আজ অনেকদিন পর বুবাইকে এক চেষ্টায় ঘুম পাড়ানো গেল। গত পাঁচ মাস ধরে যে কি ভাবে দিন কাটছে, তা ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানেন না। আর কেই বা আছে যাকে তাঁর এই বুকফাটা কষ্টের কথা বলে একটু হাল্কা হবেন আশাদেবী। যতদিন অনন্তবাবু ছিলেন, ওনার সাথে কথা বলার পর কোনও কষ্টকেই আর কষ্ট বলে মনে হত না, তেমনি আনন্দটাও ওনার সাথে ভাগাভাগি না করলে সেটা যেন পরিপূর্ণ হত না। কিন্তু সেও তো আজ প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল ওই বিশ্বাসঘাতক মানুষগুলোর নৃশংস আক্রমণ তাঁকে নির্দয় ভাবে ছিনিয়ে নিয়েছে আশাদেবীর কাছ থেকে। টানা দু’সপ্তাহ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে শেষ পর্যন্ত স্বার্থান্বেষী মানুষগুলোর লোভের কাছে হার মানতে হয় তাঁকে, বিফলে যায় আশাদেবীর ঈশ্বরের প্রতি আকুল প্রার্থনা।
সততা এবং কর্মদক্ষতার সুবাদে ফ্যাক্টরির কর্মীরাই অনন্তকে মনোনীত করেছিল ইউনিয়নের নেতা হিসেবে আর সমস্ত কর্মীই ছিল তাঁর বিশেষ অনুগত। সকলের সাথে এতটাই ভাল সম্পর্ক ছিল, যে তাঁকে সবাই তাদের পরিবারের লোকের মতই মনে করতো। যে কোনও বিপদে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো, এমনকি প্রয়োজন হলে ম্যানেজমেন্টের সাথে ঝগড়া করতে পিছপা হত না সে। তার এই জনপ্রিয়তা সহ্য হল না ভিন রাজ্য থেকে আসা ওই লোকটার, শুরু করে দিল ওর বিরুদ্ধে নানান চক্রান্ত। ম্যানেজমেন্টের কিছু সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করায়, তারাও চাইছিল অনন্তকে সরিয়ে দিতে। তাই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ম্যানেজমেন্ট লোকটাকে হাত করে ফেলল আর শুরু করে দিল নানাভাবে তাকে অপদস্থ করা, এমনকি চুরির অপবাদ দিয়ে সাসপেন্ডও করা হয়েছিল তাঁকে। প্রথমে এসব কিছু গায়ে মাখেনি অনন্ত, কিন্তু যখন বুঝতে পারলো ততদিনে ওরা আরও বেশ কয়েকজন কর্মীকে অর্থের প্রলোভনে হাত করে ফেলেছে।
অবশেষে ঘনিয়ে আসে সেই দুঃস্বপ্নের রাত। সেদিন শেষবারের মত অনন্তবাবুর সাথে আশাদেবীর কথা হয়েছিল বিকেল পাঁচটা নাগাদ, যখন অনন্ত জানিয়েছিল যে ম্যানেজমেন্টের সাথে একটা জরুরী মিটিং থাকার ফলে ফিরতে দেরী হবে। সন্ধ্যাবেলায় পূজার্চনা সেরে একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছিলেন আশাদেবী। একটু পড়ে দমাদম শব্দ দরজায়, ‘ওফ, বাড়ি ফিরলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করতে পারে না। দাঁড়াও, আসছি।‘ দরজা খোলা মাত্র খুলে প্রতিবেশী ভদ্রলোক বলে ওঠেন ‘কারা যেন অনন্ত বাবুকে মেরে সামনের রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে জ্ঞান নেই ওনার। আমি অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি, এখুনি ওনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার।‘ দৌড়ে গিয়ে দেখেন অনন্তর দেহটা কুঁকড়ে পড়ে আছে রাস্তায়। মুখটা যেন কেউ থেঁতলে দিয়েছে, আর মাথা থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। সাদা জামাটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে। চশমা, ব্যাগ, জুতো কিছুই নেই সাথে।
