে অনেক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনাও ঘটে থাকে।
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার পরিদর্শন
আমেরিকান ইতিহাস, কালচার, শিক্ষা, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু ধারণা দিতে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে একটি ব্রিফিং অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। এজন্য মেরি সেন্টারের শীর্ষ কর্তা ব্যক্তি মিস্টার আকরাম ইলিয়াসের সাথে আগেই যোগাযোগ করেছিল। আমাদের হোটেল থেকে সেন্টারের অবস্থান ছিল পায়ে হাঁটার দূরত্বের মধ্যে। যথাসময়ে পৌঁছলাম আমরা সদলবলে। বেশ দূর থেকে চিৎকার ও হাত নেড়ে মেরি গেটে অপেক্ষমাণ আকরাম ইলিয়াসকে আমাদের উপস্থিতি জানিয়ে দিলো। বুঝতে পারলাম ওরা দুজনে বেশ ভালো বন্ধু। আমরা লেবানিজ বংশোদ্ভূত সুদর্শন এ আমেরিকানের সাথে গেটেই পরিচিত হলাম।
হল রুমে গিয়ে দেখলাম ওখানে আমাদের মতো আরও ভিজিটর আছে, যারা আমেরিকান ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে এসেছে। এদের কেউ সরকারি কর্মকর্তা,এমপি,শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, ব্যবসায়ী, আবার কেউবা সাধারণ পর্যটক। আমরা ছাড়া অন্য সবার সঙ্গে দোভাষী রয়েছে। ভিজিটরদের মধ্যে একজন জাপানী প্রতিবন্ধী ছিলেন, যিনি নিজ থেকে হাঁটা চলা করতে অক্ষম। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম আকরাম ইলিয়াসই আমাদের ব্রিফ করছেন। তিনি সকলকে স্বাগত জানিয়ে তার উপস্থাপনা শুরু করলেন। অসাধারণ বাগ্মী এই ভদ্রলোক। আমি দেশি-বিদেশি যত বক্তার কথা শুনেছি তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন বক্তা হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দিতে আমার কোন দ্বিধা নেই।
তিনি যখন জন আব্রাহাম লিঙ্কনের আধুনিক আমেরিকা গঠনে নেতৃত্ব ও তার বিভিন্ন সংস্কারের বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরছিলেন তখন মনে হচ্ছিল আব্রাহাম লিঙ্কন সাহেব স্বয়ং নিজেই আমাদের সামনে কথা বলছেন। আকরামের কথার মধ্য দিয়ে খুব স্পষ্ট হয়ে আসছিলো তিনি আমেরিকান হতে পেরে গর্বিত। তার মতে সারাবিশ্বে আমেরিকার বর্তমান যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আধিপত্য তার পিছনে কাজ করছে দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রের চর্চা। মনে হল রাতারাতি গণতন্ত্রের সুফল পাওয়া যায় না, এজন্য অপেক্ষা করতে হয় এবং সকলকে একযোগে কাজ করতে হয়।
প্রতিবন্ধীদের সুবিধার্থে আমেরিকান সরকার কী কী করেছে তার একটি সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি আকরাম আমাদের সামনে তুলে ধরল। আমেরিকার রাস্তায় হাঁটলে আপনি দেখতে পাবেন প্রতিটি রাস্তায় হুইল চেয়ার উঠা নামা করার জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। এছাড়া লিফটে, পার্কিং স্পেস এবং ওয়াশরুমেও প্রতিবন্ধী বান্ধব ব্যবস্থা রয়েছে। আমেরিকানরা প্রতিবন্ধীদের বলে ডিফারেন্টলি এ্যাবলড অর্থাৎ ভিন্নভাবে সক্ষম। প্রতিবন্ধীরা যাতে মনে কষ্ট না পায় বা তাদেরকে ছোট করে না দেখা হয় তার জন্যই এ ধরনের শব্দ চয়ন করা হয়েছে। এটি অন্যকে সম্মান করার একটি চমৎকার উদাহরণ হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে।
