কোড নেম প্রমিথিউস
ক্রিস, তার বাবাকে শুয়ে থাকতে বলে ওষুধ আনতে চলে যায়। সমুদ্র আর বর্ণালী তখন একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। আমি তখন ভাবছি, তার মানে স্যার জানতেন হাইনরিখের ছাড়া পাওয়ার কথাটা। অথচ উনি আমাদের বলেননি। উনি এখনও বলেননি, ওনার গবেষণার ফল কি হয়েছিল। কেন?
তবে কি উনি আমাদের থেকে কিছু লোকাতে চাইছেন? কিন্তু কি হতে পারে সেটা? এমন কি গুপ্ত রহস্য আছে যা উনি চান না, সবাই জেনে ফেলুক? কি অন্ধ অতীত আছে তাঁর আর হাইনরিখের মধ্যে?
হঠাৎ করেই জিপসির কথাগুলো আর কাল সকালে ক্রিসের কথাগুলোর একটা নতুন মানে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যে মগ্নমৈনাককে স্যার এতদিন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, সে আর কেউ নয়, হাইনরিখ নিজেই। তার মানে…… স্যারের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে হাইনরিখ। এত বছর জেলে থাকার জন্য স্বাভাবিকভাবেই ওর মস্তিস্কের বিকৃতি ঘটেছে, তাই এত বছর পর পুরনো প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠেছে। তাই সে ফিরে এসেছে…
এই খবরটার ধাক্কা সামলাতে বেশ সময় লাগে। কিছুক্ষন পর নীরবতা ভেঙ্গে সমুদ্রই বলে, “তার থেকেও বড় কথা কি জানিস, যে জন্য গেলাম, ঝিনুককে পাওয়া যাবে কিনা, সে গুড়ে বালি। ঝিনুক পালিয়েছে আজ সকালেই। পুলিশ রেড হবার ঘণ্টা দুই আগে।“
আমি আর বর্ণালী সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম, “কি? কি বলছিস রে?”
“ঠিকই বলছি। যতক্ষণ লোকটা মোটামুটি কনফেশন দিচ্ছিল, ততক্ষণ ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু যেই জিজ্ঞেস করা হল, মেয়েটাকে ওরা কোথায় লুকিয়ে রেখেছে, তখন লোকটা পরিষ্কার স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, যে যে জন্য পুলিশ এখানে এসেছে, সেই উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ। কারন ঝিনুক তাদের হাত থেকে পালিয়েছে। এখন সে কোথায় তারা কেউ জানে না।“
আমরা আকাশ থেকে পড়লাম। ঝিনুক পালিয়েছে? অতগুলো আতঙ্কবাদীদের হাত থেকে পালাল কি করে? আমার মুখ থেকে প্রায় প্রশ্নটা কেড়ে নিয়েই বর্ণালী জিজ্ঞেস করল, “কি করে? এ তো গল্পের মত শোনাচ্ছে। অতগুলো লোক, কেউ আটকাতে পারল না?“
ওর কথা শুনে তখন সমুদ্রের মুখের হাবভাবটা রীতিমত পাল্টে গেল। সে নিজেও এই ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। তাই খানিকটা কিন্তু কিন্তু করে বলল, “তাই তো, এটা তো খেয়াল করিনি। লোকটা তখন যা বলল, সেটার সারমর্ম এই যে ঝিনুককে যে লোহার বেড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল, সেটা ভেঙ্গে… হ্যাঁ, ঠিকই শুনছিস, ভেঙ্গে… ও ঘরের জানলা থেকে লাফ দিয়ে পালায়। যে জানালাটা ও দেখায়, সেটা মাটি থেকে কম করে হলেও পঞ্চাশ ফুট উঁচু। ঘরে যতজন ছিল, সবাই অবাক হয়ে যায় লোকটার কথা শুনে। বুঝতেই পারছিস, ওর কনফেশনটা কেউ বিশ্বাস করেনি। ওরা সেটাকে একটা ডেলিরিয়াম হিসাবে ধরছে। কারন আর যাই হোক, কোনও সুস্থ শরীরের মানুষ পঞ্চাশ ফুট উঁচু জানালা থেকে লাফিয়ে বেঁচে যেতে পারে, এটা আমিও শুনিনি, আর ওরাও না।“
যতক্ষণ আমরা লোকটার কথা শুনে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, লোকটা ততক্ষণে যে আরেকটা প্ল্যান মনে মনে কষে ফেলেছে, বুঝতে আমাদের দেরি হয়ে গিয়েছিল। স্বীকারোক্তিটা দেবার পরেই লোকটা ঘোলাটে একটা হাসি হাসতে হাসতে বলে, “এই বাড়ীটার কোণে কোণে বম্ব ফিট করা। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বিস্ফোরণ ঘটবে। আমি তো যাবই, তার সাথে তোমরাও যাবে। আই উইল ওয়েট ফর ইউ ইন হেল।“
