রাজ্যবর্ধন তাঁর বস্ত্রাভ্যন্তরের কোন গোপন স্থানে একটি তীক্ষ্ণ ছুরিকা লুক্কায়িত করে রেখেছিলেন। হয়তো তাঁর উদ্দেশ্য ছিলপ্রয়োজনে তার সদ্ব্যবহার করা। হয়তো আত্মরক্ষার্থেও সেটির প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মনের কোন কুপ্রবৃত্তি বোধ হয় মহারাজরাজ্যবর্ধনের মধ্যে সেই সময় চাড়া দিয়ে উঠেছিল। মহারাজ শশাঙ্ককে আলিঙ্গনের মুহূর্তে যা তাঁর সমস্ত শুভবোধকে আচ্ছন্ন করেদিয়েছিল। তিনি যে কথাটি বারবার উচ্চারণ করেছিলেন যে তিনি ভগবন তথাগতের একজন দীন সেবক মাত্র, সেই কথাটিইহয়ত সেই মুহূর্তে তিনি বিষ্মৃত হয়েছিলেন।

মহারাজ শশাঙ্ককে আলিঙ্গনের ক্ষণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি সেই ছুরিকাটিকে বস্ত্রের ভিতর থেকে নিমেষে বার করে শশাঙ্কেরবুকে আঘাত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু শশাঙ্ক ছিলেন অত্যন্ত বলশালী। সর্বোপরি এমন কোন পরিস্থতির উদ্ভব হতে পারে সেইভেবে তিনি তাঁর বিশাল বক্ষটিকে এক কঠিন বর্মের আবরণে সজ্জিত রেখেছিলেন। অবশ্য অনুরূপ বর্মের আবরণে রাজ্যবর্ধনওসজ্জিত ছিলেন। কারণ পরস্পরের সততা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি তাঁরা সন্দিহান ছিলেন। ফলত: দুজনার মধ্যে শুরু হল একমরণবাঁচন লড়াই। কিন্তু শশাঙ্ক ছিলেন অনেক ক্ষিপ্র এবং সুকৌশলী। পরিণাম স্বরূপ কিছুক্ষনের মধ্যেই রাজ্যবর্ধনের হাত থেকেছুরিকাটি নীচে পড়ে গেল।এবার বোধ করি রাজ্যবর্ধনের হৃদয় অনুতাপের অনলে দগ্ধ হতে শুরু করল।

রাজ্যবর্ধন শশাঙ্কের নিকট নতজানু হয়ে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিমায় বললেনসম্রাট শশাঙ্ক, আমায় ক্ষমা করুন। আমিআপনার বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে পারলাম না।ভগবন তথাগতের পথানুসারী হওয়া সত্বেও মুহূর্তের অমানবিকতায় আমি আজতাঁকে কলঙ্কিত করলাম। আমার অপরাধের কোন ক্ষমা হতে পারে না। আর বিশ্বাসঘাতকতার একটিই শাস্তিমৃত্যু

এই বলে চক্ষের নিমেষে সেই ছুরিকাটিকে মাটি থেকে তুলে নিজের কণ্ঠদেশে তীব্রতার সাথে প্রোথিত করলেন যার পরিণামঘটনাস্থলেই তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু। হয়ত তিনি এটিও ভেবেছিলেন যে তিনি বেঁচে থাকলে মহারাজ শশাঙ্কের হাতে তাঁর মরণঅবধারিত। আর পরম শত্রুর হাতে মৃত্যু অপেক্ষা আত্মহত্যাই শ্রেয়। মহারাজ শশাংক বিষয়টির ব্যপকতা অনুধাবন করার পূর্বেইসমস্ত ঘটনাটি ঘটে গেল।কিন্তু তাঁর কিছুই করার ছিল না।