পরের দু’সপ্তাহের কথা তার স্মৃতিপট থেকে ধুয়ে-মুছে ফেলতে চান আশাদেবী। কেবল মনে পড়ে যায় অনন্তর সেই বেদনা ক্লিষ্ট মুখটা, চোখদুটো চেয়ে থাকতো আশাদেবীর দিকে – হয়তো অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু সব কিছুই না বলা রয়ে গেছে। যে দুঃখটা আজও আশাদেবীকে সবথেকে বেশী কষ্ট দেয় তা হল যে মানুষটা চিরকাল আপদে-বিপদে সমস্ত কর্মীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর প্রতি এই অমানবিক অত্যাচারের কোনও প্রতিবাদ হয় নি, এমনকি এদের কেউই তাঁর এই অন্তিম শয্যার পাশে এসে দাঁড়ানোর প্রয়োজন বোধ করেন নি।
প্রথমে মনে হয়েছিল জীবনটাই হয়তো থেমে যাবে। কত দিনরাত যে মনের মধ্যে আউরেছেন ‘ঠাকুর, এতো বড় আঘাত আমি সহ্য করেছি, এবার আমাকেও তুলে নিয়ে আমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ কর।’ কেবল মনে হত ঈশ্বর কেন এতো নির্দয় তাঁর প্রতি, কেন একটা প্রার্থনাও তিনি শোনেন না? কিন্তু শেষপর্যন্ত সময়ই তাঁকে বুঝতে শিখিয়েছে যে অতীত কেবলই স্মৃতি মাত্র, তাকে আঁকড়ে ভবিষ্যতে পথ চলা সম্ভব নয়। দুঃখের পেছনে দৌড়ে বেড়ানো মুক্তির পথ নয়, বরং সুখকে বরন করাই দুঃখ জয়ের একমাত্র পথ। আশাদেবীকে অমন ভেঙ্গে পড়তে দেখে পনেরো বছরের অসীম ছলছল চোখে গুটিসুটি পায়ে মায়ের কাছে এগিয়ে এসে বলতো ‘তুমিও আমাকে ছেড়ে চলে যাবে মা? তাহলে কে দেখবে আমাকে? কি করেই বা আমি লেখাপড়া শিখে বাবার স্বপ্ন পূরণ করবো?’ আশাদেবী উপলব্ধি করেন সংসারে তাঁর প্রয়োজন এখনও শেষ হয় নি, তাঁকে বাঁচতে হবে অসীমের জন্য। তাছাড়া, অসীম তো অনন্তরই প্রতিনিধি। মানুষের শরীর তো ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু তার সত্ত্বা অবিনশ্বর। তাই অসীমের মাধ্যমেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে অনন্তের আদর্শকে।
* * *
সেই শুরু হয় অসীমকে নিয়ে আশাদেবীর এক কঠিন জীবন সংগ্রাম। চরম দারিদ্রের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে লেখাপড়া শিখিয়ে গড়ে পিঠে মানুষ করে তোলেন অসীমকে। এতো দুর্দশার মধ্যেও ভেঙ্গে তো পড়েননি, বরং এক অটুট পাথরের মূর্ত প্রতীক হয়ে ছেলেকে অবিরাম সাহস জুগিয়ে গেছেন জীবনের দুর্গম ধরে এগিয়ে যেতে। চলার এই কঠিন পথে কম বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি তাঁকে, তবে কিছুতেই হার মানেন নি, বরং আরও দৃঢ় হয়েছে তাঁর প্রতিজ্ঞা। মনে হত ডাকার মত যখন আর কেউ নেই, তাঁকে একলাই চলতে হবে। প্রার্থনা করার কোনও ভাষাও ছিল না, কেবল মনকে বুঝিয়েছেন ‘বিপদে আমি না যেন করি ভয়, দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।‘
খরচের ধাক্কা সামলাতে গিয়ে প্রথম কোপটা পড়ে আশাদেবীর গয়নার ওপর। বহু স্মৃতি বিজড়িত এক একটা গয়না বিক্রি করার সময় যে চাপা কান্না বেরিয়ে আসতো তা গয়নার শোকে নয়, এক মধুর স্মৃতি হারানোর দুঃখে। আসলে গয়নাটা একটা মাধ্যম, যার মাধ্যমে জড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত আনন্দানুভূতি। প্রতিটা গয়নাই যেন এক একটা সুখস্মৃতির বাহক। বিয়ের পর চাকরীর প্রথম পদোন্নতির খবর পাওয়া মাত্র অনন্তর সেই অফিস ফেরত গলার চেনটা কিনে আনা থেকে শুরু করে প্রতিটা আনন্দের দিনে অনন্তর গয়না কেনার নেশা দেখে আশাদেবী অবাক হয়ে বলতেন ‘কি অদ্ভুত বাতিক তোমার, ব্যাঙ্কে কোনও সঞ্চয় নেই এমন কি বিয়ের লোণ এখনও শোধ হয়নি, অথচ একের পর এক গয়না কিনে যাচ্ছ।‘ শুনে অনন্ত হেসে বলতো ‘এগুলোই হচ্ছে আমাদের আনন্দের স্মারক। সোনা কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না – সুখের দিনে যেমন আনন্দ দেয়, তেমনি দুঃখের দিনে পেছনে দাঁড়ায়।‘ তখন কে জানত যে এই দুঃখের দিনে এগুলোই হয়ে উঠবে তার সবথেকে বড় সহায়।