ব্রিফিং সেন্টারে টাঙানো একটি পোস্টারে আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। পোস্টারে লেখা রয়েছে ২০০১ সালে বিশ্বের অন্যান্য দেশে থেকে প্রায় ৬ লাখ ছাত্র ছাত্রী আমেরিকাতে পড়াশুনা করতে এসেছে। ঠিক একই সময়ে আমেরিকা থেকে সাড়ে ৪ লাখ ছাত্র ছাত্রী ভিন দেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে গিয়েছে। আমেরিকানরা যে স্বর্গ ছেড়ে অন্যত্র দলে বলে গিয়ে পড়াশুনা করে সেটা ছিল আমার চিন্তার বাইরে।
আকরামের সুদীর্ঘ বক্তৃতার পর শুরু হল প্রশ্ন-উত্তর পর্ব। আমি এ সুযোগটা নিয়ে একটি প্রশ্ন করলাম তাকে। আমার প্রশ্ন শুনে আকরাম কিছুটা বিব্রত হলেও তার উত্তর কিন্তু আমাকে সহজেই কনভিন্স করতে পেরেছিল। ওয়াশিংটন ডিসির বিভিন্ন পার্ক, সার্কেল বা গোল চক্করে বেশ কিছু ভবঘুরে এবং ভিক্ষুক টাইপের লোক নজরে আসতো। রাজধানী শহর ওয়াশিংটন ডিসিতে ভিক্ষুকের দেখা মিলবে এটি ছিল আমার কল্পনার অতীত। এখানকার ভবঘুরে এবং ভিক্ষুকের সংখ্যার আধিক্য এবং এর কারণ সম্পর্কে আকরামকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
আমেরিকা সফরের কিছুদিন আগে আমি একটি প্রশিক্ষণে দক্ষিণ কোরিয়া যাই। দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলের এক মেট্রো স্টেশনে ভিক্ষুক দেখেছিলাম। সারা সিউলে হয়তো এ ধরনের ভিক্ষুকের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন হবে। এরা আবার সাধারণ ভিক্ষুক নন। ভিক্ষা করছে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে। ভিক্ষুকের আবেদন টেপ-রেকর্ডারে রেকর্ড করে পথচারীদেরকে শুনানো হচ্ছে। পথচারীরা যার যার মতো তাকে সাহায্য করছে। সিউলের ঐ ভিক্ষুকদের কেন জানি সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। এদের চেহারায় কোন কষ্ট ক্লেশ বা দুশ্চিন্তা দেখিনি। পথচারীদের সাথে সহাস্যে কুশলাদি বিনিময় করছে। বিদেশি দেখলে আগ্রহ আরেকটু বেশি দেখাচ্ছে বাড়তি কিছু সাহায্যের জন্য।
ওয়াশিংটন ডিসি’র ভিক্ষুকরা ভিক্ষা করছে পোস্টারে তার দুর্দশার কথা ব্যক্ত করে। ভবঘুরেদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যাই বেশি। এরা কিন্তু কোরিয়ান ভিক্ষুকদের মতো প্রতিবন্ধী নয়। বেশ সক্ষম বলে মনে হল। সন্ধ্যার পর রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে এরা ছিনতাইসহ অন্যান্য অপকর্মে লিপ্ত হয় বলে মেরি আমাদেরকে জানালো। সন্ধ্যার পর ঐ সকল এলাকা এড়িয়ে চলার জন্য সে আমাদেরকে উপদেশ দিলো। সত্যি বলল কিনা জানি না, তবে মেরির কথায় এক ধরনের বর্ণবাদের গন্ধ পেলাম।
আকরাম বেশ ক্ষোভের সঙ্গেই জানালো যে আমেরিকান সরকার ঐ সকল ভিক্ষুক এবং ভবঘুরেদের মৌলিক চাহিদা তথা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা অন্যত্র। মতের বিরুদ্ধে ভবঘুরে সেন্টারে নিয়ে এদেরকে আশ্রয় দিলে ভীষণভাবে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। এরা মনে করে ভবঘুরে সেন্টারে আবদ্ধ করা হলে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। ভিক্ষা করবে অথবা ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়াবে, কিন্তু সরকারি শেল্টারে গিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করাতে গেলই ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়। না খেয়ে থাকবে কিন্তু স্বাধীনতার সাথে কোন কম্প্রোমাইজ এরা করবে না! এ ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ সমাজ বিজ্ঞানীরা হয়তো ভালো বলতে পারেন।