ইতিহাসের একটি বড়সড় অধ্যায়, বিশেষত: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ঐতিহাসিকেরা যেমন হিউয়েন সাঙ, রাজ্যবর্ধন অনুজ মহারাজহর্ষবর্ধনের সভাকবি বাণভট্ট, মহারাজ শশাঙ্ককেই রাজ্যবর্ধনের হত্যাকারী হিসাবে চিহ্ণিত করে এসেছেন। কিন্তু আধুনিকঐতিহাসিকগণ বহু পরিশ্রম সত্বেও কেহই তাঁদের এই সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে কোন তথ্যপ্রমাণ বা যুক্তি খুঁজে পাননি। তাই ইতিহাসযেখানে ব্যর্থ, সেখানে ইতিহাসের ছায়া আর কল্পনার কায়ার মেলবন্ধনে যদি সমগ্র ঘটনাটির একটি অনাস্বাদিত ব্যাখ্যা দেওয়াযায়, তাহলে আশা করি ঐতিহাসিকবৃন্দ এই অধম কাহিনীকারের উপর রুষ্ট হবেন না।

এবার আবার আমাদের কাহিনীতে ফেরা যাক। মহারাজ শশাঙ্ক প্রথমে ভেবে উঠতে পারলেন না যে সেই মুহূর্তে তাঁর কি করাপ্রয়োজন।যতই হোক তিনি শত্রুশিবিরে আছেন। কোনভাবেই যদি শিবিরের প্রহরারত রাজ্যবর্ধনের সৈনিকরা তাদের মহারাজেরমৃত্যুর কথা জানতে পারে, তাহলে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। অবশ্য মহারাজ শশাঙ্ক তাঁর দৈহিক শক্তি সম্বন্ধে যথেষ্টআত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তবুও

কিন্তু শশাঙ্ক ছিলেন অত্যন্ত স্থিতধী এবং প্রাজ্ঞ।তিনি অনতিবিলম্বে তাঁর করণীয় কি তা স্থির করে ফেললেন। তিনি উপলব্ধিকরলেন যে এই মুহূর্তে তাঁর রাজ্যবর্ধনের শিবির ত্যাগ করা বান্ছনীয়। অতএব তিনি প্রথমে অত্যন্ত ক্ষিপ্রহস্তে রাজ্যবর্ধনের সাথেনিজের রাজপোশাকের কিছু পরিবর্তন করে নিলেন। এক্ষেত্রে ভগবান শিবশম্ভু তাঁর সহায় ছিলেন। কারণ দৈহিক আকার এবংউচ্চতায় তিনি এবং রাজ্যবর্ধন প্রায় সদৃশ ছিলেন। এবার রক্তপাত নিবারণের হেতু রাজ্যবর্ধনের কণ্ঠদেশের ক্ষতস্থানটিকেনিজের পোশাকের কিছু অংশ দিয়ে দৃঢ়তার সাথে বাঁধন দিয়ে দিলেন। তারপর তাঁর বক্ষস্থলের বর্মটি দিয়ে রাজ্যবর্ধনের শবটিআচ্ছাদিত করলেন। অবশেষে শ্বেতপতাকা উত্তোলন করে তিনি নীরবে শিবির থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর ধীরে ধীরেরাজ্যবর্ধনের রক্ষী দুজনকে ডাকলেন। আধো অন্ধকারে তারা তাঁকে নিজেদের মহারাজই ভেবেছিল নিশ্চয় কারণ তাঁর অঙ্গেবহিরাবরণে রাজ্যবর্ধনেরই পোশাক ছিল। তবে তার আরো একটি কারণ ছিল। রাজ্যবর্ধনের শ্বেত অশ্বটিকে তিনি আদরকরছিলেন। এবং অশ্বটি নীরবেই দন্ডায়মান ছিল।হয়ত তার সেই সোহাগভরা স্পর্শটি ভালই লাগছিল।

আসলে মহারাজ শশাঙ্ক ছিলেন অশ্ব বশীকরণ তথা অশ্বচালনায় অত্যন্ত নিপুণ তাই এক নিমেষেই তিনি রাজ্যবর্ধনের শ্বেতঅশ্বটিকে বশে আনতে পেরেছিলেন। রক্ষীদ্বয়ক্কে কাছে ডেকে তিনি তাদেরকে অস্ফুটস্বরে কি বলেছিলেন তাও বোধ করি অনুমানকরা চলে। তিনি খুব সম্ভব তাদেরকে তাঁর সৈন্যশিবিরে গিয়ে শশাঙ্কের মৃত্যু সংবাদ প্রেরণ করতে বলেছিলেন।

রক্ষী দুজন চলে যাবার পরে মহারাজ শশাঙ্ক আর এক মুহূর্ত কালবিলম্ব না করে শ্বেত অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করে তাঁর নিজস্বরক্ষী দুজন যেখানে অপেক্ষা করছিল সেখানে চলে এলেন। তাঁর রক্ষীরাও প্রথমে তাঁকে চিনতে পারেন নি। কিন্তু তিনি যখন হরহর মহাদেব মন্ত্রটি উচ্চারণ করেন তখন তারা তাদের মহারাজকে চিনতে পারে। শশাঙ্ক তাদের অবিলম্বে সেই স্থান ত্যাগ করেযুদ্ধশিবিরে ফিরে চলার তথা তাঁর আপন অশ্বটিকেও তাদের সাথে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন। সেই রাত্রির মধ্যযামে অশ্বপৃষ্ঠেআরোহণকারী রাজপুরুষটি যে মহারাজ শশাঙ্কই ছিলেন এবং কাহিনীকারের সন্ধানী দৃষ্টিকে তিনি যে ফাঁকি দিতে পারেন নি তাবলাই বাহুল্য। কিন্তু প্রশ্ন হল তাঁর মুখাবয়বে বিষণ্ণতার ছায়া অনুভব করেছিলেন কেন কাহিনীকার ! তাঁর অন্যতম শত্রুথানশ্বররাজের মৃত্যুতে তাঁর আনন্দিত হবার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। মহারাজ শশাঙ্ক রাজ্যবর্ধনের এহেন মৃত্যু কোনসময়ই চান নি। আর তিনি এও জানতেন যে রাজ্যবর্ধনের স্বজনেরা এমনকি অনাগত ভবিষ্যতও এই মৃত্যুর জন্য তাঁর দিকেইআঙুল তুলবে।আর সমগ্র পরিস্থিতিই ছিল তাঁর বিপক্ষে।অতএব তাঁর হৃদয় যে বিষণ্ণ হবেই তা বলাই বাহুল্য।হয়ত থানেশ্বরেরসাথে তাঁর শত্রুতা আরো বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু তাঁর কিই বা করার ছিল। রাজ্যবর্ধনের আত্মহত্যার সাক্ষী যে কেহ ছিল না তবে ছিলনা বললে ভুল হবে। ছিলেন তিনি ব্যতীত আরো দুজন যাঁরা অলক্ষ্যে থেকে সম্পূর্ণ ঘটনাটি অবলোকন করেছিলেন। মহাকালস্বয়ম্ভু এবং তথাগত বুদ্ধ। সে কথায় না হয় পরে আসছি।

এদিকে রাজ্যবর্ধনের সেনানী যখন বেশ কিছু সৈনিকের সাথে শিবিরে এসে পৌঁছলেন তখন শশাঙ্ক নিরাপদে তাঁর যুদ্ধশিবিরেপৌঁছে গেছেন। যখন তারা বুঝতে পারলো যে তাদের মহারাজা মৃত, তখন তারা এতটাই স্তম্ভিত আর শোকস্তব্ধ হয়ে গেল যে তাদেরপক্ষে আর কিছুই করার ছিল না। মহারাজের নেতৃত্ব বিনা যুদ্ধ করার কোন প্রশ্নই ছিল না। অতএব বিনা প্রতিরোধেই এবারমহারাজ শশাংক কনৌজ অধিকার করলেন।

কিন্তু তাঁর কনৌজ শাসনের কোন অভিপ্রায়ই ছিল না। রাজ্যবর্ধনের সাথে তাঁর যে চুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তি অনুসারে তাঁরপ্রথম কাজ ছিল গ্রহবর্মার পত্নী তথা রাজ্যবর্ধনের ভগিনী রাজ্যশ্রীকে কারামুক্ত করা। তিনি অবিলম্বে সেটিই করার জন্য উদ্যতহলেন। ইতিমধ্যেই রাজ্যশ্রীর কাছে অগ্রজের মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছেছিল। আর রাজ্যশ্রী, শশাঙ্ককেই তাঁর অগ্রজের হত্যাকারীহিসাবে চিহ্নিত করলেন।

