PART-1
এক শীতের দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে আমি আর দাদা দুজনেই ডাইনিং রুমে বসে আছি । দুদিন হল আমার সেমিস্টার শেষ হয়েছে তাই একটু চর্চা রাখার জন্য, আমি ইংলিশ অনার্সের ইউরোপিয়ান লিটারেচার খাতাটা নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিলাম আর দাদা আমার ঠিক উল্টোদিকে সিগারেট খেতে খেতে খবরের কাগজটা পড়ছিল।
ও হ্যাঁ আলাপটাই করাতে ভুলে গেছি,আমি হলাম…নামটা না হয় থাক পরে বলবো । আমার ব্যাপারে সেরকম ইন্টারেস্টিং কিছু নেই ওই বলতে গেলে থার্ড ইয়ার ইংলিশ অনার্স স্টুডেন্ট প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি কলকাতায় দাদার সাথে থাকি শ্যামবাজারে, দাদারই ভাড়া বাড়িতে ।
এবার আসি দাদার পরিচয় দাদা হল পেশায় প্রফেসর নাম প্রিয়তোষ বন্দ্যোপাধ্যায় ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি তে ফিজিক্সের প্রফেসর । লিটারেচারে অসম্ভব জ্ঞান , বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি কিন্তু এখন নাকি বিয়ে করে ওঠা হয়নি । ওর নাকি বক্তব্য বিয়ে , ভালোবাসা এগুলো নাকি ওর ক্যাটেগরির এলিমেন্ট নয় । ছোটবেলায় দু-একটা প্রেম করেছে বটে কিন্তু তা ঠিক টিকে ওঠেনি যতদূর জানি সম্ভবত শেষ প্রেমটা কলেজ লাইফের সেকেন্ড ইয়ার অব্দি করেছিল তারপর নাকি এমন মন ভেঙেছে যে প্রেম করে ওঠার সাহস হয়নি । ওর কথায় ” The more we go for a person at the conclusion we end at losing that person”. ওর এরকম অনেক বাণীই আমার শোনা । বলাই বাহুল্য যে একসময় প্রেমটা সে গভীর মনোযোগ দিয়েই করেছে ঠিক গোয়েন্দাগিরির মতন । ও হ্যাঁ বলাই হয়নি দাদা আবার পেশায় প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর । ছোটবেলা থেকে গোয়েন্দা গল্পের প্রতি ছিল এক অগাধ টান। শার্লক হোমস ,ফেলুদা ,ব্যোমকেশ সবই ছিল তার রপ্ত ঠিক যেমন পুরোহিতের পুজোর মন্ত্র । ওকে আবার পুরোহিতদের মতন পাঁচালী ঘাটতে হয়না , ঠিক যাকে বলা চলে ডিটেকটিভ স্টোরির উইকিপিডিয়া ইন হিউম্যান ভার্শন । এই কয়েক বছরে ঠিক হাতে গুনলে পাঁচ-ছটা কেস সলভ করে বেশ সুনাম কামিয়েছে বলতে হবে ।
দাদা সিগারেটের ছাই টা এস্ট্রেতে ফেলে হঠাৎ বলল, ‘কিরে আজকের খবরের কাগজে সিন্ডিকেট কান্ডটা পড়লি?’ আমি জবাব দিলাম, ‘না ,এই রাজনীতি ঠিক আমার হাতে ধরে না।’ দাদা আবার বলল, ‘চারিদিকে যা অবস্থা মানুষজন দিনদিন রাজনীতি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে , কিন্তু তোদের মতন যুবসমাজ যদি এগিয়ে না আসে তাহলে দেশটার ভবিষ্যৎ সামলাবে কে?’ আমি বেশ হতাশ হয়ে বললাম, ‘আমার কথা না হয় বাদ দিলাম আমার মতন অনেক কেউ আছে যাদের পলিটিক্সে ইন্টারেস্ট আছে ঠিকই কিন্তু বাড়ির লোক কি আর তাতে মত দেয়।’ ‘তা অবশ্য ঠিক বাবা-মার আইবা কেন চাইবেন যে তাদের সন্তানকে পলিটিক্সের ঝুট ঝামেলার মধ্যে পড়ুক । ওই কথায় আছেনা চ্যারিটি বিগিনস্ অ্যাট হোম্ কথাটাই হয়েছে কাল’ , বলল দাদা ।
এই কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ দেখি দরজায় কে কড়া নেড়েছে । এক, দুই, তিন, চার ….. পাঁচ নম্বর কড়াটা পরার আগেই দাদা দরজা খুলতেই দেখি এক মাঝ-বয়সি ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকে তাড়াতাড়ি করে দরজাটা বন্ধ করে হাঁফ ছাড়লেন। বয়স পঞ্চান্নের এর কাছাকাছি হবে চেহারা দেখেই অনুমান করা যায়, মাথার কয়েকটা চুল পাকা কিন্তু গোঁফটা এখনও পাকেনি । গায়ে সিল্কের পাঞ্জাবি, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, হাতে একটা বেশ দামি ঘড়ি । দেখে বেশ চিন্তিত মনে হলো, এই শীতেও ভদ্রলোকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে ।
এক গ্লাস জল খেয়ে বললেন ” ক্ষমা করবেন এরকমভাবে আসার জন্য আসলে ……।” তার আগেই দাদা বলে উঠলো ‘আপনি আগে বসুন তারপর আপনার সব কথা শুনব’ । আমি এর মধ্যে আর এক গ্লাস জল এনে ভদ্রলোককে দিলাম তিনি দু-চুমুকে জল টা শেষ করে গ্লাসটা টেবিলে রাখলেন ।
তার মধ্যেই দাদা হঠাৎ বলে উঠল, ‘আপনি মিস্টার ধনঞ্জয় সেন তাই না ? বারাসাত ব্লকের এমপি যিনি আগের বার ভোটে জিতেছেন । আপনারই তো ছেলে মোস্ট প্রবাবলি কি যেন নাম..ও হ্যাঁ রনজয় সেন আপনারই দলের হয়ে এবারে দাঁড়িয়েছিল যতদূর মনে পড়ে ।’ দাদার মুখে পরিচয়টা শুনে আমি এতক্ষণে ভদ্রলোককে চিনতে পারলাম আসলে পলিটিক্স এর সাথে আমার খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই তো , তাই যা হয় আর কি।
ধনঞ্জয় বাবু বললেন ‘হ্যাঁ আপনি ঠিকই বলেছেন মিস্টার ব্যানার্জি’ । বলেই পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরালেন, দাদা কেও অফার করলেন দাদা নিজের সিগারেট টা সদ্য শেষ করায় বলল, ‘না, আপনি বলুন।’ ভদ্রলোক আমাকে দেখে একটু ইতস্তত করছিলেন ।
দাদা বুঝতে পেরে বলল, ‘ও আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বলতে পারেন, আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।’
ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন, ‘ব্যাপারটা বড়ই গোপন মিস্টার ব্যানার্জি । আমারই এক বন্ধু পরিতোষ মল্লিকের মুখেই আপনার নাম শোনা , ওরই কোনো এক পারিবারিক কেসে আপনি নাকি ওনাকে খুব সাহায্য করেছেন । তাই বাধ্য হয়ে আপনার কাছে আসা । ব্যাপারটা এতটাই গোপন যে বাইরে মিডিয়ার কাছে খবরটা ছড়ালে আমার পলিটিকাল ইমেজ নিয়ে টানাটানি পরে যাবে তাই এরকম গোপনভাবে আসা।’
‘আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন মিস্টার সেন। প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটারের কাছে যখন এসেছেন তখন ব্যাপারটার গোপনীয়তা যে খুব বেশি তা আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি । আপনি বলতে থাকুন আমি দরকারি তথ্য নোট করে নিচ্ছি।’
ধনঞ্জয় বাবু বলতে শুরু করলেন, ‘ঠিক তিন মাস আগে আমার ছেলে রনজয় অত্যন্ত আশ্চর্যভাবে খুন হয় বলতে পারেন, সাস্পিশিয়াস মার্ডার খবরটা শুনেছেন নিশ্চয়ই?’
দাদা মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ শুনেছি ঠিকই কিন্তু তার তো এখনও কোনো হদিস মেলেনি যতদূর জানি।’
‘হ্যাঁ মিস্টার ব্যানার্জি আপনি ঠিকই শুনেছেন পুলিশ এবং গোয়েন্দা তদন্তও চালাচ্ছে অবশ্য তাদের সন্দেহের সাসপেক্ট আমি। লোকেরও সন্দেহ ঠিক একই, নাকি রাজনীতির রোষে আমি আমার ছেলের খুন করেছি । আপনি একটা জিনিস ভেবে দেখুন না যতই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকুক না কেন নিজের রক্ত বলে কথা খুন তো আর করতে পারিনা।’
‘কিন্তু ব্যাপারটা হল যে সে ঘটনা তো পুলিশ তদন্ত করছে আমার এখানে করার কি আছে’ দাদা প্রশ্ন করল ।
ধনঞ্জয় বাবু জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ পুলিশ সে ব্যাপারে তদন্ত চালাচ্ছে ঠিকই । কিন্তু আপনার কাছে সে ব্যাপারে সাহায্য চাইতে আসিনি মিস্টার ব্যানার্জি । আসার মূল যে উদ্দেশ্যে তা আমার ছোট মেয়ে রুপসা । গত সপ্তাহে সে খুন হয়েছে । পুলিশ তার তদন্ত চালাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার কোনো কিনারা পাচ্ছে না তাই বাধ্য হয়ে আপনার কাছে আসা।’
কথাটা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। দেখি দাদার মুখটাও কেমন গম্ভীর হয়ে গেল । বলতে বলতে ভদ্রলোক কেমন যেন ভেঙে পড়লেন এবং তার চোখটা ভারী হয়ে এলো হঠাৎ ।
তখনই দাদা বলে উঠলো, ‘আপনি নিজেকে সামলান মিস্টার সেন মেয়ে ও ছেলে হারানোর কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি । ইটস আ গ্রেট লস ফর ইউ।’
ধনঞ্জয় বাবু নিজেকে সামলে বলতে শুরু করলেন, ‘চোদ্দ বছর আগে স্ত্রী মারা যায়, ব্লাড ক্যান্সারে । স্ত্রীকে হারানোর দুঃখ টা অনেক কষ্টে কাটিয়ে ছিলাম। কিন্তু ঠিক এক সপ্তাহ আগে এক বুধবার রাতে মেয়েকে হারিয়ে ফেলি । ছোট মেয়ে টিউশন থেকে পড়ে ফিরছিল । সাধারণত ওকে রামুদা আনতে যায় , কিন্তু রামুদা সেদিন ওকে আনতে যেতে পারেনি কারণ ওর খুব শরীর খারাপ ছিল । আমিও সেদিন শহরের বাইরে ছিলাম একটা কাজে । রুপসা কে রামুদা বলে দিয়েছিল যেন সে সাবধানে একা ফিরে আসে আর সেটাই হলো সব থেকে বড় ভুল। সেদিন যখন ঠিক সন্ধ্যে আটটার সময় টিউশন থেকে পড়ে ফিরছিল তখন হয়েছিল লোডশেডিং এবং তখনই বাইরে থেকে এল এক চিৎকারের আওয়াজ । বাইরে বেরিয়ে এসে রামুদা দেখে রুপসা বাড়ির সামনে পড়ে আছে মাথার পেছন থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে আর মেয়ে মাটিতে পড়ে । রামুদা নাকের সামনে হাত রেখে বুঝতে পারে সে আর জীবিত নেই তারপরও চারিদিকে খোঁজার চেষ্টা করে কিন্তু কাউকে দেখতে পায়না । যা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে এমন কোনো বস্তু ও খুঁজে পায় না । আমি তখন সবে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে এসে বসেছি, রামুদা এসে কাঁদতে শুরু করে ততক্ষণে সবশেষ, আর কিছু আর করার নেই । ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বড় মেয়ে বাড়ি ফিরে এই খবর শুনে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি সারারাত কান্নাকাটি করে গেছে ছোট বোনের জন্য, এক ফোঁটাও নড়েনি তার কাছ থেকে। গত তিন মাসের মধ্যে ছেলে ও মেয়েকে হারিয়ে ফেললাম । কি আর রইল আমার বেঁচে থাকার জন্য ? এখন সম্বল বলতে শুধু আমার বড় মেয়ে ওর বিয়ে হয়ে গেলে আর কি নিয়ে থাকবো বলতে পারেন মিস্টার ব্যানার্জি?’
কিছু মুহূর্ত সবাই চুপ। ‘আপনাদের বাড়িতে কে কে থাকেন যদি একটু খুলে বলেন’ দাদার প্রশ্নে নীরবতা ভাঙলো ।
‘আমি আমার বড় মেয়ে ঋদ্ধিমা , রনজয়ের স্ত্রী পৌলোমী , ছোট মেয়ে রুপসা যে কদিন আগে পর্যন্তও ছিল আর কাজের লোক বলতে রামুদা আর রান্নার লোক মীরা।’
‘আচ্ছা আপনার বড় মেয়ে কি করে ?’
‘ঋদ্ধিমা পেশায় জার্নালিস্ট কলকাতা টিভিতে পলিটিকাল জার্নালিজম নিয়ে বেশ সুনাম করে ফেলেছে ইতিমধ্যে।
‘আর ছোট মেয়ে ?’
‘রূপসার এবার ক্লাস টেন দেওয়ার কথা ছিল । আমার ছোট মেয়ে একটু মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল , মাকে হারানোর পর ছোটবেলা থেকেই ওরকম হয়ে গিয়েছে, বুঝতেই পারছেন ছোট বয়সে মাকে হারানোর ধাক্কাটা ও ঠিক নিয়ে উঠতে পারেনি।
দাদা আবার প্রশ্ন করলো, ‘আর আপনাদের এই কাজের লোক গুলো?’
বাবু বললেন, ‘রামুদা আমাদের এখানে কাজ করছে বছর তিরিশ হলো । খুব বিশ্বস্ত প্রকৃতির এবং বলতে গেলে ওকে ঠিক আর কাজের লোক বলা চলে না আমাদেরই এক পরিবারের সদস্য বলতে পারেন । মীরা এখানে কাজ করছে হলো বছর পাঁচেক । রামুদার বয়স হয়ে যাওয়ায় ও আর সব দিক দেখে উঠতে পারে না তাই এই মীরার আবির্ভাব।’
‘কাজের লোকের উপর কোন সন্দেহ?’