স্প্যানিশ এক পর্যটক আকরামকে প্রশ্ন করেছিল বিশাল ভূ-খন্ডের বৈচিত্র্যময় আমেরিকার পঞ্চাশটি স্টেট কোন মন্ত্রবলে এক সূতায় গ্রথিত রয়েছে। এ প্রশ্নের উত্তরও আকরাম বেশ দক্ষতার সাথে দিয়েছিলেন যার প্রশংসা না করে পারিনি। তিনি বলেছিলেন বিশাল ভৌগলিক পরিসরের আমেরিকাকে একত্রে ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে অঙ্গ রাজ্যগুলোকে অপরিসীম স্বাধীনতা দেওয়ার কারণে। কেন্দ্রীয় বা ফেডারেল সরকার যদি বেশি বেশি বিধি নিষেধ আরোপ করতো বা শোষণ করার চেষ্টা করতো তাহলে পঞ্চাশটি স্টেটকে একসঙ্গে ধরে রাখা যেত না। এরা আলাদা আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতো। ব্রিটিশ শাসন শেষে ভারতবর্ষ একত্রে না থেকে কেন আলাদা আলাদা রাষ্ট্রে বিভক্ত হল সে গবেষণায় এসব তত্ত্ব হয়তো প্রতিফলিত হবে।
আমেরিকান সিভিল ওয়ার অর্থাৎ উত্তর এবং দক্ষিণের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে যুদ্ধের পর কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়টি খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারে। আকরাম কেন্দ্রীয় সরকারকে তুলনায় করেছে আগুনের সাথে। স্টেটসগুলোতে কেন্দ্রীয় সরকারের যত বেশি হস্তক্ষেপ হবে, সেখানে তত বেশি সমস্যা তৈরি হবে। আমেরিকান অর্থনৈতিক উন্নতির প্রধান কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে সরকারের কম সংশ্লিষ্টতা। তার মতে কোন সরকারেরই উচিত নয় ব্যবসার সাথে জড়িত হওয়া। সরকার যদি বিমান বা ট্রেন চালাতে যায় তাহলে নির্ঘাত লোকসান হবে। আমেরিকার সরকারের নীতি হচ্ছে সার্ভিস সেক্টরগুলোকে বেশি বেশি ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া। আর সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে ব্যবসায়ীদের জন্য সহায়ক আইন ও নীতি নিশ্চিত করা এবং সকলের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা। তবে যারা গ্লোবালাইজেশন বা মুক্ত অর্থনীতি বিপক্ষে অবস্থান করছেন তারা এ ধরনের মতবাদকে মানতে পারছেন না। তাদের মতে অতি আবশ্যক সার্ভিস যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের সব সময়ই নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত।
সব ক্ষেত্রেই আমেরিকার নিজস্ব ব্রান্ড রয়েছে। এটি গ্লোবালাইজেশন প্রসেসের একটি অংশ। খাবার দাবারের ক্ষেত্রে সেরকম একটি ব্রান্ড হল ম্যাগডোনালস যার উপস্থিতি প্রায় সব দেশেই দেখা যায়। পশ্চিমা দেশগুলোর ছোট ছোট শহরের আনাচে কানাচেও আপনি এর উপস্থিতি দেখতে পাবেন। আমেরিকাতে এসেছি অথচ ম্যাগডোনালসের বার্গার খাব না, এটা কী করে হয়। যথারীতি দুপুর বেলা ডুপন্ট সার্কেলের পাশে অবস্থিত একটি ম্যাগডোনালস রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করলাম। ম্যাগডোনালস আউটলেট খুঁজে বের করা সহজ। বিশাল আকৃতির এম চিহ্নিত সাইনবোর্ড এর উপস্থিতি জানিয়ে দিবে।
ম্যাগডোনালসে আকর্ষণীয় খাবারের মেনুতে যা রয়েছে তার অধিকাংশ বীফ ভিত্তিক। আমি বীফ ভক্ত না। গ্রুপের বাকীরা গো-গ্রাসে বীফ অর্থাৎ গো-মাংসের বার্গার খেতে থাকলেও আমি কিছু ফ্রেন্স ফ্রাই, চিকেন উইং ফ্রাই এবং কোক দিয়ে লাঞ্চ শেষ করে নিলাম। ম্যাগডোনালসে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা নির্ধারিত ইউনিফর্ম পরে কাজ করে। এরা কাজ কর্মে বেশ করিৎকর্মা এবং চটপটে। ম্যাগডোনালস ছাড়া আমেরিকাতে আরও বেশ কিছু প্রসিদ্ধ ফাস্ট ফুড আউটলেট রয়েছে। এদের মধ্যে কেএফসি, সাবওয়ে,বার্গার কিং অন্যতম। ফাস্ট ফুডের যেমন সুবিধা আছে, এর আবার তেমনি অনেক দুর্নাম রয়েছে। অনেকে ওবেসিটি আর নানা ধরনের রোগ বালাইয়ের জন্য ফাস্ট ফুডকে দায়ী করে। স্বাস্থ্য বিষয়ক সভা সেমিনারে ফাস্ট ফুডের মুন্ডুপাত করতে তারা দ্বিধা বোধ করেন না। মজার বিষয় হচ্ছে ফাস্ট ফুডকে গাল মন্দ করা হলেও এর জনপ্রিয়তা কিন্তু বিশ্বের কোথাও কমছে না।