ভগিনী রাজ্যশ্রী, আপনি মুক্ত আপনি যেখানে যেতে ইচ্ছুক আমি আপনার অনুমতি সাপেক্ষে তার সকল ব্যবস্থা করে দেব।আপনি নি:শংসয় থাকুন।”- কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাজশ্রী শশাঙ্কের কথায় বিশ্বাস করলেন না।

তিনি বললেন-“ মহারাজ শশাঙ্ক, আপনি হীন, কুচক্রী, বিশ্বাসঘাতক। আমার অগ্রজের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আপনি তাঁকেহত্যা করেছেন। আপনি একজন হত্যাকারী।

না, না , ভগিনী”-শশাঙ্ক আর্তনাদ করে উঠলেন।আমি জানতাম এই কলঙ্ক আমাকে খণ্ডিত করবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমিআপনার অগ্রজের হত্যাকারী নই।এই বলে সেদিন রাত্রে মহারাজ রাজ্যবর্ধনের শিবিরে যা যা ঘটেছিল রাজ্যশ্রীকে তারপুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিলেন।আমি আমার উপাস্য দেবতা মহাদেব এবং আপনাদের পথপ্রদর্শক ভগবন তথাগতের নামে শপথ করেবলছি যে আমার একটি কথাও মিথ্যা বা সাজান নয়। অলক্ষ্যে থেকে তাঁরা সকল ঘটনার আনুপূর্বিক সাক্ষী।

কিন্তু রাজ্যশ্রী দুর্ভাগ্যবশত তাঁর কোন কথাই বিশ্বাস করলেন না। তিনি কেবল বললেনমহারাজ , দয়া করে আমার অগ্রজের শ্বেত অশ্বটি আমাকে দিন। আমি অবিলম্বে কনৌজ ত্যাগ করতে চাই।

শশাঙ্কের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে সেই শ্বেত অশ্বে আরোহণ পূর্বক রাজ্যশ্রী অতি সত্বরই কনৌজের রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেন।শোনা যায় তিনি প্রথমে বিন্ধ্যপর্বতে আত্মগোপন করেন এবং পরে যখন অগ্নিতে আত্মাহুতি দিতে উদ্যত, সেই মুহূর্তে তাঁর আরএক ভ্রাতা হর্ষবর্ধন তাঁকে উদ্ধার রক্ষা করেন। পরে অবশ্য রাজ্যশ্রী

একজন ভিক্ষুণীর বেশে সংঘে যোগ দেন বলে ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে আমরা জানতে পারি।তবে সেটি একটি অন্য কাহিনী।

এদিকে শশাঙ্ক যখন কনৌজে,তখন রাজ্যবর্ধনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মহারাজ হর্ষবর্ধন, শশাঙ্ককে শাস্তি দেবার উদ্দেশ্যে কনৌজঅভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু আমরা জানি যে শশাঙ্কের কনৌজ অধিকারে রাখার কোন অভিপ্রায়ই ছিল না। আর সেই কারণেতিনি কনৌজের সৈন্যবাহিনীর একজন পদস্থ সৈনিককে ইতিমধ্যেই থানেশ্বরে কনৌজের সব সংবাদ সহ প্রেরণ করেছিলেন। তবেযে মুহূর্তে তিনি জানতে পারলেন যে থানেশ্বরের বর্তমান অধিপতি হর্ষবর্ধন তাঁকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে কনৌজের অভিমুখেরওয়ানা দিয়েছেন, তিনি আর এক মুহূর্ত কনৌজে থাকতে অভিলাষী ছিলেন না। কারণ তিনি চাইছিলেন না আর একটিরক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মুখোমুখি হতে। অতএব তিনি অবিলম্বে তাঁর সমস্ত সৈন্যবাহিনীর সাথে কনৌজ ত্যাগ করে গৌড় অভিমুখেযাত্রা করলেন। অবশ্য প্রয়াত মিত্র মালব্যরাজ দেবগুপ্তের রাজ্যটিক যথার্থ উত্তরাধিকারীর হস্তে  প্রত্যর্পণ করে রাজ্যটিকে সুরক্ষিতরাখার জন্য বিশ সহস্র সৈনিককে মালব রাজ্যের প্রহরায় রাখার ব্যবস্থা করে তবেই তিনি গৌড়ে ফেরেন। এমনই ছিল তাঁরদায়িত্ববোধ, কর্তব্যপরায়ণতা এবং বন্ধুত্বপ্রীতি। পরবর্তীকালে হর্ষবর্ধন কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণের সাথে সখ্যতা স্থাপন করেবারংবার শশাঙ্ককে অবদমিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা মহারাজ শশাঙ্কের জীবৎকালে কেহই তাঁর সামান্যতম কেশটুকুওস্পর্শ করতে পারেন নি।এমনই ছিল শশাঙ্কের জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, ক্ষিপ্রতা, কুটবুদ্ধি, রণকৌশল এবং সত্যনিষ্ঠা। তাঁদের এই ব্যর্থপ্রচেষ্টার আখ্যানই আমি লিপিবদ্ধ করেছি আমার অন্য একটি কাহিনীরহস্যময় কর্ণসুবর্ণ’-