‘না,রামুদা আর মীরা দুজনেই রুপসা কে নিজের থেকে বেশি ভালোবাসতো , ওদের উপর সন্দেহ করে লাভ নেই।’
‘আচ্ছা বাড়ির মধ্যে সবার সম্পর্ক ঠিক কেমন ছিল?’ দাদা জিজ্ঞেস করল।
ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘সারাদিন তো বাড়িতে থেকে ওঠা হয় না মিঃ ব্যানার্জি বুঝতেই পারছেন সেই সকালে বেরিয়ে যাই আর রাতে বাড়ি ফিরি । রামুদা রূপসার দেখাশুনা করত আর ঋদ্ধিমাও বেশি থাকত না। আর পৌলমী নিজের মতোই থাকে । কিন্তু একটা ব্যাপার যখন রনজয় বেঁচে ছিল তখন রনজয় আর ঋদ্ধিমার মধ্যে চলত এক প্রকার কোল্ড ওয়ার।’
দাদা হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘কোল্ড ওয়ার! ঠিক বুঝলাম না ব্যাপারটা।’ ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘রনজয় রাজনীতিতে যাওয়ার পর আর নিজেকে ঠিক পথে ধরে রাখতে পারেনি, মিঃ ব্যানার্জি । ড্রাগ ডিলিং, স্মাগলিং আরো অনেক দুনম্বরি কারবারের মাথা ছিল সে। বুঝতেই পারছেন ক্ষমতায় থাকলে যা হয় কেউ বলার নেই আর আমিই বা কোন মুখে বলব বলুন নিজের ইমেজটা যে নষ্ট হয়ে যাবে সমাজে তা কি আর আপনাকে বলতে লাগে । অনেকবার সাবধান করেছি কিন্তু কে কার কথা শোনে । কয়েকবার তো ঋদ্ধিমা ওকে বলেও ছিল ওর এই কারবার নাকি ফাঁস করে দেবে ওর চ্যানেলে কিন্তু রনজয় তো আর ধমক খেয়ে বসে থাকার ছেলে নয়, ও কম হুমকি দেয়নি ঋদ্ধিমাকে । কতবার শাসিয়েছে যে ওর ব্যাপারে নাক না গলাতে, নইলে ভালো হবে না । রনজয় এর মৃত্যু টা ছিল অনেকটা ওর নিয়তির লিখন।’
দাদা জিজ্ঞেস করল, ‘নিয়তির লিখন বলতে?’
‘ওর বিয়ে হয়েছে গত বছর । সংসারে তেমন মন ছিল না ওর । বন্ধুবান্ধব , রাজনীতি, ক্ষমতা নেশা ও দুনম্বরি কারোবারই ছিল ওর জীবন । ফলে সংসারে সব সময় অশান্তি । বৌমার সঙ্গে ছিল ওর সাপে-নেউলে সম্পর্ক, ঠিক যেমন হয় সংসারে মন না থাকায় । এর জন্যই শুরু হল সর্ম্পকে ভাঙ্গন । পৌলমীর গড়তে শুরু হল এক অবৈধ সম্পর্ক তার কলেজ জীবনের প্রাক্তন প্রেমিক ধৃতিমান গাঙ্গুলীর সাথে । এই খবর জানতে পারায় রনজয় গেল বেজায় চটে । সে ঠিক করল সেদিন রাতেই ধৃতিমানকে হুমকি দিয়ে আসবে । আর সেই রাতেই হলো তার পতন। টু বুলেট শর্টস, ওয়ান ইন চেস্ট এন্ড আনাদার ইন হেড । অনুমান কোন এক স্মাগলিং এর দ্বন্দ্বে পড়ে এই খুন ।
দাদা প্রশ্ন করল, ‘এ যে ধৃতিমানের কাজ নয় তা আপনারা এত নিশ্চিত কি করে?’
ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘যে রাতে সে হুমকি দিতে গিয়েছিল সেদিন ধৃতিমান শহরে ছিল না সে এক কাজের জন্য বাইরে গিয়েছিল।’
‘ও আইসি’ এবার দাদা একটা সিগারেট ধরালো ।
‘অসৎ পথে চললে তো তার ফল যে পেতেই হতো মিঃ ব্যানার্জি। অবশ্য এ ব্যাপারে পুলিশ এখনো সন্ধান চালাচ্ছে যে কারা এবং কেন খুন করেছে । আশা করা যায় খুব শীঘ্রই তারা সেই দলের সন্ধান পেয়ে যাবে কিন্তু আমার আপনার কাছে আসা রূপসার ব্যাপারে । সে ছিল বড় আদরের আর এই ব্যাপারটা এখনও বাইরে জানাজানি হয়নি মিস্টার ব্যানার্জি । পুলিশকে অলরেডি খবর দিয়েছি কিন্তু বলেছি খুব সাবধানে কাজ চালাতে । ওদের দিয়ে আর ভরসা পাইনা তাই আপনার কাছে আসা । আশা করি ফিরিয়ে দেবেন না।’
দাদা বলল, ‘আমি সমস্ত তথ্য নোট করে নিয়েছি । আজকের দিনটা একটু ভাবার সময় দিন, আমি আপনাকে কালকের মধ্যে টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি আর হ্যাঁ যদি কোনো দরকারি তথ্য দেওয়ার মনে হয় আমাকে অবশ্যই জানাবেন।’
দাদা যে সময়টা শুধুমাত্র নিজের দর বোঝানোর জন্য চাইলো তা আমার বুঝতে বেশিক্ষণ লাগলো না । ও যে কেসটা নেবে তা আমি জানি এমনিতেও খালি বসে আছে শীতের ছুটিতে । আর কেসটা নিলে আমারও ছুটি টা কাটবে ।
ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘তাহলে মিস্টার ব্যানার্জি আশাকরি টেলিগ্রামে মুখ ফিরিয়ে নেবেন না আপনিই এখন শেষ ভরসা।’
এই বলে চলে গেলেন মিস্টার ধনঞ্জয় সেন, যাওয়ার আগে একটা কার্ড দিয়ে গেলেন, তাতে ওনার নাম, ফোন নাম্বার লেখা ।
একটা সিগারেট জ্বালিয়ে দাদা বলতে শুরু করল, ‘কি বুঝলে অ্যাসিস্ট্যান্ট, এ যে বড়ই জটিল কেস পরিবারের মধ্যেই এত দ্বন্দ্ব তার ওপর রাজনীতির কালো ছায়া। শত্রুও তো কম নয় অনেক প্রশ্ন বাকি থেকে গেল বুঝলি।’
আমি অবাক হয়ে দাদাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তা তুই জিজ্ঞেস করলি না কেন?’
দাদা বলল, ‘মেয়ের মৃত্যুতে বড্ড দিশেহারা মানুষটা, একেবারে এত প্রশ্ন করলে নিতে পারবে না তাই বাকিটা পরের জন্য তুলে রাখলাম। খেয়াল করলি না এতকিছু মধ্যে বলতে গিয়ে মানুষটার আঙুলগুলো কেমন জড়িয়ে আসছিল । নিশ্চয়ই অ্যালজাইমার আছে । বাড়ি গিয়েই বরি নেবেন তাই তো বড্ড তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে গেলেন দেখলি না, তাইতো বললাম কাল সকালে বাকিটা টেলিগ্রামে জানিয়ে দেবো।’
আমি বললাম, ‘ও বাবা আমি তো ভাবলাম তুই তোর দর বাড়ানোর জন্য এ কথা বললি।’
দাদা বেশ ঢং করে বলল, ‘আহা সে তো আছেই কিন্তু এটাও ছিল আরেক কারণ, তোর চোখে তো আর এসব ধরা পড়ে না। ছোটবেলায় গল্প পড়ে শেখা যখনই কোন ক্লায়েন্ট আসে গোয়েন্দার কাছে, তার প্রথম কাজ হলো আগে ক্লায়েন্টকে ঠিকমত যাচাই করা।
‘তা তুই আর কি কি খেয়াল করলি শুনি?’
দাদা অল্প হেসে বলল, ‘লোকটা খুব দামি কিছু একটা আতর ব্যবহার করে মোস্ট প্রবাবলি বিদেশি কিন্তু আজ ব্যবহার করেননি, বাড়িতে খুব সম্ভবত কুকুর আছে এবং লোকটা প্রচুর লেখালেখিও করেন।’ আমি বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ও বাবা এত কিছু কি করে বুঝলি?’
দাদা আবার বলতে লাগল, ‘গন্ধটা যথেষ্ট কড়া, জামা কাপড় থেকে আসছিল কয়েকদিন আগের পাঞ্জাবি হবে হয়ত আর লেখালেখি করেন তা হাতের আঙ্গুলে কলমের বসে যাওয়া দাগ যা ফিঙ্গার টিপে খুব স্পষ্ট হালকা কালির ছাপও ছিল হাতে।
‘কিন্তু কুকুর?’ আমি বেশ কৌতূহলের সাথে প্রশ্ন করলাম ।
‘জুতোটা খেয়াল করিসনি হালকা আচরের দাগ এবং হ্যাঁ কোণার দিকটা খুব সামান্য কামড়ানোর চিহ্ন ছিল খুব রিসেন্ট হবে।’
দাদার এই অবজারভেশন পাওয়ার দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না । এতোকাল গল্পে শুনেছি এখন স্বয়ং চোখের সামনে দেখছি । কথা বলতে বলতে সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেছে চা-জল সেরে দাদা আমাকে বলল ‘তুই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়িস রাতে তাড়াতাড়ি । কালকে সকাল ন’টা নাগাদ বেরোচ্ছি । আমি একটু বাইরে থেকে আসছি কটা কাজ আছে ফিরতে দেরি হবে।’
যেমন বলা তেমন কাজ আমি ঠিক রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছি খেয়াল নেই দাদা কখন বাড়ি এসেছে । সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি দাদা একদম ফিটফাট হয়ে রেডি সারাদিন পরিশ্রমের জন্য । আমাকে বলল, ‘টোস্ট আর চা টা খেয়ে নে টেলিগ্রাম সকালবেলায় করে দিয়েছি । পৌঁছাতে ঘন্টা দুয়েক লাগবে বেশি দেরি করিস না ওনারা অপেক্ষা করবেন আমাদের জন্য ।
আমরা বেলা ১১ টা নাগাদ বারাসাত স্টেশনে এসে পৌঁছাই, নেমে দেখি ধনঞ্জয় বাবু আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। আগের দিনের চেয়ে আজ ভদ্রলোক কে অনেক কম বয়স লাগছে, নেভি ব্লু সোয়েটারের সাথে অফ হোয়াইট প্যান্ট,গলায় মাফলার। আমাদের দেখেই হেসে এগিয়ে এলেন । ওনার নিজস্ব এসি গাড়িতেই বাড়ি অব্দি পৌছালাম। স্টেশন থেকে আধ ঘন্টার পথ ।
বাড়ি টা যেমন ভেবেছিলাম তেমন ঠিক নয় । সাধারণ দোতলা বাড়ি দেখে বেশ পুরনো আমলের মনে হল, সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছোট বাগান মতো । গেটের গায়ে পাথরের ফলকে লেখা ‘সেন ভিলা’ । আমরা সোজা গেট দিয়ে ঢুকে একটা গেস্ট রুমে গিয়ে বসলাম । ঘরের কোণায় একটা বইয়ের তাক রাখা, সারিসারি বই ভর্তি তাতে এবং দেওয়ালে সব পুরনো দিনের ছবি, সেখানে এক ভদ্রমহিলার ছবি বড় করে বাঁধানো, সম্ভবত ধনঞ্জয় বাবুর স্ত্রীই হবেন । এই সবই লক্ষ্য করছিলাম হঠাৎ ধনঞ্জয় বাবু আমাদের প্রশ্ন করলেন, ‘চা না কফি।’
দাদা সেসব তোয়াক্কা না করেই বললো, ‘সেসব হবে পরে আমি আগে বাড়ির লোকের সাথে কথা বলতে চাই আর তার আগে আমি একটু ঘরগুলোঘুরে দেখতে চাই,যদি কারও অসুবিধা না থাকে ।
ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘অবশ্যই, আসুন।’ আমাকে বসতে বলে দাদা উপরে চলে গেল, ফিরে এল প্রায় আধঘন্টা পর মনে হয় সবকটা ঘর গিয়ে একবার করে দেখে নিলো প্রাইমারি এক্টিভিটিজ এর মধ্যে পড়ে এই সার্চিং ।
মিনিট দশ এর মধ্যেই দেখলাম বাকিরা গেস্ট রুমে এসে হাজির। দাদা সবাইকে বলল একে একে আসতে । প্রথম এলেন ধনঞ্জয় বাবুর বড় মেয়ে ঋদ্ধিমা সেন বয়স আঠাশ এর কাছাকাছি হবে, ছোট করে কাটা চুল, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা,শর্ট কুর্তি আর জিন্সে বেশ স্মার্ট। সুন্দর গঠন দেখে মনে হয় জার্নালিস্ট। না, সাধারণত এরা একটু রাফ অ্যান্ড টাফ হয় বলেই আমার ধারণা ছিল ।
দাদা প্রশ্ন শুরু করল, ‘আপনিই তাহলে ঋদ্ধিমা সেন।’
মৃদু গলায় উত্তর এলো, ‘হ্যাঁ’ ।
‘পেশায় জার্নালিস্ট, রাইট?’
‘হ্যাঁ বছর পাঁচেকে হল কলকাতা টিভিতে পলিটিক্যাল জার্নালিজমের আন্ডারে লিড রোলটা করছি’ ।
‘আপনার সাথে আপনার বোনের সম্পর্ক কেমন ছিল ?’
‘সম্পর্ক কেমন ছিল মানে? নিজের বোন বলে কথা ভালোই ছিল।’ বেশ মেজাজের সাথেই বললেন ।
দাদা একটু গম্ভীর গলায় বলল, ‘না দাদার সাথে সম্পর্কটা খুব একটা ভালো ছিল বলে আমার মনে হয় না।’
‘ঠিকই বলেছেন, বেটার টু সে আপনাকে ঠিক ইনফর্মেশন ই দেওয়া হয়েছে । ওর সাথে আমার খুব একটা ভাব ছিল না। ওর এই দুনম্বরি কারোবার এর ব্যাপারে তো আপনি সবটাই জানেন আশা করি । পার্সোনালি ওর এই কাজ আমার বা বাড়ির লোকের কারোরই ঠিক পছন্দ ছিল না এবং ওর এই খবর বাইরে প্রকাশ করে দেওয়ার ভয়ে আমাকে অনেকবার হুমকিও দিয়েছে । বাবার সাথেও ওর খুব একটা ভালো সম্পর্ক ছিল না কিন্তু এর সাথে তো আমার আর আমার বোনের সম্পর্কের কোনো প্রশ্নই হয় না । ও যথেষ্ট আদরের ছিল আমার কাছে। মা মারা যাবার পর ছোটবেলায় বেশিরভাগ সময়টাই আমার কাছে কাটিয়েছিল এখন আর বেশি সময় হতো না বলেই রামুদা ওর দেখাশুনা করত।’
‘ঘটনার দিন রাতে আপনি কোথায় ছিলেন’ প্রশ্ন করল দাদা ।
ঋদ্ধিমা সেন বললেন, ‘আমার সেদিন অফিসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তাই সেদিন আমার বেরোতে দেরি হয়েছিল এবং বাড়ি এসে শুনি এই কান্ড।
‘একটু মনে করে বলবেন অফিস থেকে সেদিন কটা নাগাদ বেরিয়েছিলেন?’ বেশ আশ্চর্য ভাবে জিজ্ঞেস করল দাদা ।
‘সেদিন কাজ সেরে আমার বেরোতে বেরোতে আটটা বেজে গেছিল তারপর বাস ধরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সাড়ে নটা।’
‘আপনি অফিসের গাড়ি ব্যবহার করেন না?’
‘হ্যাঁ করি, সেদিন গাড়ি ছিল না।’
‘আচ্ছা আপনার কি বাড়ির কারোর উপর কোন সন্দেহ?’
বেশ ভারী গলায় জবাব দিলেন, ‘না’ ।
দাদা বলল, ‘আচ্ছা আপনি এবার আসতে পারেন দরকার পড়লে আবার আপনাকে ডাকতে হতে পারে, কিছু যদি মনে হয় বলা দরকার আমাকে অবশ্যই জানাবেন।’
দাদা দেখি নিজের পকেট থেকে নোটবুকটা বের করে কি একটা লিখে তারপর আবার ঢুকিয়ে নিল । এরপরই ঘরে ঢুকলেন মীরা, পোশাক দেখে মনে হলো বাঙালি নয় । মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব ভীত হয়ে পড়েছেন। খুব জড়োসড়ো ভাবে ঘরে ঢুকে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘আমি কিছু জানি না । আমাকে ছেড়ে দিন সাব।’
সাধারণ কাজের লোক পরপর দুটো ঘটনায় পুলিশ ও গোয়েন্দা চক্করে পড়ে বেচারি বড় ভয় পেয়েছে।দাদা আশ্বস্ত করল, ‘আহা ভয় পাওয়ার কিছু নেই । আপনি শান্ত হয়ে বসুন সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দিন আপনার কোন ক্ষতি হবে না। আপনি আমার উপর ভরসা রাখতে পারেন।’
এটা শুনে উনি এবার অনেকটাই শান্ত হয়ে চেয়ারে বসলেন । ‘আপনি এখানে কত বছর হয়েছে কাজ করছেন?’ অত্যন্ত ধীর গলায় জবাব দিল ‘তা সাব বছর পাঁচ হবে।’
‘আচ্ছা রুপসা দিদির সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন ছিল।’
মীরাদি জবাব দিলেন, ‘দিদি খুব আদরের ছিল সাব । সব সময় হাসিখুশি থাকত আর খেলে বেড়াতো শুধু মাঝেমধ্যে একটু দিমাগের গড়বড় দেখা দিত কিন্তু তাও বেশিক্ষণ থাকতো না ঘুমালে দিদিমণি একদম ঠিক হয়ে যেত।’
‘আচ্ছা ঘটনার দিন রাতে তুমি কোথায় ছিলে?’
‘আমি রান্নাঘরে ছিলাম সাব, রুটি বানাচ্ছিলাম। হঠাৎ রামুদার গলার চিখ শুনে আমি ছুটে চলে আসি এসে দেখি এই কাণ্ড।’
‘আচ্ছা বড় দাদার মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু কি জানো?’
‘না, সাব সেদিন রাতে দাদা তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে পড়েছিলেন কিছু না খেয়েই । পৌলোমী দিদিমনির সাথে সেদিন অনেক ঝগড়া হয়েছিল তারপর সকালবেলা এই খবর আসে।’
দাদা প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা গত তিন মাসে তুমি কি অন্য রকম কিছু খেয়াল করেছো যেমন বাড়ির লোকের আচার-আচরণে অন্য কিছু?’
মীরাদি ঘাড় নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিল এবং বলল, ‘দাদা-সাব মারা যাওয়ার পর থেকেই এমনিতেই সবাই শান্ত হয়ে গেছে আর ছোট দিদি মনি মারা যাবার পর তো বাড়িতে আরও সান্নাটা ছেয়ে গেছে সাব।
দাদা মীরাদিকে বলল, ‘আচ্ছা তুমি এখন আসতে পারো আর কোনো ভয় নেই আর কোনো দরকার পড়লে আমাকে জানিও।’
দাদা দেখলাম এরপর রামুদা কে ডেকে নিল, বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে সমস্ত চুল পেকে গেছে দেখে মনে হয় একসময় বেশ তন্দুরস্ত ইনসান ছিল এখন বয়সের প্রকোপে পড়ে অনেকটাই শান্ত স্বভাবের হয়ে গেছে । রামুদা এসে চেয়ারে বসলো তারপর শুরু হল দাদার জেরা । ‘আচ্ছা আপনি এ বাড়িতে কতদিন হলো কাজ করছেন?
জবাব দিল ‘তা বাবু বছর তিরিশেক হবে, বড় দিদিমনি ঋদ্ধিমা হবার বছর দুয়েক আগে আমি এ বাড়িতে আসি।’
‘এ বাড়িতে সবার সাথে সবার সম্পর্কটা ঠিক কেমন একটু খুলে বলবেন?’
রামুদা অতিরিক্ত দুঃখিত গলায় জানায়, ‘খুব গোলমেলে বাবু । গিন্নি মা মারা যাওয়ার পর থেকে কেমন যেন সব ছন্নছাড়া হয়ে গেছে । আগের মতন আর কিছু নেই । প্রতিটা মানুষই কেমন নিজেদের মধ্যে কিছু না কিছু গোপন রাখার চেষ্টা করে।’
দাদা কথাটা শুনে বেশ অবাক হল এবং আবার জিজ্ঞেস করল,’গোপন বলতে?’
রামুদা বলেন, ‘সেরকম তো বেশি কিছু জানিনা বাবু কিন্তু মাঝেমধ্যেই বড় দাদা আর কর্তামশাই এর মধ্যে গোলমাল বাধত আবার বড় দিদিমনির সাথে বড় দাদার বেশ গোলমাল বাধত কিন্তু আবার এদিকে বড় দিদিমনির সাথে কর্তা মশাইয়ের বেশ ভালো ভাব ছিল। আমি তো বুঝে উঠতে পারতাম না মাঝেমধ্যে যে কার সাথে কার কি নিয়ে ঝামেলা চলছে।’
‘আচ্ছা আপনাদের এই পৌলোমী দিদির ব্যাপারে একটু খুলে বলুন তো।’
‘পৌলোমী দিদিমণি খুব অন্তর্মুখী কারো সাথে তেমন বেশি কথা বলে না, চরিত্র খুব একট ভালো নয় বুঝতেই পারছেন কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার ফলে যা হয়, তার ওপর দাদাবাবুর সাথে তেমন সম্পর্কও ভালো ছিল না, যতদূর জানি একটা অবৈধ সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েছিলেন কিন্তু দাদাবাবু মারা যাওয়ার পর আর তেমন সে ব্যাপারে কোনো কথাবার্তা শুনিনি।’
‘আচ্ছা রূপসার ব্যাপারে কোন আশ্চর্যজনক কিছু যা আগে খেয়াল করোনি এমন কি কিছু মনে পড়ে?’
রামুদা বলে, ‘এমনিতে তো মাথা ঠিক ছিল না বাবু কিন্তু বড় দাদাবাবু মারা যাওয়ার পর মাঝেমধ্যেই কি সব বিড়বিড় করে বলতো নিজের মধ্যেই যেমন “আমি জানি আমি জানি দাদাকে ওরা মেরে ফেলেছে ওরাই দাদা কে মেরেছে ওরা খুব বাজে লোক।” অনেকবার তাকে জিজ্ঞাসা ও করা হয়েছে কিন্তু তেমন পরিষ্কার করে কিছু বলতো না বেশ ভয়ে ভয়ে থাকত কর্তাবাবু তো তারপর অনেক ডাক্তারও দেখালে কিন্তু অবস্থা আরো বাজে হতে লাগলো সব সময় যেন কেমন আতঙ্কে থাকতো।’
‘ভেরি স্ট্রেনজ’ বলে দাদা বেশ কিছু ডাইরিতে লিখে নিল।তারপরই প্রশ্ন করল, ‘সন্দেহজনক কিছু কি খেয়াল করেছো তারপর আই মিন কিছু এমন অন্যরকম যা তোমার বেশ আশ্চর্যজনক মনে হয়েছে?’
‘এমন তো কিছু মনে পড়ছে না বাবু কিন্তু হ্যাঁ বড় দাদা বাবুর মৃত্যুর পর ঋদ্ধিমা দিদিমণি বেশ অন্যমনস্ক থাকতেন হয়তো বড় দাদাবাবুর মৃত্যুটা তিনি মেনে নিতে পারেননি । সম্পর্কটা ভালো না থাকলেও যতই হোক দাদা বলে কথা আর রুপসা দিদি মারা যাওয়ার পর অনুপ দাদা বাবুর বাড়িতে আসা যাওয়া টা বেশ বেড়েছে, আগে তাকে ঠিক চিনতাম না হঠাৎ তাঁর আবির্ভাবে তাকে চিনতে লাগলাম।’
ভারী আশ্চর্য হয়ে দাদা প্রশ্ন করে, ‘অনুপ বাবুটা কে?’
‘ঋদ্ধিমা দিদিমনির বন্ধু । খুব একটা বেশি তাকে চিনিনা প্রথম বড় দাদা বাবুর শেষকৃত্যের দিন দেখেছিলাম তারপর আর দেখিনি কিন্তু এই ছোট দিদিমনির শেষকৃত্যের পর থেকেই তাকে এবাড়িতে দেখি, বেশ ভাল বন্ধু হন ঋদ্ধিমা দিদিমনির । বড় শান্ত স্বভাবের মানুষ, বেশি কথা বলেন না কিন্তু তার এই আবির্ভাবটা বেশ আশ্চর্যের বিষয় আমিও ঠিক করে তাল করে উঠতে পারিনা।’
দাদা আবার বলল, ‘আর এমন কিছু যা তোমার চোখে পড়ার মতন?’ রামুদা অনেকক্ষণ ভেবে জানালো, ‘না বাবু তেমন তো কিছু মনে পড়ছে না।’
দাদা তাকে বলে ‘আচ্ছা, তুমি এবার আসতে পারো । দরকার পড়লে আবার ডেকে নেবো আর হ্যাঁ তোমাদের পৌলোমী দিদিমণিকে একটু ডেকে দিও তো বেশ কয়েকটা কথা বলার আছে।’
রামুদা ঘর থেকে চলে যাওয়ার পরই দাদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখেছিস বাড়ির এই লোকগুলো কত কাজের হয় এদের কাছে এমন সব খবর থাকে যা মনিবদের কাছেও থাকেনা।’
তারপরেই ঘরে ঢুকলেন পৌলোমী সেন , রনজয় সেনের স্ত্রী । বয়স খুব বেশি হলে ২৫ হবে।সাদা শাড়ির ওপরে একটা কালো চাদর জড়িয়েছেন । কেমন শুকনো মুখ, চুল গুলো উস্কখুস্ক। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এত কম বয়সে স্বামী হারিয়ে বেশ ভেঙে পড়েছেন। আমার দেখে বেশ করুণা হল, দাদা তাকে চেয়ারে বসতে বলে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা পৌলোমী দেবী আপনার স্বামীর আশ্চর্যজনক মৃত্যু সম্বন্ধে কিছু বলার আছে?’
পৌলমী দেবী খানিকটা রেগে গিয়ে বললেন, ‘ওটা আশ্চর্যজনক মৃত্যু ছিল না ওকে খুন করা হয়েছে ।
দাদা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘অবশেষে আপনার প্রাক্তন প্রেমিক খুনি বেরোল । এই আপনাদের প্রেমের নিদর্শন।’
পৌলোমী দেবী আবার খানিকটা রেগে গিয়ে বললেন, ‘ধৃতিমান খুনি নয়। ও যথেষ্ট ভদ্র প্রকৃতির মানুষ তাছাড়া খুনের রাতে ও এই শহরেও ছিলনা কাজের জন্য বাইরে গিয়েছিল।’
‘তা আপনি এতটা কি করে সিওর হচ্ছেন যে আপনার প্রেমিক এই খুন করেনি?’
‘আমি ওকে খুব ভালো করে চিনি ও এরকম কাজ করতেই পারে না । আমার যথেষ্ট বিশ্বাস আছে ওর উপর’ এক নিঃশ্বাসে বললেন পৌলোমী দেবী ।
‘যাই হোক..সেসব বাদ দিন রূপসার মৃত্যুর দিন আপনি কোথায় ছিলেন হঠাৎ প্রশ্ন করল দাদা?’
‘আমি নিজের ঘরে ছিলাম বই পড়ছিলাম রামুদার চিৎকারের আওয়াজ শুনে বাইরে আসি এসে দেখি এরকম ।
‘আচ্ছা এই ব্যাপারে আপনার কি কারো উপর কোন সন্দেহ হয়?’
বেশ শান্ত উদাসীন গলায় পৌলোমী দেবী জানালেন ‘না’ ।
‘আচ্ছা একটা প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন? ঋদ্ধিমার এই নতুন বন্ধু অনুপ গাঙ্গুলী হঠাৎ করে বাড়িতে এত বেশি আসা যাওয়ার কারণ?’ পৌলোমী দেবী বেশ অস্বস্তিকর গলায় জানালেন, ‘আমি কারো ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাটাতে যাই না বা কোনদিনও প্রশ্নও করিনা । কিন্তু যতদূর জানি রূপসার মৃত্যুর পরই ওদের সম্পর্কটা বেশ ভালো হয়। তার আগে রনজয়ের শ্রাদ্ধে এসেছিল ঠিকই কিন্তু তখন সে রকম পরিচয় হয়নি ওদের দুজনের । তারপর তো ঋদ্ধিমা অনেক খোঁজও করেছিল ওর ব্যাপারে কিন্তু কোনো সন্ধান পায়নি।
দাদা তারপর বলল, ‘ঠিক আছে এবার আপনি আসতে পারেন দরকার পড়লে আবার ডেকে নেব।’
দাদা হঠাৎ আমাকে বসতে বলে ধনঞ্জয় বাবুর সাথে আলাদা ভাবে কথা বলতে চলে গেল । এর মধ্যে রামুদা আমাদের জন্য চা আর নিমকি নিয়ে উপস্থিত । আমি বেশ কৌতুহল এর সাথে প্রশ্ন করলাম, ‘আপনাদের বাড়িতে কি কোন কুকুর আছে?’
রামুদা অবাক হয়ে হেসে জানাল, ‘একটা ছোট স্প্যানিয়াল আছে নাম ভুতু । কিন্তু আপনি কি করে বুঝলেন?’
আমি বললাম, ‘না এমনি প্রশ্ন করলাম, দাদা বলছিল মিস্টার সেনের নাকি কুকুর খুব পছন্দ তাই । তা ওকে তো দেখছি না।’
রামুদা বলল ‘হ্যাঁ এখন এখানে নেই । বাড়ির যা অবস্থা চলছে ওকে কেইবা সামলাবে বলুন পাশের বাড়ির মিস্টার দাসের বাড়িতে রেখে এসেছি। উনি আমাদের প্রতিবেশী হন, আপত্তি জানাননি তাই ওখানেই রাখা ওকে।’
আমি মনে মনে দাদার অবজারভেশন পাওয়ারের তারিফ না করে পারলাম না । আমি রামুদার সাথে বাগানে গেলাম বাগানটা দেখার জন্য । দেখি কত রকম গাছ তার মধ্যে বেশিরভাগই দেখলাম অজানা সব ফুলগাছ । এরমধ্যেই দেখি দাদার ডাক পড়েছে ।
মিস্টার সেন আমাদের গাড়ি করে স্টেশনে ছেড়ে দিলেন । সারা রাস্তায় যেতে যেতে দাদা দেখলাম একটাও কথা বলল না ।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেল । তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে দেখলাম দাদা বেরিয়ে গেল কিছু না বলে, ফিরল সেই নটার সময় । রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে আমার ঘরে ঢুকে বলল, ‘কি বুঝলি ঘটনা সম্পর্কে?’
‘সে না হয় বলছি কিন্তু তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলিস?’
‘আমি বেরিয়েছিলাম কয়েকটা তথ্য জোগাড় করতে । বেশ কয়েকটা তথ্য পেলাম রে বুঝলি, ভেরি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার গুলো।’
আমি বেশ কৌতূহল এর সাথে প্রশ্ন করলাম, ‘কি তথ্য জোগাড় করলি শুনি?’
দাদা বললো ‘আগে কটা প্রশ্নের উত্তর দে তো দেখি ঠিক করে।’
আমি বেশ থতমত খেয়ে বললাম ‘আচ্ছা বল দেখি।’
‘ফার্স্ট ঋদ্ধিমাকে ওর দাদা এতবার থ্রেট দেওয়ায় ও কি চুপচাপ বসেছিল?’
আমি বললাম, ‘বলাইবাহুল্য হয়তো পারিবারিক শান্তি বজায় রাখার জন্য চুপ করে গিয়েছিল।’
‘একটা জার্নালিস্ট কখনোই এরকম একটা ইন্টারেস্টিং খবর শুধু ধমক খেয়ে বা পরিবারিক শান্তির কথা ভেবে ছেড়ে দেবে না রহস্যটা কিছু অন্যই আছে।’ দাদা সিগারেট ধরালো ।
‘আমার একটা বিষয়ে বেশ খটকা লাগছে’ দাদার দিকে তাকিয়ে বললাম । ‘ব্যাপারটা হল যে এই নতুন ব্যক্তির আবির্ভাব, কি যেন নাম বেশ ও হ্যাঁ অনুপ রায়।’
‘খুব ভালো জায়গায় চোখ পড়েছে । তোর এই ব্যক্তিটির ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে আর এমন কি কিছু আছে যেটা তোর চোখে পড়ছে না?’ অনেকটা ভেবেও কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না । দাদা বলল, ‘ঠিক করে যদি ভেবে দেখিস তাহলে একটা খুব অবাক জিনিস চোখে পড়বে যেটা হলো রূপসার শেষ কয়েক মাসে মানসিক অবস্থার অবনতি তার উপর সেই কথা গুলো যেগুলো সে প্রায়ই বলতো।’
আমি অনেকক্ষণ ধরে ভেবে কিছু উদ্ধার করতে না পারায় দাদাকে প্রশ্ন করলাম, ‘তখন তুই ধনঞ্জয় বাবুর সাথে আলাদা করে কি কথা বলতে গেছিলিস?’
দাদা বললো, ‘তোকে তো বলতেই ভুলে গেছি আমি মিস্টার সেন কে ওই দুই ব্যক্তি অনুপ রায় আর ধৃতিমান গাঙ্গুলীকে আসার জন্য বলেছি। কয়েকটা প্রশ্ন মনের কোনে জমে আছে উত্তর গুলো না পেলে ঠিক অন্ধকারটা পরিষ্কার হচ্ছে না।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা তুই তখন নোটবুকে কি একটা বেশ লিখলি খেয়াল করলাম । কি লিখেছিস তখন?’
‘কিছু বেসিক ডিটেকটিভ নোটডাউন । ও তোমার বোঝার বাইরে আর হ্যাঁ কুকুরের কোন সন্ধান পেলে?’
‘তা আবার খোঁজ না নিলে হয় । ঠিকই ধরেছিলিস একটা স্প্যানিয়াল আছে । এখন পাশের বাড়িতে থাকে । তোর দৃষ্টিশক্তির তারিফ না করে পারছি না।’ বেশ কিছুক্ষণ ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলল । তারপর আমি চললাম ঘুমাতে ।
মাঝরাতে একটার সময় বাথরুমে গিয়েছিলাম, দেখি তখনও দাদা ঘুমায়নি অনেক রাত অব্দি তথ্য নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে মনে হয়। আমি আবার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম ।
সকালবেলা ঘুম ভাঙলো নটার সময় উঠে দেখি দাদা অলরেডি ঘুম থেকে উঠে চা আর খবরের কাগজটা নিয়ে বসেছে আমি এসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাল রাতে কখন ঘুমালি?’ অনেক রাত অব্দি দেখলাম ঘরের আলো জ্বলছিল।’
‘ঘুমাতে একটু রাত হয়ে গিয়েছিল বইটা নিয়ে একটু বসে ছিলাম।’
ও হ্যাঁ, বলা হয়নি দাদার এই বয়সেও গল্পের বই পড়ার অভ্যাস টা যায়নি সময় পেলেই এগুলো নিয়ে বসে বলে নাকি বই না পড়লে ওর মাথা খোলে না। ‘তা কিছু উদ্ধার করতে পারলি রাত জেগে?’
‘অনেক নতুন প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটেছে বুঝলি । প্রশ্নগুলোর সন্ধানে আজ দুপুর তিনটে নাগাদ একবার যাব মিস্টার সেনের বাড়ি, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিস।’
আমরা যথারীতি খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরলাম। মিস্টার সেনের বাড়ি পৌছালাম বিকেল পাঁচটা নাগাদ । এবারে আমরা নিজেরাই চিনে ওনাদের বাড়ি পৌঁছে গেলাম । কোন অসুবিধাই হল না । রামুদা দরজা খুলে আমাদের ভেতরে বসতে দিয়ে বলল, ‘আপনারা বসুন বড় কর্তা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছে । আমি আপনাদের জন্য চা এর ব্যবস্থা করছি’
বসে অপেক্ষা করতে করতে ধনঞ্জয় বাবু দশ মিনিটের মধ্যেই এসে উপস্থিত । সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পড়ে রয়েছেন, ভদ্রলোকের বোধ হয় শীত টা কমই ।
দাদা এবার নিজের মতো বলতে শুরু করল, ‘আচ্ছা মিস্টার সেন আপনাদের ওই দুই বিশেষ ব্যক্তি কবে আসবেন?’
ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘কাল আপনারা চলে যাওয়ার পরই টেলিগ্রাম করে দিয়েছিলাম ওদের । দুজনেই সামনে রবিবার আসছে । আজ দুপুরে টেলিগ্রাম এসেছে অনুপের । ধৃতিমানেরটা সকালেই এসে গিয়েছে। আমিই বলেছিলাম ওদের রবিবার আসার কথা কেউ আপত্তি জানায়নি।’ দাদা বলল, ‘তা খুব ভালো কথা। আজ বিশেষভাবে আসা আপনার সাথে দেখা করার জন্য কয়েকটা জিনিস জানার ছিল।’
ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘তা বেশ তো প্রশ্ন করুন যা আছে।’
‘আপনার ছোট মেয়ের অবস্থা তো গত তিন মাসে আরো খারাপ হচ্ছিল যবে থেকে আপনি ওকে নতুন ডাক্তার দেখিয়েছিলেন।’
‘হ্যাঁ ছোটবেলায় মা এবং এখন বড় দাদার মৃত্যু ও আর নিতে পারেনি । এমনিতেই তো জানতেন ওর মানসিক ভারসাম্য ঠিক নেই তার ওপর দাদার মৃত্যু ও নিজেকে সামলাতে পারেনি । নতুন ডাক্তার নতুন ওষুধ দিয়েছিল, বলেছিল কড়া ডোজের প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হবে তারপর ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ডাক্তারের কোন প্রেসক্রিপশন বা কিছু যদি থাকে একটু দিতে পারবেন?’ ধনঞ্জয় বাবু রামুদা কে জোর গলায় হাঁক দিয়ে বললেন রূপসার ঘর থেকে প্রেসক্রিপশনটা আনার জন্য । রামুদা দেখলাম মিনিট দুইয়ের মধ্যে প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে এলো এবং দাদা সেটাকে পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে আবার প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা আপনার এই সম্পত্তির উইল কি আপনি তৈরি করে ফেলেছেন?’
ধনঞ্জয়বাবু বললেন, ‘হ্যাঁ সেটা তৈরি, কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
দাদা পাল্টা প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা এই উইলের ব্যাপারে কে কে জানে?’
ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘না উইলটা আমি এখনো ডিসক্লোজ করিনি । জানি বলতে আমি আর আমার উকিল মিস্টার অধীর চৌধুরী।’
‘আচ্ছা আপনার কি বাইরের কারোর উপর কোন সন্দেহ আছে?’ দাদা প্রশ্ন করল।
‘বাইরে তেমন কারুর উপর কোনো সন্দেহ নেই।’
‘এই যে মিস্টার অনুপ রায় ব্যক্তিটির হঠাৎ এ বাড়িতে আসা যাওয়ার কারণ?’
ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘অনুপ ছিল রনজয়ের বন্ধু । প্রথম দেখেছিলাম রনজয়ের শ্রাদ্ধের দিন কিন্তু তারপর ওকে আর দেখিনি । ঋদ্ধিমা ওর অনেক খোঁজ করার চেষ্টা করে কিন্তু পাইনি । তারপর ওকে আবার দেখা রুপসা শ্রাদ্ধের দিন ঋদ্ধিমা তখনই ওর খোঁজ পায় তারপর থেকেই ওর এ বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু হয় ঋদ্ধিমার ভালো বন্ধু হিসেবে।
দাদা ফিসফিস করে নিজের মধ্যে বলল, ‘দ্যাটস্ ভেরি ইন্টারেস্টিং।’ ‘আচ্ছা মিস্টার সেন আপনি আসতে পারেন । একটু যদি ঋদ্ধিমাকে ডেকে দেন ভালো হয়।’
এই ফাঁকেই রামুদা চা আর গরম পকোড়া দিয়ে গেল । একটু পরেই ঋদ্ধিমা সেন ঘরে এল, মুখ দেখে মনে হচ্ছে একটু বিরক্ত । বসতে না বসতেই শুরু হয়ে গেল দাদার জেরা।
‘আচ্ছা আপনার এই অনুপ বাবুর সাথে কিভাবে পরিচয় হল যদি একটু জানান।’
ঋদ্ধিমা একটু রাগী রাগী মুখ করে বলেন, ‘আপনারা শেষমেষ ওকে সন্দেহ করছেন, ও একদম নির্দোষ, ওকে এর মধ্যে টানবেন না।’
‘আমি তো খুব সোজা একটা প্রশ্ন করেছি এর সাথে তো উনার সন্দেহ করার কোনো সম্পর্কই নেই।’
ঋদ্ধিমা বলে, ‘অনুপ কে প্রথম দেখেছিলাম দাদার শেষকৃত্যের দিন । প্রথমবার আলাপ করে বেশ ভালো লেগেছিল । খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ যথেষ্ট স্মার্ট এবং হ্যান্ডসাম কিন্তু দাদার শ্রাদ্ধের এত কাজ ছিল যে ওনার সাথে সেরকম ভাবে আলাপ করা হয়নি । মানে কোথায় থাকেন কি করেন এমনকি ওনার পুরো নামটাও জানা হয়নি । পরে অনেক চেষ্টা করেও কোনো খোঁজ পায়নি । তারপর যখন রূপসার শেষকৃত্যের কাজ হয় ওনাকে আবার দেখতে পাই । তারপর থেকেই ওনার সাথে এত ভালো পরিচয় এবং মেলামেশা।
দাদা হঠাৎ প্রশ্ন করল, ‘আর ইউ গাইস ইন লাভ?’
হঠাৎ ইংরেজিতে এরকম একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ায় আমি আর ঋদ্ধিমা দুজনেই থতমত খেয়ে গেলাম ।
ঋদ্ধিমা বেশ অস্বস্তিকর গলায় জানায় ‘দ্যাটস টোটালি মাই পার্সোনাল ম্যাটার। সেটা আমি বলতে বাধ্য নই।’
দাদা বলল, ‘আই অ্যাম সরি ঋদ্ধিমা, তোমার পার্সোনাল লাইফের ব্যাপারে আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই, আমার যা জানার জানা হয়ে গেছে।’
দাদা এরপর মিস্টার সেন কে বলল, ‘তাহলে আজ আসি মিস্টার সেন, আগামী রবিবার দেখা হবে।’
ধনঞ্জয় বাবু বললেন, ‘ঘটনার কোন হদিস মেলেনি মিস্টার ব্যানার্জি?’
দাদা হাসল, ‘প্রায় কিনারায় দাঁড়িয়ে মিস্টার সেন। রবিবার ওই দুই ব্যক্তির সাথে কথা না বলে আমি কিছু সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না । আশাকরি সেদিনই সব উদ্ধার করতে পারব । আসি এখন।’ এই বলে দাদা আর আমি চলে এলাম।
রাস্তায় আমি খেয়াল করলাম দাদার ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি । আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলাম, ‘কিরে হাসছিস কেন?’ দাদা বলল, ‘এখনো কিছু ধরতে পারিস নি?’
আমি বোকার মতো বললাম, ‘না আমিতো কিছুই ধরতে পারছিনা । উল্টে কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে।’ ‘সব বুঝে যাবি খুব শীঘ্রই রবিবারটা আসতে দে শুধু। তার আগে আমার কয়েকটা খোঁজ নিতে হবে । এবার শুধু হিসাব মেলানোর পালা।’ সারা রাস্তা আর এই বিষয়ে কোন কথা হল নাৎ। একটা কি গল্প করতে করতে বাড়ি চলে এলাম আমরা ।
~ অন্তর্ঘাতী কে? ~