জাতিতে কাহার অসহায় এক বৃদ্ধ অশীতিপর,

পথ চলে সে বহু কষ্টেই দণ্ড করিয়া ভর।

আপনজন কেহ নাহি বটেভিক্ষাই সম্বল,

দিবানিশি জপে কৃষ্ণের নামকপোলে অশ্রুজল।

নিবাস তাহার অজ্ঞাত কোন সুদূর গণ্ডগ্রামে,

ভাবিল বৃদ্ধ দেখিবে সে রথ শ্রীক্ষেত্র পুরীধামে।

যবেকার কথা পদব্রজই তখন উপায় কেবল,

সংকল্পে তথাপি বৃদ্ধ ছিল সদা অবিচল।

বৈশাখ মাসে এক শুভদিনে রওনা হইল ভক্ত,

তপ্ত দহনে হায় পথিমাঝে অবয়বখানি সিক্ত।

কিন্তু তাহাতে ভ্রুক্ষেপ নাহিকণ্ঠে জগন্নাথ,

অর্ধ যোজন হাঁটে কোনমতেতাহাতেই নামে রাত।

এমন ভাবেই পৌঁছিল যবে ভক্তটি জাজপুরে,

মাসাধিক কাল অতিক্রান্তরথ বুঝি নাহি দূরে।

পুরীর যাত্রী চলে দলে দলেবৃদ্ধ সবার পিছে,

খঞ্জকে হায় করে বিদ্রুপ – “কষ্ট তোমার মিছে,

পৌঁছিবে যবে শ্রীক্ষেত্রে তুমিতখন শূন্য পুরী,

এখনো সময় আছে হে খঞ্জযাও তব গেহে ফিরি

নিরুত্তর রহে সে বৃদ্ধচলে পিছে সবাকার ,

ভুবনেশ্বর পৌঁছিল যবেরথ নাহি দেরী আর।

পথিকজনেরা শুধায় তাহারে -“ কোথায় চলিলে বৃদ্ধ !

মনস্কামনা হইবে না তব কোনমতে হায় সিদ্ধ।

আগামীকল্য রথের রশিতে যাত্রীরা দিবে টান,

কেমনে পুরীতে পৌঁছিবে তুমিবৃথাই ব্যাকুল প্রাণ।

কহিল কাহার – “পণ করিয়াছি হেরিব জগন্নাথে,

দেখি না কেমনে ভক্ত বিহনে রথ চলে রাজপথে !”

তাহার বাক্যে হাসে পুরবাসী – “বৃদ্ধ পাগল বটে,

রথ কি কখনো কাহারো জন্য অপেক্ষা করে মোটে !”

ঘুমায় বৃদ্ধ পথের ধারেই রাত যবে ঘনঘোর,

পুনরায় করে যাত্রার শুরু যখন হইল ভোর।

দুটি পদে হায় অশেষ যাতনাউঠিতে বুঝি বা নারে,

তথাপি তাহার কণ্ঠ হইতে হরিনাম কে বা কাড়ে !

হামাগুড়ি দিয়া চলে সে খঞ্জহরির নামেতে শক্তি,

রথেতে হেরিবে শ্রীমুখ প্রভুরঅটল তাহার ভক্তি।

অপেক্ষা কর হে দীনের বন্ধুভক্ত আসিছে দুয়ারে,”

নীলমাধবের বন্দনা গানে দুনয়নে বারি ঝরে।

ভক্তের ঢল নামিছে এদিকে শ্রীক্ষেত্র রাজপথে,

অপরূপ বেশে উঠিলেন হরি অবশেষে স্বীয় রথে।

রথযাত্রার শুভক্ষণে যবে রশিতে পড়িল হাত,

লক্ষ যাত্রী সবার কণ্ঠে – “জয় জগতের নাথ

কিন্তু নিথর নিশ্চল হায় নন্দীঘোষের চাকা,

হস্তীযুথের আকর্ষণেও ম্রিয়মাণ রথোশিখা।

একি অঘটনস্তম্ভিত নৃপ তথা পুরোহিত মুখ্য,

হতবাক যত ভক্তের দল সমবেত সেথা লক্ষ।

ব্যাকুল পূজক লুটান রজোয়প্রভু চিন্তনে মগ্ন,

জানিতে পারেন অবশেষে তিনি কি হেতু এহেন বিঘ্ন।

পরম ভক্ত শ্রী হরির কেহ মৃত্তিকা কর্ষণে,

নন্দীঘোষকে হরিনামে বুঝি বিপরীত পথে টানে।

কোথা সে ভক্ত যাহার এমত অসীম পুণ্যবলে,

গজরাজও আজি শক্তিবিহীনরথ নাহি পথে চলে !