বারংবার এই যুদ্ধ আর অহেতুক রক্তক্ষয়ে মহারাজ শশাঙ্ক বুঝি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই সাথে তাঁর বয়সও একটু একটু করেবাড়ছিল। রাত্রে প্রায়শই তাঁর ঘুম হতো না। যুদ্ধক্ষেত্রের অস্ত্রের ঝনঝনানি, মানুষের আর্তরব তাঁকে প্রায়শই অস্থির করে তুলতো।আর হর্ষবর্ধন, ভাস্করবর্মণ সহ বিভিন্ন বহি:শত্রুর আক্রমণ থেকে নিজের রাজ্যকে রক্ষা করার জন্য তাঁকে অহর্নিশই সতর্ক থাকতেহত। মাঝে মাঝে যখন তিনি খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়তেন, তখন মধ্যরাত্রে তিনি মহাকালের মন্দিরে চলে আসতেন মানসিক শান্তিরখোঁজে।বারবার মহারাজ রাজ্যবর্ধনের আত্মহত্যার দৃশ্যটি তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠত। তাঁর অন্তরের হাহাকার রবকে তিনিযেন কিছুতেই শান্ত করতে পারতেন না। আর তখনই তিনি শিবশম্ভুর মন্দিরে ছুটে যেতেন।

এমনই এক মধ্যরাত্রে তিনি অস্থির হয়ে তাঁর উপাস্য দেবতা ইষ্টপিতা মহাদেবের মন্দিরে ছুটে এসেছিলেন মনের শান্তির খোঁজে।

হে ঈশ্বর, তুমি বলে দাও আমি কি করবো। এই অসহনীয়

মানসিক যন্ত্রণা আর সহ্য করা যায় না। তুমি আমায় পথ দেখাও প্রভু, আমাকে শান্তির আলোয় আলোকিত কর।”- মহারাজশশাঙ্ক মহাদেবের পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়লেন। তাঁর অশ্রুতে দেবাদিদেবের চরণ দুটি সিক্ত হয়ে গেল। এইরকম অবস্থায় তাঁরচৈতন্যই বুঝি লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এমন সময় হঠাৎ সেই দেবদেউলের চতুর্দিক যেন এক অসামান্য জ্যোতির্ময় আলোকে উদ্ভাসিতহয়ে উঠল। এক মেঘমন্দ্র কণ্ঠস্বর শশাঙ্কের কানে ভেসে এল।

ওঠ্ পুত্র শশাংক, তোর চিত্তে এত দোলাচল কেন ! ওঠ্ , জাগ্

ধীরে ধীরে শশাঙ্কের অন্তরের সমস্ত অনুভূতির প্রত্যাবর্তন ঘটল। তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে যেন কিছুই দেখতে পেলেন না কেবল প্রবল একটা আলোকদ্যুতি তাঁর আঁখি দুটিকে বুঝি গ্রাস করতে আসছিল।অবশেষে সেই অসামান্য আলোকমালার মধ্যেতিনি দেখতে পেলেন এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে।এ কি! স্বয়ং মহাকাল দেবাদিদেব স্বয়ম্ভুনাথ যে তাঁর সম্মুখে আবির্ভুত।শশাঙ্কমূক,বিহ্বল।