একে একে সমস্ত গয়না শেষ হওয়ার সাথে সাথে আশাদেবীর মনে হয়েছিল সব স্মৃতিই যেন ধুয়ে মুছে গেল। শুরু হয়ে যায় আরও কঠিন সংগ্রাম – বাড়ি বাড়ি খাবার সাপ্লাই, সেলাই-বোনা, এমনকি অন্যের বাচ্চা সামলানো ইত্যাদি কিছুই বাদ যায় নি। কিভাবে যে সেইদিনগুলো ওদের দুজনের পেট চালিয়ে অসীমের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলেন, তা ভাবলে এখনও আঁতকে ওঠেন। কেবল মনে হত কোন একটা অদৃশ্য শক্তি যেন পেছন থেকে তাঁকে ঠেলে নিয়ে চলেছে।
মায়ের এই চরম ত্যাগ এবং কষ্টের কথা অসীমের অজানা নয়, তাঁর সংগ্রামের প্রতিটা মুহূর্ত এতো কাছ থেকে দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন করতো ‘কতদিন আর এভাবে চলবে মা? সারাটা দিন তুমি ঘরে-বাইরে এমন অমানুষিক পরিশ্রম করবে, আর আমি শুধু বসে বসে খাব আর পড়াশোনা করবো? আজকাল একসাথে খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছ – জানতেই পারিনা তোমার পেটে দানাপানি জুটছে কিনা? এরপর আমার সাথে রাত জাগা – যতক্ষণ আমি পড়াশোনা করবো, তুমি ঠায় বসে থাকবে। আমি আর পারছি না মা, দিনের পর দিন তোমার এই কষ্ট দেখে চুপ করে বসে থাকতে পারবো না, এবার পড়াশোনা ছেড়ে কিছু একটা কাজ জুটিয়ে নেব। আমার বয়সী কত ছেলেই তো কাজ করে উপার্জন করছে।‘ জবাবে আশাদেবী শুধু এটুকুই বলেন ‘তুই কি চাস আমার এতদিনের চেষ্টা সব বিফলে যাক? সত্যিই যদি তুই আমার কষ্টটা বুঝে থাকিস, তোকে লেখাপড়া শিখে একটা বড় মাপের মানুষ হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই হবে।
* * *
অসীম যখন পাশ করার সাথে সাথেই এক মস্ত চাকরীতে ডাক পেল, দুহাতে মায়ের পা’দুটো জড়িয়ে বলেছিল ‘এতদিন তুমি আমাকে দেখে এসেছ, আজ থেকে তোমার সমস্ত দেখাশোনার ভার আমার। শুধু আশীর্বাদ কর তোমার ছেলে যেন তোমারই মত জীবনের সব দুঃখকে জয় করতে পারে।
আশাদেবী ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন ‘যে কষ্ট তুমি আমাকে দিয়েছিলে অনন্তকে কেড়ে নিয়ে, তাকেই শক্তি করে আমি অসীমের মধ্যে গড়ে তুলেছি আমার ‘অনন্ত’ ভালবাসা। অসীম সম্পূর্ণ আমারই একটা অভিন্ন অংশ, আমি ওকে রক্ষা করবো আমার জীবন দিয়ে – কোনও আঁচর লাগতে দেব না’।
অসীমের মানুষ হওয়ার পেছনে আশাদেবীর ত্যাগের কথা অসীম ছাড়া আর কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। অসীমের সাফল্যের পেছনে পূর্ণ অবদান শুধুমাত্র ওর মায়ের, আর তাই আশাদেবীকেই অসীম তার একমাত্র ভগবান বলে বিশ্বাস করতো । মায়ের প্রতি অসীমের শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা আশাদেবীকে জীবনের সমস্ত দুঃখ ভুলে বেঁচে থাকার নতুন অর্থ খুঁজে পেতে সাহায্য করে। যদিও অসীম বিয়েতে একেবারেই রাজি ছিল না, কিন্তু আশাদেবীই জোর করে তার বিয়েটা দেন। সম্বন্ধ অনেক এসেছিল, কিন্তু অহনাকে দেখা মাত্রই আশাদেবীর মনে ধরে যায়। যেমন মিষ্টি দেখতে, তেমনি নম্র স্বভাব মেয়েটার। তাছাড়া, অমন অভিজাত ধনী এবং শিক্ষিত পরিবার হওয়া সত্ত্বেও বাড়ির সকলেই কত মার্জিত এবং আন্তরিক। অহনা তো নিজেও কত শিক্ষিত, কিন্তু যেদিন থেকে এই বাড়িতে পা রেখেছে, রান্না থেকে শুরু করে ঘর গোছানো, অসীমের প্রতিটা