বিদেহাধিপতি পৃথুপাল–
প্রতাপে তাঁহার কম্পমান আর্যাবর্ত বিশাল।
শক্তি পূজারী রাজন ছিলেন–বলশালী নির্দয়,
হিংসা ব্রতেই দীক্ষা নৃপের–চিত্ত অকুতোভয়।
কিন্তু এহেন কঠোর হৃদয়ে সহসা তীব্র শোক,
সন্দেশ আসে–পুত্র তাঁহার ত্যজিয়াছে ইহলোক।
একটিমাত্র তনয় পিতার–মহীপাল যুবরাজ,
হায় সে নিহত অরির হস্তে–বিনা মেঘে পড়ে বাজ।
বৌদ্ধভিক্ষু আশ্রমবাসী–পাহাড়ের পাদদেশে,
তাঁহারই দোষী–নিশ্চিত রাজা–কপট সাধুর বেশে।
তবে রাজপুত্রের শোণিতে গাহন–এমত দু:সাহস !
উচিত দণ্ড লভিবেই সবে–মিথিলাপতির রোষ।
প্রতিহিংসায় দীর্ণ নৃপতি–অন্তরে শোকানল,
রাজদরবারই বিচার আলয়–থমথমে সভাতল।
মঠাধক্ষ্য গৈরিকধারী বৃদ্ধ অকিন্চন,
রাজফরমানে তিনি শৃঙ্খলে–অপরাধী দুর্জন।
পুত্রবিয়োগে কষায়িত নৃপ–তাঁহারই বিচার ব্যস্ত,
পাত্র,মিত্র,অমাত্যগণ–সভাসদজনে ত্রস্ত।
কিন্তু বৌদ্ধভিক্ষু নিধনযজ্ঞে–এ কথা অবিশ্বাস্য,
যাঁহাদের হৃদে তথাগত ব্রত–কণ্ঠে বুদ্ধভাষ্য।
কেমনে তাঁহারা করিবেন এই ঘৃণ্য পাতক কর্ম,
ভিক্ষুরা যবে শান্তির দূত–অহিংসা জীবধর্ম !
মোরা তবে ফিরি ঈষৎ অতীতে–করি এবে সন্ধান,
কি হেতু ভিক্ষু অকিন্চনের আজি বুঝি যায় প্রাণ।
শ্রমণেরা যবে গড়িলেন মঠ মিথিলাপ্রদেশ পরে,
অহিংসরূপ বৌদ্ধধর্ম সেথা প্রচারের তরে—
সেই লগণেই সংঘাত শুরু–রাজন ধরেন রাশ,
অনুজ্ঞা বিনা বিহার স্থাপন–স্পর্ধিত অভিলাষ।
রাজশক্তির বিরুদ্ধাচারী সন্ন্যাসী ষড়যন্ত্রী,
নৃপের ধারণা কপট তাহারা–লক্ষ্য কেবল ক্রান্তি।
সেই হেতু সবে রাজফরমানে স্বীকার করে না নতি,
রাজঅনুজ্ঞা লঙ্ঘন করি’ ধর্মপ্রচারে ব্রতী।
ভূপতির মতে সন্ন্যাসবেশ কেবলি একটি ছল।
এই লহমায় লইবে বিদায় যতেক ভিক্ষু দল ।
নচেৎ বিহার করিব ধ্বংস–বিদেহ নরেশ ক্ষিপ্ত,
অভিযানে সেনা–নেতা যুবরাজ–ঊজ্জ্বলতায় দীপ্ত।
সঙ্ঘের প্রতি তাহার ছিল না সামান্যতম রোষ,
কিন্তু পিতৃআদেশ অমান্যের ছিল না তিলেক সাহস।
পাহাড়ের তলে অশ্বপৃষ্ঠে সেনাপতি–পিছে বাহিনী,
নীচে বহে চলে গভীর নিনাদে পাহাড়ী স্রোতস্বিনী।
ঊষশী আলোকে পূর্ব গগনে তখন কনক সাজ,
তুষারশৃঙ্গে স্বর্ণালী আভা–আবিষ্ট যুবরাজ।
তরুণটি বুঝি চেতনাবিহীন অপরূপ রূপ হেরি’,
এমত লগণে বিহার হইতে বাজিল তুর্য্য ভেরী।
সহসাই সেই দুন্দুভি নাদে অশ্বটি শঙ্কিত,
হয় পৃষ্ঠের উপর হইতে মহীপাল ভূপাতিত।
অকাল মৃত্যু রাজপুত্রের সেই পতনের ফল,
দুর্ঘটনার অন্তরালে ছিল না ভিক্ষুদল।
কিন্তু মিথিলাপতির সঙ্ঘের প্রতি বিদ্বেষভরা মন,
হত্যাকারীর অভিযোগ মাথে ভিক্ষু অকিন্চন।
রাজার আদেশ অমান্য হেতু ঘটনার বিস্তার,
রাজপুত্রের অকালনিধন–ঘটনার দায়ভার।
সেই সঙ্ঘের দলপতি ঐ ভিক্ষু সৌম্য বৃদ্ধ,
তিনিই রাজার পুত্রহন্তা–আইনের ফাঁসে বিদ্ধ।
পুত্রশোকের শোকানল তথা হিয়ায় অসীম ক্লেশ,
নৃপের ঘোষণা–অকিন্চনের মৃত্যু দণ্ডাদেশ।
“তব পুত্রের অকাল নিধন–মোরা কি হেতু দায়ী !
অহিংসাব্রতে দীক্ষিত মোরা–নহি হিংসাশ্রয়ী।
মহীপাল ছিল মোদের তনয়–সংঘও শোকাহত,”
অকিন্চনের এহেন উক্তি–নৃপ আরও উদ্ধত।
আগামীকল্য নিশা অবসানে বিদ্ধ হইবে শূলে,
বৌদ্ধ বিহার করিব প্রহার–যত আছে ধরাতলে।
মিথিলাপতির আদেশ শ্রবণে অকিন্চনের হাস্য,
অমাত্যজন বিষ্ময়াহত–এ যেন অবিশ্বাস্য !
সংঘ সেবীরা মৃত্যুভয়ে কি হয় না কভুই ভীত !
অমোঘ বিধান–তথাপি আননে হাস্য শুচিস্মিত !
ক্রুর পৃথুপালও বুঝি চিন্তিত–কি আছে এমন দণ্ড,
আরো নির্মম–যাহাতে দীর্ণ হইবে ভিক্ষু ভণ্ড !
চিরন্জীব প্রধানীমাত্য–আসীন রাজার পার্শ্বে,
কহিলেন কিছু তাঁহারে গোপনে–নৃপতি দৃপ্ত হর্ষে।
“শ্রীকল্যাণ, পুত্রটি তব”-অকিন্চনেই শুধান,
তাহারেই আজি করিব হনন–প্রাণের বদলে প্রাণ।
চরম শাস্তি সেইটিই তব–পাপিষ্ঠ নরাধম,
মিথিলাপতির গর্জন কাড়ে ভিক্ষুর সংযম।
হাহাকার রব শ্রমণ কণ্ঠে–অশ্রু মানেনা বাঁধ,
“আমাকে হত্যা করুন রাজন”-পুত্র নিরপরাধ।
“ অদ্য নিশীথে ভিক্ষু পুত্রে করহ শিরশ্ছেদ,
তাহার শোণিতে হইবে আমার যজ্ঞ অশ্বমেধ।”
রাজার ঘোষণা–অট্টহাস্য–অন্তরে উল্লাস,
সভাসদগণ বুঝি নির্বাক–শ্রমণের হাহুতাশ।
মধ্যরাত্রে সমন আসিল ভিক্ষুর রাজকক্ষে,
কর্তিত শির পুত্রের তিনি হেরিলেন স্বীয় চক্ষে।
ভিক্ষু তখন অচন্চল–শোক বুঝি সমাহিত,
বিদেহপতিরে দিলেন আশীষ–পৃথুপাল বিষ্মিত।
“পুত্রের হেতু হিয়াপটে মোর ছিল অহেতুক মায়া,
সন্তান স্নেহে ছিলেম বদ্ধ–সে ছিল আমার ছায়া।
সন্ন্যাসী হৃদে সেই মায়াজাল ছিল সততই রিষ্ট,
আজ সে অতীত–আমিও মুক্ত–নহি ত’ মোটেই ক্লিষ্ট।
আপনি যে মোর কল্যাণকামী পরমোপকারী মিত্র,
চতুরাশ্রম মূর্ত আজিকে–ছিন্ন সকল সূত্র।
এই পৃথ্বীর প্রতিটি নবীন মম সন্তান সাথী,
হে মহারাজ–গ্রহণ করুন অকিন্চনের প্রণতি। “
নৃপ নির্বাক, বিবশ,বিভোল–ইনি কি সত্য মানব !
এত প্রশান্তি কিমতে সিদ্ধ হেরি আত্মজ শব।
ধীরে ধীরে রাজ চেতনায় যেন আলোকের উন্মেষ,
নৃপতি কপোল বুঝি বাণভাসি–মানসে অরুণ আবেশ।
লুটায়ে নরেশ শ্রমণ চরণে–মনস্তাপেই স্নান,
আমি পাষণ্ড–উচিত দণ্ড–করুন প্রতিবিধান।
সৌম্য শ্রমণ বিদেহ নরেশে করেন আলিঙ্গণ,
হিংসা বিদিত–মিথিলারাজ্যে তথাগত বন্দন।
অকিন্চনের দিব্য আননে অমরাবতীর দ্যুতি,
পৃথুপাল হিয়া উদ্ভাসিত–পুবাকাশে ভানু–জ্যোতি।
রাত্রি প্রভাত–রাজপথে পুত উদগীত কলরব,
ধর্ম শরণ, সঙ্ঘ শরণ, উদ্বোধিত স্তব।
কিন্তু কাহার উদাত্ত স্বরে দিগন্ত মোহাবিষ্ট !
পুরনাগরিক অর্গল খুলি হতবাক সংহৃষ্ট।
ভিক্ষু অকিন্চনের পার্শ্বে কে বা উনি শালপ্রাংশু !
দৃষ্টি যাঁহার অন্তর্মুখী, অংগে দিব্য অংশু !
গৈরিকধারী মুণ্ডিতকেশ প্রতাপাণ্বিত মহারাজ,
বিদেহাধিপতি শ্রীপৃথুপাল–তাঁহারও শ্রমণ–সাজ।