কালীপদবাবুর ছিল খুব গানের সখ । গানের গলাটি ভালো । গাইতেনও ভালো । ব্যাস ওই পর্যন্ত । মুদির দোকান সামলাবেন না গলা সাধবেন । খুব ভোরে উঠে রেওয়াজ করতেন । এতে বিরক্ত হত পাড়া পড়শিরা । তাদের ঘুম যেত চোটে । এমনিতেই গরমে রাতের দিকে ঘুম হয় না । ঘুমটা আসে ভোরের দিকে । আর তখনি গলা ফাটিয়ে চিৎকার । পারা যায় না । এ কি এক দিন দু দিনের ব্যাপার ? বারোমাস এই এক উপদ্রব। এর একটা বিহিত করতেই হবে। সাধের ঘুম চটে যাওয়ায় বিরক্তি প্রকাশ করলেন গৌড়কিশোরবাবু। মেজাজটা গেল সপ্তমে চড়ে। হাতের কাছে কাউকে না পেয়ে মেজাজ আছড়ে পড়লো গিন্নির ওপর ।
চা কী পাবো , না চা নাখেয়েই বাজারে ছুটতে হবে ?
বলি ক’টা বাজে ? মশারির ভেতর থেকে মুখ ঝামটা দিয়ে উঠলেন গিন্নি ।
পৌনে ছ ‘টা বাজে ।
তোমার বাজার এত সকালে বসেছে? বলি, অন্যের ওপর রাগ আমাকে দেখিয়ে লাভ কী ? যাও না , এর একটা বিহিত করে দেখাও তাহলে বুঝি তোমার কত মুরোদ ।
দেখিয়ে ছাড়বো। কালী মুদিকে আমি দেখিয়ে ছাড়বো । ও জানে না । রেগে গেলে আমি বাপের কু-পুততুর। ওর হারমোনিয়াম আমি না ভেঙেছি তো আমার নামে কুকুর পুষবে। রাগে গড়গড় করতে লাগলেন ।
গৌড়কিশোরবাবু থাকেন কালীপদবাবুর ঠিক পাশের বাড়িতে। সব চেয়ে বেশি ভোগান্তি তার। তিতি বিরক্ত হয়ে চললেন বাজারে ।
বেলতলায় মধুর চায়ের দোকান । রাত দিন তো ওখানে আড্ডা মারে পাড়ার ছেলে ছোকরাগুলো । ওদের দিয়েই ঢিট করতে হবে কালীপদ মুদিকে । এটাই তার মনের ইচ্ছা ।
সামনে মে মাস । রবীন্দ্র জয়ন্তী । পাড়ার ছেলেদের লিডার ঘনা। সে দিন বাজার থেকে ফেরার সময় ডাকলেন ঘনা কে ।
বললেন , কেমন আছ, ঘনা ?
আমাদের আর থাকা ! ওই চলে যাচ্ছে । তা আপনি বাজার নিয়ে আসছেন ? পুলু কোথায় ?
ওর আবার কালকে একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে । তার জন্য একটু প্রেপারেশন নিচ্ছে । যে কথা বলছিলাম , এবার পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে না ?
রবীন্দ্র জয়ন্তীর নাম শুনলেই ঘনার জিব এক হাত বেরিয়ে আসে । কুঁতকুঁতে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে ওঠে । মণিদীপার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে । এই তো একটা মাত্র দিন । মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঘনা একটা লাল পাঞ্জাবি আর সাদা চুড়িদার পড়ে । রোগা হাড়গিলে চেহারা ।একের পর এক শিল্পীরা মঞ্চে উঠছে , রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে তারপর নেমে যাচ্ছে । কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঁচু মঞ্চে উঠতে মহিলা শিল্পীদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে ঘনা । স্বাস্থবতী যুবতীদের হাতের চাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত । নীল শিরা বের করা হাত যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে না গেলেও মচকে যেতে পারে । তবুও ও ভয়ে কম্পিত নয় ঘনার হৃদয় । এত কষ্ট সহ্য করে কি এমনি এমনি ? শুধু মাত্র মণিদীপার জন্য । আর এমন এক বগ্গা মেয়ে কিছুতেই ঘনার হাত ধরবে না । গত বছর তো তবলচি ছেলেটাকে বলল , বরুন দা , হাত টা একটু ধরুন না । সিঁড়িটা খুব নড়বড়ে । ওগো দীপা , তুমি কেন বুঝতে পার না সিঁড়িটাকে নড়বড়ে আমি করে রাখি শুধু তোমার হাত টা ছোঁয়ার জন্য । কত দিনের সখ তোমার নরম হাতটা আমার হাতের মুঠোর মধ্যে একটু নিয়ে জীবন সার্থক করি ।
কী হলো ? কী ভাবছো ?
গৌড় কিশোর বাবুর প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পায় ঘনা । লজ্বা পেয়ে বলে , কৈ , কিছু নাতো ।হ্যা , রবীন্দ্রজয়ন্তীতো হবেই । আপনি তো জানেন মেসোমসাই , ওই একটা ফানসান ই তো করি আমরা । এবার কিন্তু চাঁদা একটু বেশি দিতে হবে ।
কেন , বেশি কেন ?
বাহ রে ! এবার পঁচিশ বছর না ?
কার? রবীন্দ্রনাথের জন্মের ?
কী যে বলেন আপনি । আমাদের ক্লাবের । আমরা ঠিক করেছি এ বারের পোগ্গাম টা হেবি করতে হবে । দলের সিদ্ধান্ত ।
মনে মনে বললেন , সে আর জানবো না । তোমাদের দলটাকে তো আমি হাড়েহাড়ে চিনি । এত বছর বয়স হয়ে গেল এখনো ফাংশন কথাটা বলতে শিখলে না । শিক্ষার কি বাহার ! মেসোমশাইকে মেসোমসাই , ফাংশানকে ফানসান । প্রোগ্রাম কে পোগ্গাম । আরো কত শুনবো । যা পারিস কর গিয়ে । কালীমুদির হারমোনিয়াম না ভাঙা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না ।
কালীপদ বাবু মানুষ ভালো । সাথে পাছে নেই । আর থাকবেনই বা কী ভাবে ? সকাল থেকে দুপুর দুটো আবার বিকেল পাঁচটা থেকে রাত দশটা , দোকান সামলাতেই ব্যস্ত । মাঝে তিন ঘন্টার স্নান , খাওয়া , বিশ্রাম । রাত দশটায় দোকান বন্ধ হলেও হিসাব মেলাতে মেলাতে রাত এগারটা সাড়ে এগারটা বেজে যায় । এরপর রাতের খাওয়া । শোবার আগে আর একবার স্নান । শীত গ্রীষ্ম বারোমাসই রাত্রে শোবার আগে স্নান করা অভ্যাস । সময় একদম রুটিনে বাঁধা । বৃহস্পতিবার দোকান বন্ধ । সাপ্তাহিক ছুটি । কালীপদবাবুর না । ননী আর ছক্কুর । দোকানে কাজ করে । ননীটা ভালো কিন্তু ছক্কু একনম্বর শয়তান । খালি কামচুরি । ঠেলে ঠেলে কাজ করাতে হয় । বৃহস্পতিবার কালীবাবু যান পাইকারি বাজারে । ফর্দ মিলিয়ে সপ্তাহের মাল কিনে আনেন । তবে বেশির ভাগ মালই দিয়ে যায় বিভিন্ন কম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরের ছেলেরা । রোববার রোববার আবার তাদের পেমেন্ট থাকে । এত কাজের মাঝে গলা সাধবেন কখন ? নেহাত গান ভালোবাসেন । চর্চা না করলে গলা বসে যাবে । প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে আধঘন্টা তানগুলো একটু ঝালিয়ে নেওয়া ।
কালীবাবুর বাবাও ভালো গান করতেন । অবশ্য ভাটিয়ালী । জন্ম সূত্রে জেলে । বাবা , ঠাকুরদা , ঠাকুরদার বাবা সবাই গঙ্গায় জাল ফেলে মাছ ধরতো । নিজেদের ডিঙি নৌকো । খেপলা জাল ফেলে বসে থাকতো চুপ করে । তারপর আস্তে আস্তে জাল গুটিয়ে তুলতো নৌকায় । সব মাছ কিনে নিত আড়ৎদার । ছোটোবেলায় ঠাকুরদার সাথে , পরে বাবার সাথে নৌকোয় থাকতো কালীপদ । হাল ধরে রাখতো শক্ত করে । মাঝে মাঝে স্নানের ঘাটের থেকে একটু দূরে নৌকাটাকে নোঙর করতো বাবা । ছিপ ফেলে মাছ ধরতো ।কালীপদও ধরতো। ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে খুব মজা । কিন্তু বাবা বকা লাগাতো। স্কুলে যেতে হবে। স্কুলে যেত বটে, পড়ায় মন বসত না কিছুতেই ।
পড়া হলো না । ওদিকে মাছের ব্যবসাও মন্দার দিকে । কালীপদর বাবার শরীর আর দেয় না । মারণ রোগে ধরলো তাকে । জলের মত টাকা বেরিয়ে গেল । বাঁচানো গেল না । বাড়িতেই বারান্দায় দোকান খুলে বসলো কালীপদবাবুর মা । স্কুল ছেড়ে দিল কালীপদ । মার সাথে থেকে থেকে শিখে নিল সব । দোকানে যখন খরিদ্দার থাকতো না গলা ছেড়ে গান গাইতো সে । ভারী মিষ্টি গানের গলা । বাবার মত গাইতো ভাটিয়ালি সঙ্গীত । সবই বাবার থেকে শেখা । কালীপদর মায়ের বাপের বাড়ি পাশের পাড়াতে । মামা বাড়ির জানা শোনা একজন গানের দিদিমনি ছিলেন । মামারাই দিদিমনির গানের স্কুলে ভর্তি করে দিল কালীপদকে । বড়মামা কিনে দিয়ে ছিল হারমোনিয়াম । সে কি আজকের কথা । কত বছর হয়ে গেল । কালীপদর বিয়ে হয়েছে । মেয়ে স্কুলে পড়ে । ছেলে কলেজে । মা মারা গেছে তাও অনেক বছর হয়ে গেল । বড় রাস্তার ধারে ফ্ল্যাট বাড়ির নিচে একটা দোকান ঘর কিনেছে । দোকান ঘর কেনা কে কেন্দ্র করে কম ঝামেলা পোহাতে হয় নি । সব কিছু সামলেছে একা হাতে । হাজার সমস্যার মধ্যেও সকালে আধ ঘন্টা হারমোনিয়াম নিয়ে বসতে ভুল হয় নি । ছোট বেলায় যে সব প্রতিবেশীরা তার গান শুনতে ভিড় জমাতো আজ তারাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ভোরবেলায় তার রেওয়াজ করার জন্য । মিথ্যে কথা বলবে না । সবাই না । হয়তো দু-চারজন আছে । তবে সবচেয়ে বেশি পাশের বাড়ির গৌরকিশোরবাবু । প্রথম দিকে সেটা বুঝতে পারেন নি কালীপদবাবু । পরের দিকে যখন চিৎকার করে তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন তখনই বুঝতে পারলেন । ভেবে ছিলেন গান করা বন্ধ করে দেবেন । কিন্তু মায়ের কথা মনে পড়লেই বুকটা চিন চিন করে ওঠে কালীপদর । মারা যাওয়ার আগে তাকে তার মা বলেছিল , গানটা তুই ছাড়িস না , কালী । তোর গানের গলা একদম তোর বাবার মত । তোর গান শুনলে মনে হয় যেন তার গান শুনছি । তোর গানের মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকুক তোর বাবা । মা কে কথা দিয়েছেন কালীপদ । সে কথা ভুলে যায় কী করে ? প্রতিবেশীদের অসুবিধা হয় বুঝেও গলা সাধেন । ওদিকে আবার পিকলুর ঠাকুমা , রন্টির বিধবা পিসি দোকানে জিনিস কিনতে এলেই বলবে , তুমি এত ভালো গান কর যে সকাল বেলায় তোমার গান শুনলে মনটা ভরে যায় । তোমার বাবাও এরকম গাইতেন ।
দলবল নিয়ে রবীন্দ্র জয়ন্তীর চাঁদা নিয়ে গেল ঘনা । এবারে পঞ্চাশ টাকা বেশি দিলেন গৌড়কিশোরবাবু । ইচ্ছা ছিল না তবু দিলেন । দিলেন কী আর সাধ করে ? চোখের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই হারমোনিয়াম । কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে কালীপদবাবুর গলা সাধা। প্রতিদিন সকালে ঘুমের চৌপট । হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বেন না । তার ওপর গিন্নিকে কথা দিয়েছেন কালীপদবাবুর গলা সাধা বন্ধ করতে না পারলে তার নামে কুকুর পুষবে । এতো ইজ্জ্ত কা সওয়াল । ঘঁনাকে বললেন ,
শোনো ঘনা , তোমাকে একটা কাজ করতে হবে ।
বলুন মেসোমসাই ।
কালীপদ মুদিকে দিয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীত গাওয়াতে হবে ।
সে আর এমন কথা কি ?
কথা হচ্ছে , ও গান গাইবে ওর নিজের হারমোনিয়াম বাজিয়ে ।
কেন , আমরাতো রানাদের বাড়ি থেকে প্রতি বছর তবলা , হারমোনিয়াম সব নিয়ে আসি ।
সে আনো । কিন্তু সে হারমোনিয়াম কালী মুদিকে দেওয়া যাবে না । ওকে ওর হারমোনিয়াম নিয়ে আসতে হবে ।
সে না হয় বলবো । কিন্তু কেন যদি বলেন ?
ঠিক আছে , এই নাও আরও পঞ্চাশ টাকা । কথার যেন নড়চড় না হয় ।
কথা দিচ্ছি । যেমন বললেন ঠিক তেমনটি হবে । ঘনা দলবল নিয়ে চলে যেতেই মনের আনন্দে গৌড়কিশোরবাবু ডাকলেন স্ত্রীকে । বললেন :
শুনেছ তো সব । এবার দেখ কী করি । বেটার বহুত বার বেড়েছে । ওর গলা সাধা আমি দেখাচ্ছি । জীবনের মত আর গান গাইতে হবে না ।
গিন্নি বলল , তোমার বুদ্ধির বলিহারি । ঘনাকে বলে দিলে । এবার কালীবাবুর হারমোনিয়াম অনুষ্ঠানের দিন খারাপ হলে বা অন্য কিছু হলে সবাইতো জেনেই যাবে কাজটা কে করেছে । সেটা কী ভালো হবে ? ওই ঘনাইতো সবাইকে বলে দেবে । পাড়ায় আর মুখ দেখতে পারবো ?
খুব পারবে । দু-দিন বাদে সব শান্ত হয়ে যাবে । তখন দেখবে শান্তিতে ঘুমাতে পারছো । কালী মুদির উপদ্রব আর থাকবে না । বাঁচা যাবে । তুমি তখন বলবে বেশ একটা বুদ্ধি বের করে ছিলেতো ।
পঁচিশে বৈশাখ সকাল থেকেই বৃষ্টি । তার মধ্যেই চলতে লাগলো প্যান্ডেল তৈরির কাজ । ভাগ্য ভালো । দুপুরের পরেই বৃষ্টি গেল থেমে । ছেলেরা কোমর বেঁধে নেমে পড়লো মাঠে । ড্রেন কেটে বের করে দিল সব জমা জল । কোথা থেকে বস্তা বস্তা বালি এনে ঢেলে দিল নিচু জয়গাগুলোতে । কিন্তু কাদা তো রয়েই গেল । ছুটলো প্রাইমারি স্কুলের হেডস্যারের বাড়ি । তার হাতে পায়ে ধরে মত করালো স্কুল থেকে বেঞ্চ আনার । তারপর স্কুল থেকে বেঞ্চ এনে পরপর পেতে দিল মাঠে । কথা একটাই অনুষ্ঠানের শেষে সমস্ত বেঞ্চ আবার রেখে আসতে হবে স্কুলে । দুর্যোগের কারনে অনুষ্ঠান শুরু হলো নির্দিষ্ট সময় থেকে এক ঘন্টা পরে ।
দলের মধ্যে একমাত্র হারান একটু পড়াশুনো জানে । হারান অবশ্য দলের কেউ না । দলের মধ্যে সবচেয়ে মারকুটে বল্টুর ভাই হলো হারান । কলেজে পড়ে। কথা বলে খুব সুন্দর গুছিয়ে । স্বাভাবিক কারণেই এঙ্কারিংয়ের দায়িত্ব তার ওপর । প্রথমেই সভাপতির ভাষণ । তারপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করবেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তিমির বরন অধিকারী । উদ্বোধনী সঙ্গীত । পরিবেশন করবেন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ,পাড়ার গৌরব , সকলের অত্যন্ত প্রিয় শ্রী কালীপদ মাঝি । মঞ্চের বা দিকে মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে হারান ঘোষণা করছে , ভলেন্টিয়ার্সগণ , কালীপদবাবু নিজের হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইবেন । উনার হারমোনিয়ামটা মঞ্চে নিয়ে আসা হোক ।
নিয়ে আসা হল হারমোনিয়াম । বসলেন গান গাইতে । সকলকে নমস্কার করে গান গাইতে যাবেন । দেখেন হারমোনিয়াম এর ব্লোয়ারটা কে বা কারা ব্লেড দিয়ে কেটে রেখেছে । বুঝতে পারলেন কাজটা ইচ্ছাকৃত । যাতে তিনি গাইতে না পারেন সেই জন্য ব্লোয়ারটা কেটে দিয়েছে । মানুষ এত নিচে নামতে পারে ? চোখ ফেটে জল এসে গেল তার । সামলে নিলেন নিজেকে । হাতজোড় করে বললেন , আমাকে মার্জনা করবেন আপনারা । আমার শরীরটা ভালো লাগছে না । অসুস্থ বোধ করছি । আমি গাইতে পারবো না ।
ক্লাবের সভাপতি নামকরা ডাক্তার । কিছু একটা সন্দেহ হওয়াতে ছুটে গেলেন গ্রীনরুমে । হাতের ইশারায় হারানকে ডেকে বললেন পর্দা ফেলতে । পর্দা পড়তেই শুরু হল শোরগোল । হারানকে বললেন মাইকে ঘোষণা করে দাও ঠিক পাঁচ মিনিট পরে অনুষ্ঠান শুরু হবে । হারান সেই রকমই ঘোষণা করতে লাগলো । ডাক্তার দু মিনিট কালীবাবুর সাথে কথা বলেই বুঝে গেলেন সমস্যাটা শরীরের নয় । মনের । কারণটাও জানতে পারলেন । হাতজোড় করে কালীবাবুকে অনুরোধ করলেন গান গাওয়ার জন্য । হারানকে বললেন মঞ্চে অন্য হারমোনিয়াম নিয়ে আসতে । ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পর্দা উঠে গেল । শুরু হল উদ্বোধনী সঙ্গীত । গান শেষ হলে করতালিতে মুখরিত দর্শকগন ।
উইংসের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্লাবের সভাপতি কাম ডাক্তার প্রদ্যুম্ন বাগচী । মাইক্রোফোন হাতে এসে দাঁড়ালেন মঞ্চে । আবেগে জড়িয়ে ধরলেন কালীপদবাবুকে । তারপর উপস্থিত দর্শকদের উদ্দেশ্যে বললেন , অনুষ্ঠানের পরবর্তী পর্যায়ে যাওয়ার আগে আপনাদের দুটো কথা বলতে চাই । দয়া করে শুনবেন । কে বা কারা আমি জানি না যদিও পরে জেনে যাবো , কালীপদবাবুর হারমোনিয়ামের ব্লোয়ারটা ব্লেড দিয়ে কেটে দিয়েছে । অনুমান করতে অসুবিধা হয় না সেই ব্যক্তি বা তাদের উদ্দেশ্য ছিল যাতে কালীবাবু গান গাইতে না পারেন । ভাবুন , কী গভীর চক্রান্ত । শিল্পীর কন্ঠরোধ করার কী নোংরা মানসিকতা । এভাবে কি শিল্পীকে দমানো যায় ? যিনি বা যারাই করে থাকুন না কেন তাদের উদেশ্যে আমি সবার সামনে বলছি এই জঘন্য মানসিকতা পরিত্যাগ করুন । শিল্পীকে সম্মান করতে না পারুন তাকে অসম্মান করার অধিকার আপনাকে বা আপনাদের কেউ দেয় নি । যুগ যুগ ধরে শিল্পীরা আক্রান্ত হয়েছেন এই সব ভ্যান্ডালিস্টদের দ্বারা । কিছু করতে পারে নি কেউ । ক্ষমতার জোরে সাময়িক ভাবে তাকে স্তব্ধ করে দিলেও মানুষের মন থেকে শিল্পীকে মুছে ফেলা যায় নি | কোনোদিন যাবেও না । আমি ঘোষণা করছি ক্লাবের তরফ থেকে শিল্পী কালীপদবাবুর হারমোনিয়াম সরিয়ে দেওয়া হবে । আর সব শেষে এই কদর্য কাজের পেছনে যাদের হাত রয়েছে তাদের ধিক্কার দিয়ে মাইক্রোফোন আমি হারান কে ফিরিয়ে দিচ্ছি পরবর্তী অনুষ্ঠান শুরু করার জন্য । আপনাদের সময় নষ্ট করার জন্য মার্জনা করবেন । নমস্কার ।
**************