ওয়াশিংটন ডিসিতে হোম হসপিটালিটি
ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটর প্রোগ্রামের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে স্থানীয় আমেরিকানদের দ্বারা ভিজিটরদের হোম হসপিটালিটি বা গৃহ আতিথেয়তা প্রদান। আমেরিকার বিভিন্ন শহরে একদল ভলান্টিয়ার আছে যারা স্থানীয় স্টেট ডিপার্টমেন্টের অফিসের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে ভিজিটরদের আতিথিয়তা প্রদান করে থাকেন। এ বিষয়ে ঢাকাস্থ আমেরিকান সেন্টার থেকে আমাদেরকে ব্রিফিং কালেই অবহিত করা হয়েছিলো।
ভিজিট এডভাইজার আমাদেরকে বলেছিলেন আতিথিয়তা প্রদানকারী হোস্ট বা মেজবানদের জন্য সাথে করে কিছু গিফট আইটেম নিয়ে যেতে। আমরা সকলে সেমতে কিছু গিফট আইটেম সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওয়াশিংটন ডিসি-তে দুটো পরিবার আমাদেরকে হোম হসপিটালিটি দিবে বলে মেরি জানালো। সে কারণে আমরা দু’জন করে দু’দলে বিভক্ত হয়ে গেলাম। তারেক আর আমার জন্য নির্ধারিত হল আমেরিকান ফেডারেল লেবার কোর্টের বিচারপতি রুহুল আমিন কান্দারের বাসা। বিচারপতি আমিন নিজেই আমাদের ড্রাইভ করে নিয়ে যাবেন বলে আমাদেরকে মেরি জানিয়ে দিলো। শহীদ আর পার্থ যাবে অবসর প্রাপ্ত এক আর্মি জেনারেলের বাসায়, মেরি ওদেরকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে।
বিকেলের দিকে বিচারপতি আমিন আমার রুমে ফোন করে জানালেন তিনি সন্ধ্যার পর পরই হোটেলে আসবেন, আমাদের দুজনকে তার বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমরা যাতে সন্ধ্যার আগেই প্রস্তুত হয়ে থাকি সেজন্য তিনি অনুরোধ জানালেন। যথা সময়ে হোটেলের লবিতে নামতেই আমাদের হোস্ট এগিয়ে আসলেন। আমরা যে তার অতিথি তিনি বুঝতে পেরেছেন। গাড়িতে উঠতে উঠতে পরিচয় পর্ব সেরে নিলাম।
বিচারপতি আমিন জানালেন তার দাদা একজন ভারতীয় বাঙালি, দাদী জামাইকান। দাদা’র ছিল কাপড়ের ব্যবসা। ব্যবসায়িক কারণে জামাইকা অবস্থানকালে দাদা ও দাদীর মধ্যে ভালোবাসা হয় এবং পরবর্তীতে তারা বিয়ে করে আমেরিকাতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সে সূত্রে সে দ্বিতীয় প্রজন্মের অভিবাসী আমেরিকান। আমাদের কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাগত ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি বিষয়ে আমীন সাহেব জানতে চাইলেন। তিনি অসম্ভব আগ্রহ নিয়ে আমাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছিলেন। সিটিং বিচারপতিরা এতোটা খোলামেলা ভাবে কথা বলতে পারেন তা আমার জানা ছিল না। বরং মনে হল আমাদের হোস্ট হতে পেরে তিনি বেজায় খুশি। এর মধ্যেই মিস্টার আমীন একটি দ্বিতল নয়নাভিরাম বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে আমাদেরকে নামার জন্য ইশারা করলেন। বুঝতে দেরি হল না আমরা তার বাড়িতে এসে গেছি।
বাড়ির ফটকে মধ্য বয়সী একজন মহিলা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এগিয়ে আসলেন। বিচারপতি সাহেব তার স্ত্রীর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। মজা করে বললেন ‘ সি ইজ মাই সুইট হার্ট, দ্য প্রেটিয়েস্ট লেডি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। সামান্য কিছু আলাপ চারিতায় বুঝা গেল মিস্টার এবং মিসেস আমীন অত্যন্ত সদালাপী এবং আন্তরিক। ঐ বাসায় আমরা প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা অবস্থান করেছিলাম। এ সময়ে প্রতিটি মুহূর্তে আমরা অত্যন্ত উপভোগ করেছিলাম। মনে হল নিজেদের কোন নিকট আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে এসেছি।