প্রয়োজনীয় জিনিষের খেয়াল রাখা, আশাদেবীকে ঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়ানো এমনকি রাত্রে আশাদেবীর বিছানা করা, মশারি খাটানো ইত্যাদি এতটাই নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার সাথে করতো যে বাচ্চা মেয়েটাকে এতো খাটতে দেখে নিজেকে ভীষণ স্বার্থপর বলে মনে হত আশাদেবীর। কিন্তু কি করবেন, কোনও কথাই যে শুনত না মেয়েটা। কিছু বললে, করুন মুখে বলে উঠত “আমি তো এই বাড়ির মেয়ে আর এতো সব আমারই কাজ। তবে কোনও ভুল ত্রুটি হলে অবশ্যই আমায় বকবেন’।”
মেয়েটা আসার পর থেকে একটা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল ওদের সংসারটা, ফিরে এসেছিল জীবনে ছন্দ। কুড়ি বছরের হতাশা আর নৈরাশ্যের আঁধার কেটে গিয়েছিল অহনার আগমনে। জীবনটাকে বয়ে নিয়ে চলার অর্থ খুঁজে পেয়েছিলেন আশাদেবী। কুড়ি বছর পুরনো সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কখন যেন চলে গিয়েছিল স্মৃতির অন্তরালে। এখন আর আশাদেবী নিদ্রাহীন রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারার পানে চেয়ে খুঁজে বেরান না কাউকে, মনে পড়ে না ছুটির দিনে চৌমাথার মোড়ের সেই ফুচকা খাওয়ার প্রতিযোগিতা বা হোলির দিনে আবির খেলার আনন্দ।
* * *
কিছুদিন পরে অহনার কোলে আসে এক ফুটফুটে সন্তান। অহনা ওর নাম রাখে অশেষ, তবে আশাদেবী আদরের নাম রাখেন বুবাই। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রাখতো সারা বাড়িটা, আর অহনা ছুটে বেড়াতো ওর পেছন পেছন ‘দেখুন মা, কি দুষ্টুমিটাই না করছে, এক ঘণ্টা চেষ্টা করে এক গ্রাস ভাতও খাওয়াতে পারিনি।‘, ‘দেখেছেন কি পাজি হয়েছে আপনার নাতিটা? জানলা দিয়ে খেলনাটা ছুঁড়ে দিল – যদি কারও মাথায় পড়ত?’ শুনে আশাদেবী হাসতেন, আর মনে পরে যেত সেই ছোট্ট অসীমের কথা। একেক সময় এমন দুষ্টুমি করতো যে আশাদেবী পিঠে বসিয়ে দিতেন এক ঘা, আর তারপর শুরু হয়ে অসীমের বকুনি সারাটাদিন ধরে।
কয়েকটা বছর এমনই আনন্দে ভরে ছিল সংসারটা, যেন এক নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল। মনে হয়েছিল সত্যিই বোধ হয় ‘রাত পোহাল শারদ প্রাতে’। কিন্তু দিনগুলি যে সোনার খাঁচায় চিরদিন রইবে না, তা বোধ হয় স্বপ্নেও ভাবেন নি আশাদেবী।
* * *
সেদিন ছিল অহনার একমাত্র বোন উদিতার আশীর্বাদ। বিয়েটা হঠাতই ঠিক হয় আমেরিকা বাসি এক ইঞ্জিনিয়ারের সাথে এবং পাত্র পক্ষের ইচ্ছেমত ঠিক আঠারো দিনের মাথায় বিয়ের দিন ধার্য হয়, কারণ পাত্রের হাতে আর ছুটি নেই। যথারীতি বিয়ে সমস্ত ভার এসে পড়ে অসীম আর অহনার ওপর, আর সেই সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিল ওরা। আশীর্বাদের অনুষ্ঠান সুষ্ঠু ভাবে মিটে যাবার পর অহনাদের হাতিবাগানের বাড়ি থেকে ওদের বেরোতে রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। বুবাইটাকে পেছনের সিটে সুইয়ে দিয়ে অসীমের পাশের সিটে বসেছিল অহনা, আর লক্ষ্য রাখছিল অসীমকে, যেন গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমে ঢলে না পড়ে কারণ আগের রাতে ওরা দুজনই একদম ঘুমোতে পারেনি। শীতের রাত, তাই রাস্তাও একদম ফাঁকা। শর্টকাট পথ ধরার জন্য অসীম যতসব খারাপ, অন্ধকার রাস্তায় দিয়ে চলেছিল আর অহনা ততই মানা করছিল অমন বাজে রাস্তায় রাতবিরেতে না ঢুকতে। এই রাস্তাটায় ঢোকা মাত্রই অহনা ভীষণই রেগে গিয়ে বলেছিল ‘সেই তুমি এমন বিশ্রী রাস্তাটায় ঢুকলে? না জ্বলছে আলো, না আছে রাস্তায় কোনও লোক।‘ অসীম হেসে বলে ‘কেন, ভয় করছে নাকি? গাড়ির মধ্যেই তো আছ, তবে এতো এতো ভয় কিসের? দেখো, ঠিক কুড়ি মিনিটের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে দেবো।‘
একটু এগোতেই চোখে পরে রমার, আর বলে ওঠে ‘কি হয়েছে ওখানে? দেখো, মনে হচ্ছে তিন-চারটে ছেলে মিলে ওই মেয়েটাকে ধরে টানাটানি করছে। তুমি তাড়াতাড়ি গাড়িটা চালিয়ে এই রাস্তা থেকে আগে বেরও।’ অসীম দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু এতো অন্ধকার, যে ভাল করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। গাড়িটায় ব্রেক চেপে একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়ে আর দেখতে পেয়ে বলে ‘হ্যাঁ, তাই তো! এটা হচ্ছেটা কি? আর ওই বয়স্ক ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা – নিশ্চয় মেয়েটার বাবা-মা, ছেলেগুলোর পায়ে ধরে কাকুতি মিনতি করছেন। একি!, ওদের বাবার বয়সী মানুষটাকে তো ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলেই দিল ছেলেগুলো, আর সাথে কি অকথ্য গালিগালাজ। মেয়েটার মুখটা চেপে ধরে সামনের মারুতি ভ্যানটায় তোলার চেষ্টা করছে, আর মেয়েটা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে ওদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে।
আতঙ্কিত ওই ভদ্রমহিলা ওই পথচলতি লোক দুটোকে ডাকামাত্রই ওরা পাশ কাটিয়ে চলে গেল। পাশ দিয়ে গাড়িগুলো যাবার সময় একটু আস্তে হচ্ছে, কিন্তু মুখ বাড়িয়ে একবার দেখেই আবার জোরে চালিয়ে দিচ্ছে।‘ ‘না, এবার আমাকেই কিছু করতেই হবে’ বলে গাড়ির দরজা খুলে বেরোতে যাওয়া মাত্র অহনা অসীমের হাতটা চেপে ধরে ‘এভাবে তুমি একা যেওনা। ওরা চারজন, তুমি একা কি করবে ? ভেবে দেখো, আমি আর আমাদের বাচ্চা তোমার সাথে রয়েছে। তুমি বরং পুলিশে খবর দাও।‘ অসীম চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কি বলছ তুমি? পুলিশ যতক্ষণে এসে পৌঁছবে, ওরা মেয়েটাকে তো ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।‘ অহনা আর কোনও কথা না বলে অসীমের হাতটা টেনে জোর করে বসিয়ে দেয় গাড়িতে। ইতিমধ্যে ওদের দেখতে পেয়ে ওই বয়স্কা মহিলা ওদের কাছে এগিয়ে এসেছেন, হাঁপাতে হাঁপাতে বলে ওঠেন ‘ট্যাক্সির জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাত ওই রাক্ষসগুলো মারুতি থেকে নেমে আমার মেয়েটাকে টেনে হিঁচড়ে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করতে থাকে। ওর বাবাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে – বাঁচাও, ওকে বাঁচাও তোমরা।‘ অসীম আবার গাড়ি থেকে বেরনোর চেষ্টা করে, কিন্তু তখনও ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে অহনা। এবার ভদ্রমহিলা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে অহনাকে জড়িয়ে ধরেন, ওনার সারা শরীরটা তখন ভয়ে কাঁপছে। অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন ‘ওই পশুগুলোর খিদে কখনো মিটবে না। আজ আমার মেয়েকে ওরা শিকার করেছে, এরপর ধরবে অন্য শিকার। যত সহজে পাবে শিকার, ততই ওরা আরও ক্ষুধার্ত ও হিংস্র হয়ে উঠবে। কাল তোমার বোন, বা পরশু তুমিও তো একা বেরোতে পার মা এই শহরের রাস্তায়?‘
অসীম এতক্ষণ রাগে ফুঁসছিল, এবার চিৎকার করে ওঠে ‘আমি ছাড়ব না ওই জানোয়ারগুলোকে’, এক ঝটকায় অহনার হাত ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে ছুটে যায় ওদের দিকে। মেয়েটাকে তখনও ওরা কাবু করতে পারেনি। অসীমকে এগোতে দেখে ছেলেগুলো আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। অকথ্য গালিগালাজের সাথে চিৎকার করে শুরু হয় শাসানো ‘এদিকে এলে শেষ করে দেব, রাস্তায় পুঁতে দেব, ল্যাম্প পোস্টে টাঙ্গিয়ে দেব’ ইত্যাদি। অসীম দৌড়ে গিয়ে প্রথমেই সজোরে এক ঘুষি চালিয়ে দেয় ওই ছেলেটার মুখে যে বেশী গালিগালাজ করছিল, তারপর এলোপাথাড়ি চালাতে থাকে ঘুষি, চড়, কিল, থাপ্পড়। ছেলেগুলো তখনও মেয়েটাকে কব্জা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু অসীমকে ক্রমাগত আক্রমণ করতে দেখে হিংস্র হয়ে ওঠে। শুরু হয়ে যায় ওদের পাল্টা আক্রমণ অসীমের ওপর। চারটে ষণ্ডা মার্কা গুণ্ডা একজন মানুষের ওপর চালাতে থাকে পাশবিক অত্যাচার – কখনো সজোরে পেটে লাথি, কখনো বা ঘুষি মেরে মুখ ফাটিয়ে দেওয়া, কখনো চুলের মুঠি ধরে মার ইত্যাদি। ততক্ষণে অসীমের চশমাটা ছিটকে গেছে অনেক দূরে, সারা মুখ ফেটে ঝরছে রক্ত – তবুও ওদের আক্রমণ অব্যাহত। আচমকা একটা ঘুষি এসে পরে অসীমের পেটে, সামলাতে না পেরে লুটিয়ে পরে রাস্তায়। এতক্ষণ অহনা বুবাইকে বুকে জড়িয়ে বসেছিল, কোনও বুদ্ধি কাজ করছিল না। অসীমকে এই ভাবে মার খেতে দেখে অহনা চিৎকার করতে থাকে ‘বাঁচাও, বাঁচাও – ওরা মেরে ফেলছে আমার বরকে।’ অহনাকে চেঁচাতে দেখে ওদের মধ্যে একজন বলে ওঠে ‘চুপ, আর একবার চেঁচালে তোকেও তুলে নেব আমাদের গাড়িতে। ভাল চাস তো চুপচাপ পালা এখান থেকে।‘
অসীমকে জখম হয়ে পরে যেতে দেখে ছেলেগুলো আবার মেয়েটাকে চ্যাংদোলা করে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করতে থাকে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে কোনোক্রমে আবার উঠে দাঁড়ায় অসীম, আর পেছন থেকে সজোরে দু’হাতে টিপে ধরে একজনের গলা। রাগে, প্রতিহিংসার জ্বলে ওঠে ওই নরখাদক গুলো। চেঁচিয়ে ওঠে ‘এতো সাহস তোর?’ ওই বেঁটে মত ছেলেটা পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে অসীমকে এক ধাক্কা মেরে বলে ‘দাঁড়া, তোর ডেথ সার্টিফিকেটটা এখনই লিখে দিচ্ছি।‘ আর্তনাদ করে ওঠে অহনা, গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে ছেলেটার পা’দুটো ধরে বলে ‘ভগবানের দোহাই, এবারের মত ক্ষমা করে দাও ভাই আমাদের। আমরা এখুনি এখান থেকে চলে যাব। আমি তোমাদের দিদির মত………।‘ পাশ থেকে অন্যজন বলে ওঠে ‘আরে মালটা তো ভালই দেখছি, এটাকেও তুলে নে।’ শোনামাত্র অসীম কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে কামড়ে ধরে ছেলেটার একটা পা। ‘ওরে বাবাগো, ছুঁচোটা আমার পা’টা খেয়ে ফেলল। দে চাকুটা ওর পেটে চালিয়ে’ বলে চিৎকার করে ওঠে ছেলেটা আর তখনই ওই বেঁটে ছেলেটা ছুড়িটা সজোরে ঢুকিয়ে দেয় অসীমের পেটে। ছটকে বেরিয়ে আসে রক্তের ধারা, মুহূর্তের মধ্যে যন্ত্রণায় লুটিয়ে পরে অসীমের দেহটা। চোখের সামনে অসীমের রক্তাক্ত দেহটাকে ছটফট করতে দেখে অচৈতন্য হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরে অহনা। ইতিমধ্যে ওরা মেয়েটাকে কাবু করে গাড়িতে ঢুকিয়ে ফেলেছিল, আর অহনার অচেতনতার সুযোগে ওকেও তুলে নেয় ওদের গাড়িতে আর সজোরে চালিয়ে দেয় গাড়িটা। মেয়েটির ওই মা ওদের পথ আগলানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ওই পশুর দল ওই বয়স্কা মানুষটিকেও রেহাই না দিয়ে চাকার তলায় পিষে দিয়ে পালিয়ে যায়।
ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টা বাদে যখন পুলিশ এসে পৌঁছায়, অসীমের দেহটা ততক্ষণে নিথর হয়ে গিয়েছিল আর ওই ভদ্রলোককে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়, যেখানে সপ্তাহ দুয়েকের লড়াইের পর হার মানতে বাধ্য হন তিনি।
রাত একটা বাজার পর থেকেই চিন্তায় আশাদেবীর মধ্যে আনচান শুরু গিয়েছিল। ফোনে যখন জানতে পারেন যে রাত সাড়ে এগারোটায় ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, চিন্তায় সবকিছু ওলটপালট হতে শুরু করে – কেনই বা অসীম, অহনা কেউই ফোন ধরছে না? মনে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পুরনো সেই দুর্ঘটনার স্মৃতিগুলো আবার যেন দাপিয়ে বেড়ানো শুরু করে দেয়। রাত দুটো নাগাদ বেলটা বেজে উঠতেই চমকে ওঠেন আশাদেবী, পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগোতে গিয়ে ঠিক করে নেন আজ খুব ধমকাতে হবে ওদেরকে ‘তোরা ভেবেছিসটা কি? একবারও কি মনে পরে না যে এই বুড়ো মানুষটার কি চিন্তাটাই না হতে পারে?’ দরজা খুলতে গিয়ে মনে বাইরে কারা যেন কথা বলছে, ছ্যাঁত করে ওঠে বুকের মধ্যে। আস্তে করে দরজাটা খোলা-মাত্র অবাক হয়ে যান আশাদেবী ‘একি! এতো পুলিশ কেন বাড়িতে? ওমা, বুবাইটা ওই পুলিশের কোলে চরে কেমন ছলছল চেখে চেয়ে আছে। কিন্তু অসীম আর অহনা কোথায়?’ বুবাইটা ঝাঁপিয়ে চলে আসে আশাদেবীর কোলে, কিন্তু চিন্তায় ওনার পা দুটো থরথরিয়ে কাঁপছে, মনে হচ্ছে এই বুঝি পড়ে যাবেন। কোনোমতে জিজ্ঞাসা করেন ‘কি হয়েছে? আপনারা এতো রাতে কেন? কি হয়েছে আমার অসীম আর অহনার?’ একটু থেমে একজন পুলিশ বলতে শুরু করে ‘আমরা অত্যন্ত দুঃখিত যে একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে কলকাতায়। এই মুহূর্তে আপনাকে এমন একটা নির্মম ঘটনা জানানোর ইচ্ছা না থাকলেও, নিরুপায় হয়ে বলতে হচ্ছে যে কিছুক্ষণ আগে আপনার ছেলেকে একদল গুণ্ডা নৃশংস ভাবে পিটিয়ে খুন করেছে, আর তারাই আপনার পুত্রবধূকে জবরদস্তি উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আমরা তল্লাশি চালাচ্ছি……………………।‘
না, আর কিছুই মনে করতে পারেন না আশাদেবী। শুধু মনে পড়ে যে এরপর ওনার ঘুম ভাঙ্গে বুবাইয়ের কান্নার শব্দে। চোখ খুলে দেখেন উনি বিছানায় শুয়ে, আর বুবাইটা ওনার বুকে মাথা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখেন অসংখ্য মানুষের ভিড়। পায়ের কাছে দাঁড়ানো পুলিশকে দেখেই মনে পড়ে যায় গতরাতের কথা। দুহাতে বুবাইকে জড়িয়ে চিৎকার করে ওঠেন ‘অ _ _ সী _ _ ম _ _, ব _ _ উ _ _ মা _ _ ।‘ মনে হচ্ছে মাথাটা বনবন করে ঘুরছে, ঠিক যেন এক প্রবল ভূমিকম্পে দুলছে দুনিয়াটা, ফেটে যাচ্ছে পায়ের তোলার জমি আর সেই প্রকাণ্ড এক ফাটলের মধ্যেই তলিয়ে যাচ্ছেন আশাদেবী। শুরু হয়ে যায় আলোর ঝলকানি, ক্যামেরার ক্লিক, ক্লিক শব্দ। মুখের সামনে কারা যেন এগিয়ে দেয় বেশ কয়েকটা মাইক আর শুরু হয় প্রশ্ন ‘আচ্ছা, আপনি কখন ঘটনাটা জানতে পারেন? আপনি তখন কি করছিলেন?’, ‘আপনার ছেলে-বউ কেন এতো রাতে বাড়ি ফিরছিলেন? ওঁরা কি প্রায়ই এমন দেরীতে বাড়ি ফিরতেন?’, ‘আচ্ছা, আগে কখনও আপনার ছেলে মারামারি করেছিলেন? উনি কি বদ মেজাজি ছিলেন?’
দুহাতে মুখটা চেপে ধরে কেঁদে ওঠেন আশাদেবী ‘সেবার এতো চেষ্টা করেও আমি পারিনি ওর বাবাকে ফিরিয়ে আনতে, আপনারা কি পারবেন ফিরিয়ে দিতে আমার অসীমকে?’ মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, তারপর আবার শুরু হয়ে যায় মিডিয়ার লোকগুলোর সেই এক আচরণ। ‘তোমার নাম কি? তোমার কি বাবা-মার কথা মনে পরছে?’, ‘মাসীমা, প্লিজ একবার অসীমবাবুর ছবিটার পাশে দাঁড়ান – এক মিনিটও লাগবে না আমার ছবি তুলতে।‘, ‘আচ্ছা, বিয়ের আগে আপনার ছেলে কখনও এমন ফালতু ঝামেলায় জড়িয়েছিল?’ ‘আপনার পুত্রবধূর একটা ছবি পেতে পারি?’ ‘না পারেন না’ বলে চিৎকার করে ওঠেন আশাদেবী। এদের এই অসহ্যকর আচরণ সইতে না পেরে হাতজোড় করে অনুরোধ করেন ‘পায়ে পড়ি আপনাদের, দয়া করে আমায় একটু একা থাকতে দিন। পাড়বেন না যখন আমার দুঃখ লাঘব করতে, তখন কেন বিব্রত করে চলেছেন? অসহায় মায়ের এই যন্ত্রণাক্লিষ্ট ছবিটা ছাড়া দেশে আর কি কোনও ছবি নেই পাঠকদের মন জয় করার জন্য, না সন্তানহীন মায়ের আর্তনাদ দেখানো ছাড়া আর কোনও অনুষ্ঠান করা যায় না দর্শকদের পৈশাচিক আনন্দ দেয়ার জন্য?’
কিছুটা নিবৃত্ত হয় ওই রিপোর্টারের দল। কয়েক মিনিটের স্তব্ধতা ভেঙ্গে বেজে ওঠে পুলিশের হাতের মোবাইল ফোন ‘হ্যাঁ স্যার বলুন,…………… কোথায় পাওয়া গেছে স্যার বডিটা – খালের ধারে?…………. কি মনে হয় – সুইসাইড না খুন ?……… ওহ, তার মানে ছেলেগুলো ভদ্রমহিলাকেও ছারে নি। আর ওই মেয়েটার কোনও খবর পাওয়া গেছে নাকি?’
এরপর থেকে কান্নাও বন্ধ হয়ে যায় আশাদেবীর। মনে পড়ে সেই কুড়ি বছর আগের কথা। হিসেবের নিরিখে সেদিনের সাথে আজকের একমাত্র তফাৎ অসীমের জায়গায় বুবাই, কিন্তু সময়ের নিরিখে ঘটে গেছে অনেক পরিবর্তন। আজ না আছে আশাদেবীর লড়াই করার শক্তি, না আছে সেই মানসিক দৃঢ়তা। তবু তাঁকে এই আঁধার হাতড়ে চলতে হবে পথ, প্রভাত আর আসবে কিনা জানা নেই। ঈশ্বরের কাছে আর চাওয়ার মত কিছুই অবশিষ্ট নেই, শুধু এইটুকু প্রার্থনা ‘দুঃখ দিয়েছ, ক্ষতি নাই, কেন গো একেলা ফেলে রাখ? ডেকে নিলে ছিল যারা কাছে, তুমি তবে কাছে কাছে থাকো।’