তাহার পরশ বিহনে আজিকে রথ রহিবে অচল,

অন্বেষ কর এইক্ষণে আজি শুচি সেই করতল।

পূজকের দল ছোটে চৌদিকেখোঁজ খোঁজ মহারবে,

কেউ বা আনিল সাধু সন্ন্যাসীকেউ বা বৈষ্ণবে।

কিন্তু কাহারো পরশেই হায় রথ নন্দীঘোষ,

তালধ্বজ কি দর্পদলনহয় না মোটেই বশ।

খুঁজিতে খুঁজিতে প্রধান পূজক বহুদূর দেন পাড়ি,

দেখেন সহসা পথের মধ্যে দেয় কেহ হামাগুড়ি।

অশীতিপর বৃদ্ধ সে বটেখঞ্জও বুঝি হায়,

জয় জগন্নাথ কণ্ঠে তাহারপুরী অভিমুখে ধায়।

শুধান পূজক -“ ভিক্ষার লাগি চলিতেছ কোথা বৃদ্ধ,

কাহার জন্য তোমার আজিকে এহেন জীবন যুদ্ধ !

খর রবিকরে পুড়িতেছে পথঅবয়ব ক্লেশে সিক্ত,

ভিক্ষার কি এত প্রয়োজনতুমি কি এমনই রিক্ত !

লহ তবে এই মুদ্রার থলিযাও ফিরিতব গেহে,

তোমার যাতনা হেরিতে না পারিকেমনে হৃদয় সহে !”

খঞ্জটি হাসে – “মুদ্রার মোর নাহি কোন প্রয়োজন,

পুরীধাম আর কত দূর সেটি কহ মোরে ব্রাহ্মণ।

রথের মধ্যে প্রভুরে হেরিবসেই মোর অভিলাষ,

বলিতে কি পার রথ কবে সুধীপূরিবে কি মনোআশ !”

শুনিয়া পূজক বৃদ্ধ খঞ্জে করেন আলিঙ্গন,

উথালপাথাল হৃদয় তাঁহারঅশ্রুসিক্ত নয়ন।

প্রভুর কৃপায় সাক্ষাত সেই পরম ভক্ত সাথে,

স্কন্ধে তুলিয়া খঞ্জে পূজক ধাবিত পুরীর পথে।

কণ্ঠে তাঁহার জগন্নাথের জয়জয়কার স্তুতি,

বৃদ্ধ ব্যাকুল – “কর কি,কর কি,আমি অতি নীচু জাতি।

তুমি ব্রাহ্মণ তায় পুরোহিতবর্ণে সর্বশ্রেষ্ঠ,

মোর পরশে হও যে  ক্লিন্নপ্রভু হইবেন রুষ্ট।

পূজক কহেন – “কে বলে তোমারে অশুচি অস্পৃশ্য,

তোমা বিনা আজি রথ নিশ্চলথমকিবুঝি বা বিশ্ব।

পদধূলি দাও হে পবিত্র প্রাণপ্রভুর শ্রেষ্ঠ ভক্ত,”

অশন বসন পূজকের সবই অশ্রুধারায় সিক্ত।

প্রধান পূজক আসিলেন যবে খঞ্জ বৃদ্ধ স্কন্ধে,

ভক্তের দল বিষ্মিত হেরিকলরোল করে ধন্ধে।

এহেন বৃদ্ধ অশীতিপরতায় সে খঞ্জ রিক্ত,

প্রভুর সে নাকি পরম ভক্তবিশ্বাস করা শক্ত।

কিন্তু বৃদ্ধ পরশমাত্র রথ যবে চলমান,

হেরি হতবাকযাত্রীরা সবে উল্লাসে গাহে গান।

জগন্নাথের বন্দনা গীতিহরিনামে দুলে দুলে,

নন্দীঘোষেতে বসায় খঞ্জে প্রভুর চরণতলে।

সত্যই তুমি দীনের বন্ধুরাখ নি:স্বেরও মান,

কাঙালের হরিতাই তুমি প্রভু ভক্তের ভগবান।

————————————————————-

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleঅন্ধকার
Next articleঅর্ধ্বলাড্ডুশ্বর
2 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments