সন্ধেবেলা পড়ার টেবিলে বসে একটু বিভূতিভূষণ পড়ছিলাম। হঠাৎ করে লোডশেডিং। অগত্যা মোমবাতি জ্বালিয়ে এনে বসলাম। ভৌতিক, গা-ছমছম করা গল্প। বেশ রোমাঞ্চ লাগছিল। লেখকের অসামান্য দক্ষতায় গল্পের চরিত্রগুলো চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছিল, ঘটনাগুলো ঘটতে দেখতে পাচ্ছিলাম। এজন্যই উনি বিভূতিভূষণ। হাজার চেষ্টা করলেও কোনদিন তার নখের যোগ্য হয়ে উঠতে পারব না। পরিতৃপ্তি নিয়ে গল্পটা শেষ করলাম।
গরমে উশখুশ করছিলাম। পাড়াগাঁয়ে সন্ধের পর কারেন্ট না থাকাটা কমন ব্যাপার। কোথায় বাড়ি আর গবর্মেন্ট কোন মুল্লুকে চাকরি করতে পাঠিয়েছে। এ যেন পানিশমেন্ট, বাড়ির কাছে একটু শান্তিতে থাকব, তার জো নেই। যেতে একদিন আবার আসতে একদিনের ধাক্কা। তাই মাসদুয়েকের আগে বাড়ি যাওয়া হয়না, ইচ্ছেও করে না। পরিবার জলাঞ্জলি দিয়ে এই মফঃস্বলে বসে অন্ধকারে মশার কামড় খাচ্ছি।
আমি এ অঞ্চলে নতুনই বলা যায়। মাস ছয়েক হল এসেছি। ভাবলাম একটু বাইরে বেরিয়ে আসি যদি একটু হাওয়া-বাতাস পাওয়া যায়। রাত তখন সাড়ে আটটা। বাইরে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম। জ্যোৎস্না রাত। রাস্তাঘাট পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে। হাঁটতে ভালই লাগছিল। রাস্তার দুধারে গাছ লাগানো, শিরশিরানি হাওয়া এসে শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে। আশেপাশে জনবসতি সেরকম নেই। অনেক দূরে দূরে টিনের চালা দেওয়া দুএকটা বাড়ি নাহলে কুঁড়েঘর। দুদিকে দিগন্তবিস্তৃত ধানক্ষেত জ্যোৎস্নার আলোয় পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কাঁচানালা দিয়ে কত দূর থেকে জল কলকল করে এসে ঢুকছে ধানের খেতে। মাঝেমাঝে আমগাছে সদ্য গুটি ধরা আম দেখতে পাচ্ছি।
বিভূতিভূষণের লেখায় যেমন অরণ্যে রাত্রিযাপনের নিখুঁত বিবরণ পাওয়া যায়, সেরকম ঝোপঝাড়, ফুল মাঝে মাঝে দেখতে পাচ্ছি। কি যেন মিষ্টি ফুলের সুবাস এসে প্রাণ ভরিয়ে দিচ্ছে। বিভুতিবাবু বোটানির প্রফেসর ছিলেন কিনা কে জানে, কি সব অদ্ভুত গাছের নাম, ফুল, গন্ধ বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লিখতেন। উনি এখানে থাকলে নিশ্চয়ই একটা সুন্দর লেখা উপহার দিতে পারতেন। অনেক হাঁটার পর একটা কাল্ভার্টের উপর গিয়ে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালাম। অদ্ভুত রিলাক্স লাগছিল। ভাবলাম, আজ রাতে ঘুমটা খুব ভালো হবে। সিগারেট শেষ করে মনে হল, এবার ফেরা দরকার, রাত প্রায় দশটা বাজে। এ অঞ্চলে দশটা মানে অনেক রাত। ফিরছি, রাস্তায় একটা লোকের দেখা নেই। আমি নির্জনতাপ্রেমী, ভালই লাগছিল।
“ও বাবু, দাঁড়ান”-পেছন থেকে বাজখাঁই গলায় কে যেন বলে উঠল। চমকে উঠে পেছনে তাকালাম। দেখি খালি গা, লুঙ্গি হাঁটুর উপর তোলা একটা লোক একটা মোটা লাঠি হাতে আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকছে। প্রচণ্ড ভয় পেলাম। গুন্ডা প্রকৃতির লোক বলে মনে হল। এই রাস্তায় চিৎকার করলেও কেউ শুনতে পাবে না। সামনের দিকে জোরে জোরে হাঁটতে লাগলাম। মনে হল লোকটাও দ্রুত পেছন থেকে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। পকেটে পার্সে দুহাজার টাকা আছে, গলায় সোনার চেন আর হাতে সোনার আংটি। মাথায় বারি মেরে সব কিছু কেড়ে নিলেও আমার কিছুই করার নেই। বুকের ভেতর ধড়াসধড়াস করতে লাগল।
পেছনের লোকটা মনে হয় আমাকে ধরে ফেলবে। হাতপা হিম হয়ে যাচ্ছে। লোকটা এসে কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “বাবু, দেশলাইটা একটু দেন না?” হঠাৎ যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। মনে মনে বললাম, “এত রাতে ছ্যাবলামো মারতে এসেছ”। “বিড়ি ধরাতে গিয়ে দেখি, দেশলাইটাই বাড়িতে ফেলে এসেছি। একটু আগে আপনাকে সিগারেট ধরাতে দেখলাম”- বলে উঠল লোকটা।
বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দিয়ে আমাকে বলল, “বাবু, আপনি এ অঞ্চলে নতুন বুঝি? এরকম নিশিরাতে একাএকা বেরবেন না। এসব জায়গায় চোরচোট্টার উপদ্রব আছে বইকি। আমি একজন মাছুয়া। একবার রাত্রিবেলা বাজার থেকে ফিরছিলাম। পকেটে মালকড়ি ভালই ছিল। পড়েছিলাম দুই ছ্যাঁচ্চোড়ের পাল্লায়। একজন আমার হাত ধরল শক্ত করে, আরেকজন আমার ট্যাঁক ফাঁকা করে চম্পট দিল। সেই থেকে রাত্রিবেলা সাথে এই লাঠি রাখি, আসুক না ব্যাটা, এমন বারি মারব না, বাপের নাম ভুলিয়ে দেব। আপনি ভাববেন না বাবু। আমি চোর বাটপার নই। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান”। বুকটা শান্ত হল। দ্রুতপদে বাড়ি ফিরে এলাম।