খবর আজ রোববার। পেপার টায় এই খবর টাই খুঁজছিলাম। দ্বিতীয় পাতার শেষ দিকে লেখা।
খুব ছোট্ট একটা খবর, “মুখোমুখি সংঘর্ষ রাতের বেলায়,মৃত পাঁচ,আহত এক,ফের রক্তাক্ত কলকাতা র রাত”। খবর টা খুব ই সাধারন। কলকাতা থেকে ঝারখন্ড যাবার পথে,রাস্তায় দুটো বাস,একদম মুখোমুখি ধাক্কা খেয়েছে। বাসের ঐ দুই ড্রাইভার ছাড়া, আর ও তিনজন মারা গেছে। মাথায় আঘাত। আর এক জন আহত। দুই বাসেই আর বেশি লোক ছিল না।
গত পরশু, খবর টা শোনার পর থেকেই, কোন রকমে,তাড়াতাড়ি করে ছুটে চলে এসেছিলাম। না না আমার কেউ ই ছিল না বাস টায়। আমি একজন উঠতি সাংবাদিক। (উঠতি ই, কারন বাজারের বড় বড় পত্রিকা আমার লেখা টেখা ছাপে টাপে না, নবারুন দা আমার বাবার বয়সি, ক্ষমা ঘেন্না করে, তার পত্রিকায় আমার লেখা ছাপেন) সক্কাল সক্কাল সেখানে পৌছে ই, যা হোক কার ও একটা নাম কি ওয়াস্তা ইন্টারভিউ নিতে হবে, তারপর লিখতে হবে, বুঝতেই পারছেন অনেক ব্যস্ত ছিলাম।
মৃতদেহ গুলি দেখার দুর্ভাগ্য হয় নি, সে দিক দিয়ে বাঁচোয়া। জানা গেল, বাসের চালক গুলো ছিল কুড়ি একুশ বয়সের চ্যাংরা ছেলে। বাসের দুই মালিক কে থানায় নিয়ে গেছে, আমি আর সে পথে যাই নি, জানেন ই তো,আঠেরো ঘা। রাস্তার পাশে চা য়ের দোকানদার অনেক খবর দিচ্ছিল। “আরে ঐ চোলাই গিল্যা, পোলা গুলান বাস চালায়, রাইতের বেলায় এত জোড়ে কেউ বাস চালায়? বাস গুলানের ব্রেক ও খারাপ।” বোঝা গেল, কেস টা এক্কেবারে জলের মতন সোজা।
চা আর বিস্কুট এর অর্ডার দিয়ে,ভাবতে বসি কি ভাবে লেখা যায় এই ঘটনা টা নিয়ে। নবারুন দার ঐ প্যাচ মার্কা মুখ আর কথায় কথায় বাংরেজি তে “লজ্জা হ্যাজ?” বলে গালি দেওয়া টাই শুধু মনে পড়ছিল। চা ওলা ডাক দিল, ” ও ছ্যার, এ দিকে আসুন, আমার একটা গানের মেশিন একটু ভেঙে গেছে, এটা বিক্রি করা যাবে দেখুন তো”। বেশ সুন্দর একটা আইপড,কিন্তু স্ক্রীন টা ভাঙা। বেশ ভালোই আছে,বেশ নতুন নতুন ভাব। ভাবলাম আমি ই নিয়ে নিই,সস্তায় পাব,ভাল লেখা না হলেও নিবারন দা কে একটা উপহার তো দিতে পারবো।
চা ওলা তো,আমার কেনার কথায় এক পায়ে রাজি। নগদ চারশো টাকায় আমি ও ভালোই লাভ করলাম। দোকান থেকে বেরতে যাবো,এমন সময় দেখি এক প্রায় অর্দ্ধ উলঙ্গ পাগল,তার গোটা পায় ব্যান্ডেজ নিয়ে,আমার কাছে,কিছু পয়সার জন্য হাত পাতছে। না দিলাম বুঝলেন? দশ টা টাকা। মন টা ভারি ছুশি ছিলো তো। পাগলা চা’র দোকানে বসে ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না শুরু করেদিল। চা-ওলা যতই খ্যাদায়,পাগলা তো নড়েই না। চা-ওলা বিরক্ত হয়ে,তার ছোট ছেলেকে দোকানে রেখে,কোথাও একটা বেরিয়ে গেলো।
আমি ও ঠায় বসে ভাবার চেষ্টা করছি,ঠিক কি ভাবে লেখা টা শুরু … “কাকু,বাবা যেটা দিল তোমাকে, একটু দেখাবা?” চা-ওলা র ছেলের সরল প্রশ্নে ,ভারি বিরক্ত হলাম। কিছু না বলে,পকেট থেকে বের করেদিলাম। বছর ছয়ের শিশুর হাতে গরম চায়ের কেটলি র থেকে, আইপড যথেষ্ট মানানসই। আমি মজা করে বললাম “তা তুই এটা ভেঙে দিয়েছিস, বলেই তো তোর বাবা আমাকে দিয়ে দিল!”