মিস্টার আমিন বাসায় তার বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং বন্ধু বান্ধবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এরা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে বেশ প্রতিষ্ঠিত। এদের একজন হলেন ডাক্তার, ইন্ডিয়ান আমেরিকান, নাম রাম নায়েক। রাম নায়েকের ব্যাপারে মিস্টার আমীনের সামান্য অভিযোগ পাওয়া গেল। রাম নায়েক কখনোই নিজের পরিচয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত কথাটি যোগ করেন না। যদিও রাম নায়েকের বাবা ছিলেন একজন ভারতীয় আর মা ক্যারিবিয়ান। ক্যারিবিয়ান আমেরিকান হিসেবে পরিচয় দেওয়ায় বিচারপতি সাহেব তার বন্ধুর উপর মৃদু ক্ষিপ্ত, যা আমাদের সামনে প্রকাশ করতে দ্বিধা করলেন না। দু’জন এ নিয়ে বেশ প্রাণবন্ত বিতর্কেও জড়িয়ে গেলেন। আমরা তাদের যুক্তি ও পাল্টা যুক্তি উপভোগ করতে লাগলাম।
বিতর্কের অবসান হল বিচারপতি সাহেবের ছোট মেয়ে ইলিয়ানার আগমনের মাধ্যমে। মিস্টার আমীন জীবনে কখনও ভারতে যাননি অথচ ভারত, পশ্চিম বাংলার প্রতি কি দরদ তার। সময় করে দু’এক বছরের মধ্যে তিনি ভারতে যাবেন বলে জানালেন। কিন্তু সমস্যা হল ভারতে আমিন সাহেবের আত্মীয় স্বজনের কে কোথায় থাকেন তা তিনি জানেন না। এদেরকে যে ভাবেই হোক খুঁজে বের করবেন বলে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন। মাটির টানে তিনি পূর্ব পুরুষের ভিটায় আদৌ আসতে সক্ষম হয়েছেন কিনা তা আর জানা হয়নি।
আলাপচারিতার এক পর্যায়ে মিস্টার রাম নায়েক আমাদের জানালেন বাংলাদেশ থেকে আমরা ব্যাপক সংখ্যক নার্স আমেরিকাতে পাঠাতে পারি। নার্সের বিশাল সঙ্কট রয়েছে আমেরিকান হাসপাতালগুলোতে। স্থানীয় আমেরিকানরা নার্স হিসেবে কাজ করতে চায় না। এ কারণে তাদের বিদেশিদের ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করতে হয়।
কথাবার্তার এ পর্যায়ে মিসেস আমিন জানালেন তার আশি বছর বয়সী মা তাদের সঙ্গে থাকেন। যদিও আমাদের সঙ্গে তার তখনও পরিচয় হয়নি। আমি অনেকটা ক্যাজ্যুয়ালি বলে ফেললাম পশ্চিমা সমাজে তো তাদের বয়স্ক বাবা-মাকে ওল্ড হোমসে পাঠিয়ে দেয়। বুড়োদের ঝামেলা নেওয়ার সময় তাদের কোথায়! আমার এ বক্তব্যে মিসেস আমিন বেশ খানিটা উষ্মা প্রকাশ করলেন এবং তার বহিঃপ্রকাশও হল কিছুক্ষণ বাদে। মিসেস আমিন জানালেন তার মা আমৃত্যু তাদের সাথে থাকবেন। জমের বাড়িতে না যাওয়া পর্যন্ত তার মা তাদের সঙ্গেই থাকবেন, অন্য কোথাও পাঠাবেন না। আমার ধারণা এ মহিলা পারলে তার প্রাণপ্রিয় মায়ের মৃতদেহ মমি বানিয়ে সংরক্ষণ করবেন। মিসেস ও মিস্টার আমিন উভয়কেই দেখলাম পিতা মাতার প্রতি ভীষণ কৃতজ্ঞ। মাইগ্রেন্ট হওয়ার পরও আমেরিকান সমাজে তাদের মজবুত অবস্থানে পিছনে রয়েছে একাডেমিক যোগ্যতা। আর তা সম্ভব হয়েছে পিতা মাতার কারণেই। টিপিক্যাল আমেরিকানদের সাথে এ পরিবারের মিল খুঁজে পেলাম না। ব্যতিক্রম সব সমাজেই রয়েছে!
মিস্টার আমিনের দু মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ফাতেমা নিউইয়র্কে একটি ফ্যাশন কলেজে পড়ছে। আলোচনার এক পর্যায়ে ফাতেমার একটি ছবি মিসেস আমিন আমাদের দেখালেন। মেয়েটি পোশাক নিয়ে মিসেস আমিন বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। যদিও ক্ষোভ প্রকাশের কোন কারণ আমার কাছে ধরা পড়েনি। ফাতেমার পোশাক কিছুটা সংক্ষিপ্ত, আঁটসাঁট পোশাক পরেছে তবে তা বিপদসীমার মধ্যেই রয়েছে। ফাতেমার পোশাক আমেরিকান কালচারের সাথে মানানসই। নিউইয়র্কে গিয়ে মেয়েটি গোল্লায় গিয়েছে বলে তারা মনে করছেন। তাদের ধারণা মেয়েটি নিশ্চয় কোন বাজে ছেলের পাল্লায় পড়েছে, তা নাহলে এ পোষাকে ছবি তুলবে কেন? মিসেস আমিন জাজ সাহেবকে মেয়েকে অবিলম্বে ডিসিতে ফেরত আনতে রীতিমতো নির্দেশ দিয়ে দিলেন। আমিন পরিবারের এসব বিষয় আমার হিসেবে মিলছে না। এর মধ্যেই ছোট মেয়ে ইলিয়ানা আমাদের সাথে পরিচিত হতে লাগলেন। ইলিয়ানা ডিসি’র একটি নামকরা স্কুলে ৯ম গ্রেডের ছাত্রী। মিসেস আমিন জানালেন তাদের ছোট মেয়ে লেখা পড়ায় প্রচণ্ড মেধাবী। ইলিয়ানার কথা বার্তার মধ্যে তার কিছু প্রমাণও মিলল।
প্রায় তিন ঘণ্টা নন-স্টপ আলোচনার পর ডিনারের টেবিলে আমন্ত্রণ জানানো হল। সাকুল্যে আট-দশ জনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিস্টার আমিন প্রথমে জানালেন তারা হার্ড ড্রিংক বা মদ্যপানে অভ্যস্ত নন। এ নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথাও ছিল না। জীবন প্রথম কোন আমেরিকানের বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসেছি। তাই আমার কৌতূহল ও উৎসাহের কমতি ছিল না। আলোচনার সব বিষয়েই অংশ নিচ্ছিলাম। লিকার দেওয়া হল কিনা তা নিয়ে চিন্তার সুযোগ ছিল না। ডিনার শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে হঠাৎ করেই একটি রিচুয়ালে অংশ নিতো হল। তবে বিষয়টি আমার কাছে একেবারেই নতুন মনে হয়েছিল। বিচারপতি আমিনের নেতৃত্বে আমাদেরকে মোনাজাত করতে হল। হাত তুলে খোদার দরবারে যা বলা হল তা সারকথা এরকম:
‘হে খোদা, তুমি আমাদের জন্য পৃথিবীতে যেসব নিয়ামত দিয়েছ তার জন্য আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। খাবারও এ ধরনের একটি অশেষ নিয়ামত। আমরা তোমার ইচ্ছেতেই এ খাবার আজ রাতে খাবো। সকল প্রশংসার দাবীদার কেবলই তুমি। যিনি আমাদের সকলের জন্য আজ এ খাবার তৈরি করেছেন তার মঙ্গল তুমি নিশ্চিত করো। আমীন’।
মোনাজাতের ধরন এবং এর শব্দমালাগুলো আমার খুব ভালো লাগলো। খাবার গ্রহণের পরেই আমরা সাধারণত খোদার শুকরিয়া আদায় করি। কিন্তু এই আমেরিকান পরিবারটি করলেন খাবার গ্রহণ করার আগে। এ পিছনে কী যুক্তি বা ব্যাখ্যা রয়েছে তা আমার জানা নেই। তবে বিশ্বাসীদের কাছে ব্যাপারটি খারাপ লাগবে না।
ডিনার শুরু করার আইটেম ছিল আঙ্গুর। এর পর আসলো ভাত, পুঁই শাক, স্যামন মাছ এবং সবশেষে সফট ড্রিংক। পুই শাক মিসেস আমিন নিজ হাতে রান্না করেছেন বলে জানালেন। ভদ্রতার খাতির বললাম অপূর্ব, এক্সিলেন্ট। যদিও রান্নার মান ছিল সাদামাঠা, লবণ দিয়ে সিদ্ধ করা শাক, প্রশংসা করার মতো মান ছিল না। নিজ বাসায় ঐ মানের রান্না হলে হয়তো মুখেই তুলতাম না। সাথে রাঁধুনিকে দু’চার কথা শুনিয়ে দিতাম। মুখ দিয়ে যে শব্দটি বের হতো তা হল-’ওয়াক’
ডিনারের টেবিলে আইটেম সংখ্যা আমাদের মতো লম্বা ছিল না। আমার মনে হয় খাবারের ক্ষেত্রে বাঙালিদের মতো আর কোন জাতিই এতো বিলাসিতা করে না। মনে মনে ভাবলাম মিস্টার আমিন যদি কোন দিন আমার বাসার বেড়াতে আসেন তাহলে কমপক্ষে ২০ আইটেমের তরকারি রান্না করে খাওয়াব। বাসায় রান্না করতে অসুবিধা হলে হোটেল থেকে কিনে আনবো। বুঝিয়ে দিবো বাঙালি গরীব হলেও খাবারের বিষয়ে খুবই যত্নবান এবং অতিথিপরায়ণ।