ওর কথা শেষ হবার সাথে সাথেই ঘরের মধ্যে একটা টিকটিক করে শব্দ হতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটা পকেট সার্চ করে আবিষ্কার করি আমরা, যে সে বম্বগুলো অ্যাক্টিভেট করে দিয়েছে পকেটের মধ্যে থাকা একটা রিমোট টিপে। আর তারপরই আমরা ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে আসি। এমনিও লোকটাকে বাঁচানো যেত না, তাই ওকে ওখানেই ফেলে আসা হয়। বাড়ীটা থেকে বেরোনোর সাথে সাথেই বিস্ফোরণে পুরো এলাকাটা কেঁপে ওঠে। আমরা ছিটকে গিয়ে পড়ি শকওয়েভের ইমপ্যাক্টে। আমরা কেউই খুব একটা অনাহত ছিলাম না, শুধু স্যারের চোটটাই মেজর। যেহেতু উনি আমাদের সবার পিছনে ছিলেন, তাই বম্বের স্প্লিনটার ছিটকে ওনার কপালে লাগে।“
“তবে কি লোকটা তদন্তের মোড় ঘোরানোর জন্য মিথ্যে বলছে?” ক্রিসের কথায় সম্বিৎ ফেরে আমাদের। ও ঢুকেছে ঘরে, জুলিয়াসের জন্য ওষুধ নিয়ে।
আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকাই। হতেই পারে, ক্রিমিন্যালটা মিসলিড করার জন্য এইরকম উদ্ভট কথাবার্তা বলছে। অনেকসময়ই হয়, এইরকম কনফেশন দিয়ে তদন্তের গতি ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ওরা, যাতে বাকিদের খুঁজে না পাওয়া যায়।
হঠাৎ করেই ঘরের মধ্যে গম্ভীর এক স্বরে শোনা যায়, “না, মিথ্যে বলছে না লোকটা।“
আমরা চমকে উঠে দেখি, স্যার এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরের দরজায়। মাথার ব্যান্ডেজের একটা কোন রক্তে ভেজা। চোখদুটো যেন জ্বলছে হিংস্র কোনও প্রাণীর মত। বুকটা কেঁপে ওঠে স্যারের এই রূপ দেখে।
সমুদ্রই প্রথম প্রশ্ন করে স্যারকে, “স্যার, আপনি উঠে এলেন কেন? আপনার না মাথায় চোট?”
স্যার মাথা নাড়েন। তারপর বলেন, “এখনও অতটা চোট পাইনি, যাতে মেয়েকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে হয় একদম।“ তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জমেছে, তাই না? কিভাবে ঝিনুক পঞ্চাশ ফুট উঁচু থেকেও লাফ মেরে অক্ষত থাকতে পারে? কিভাবে একটা কুড়ি বছরের মেয়ে লোহার চেন ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারে?”
আমি মাথা নাড়ি। সমুদ্র, বর্ণালী আর ক্রিস বলে, “হ্যাঁ স্যার, বলুন। আমরা জানতে চাই।“
স্যার আমাদের দিকে তাকালেন। দেখলাম স্যারের চোখে জল চিকচিক করছে।
কিছু বলতে গিয়েও যেন থেমে গেলেন উনি। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে ঘরের মধ্যে রাখা চেয়ারটার ওপর বসে থুতনিটা রাখলেন দুহাতের ওপর। অনেকক্ষণ ধরে স্যার নিজেকে যেন আত্মস্থ করলেন। তারপর বলা শুরু করলেন ধীরে ধীরে।
“অয়ন, সমুদ্র, বর্ণালী, ক্রিস। আজ তোমাদের জানা প্রয়োজন। ঝিনুক আর আমার সম্পর্কটা ঠিক কি সেটা তোমাদের জানা দরকার। এর সাথেই আসলে জড়িয়ে আছে, আমি কি নিয়ে গবেষণা করছিলাম এতদিন। এতদিন ধরে এই গুরুভার আমি বয়ে বেড়িয়েছি। আজ সময় হয়েছে সেই ভার নামিয়ে দেওয়ার। তোমরা বড় হয়েছ, তোমাদের সেন্স অফ রেসপন্সিবিলিটি এসেছে। শুধু কথা দাও, এই মানুষটাকে তার কাজের জন্য রূঢ়ভাবে বিচার করো না। অনেক দুঃখ, অনেক কষ্ট পেলে তবেই একটা মানুষ এই কাজে নামতে পারে।“
আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকালাম। তারপর বর্ণালী আমাদের তিনজনের হয়েই বলল, “ঠিক আছে স্যার, তাই হবে। আপনি যা বলেননি আমাদের, সেটা আজ খুলে বলুন প্লিজ।“
স্যার বিষণ্ণভাবে হাসলেন। তারপর বলা শুরু করলেন।
চার
“সেইদিন প্রমিথিউসের ওপর আমাদের শেষ কথা হয়েছিল তো? একমাত্র টাইটান, যে মানবজাতির উপকার করতে চেয়েছিল, কিন্তু বিনিময়ে পেয়েছিল এক অসহ্য যন্ত্রণার শাস্তি?”
বর্ণালী বলল, “হ্যাঁ স্যার।“
স্যার তখন ক্রিসের দিকে তাকালেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “তুমি তো আর্টসের ছাত্র। আশা করি, প্রমিথিউসের ওপর তোমার ভালই জ্ঞান রয়েছে।“
ক্রিস ঘাড় নাড়ে। স্যার তখন বলা শুরু করলেন।
“তোমরা সবাই জান, জীবদেহে অনেক রকমের কোশ থাকে। টোটিপোটেণ্ট, প্লুরিপোটেণ্ট, ইউনিপোটেণ্ট… অনেকরকম। এর মধ্যে প্রথমটা সমস্ত রকমের কোশ তৈরি করতে পারে, পরেরটা অনেকগুলো সেল লাইনের কোশ তৈরি করতে পারে, তবে সব নয়। আর শেষেরটা শুধু মাত্র একরকমেরই কোশ তৈরি করতে পারে। যেকোনো রকমের রিজেনারেশনে এই ধরনের কোশগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।”
~ কোড নেম: প্রমিথিউস (পর্ব ৯) ~