“আমি কোথায়?? এটা তো,আজ সকালে বাবা ঐ দাদা টার পকেট থেকে পেয়েছিল। আর ও কত কি পেয়েছে, !!” আমি তো পুরো অবাক। আইপড ভর্তি ভোজপুরি আর হিন্দি গান। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল। “…বাবা টাকা পেয়েছে,অনেক টাকা। ঐ দাদা গুলো ঘুমোচ্ছিল,ওদের নিয়ে যাবার কেউ ছিল না। এই পাগলা টা একটা ভ্যান এ করে ওদের নিয়ে যেতে গিয়ে, নিজের ও পা কেটে ফেলে। বাবা এই পাগলা কে আজ খেতে বলেছে, আমাদের বাড়ি…..”
আমার তো পুরে বিষম খাওয়ার মতন অবস্থা। পাগল টা কান্না থামিয়ে,নিজের পায়ে হাত বুলোতে বুলোতে আমার দিকে দেখছিল। সেই পাগলার, দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খুব ভাল লাগছিল। এরকম লোক জীবনে আর বেশি বার দেখবো কি না সন্দেহ। চা-ওলা এতক্ষন পর, হাতে মুড়ি মাখা নিয়ে ঢুকলো, পাগল টা কে দিলো। পাগলা খুব আনন্দ করে খেতে থাকলো
আমি বললাম ” ও রা চুল্লু খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল কি করে বুঝলে?” চা-ওলা “তা ঠিক জানি না,তবে মনে হলো” আমি চুপচাপ উঠে থানার দিকে পা বাড়ালাম। ছেলে গুলোর ঠিকানা জানতে হবে,এই আইপড টা,যেন আসল মালিকের বাড়ি তে যায়।
রাস্তায় আসতে আসতে পুরো ঘটনা টা নিয়ে অনেক ভাবছিলাম, চা-ওলা র সংসার, পাগল, আমার কেরিয়ার, নিবারন দা, ঐ ছেলেগুলো সব। কিছুতেই পারলাম না, দশ লাইনের খবর বানাতে। আজ রোববার। পেপার টা পড়ে, বুঝে গেলাম, আমার দ্বারা সাংবাদিক হওয়া হবে না। ঐ পাগল টার নিঃস্বার্থ কাজ, ঐ চা-ওলা আর তার ছোট ছেলেরা, চিরকাল ই, ছাপার কালির বাইরেই থেকে যাবে। দুই লাইনের ভেতরের ঐ সাদা কাগজের মাঝে।
তবে আমি ঐ আইপড টা থানায় গিয়ে জমা রেখে দিয়েছিলাম। এখন তাই নতুন কাজ খুঁজছি, নয়তো দোকানে বসবো। দশ পনেরো লাইনের ভেতরে, আমার এই জীবন্ত ক্যন্সার রুগির মতো সমাজ কে, আমি প্রকাশ করতে পারবো না।