খাওয়া ও গাল-গল্প এক সাথে চলতে থাকলো। আলোচনা যে পর্যায়ে চলে গেছে তাতে মনে হল ডিনার মনে হয় ব্রেকফাস্টে গিয়ে মিশবে। বুশ, সাদ্দাম থেকে শুরু করে হঠাৎ আবির্ভূত স্নাইপার কেউ আলোচনা থেকে বাদ গেল না। যাহোক রাত বারোটায় দীর্ঘ ডিনার পর্বের সমাপ্তি ঘটলো। মিস্টার আমিন নিজে ড্রাইভ করে আমাদের হোটেলে ছেড়ে গেলেন। হোটেলে এসে দেখলাম শহীদ এবং পার্থ আমাদের জন্য লবিতে অপেক্ষা করছে। লবিতেই আমরা উভয়েরই হোম হসপিটালিটি’র অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করলাম। শহীদের রুমে শুরু হল আমাদের আড্ডার নিজস্ব পর্ব। আড্ডা যখন শেষ হল তখন বাজে মাঝ রাত পেরিয়ে দু’টা। রুমে এসে ক্লান্ত শরীরটি মখমলে বিছানায় এলিয়ে দিলাম। ঘুম আসতে সময় লাগলো না।
গিফট প্যাকেট বিড়ম্বনা
রওনা হওয়ার পূর্বে স্বল্প পরিচিত এক অবসর প্রাপ্ত সিনিয়র কলিগ আমেরিকা প্রবাসী তার মেয়ে মিলি এবং নাতনীর জন্য একটি গিফট প্যাকেট আমার কাছে দিয়েছেন। এই প্যাকেট নিয়ে যে এতো ঝামেলায় পড়তে হবে তা আগে বুঝলে ভদ্রলোককে বিনীতভাবে না বলে দিতাম। মিলি তার একমাত্র মেয়ে শিলুকে নিয়ে টেক্সাসের হিউস্টোনে থাকে।
গিফট প্যাকেটের ওজন ২-৩ কেজি’র বেশি হবে না। ধারণা করছিলাম কানসাস সিটিতে যখন সফর করবো তখন এক ফাঁকে হিউস্টোন ঘুরে আসবো, আর মিলির গিফট প্যাকেটটিও দিয়ে আসবো। হিউস্টোনে আমার বন্ধু মাহবুবের ছোট দুই ভাইও থাকে। তাদের সাথে সাক্ষাত করারও খুব ইচ্ছে ছিল।
আমেরিকাতে আমাদের অন্তত সাতটি অঙ্গরাজ্য ঘুরতে হবে। এ রকম লম্বা সফরে গিফট বক্সটি সাথে নিয়ে ঘোরা কিছুতেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাছাড়া লাগেজ হালকা করা দরকার। এর মধ্যেই শপিং পর্ব শুরু হয়ে গেছে এবং ব্যাগের খালি জায়গাগুলো ভর্তি হচ্ছে। তাছাড়া মেরির কাছে সফর বৃত্তান্ত শুনে নিশ্চিত হলাম কানসাস সিটি হিউস্টোনের মোটেই কাছে নয়। বাসে বা ট্রেনে দুদিনের পথ যাওয়া-আসা মিলে। মেরির ভাষ্যমতে দলছুট হয়ে একা হিউস্টোন যাওয়া হবে না কিছুতেই। মনে মনে ভাবলাম গিফট বক্সটি কীভাবে মিলির কাছে পৌঁছানো যায়।
তারেক অবশ্য পরামর্শ দিলো প্যাকেটটি মেরিকে গিফট করে দিতে। এতে মেরি অনেক খুশি হবে এবং আমাদের ট্যুরটি আরও বেশি আরামদায়ক হবে। দুটো কারণে এ কাজটি করা সম্ভব হল না। প্রথমত প্যাকেটের ভিতরে কী আছে সেটা আমার অজানা, দ্বিতীয়ত আমি ঐ সিনিয়র কলিগকে কথা দিয়ে এসেছি এটি ঠিকমতো তার মেয়ে নাতির কাছে পৌঁছে দিবো। ওয়াদা পালনে আমি বদ্ধপরিকর হলাম।
মিলির ফোন নাম্বার নিয়ে এসেছিলাম। ওর সাথেই পরামর্শ করে বিষয়টি ঠিক করবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন রাত ১০টার মতো বাজে। বেশ ক্লান্ত। মিলিকে ফোন করলাম। তিন চার বার রিং হবার পর ও ফোন ধরল। জানতে চাইলাম ফোন রিসিভার মিলি কিনা। জবাবে নিশ্চিত হলাম মিলির সাথেই কথা বলছি। কণ্ঠে বোঝা গেল সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কথা প্রসঙ্গে মিলি অতি ভদ্রতার সাথে জানালো ডিসি এবং হিউস্টোনের মধ্যে সময়ের পার্থক্য প্রায় ৩ ঘণ্টা। বিষয়টা মাথায় একদম ছিল না। আমি অপরাধ বোধ করলাম এবং ক্ষমাও চাইলাম। আমার পরিচয় জানতে পেরে সে বেশ উৎসাহ নিয়ে কথা শুরু করলো। ফোন দু’চার কথায় শেষ করে রাখতে পারলাম না। আলাপ চারিতা বেশ দীর্ঘ হল। বুঝতে অসুবিধা হল না তার স্বামী বিছানায় নেই, থাকলে দীর্ঘক্ষণ আলাপের সুযোগ পেত না।
মিলি চার পাঁচ বছর আগে ভিডি লটারি পেয়ে আমেরিকা এসেছে। বয়স ত্রিশ এর কাছাকাছি বলে মনে হল। হিউস্টোনের একটি হাসপাতালে কাজ করে। কী কাজ করে তা অবশ্য জানতে চায়নি। একমাত্র মেয়ে শিলু স্ট্যান্ডার্ড টু-তে পড়ে। পরে অবশ্যই শিলু’র সাথে আমার বেশ কয়েকবার কথা হয়েছিল। স্বামী সাথে থাকে কিনা জানতে চায়নি। মিলি নিজ থেকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি। তবে তার কথা বার্তায় এক ধরনের নিঃসঙ্গতার আভাস পেলাম। এ বয়সের একটি মেয়ে একটি ছোট বাচ্চা নিয়ে আমেরিকাতে আছে, অথচ স্বামী সাথে থাকছে না বিষয়টি নিশ্চয় তার জন্য সুখকর নয়।
কথা-বার্তার এক পর্যায়ে তার বাবার দেয়া গিফট এর কথা জানালাম। পার্সেল করে এটি পাঠাবো কিনা তা বলতে মিলি বেশ আপত্তি করলো। বলল যেভাবেই হোক অন্তত একদিনের জন্য হলেও হিউস্টোনে তার বাসায় যেন বেড়িয়ে যাই। ওখানে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। সে নিজে আমাকে ঐসব দর্শনীয় জায়গায় নিয়ে যাবে বলে জানালো। আমি জানালাম গিফট প্যাকেটটি পার্সেল করে পাঠাবো। তবে হিউস্টোন বেড়ানোর আমন্ত্রণ রাখতে পারবো কিনা তা নিয়ে সংশয়ের কথাটি অকপটে স্বীকার করলাম।
মিলির বাসার ঠিকানা ভালো করে লিখে রাখলাম। হাতে মাত্র একদিন আছে। পরদিন সকালে সিয়াটলের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। দ্রুত হোটেল রিসিপশন থেকে নিকটতম পোস্ট অফিসের ঠিকানা জোগাড় করে বের হয়ে পড়লাম। বাইরের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আমাকে নিরুৎসাহিত করতে পারলো না। অক্টোবর মাসে আমেরিকার হঠাৎ বৃষ্টি আমার বেশ পছন্দ হতো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা নেই, বজ্রপাতের শব্দ নেই, অথচ বৃষ্টি। বেশ ইন্টারেস্টিং বিষয়।
পথ চিনে পোস্ট অফিসে পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগলো না। সার্ভিস কাউন্টারের সামনে বিশাল লাইন। উইকেন্ড শুরু হবে। এ কারণে হয়তো ভিড়টা একটু বেশি। লাইন এগুচ্ছে ধীরগতিতে। এমন সময় দেখি পেছন থেকে মাঝ বয়সী এক ভদ্র মহিলা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারিনি দেখে তিনি নিজেই ছুটে আসলেন। তিনি নিশ্চিত হলেন আমি একটি প্যাকেট পার্সেল করবো। হোটেল থেকেই পার্সেল করার মতো উপযোগী করে প্যাকেটটি নিয়ে এসেছি। এর উপরে ঠিকানাও সুন্দর করে লেখা হয়েছে। আমাকে বললেন পার্সেল সার্ভিসের নিজস্ব মোড়কে প্যাকেট করতে হবে। শুনে মেজাজটা খারাপ হল। একে তো হোটেলে কিছু বলে আসেনি। মেরি এতক্ষণে হয়তো খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। বড্ড বদ মেজাজ এ মহিলার। বেশি দেরী করে হোটেলে ফিরলে কৈফিয়ত দিতে দিতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।
পার্সেলের জন্য নতুন প্যাকেট কেনা হল, ঠিকানাও সাবধানতার সাথে লিখে ফেললাম। কাউন্টারে সেটি জমা দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। সব মিলে পকেট থেকে কুড়ি ডলার খরচ হল পার্সেল করতে। দুঃখ নেই, লাগেজ হালকা করতে পেরেছি এটাই বড় কথা। গিফট বক্সটি মিলি ঠিকমতো পেয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে প্রতিদিনই রাতে ফোন করা হতো। চার দিন পরে জানালো প্যাকেটটি তার কাছে পৌঁছিয়েছে। মিলি আমাকে অনুরোধ করলো আমি যে স্টেটেই থাকি না কেন, তাকে যেন হোটেলের ফোন নাম্বার জানাই। আমি যথারীতি তাই করলাম। এরপর আমাকে খুব একটা ফোন করতে হতো না, ও নিজেই ফোন করতো সময় হিসেব করে। ঐ সময়ে আমি হোটেলেই থাকতাম। কথা বলতে বলতে এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল ওর সাথে।
পোস্টাল অফিস থেকে হোটেলে ফিরে দেখি লঙ্কাকাণ্ডের মতো অবস্থা। মেরি রাগে আগুন। ওর আশে পাশে আলুর পোটলা ধরলে তা সিদ্ধ হয়ে যাবে। আমি দুঃখ প্রকাশ করলাম। মেরি আবারো স্মরণ করিয়ে দিলো পরদিন ওয়াশিংটন স্টেট এর রাজধানী সিয়াটলের উদ্দেশ্যে দলবলে ডিসি ত্যাগ করবো। রাতেই যেন লাগেজ তৈরি রাখি। তার আদেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হল।