দেবাদিদেব বললেন-“পুত্র, আমি জানি সেদিন রাত্রে কি ঘটনা ঘটেছিল। আমি স্বয়ং তার সাক্ষী, সে সম্বন্ধে তুই নিশ্চিত। আরতোদের অলক্ষ্যে আরো একজন সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিল সেই তথাগতের কথাও তুই ইতিমধ্যে রাজ্যবর্ধনের ভগিনীকে ব্যক্তকরেছিস।তোর মানসিক যন্ত্রণার কোন কারণ নেই। যদিও অনাগত ভবিষ্যত হয়ত তোকেই সেরাত্রের ঘটনার জন্য দায়ী করবে, কিন্তু একদিন আসবে যেদিন মানুষ তার ভুল বুঝতে পারবে। আর এই যে রক্তক্ষয়, এই যে হিংসা, জানবি এর অধিকাংশই তোরইচ্ছার বিরুদ্ধে সাধিত হয়েছে। কিন্তু এখন সময় হয়েছে সুচারুরূপে রাজ্য শাসন করার। আগ্রাসী মনোভাব বর্জন করে এখন তোরউচিত প্রজাদের হিতসাধনের জন্য মঙ্গলময় কার্য করার। তুই চিন্তা করিস না। তোর শাসনকালে এই রাজ্য চির সুরক্ষিত থাকবে।কোন শত্রুই আর তোর বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস পাবেনা। তুই নিশ্চিন্তে একজন সফল প্রজারন্জক রাজা হিসাবেরাজ্য শাসন কর। আর সর্বত্র শান্তির বীজ বপন কর। আর সেইসাথে তুই তথাগতেরও স্তব কর, চিত্ত শান্ত হবে, সংযত হবে।

ক্রমে ক্রমে সেই জ্যোতিপূর্ণ দীপ্তি মন্দিরের ভিতর থেকে অন্তর্হিত হয়ে গেল। মহারাজ শশাংক মহাকালের উদ্দেশ্যে করজোড়েপ্রণাম নিবেদন করে দেউলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। তাঁর হৃদয় এখন অনেক ধীর,স্থির ,সংযত।

ঊষার আলোকে সমগ্র পুবাকাশে এক রক্তিম দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর অন্তরও যেন আজ এক অসীম শান্তির আলোকেআলোকিত।

এর পরে কি ঘটেছিল তা অনুমানসাপেক্ষ। শশাংক অধীনস্থ গৌড় বাংলার যে সমস্ত ধ্বংসাবশেষ এখনো অবধি পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে বেশ কিছু বৌদ্ধ মূর্তি স্তুপ আছে। এগুলিই প্রমাণ করে যে বাংলার প্রথম সার্বভৌম সম্রাট শশাঙ্ক কখনোই বৌদ্ধ ধর্মবিরোধী ছিলেন না।পক্ষান্তরে তিনি ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের পৃষ্ঠপোষক। এবং তিনি মহাকালের উপাসক হলেও তাঁর হৃদয়েতথাগত বুদ্ধেরও স্থান ছিল।

দিন এগিয়ে চলেছে আর এগিয়ে যাবার কালে ইতিহাসের পাতায় তার ছাপ রেখে কত না গল্প সৃষ্টি করে আমাদেরসাহিত্যেভাণ্ডারকে ভরিয়ে তুলেছে। সুধী পাঠককুল, শিবপুত্র মহারাজ শশাঙ্কের এই কাহিনী ইতিহাসের পাতায় হয়ত খুঁজে পাওয়াযাবে না। কাহিনীকারের কল্পনা আর কিছুটা ইতিহাসদুয়ের সংমিশ্রণে এই আখ্যানের সৃষ্টি। কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ নৃপতি হিসাবেমহারাজ শশাঙ্ক যে তদকালীন ভারতবর্ষে এক বিশেষ মর্যাদা লাভে সমর্থ হয়েছিলেন,তা অনস্বীকার্য।        ।।  ওম্  নম:  শিবায়:  ।।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleআগমনী বন্দনা
Next articleআগমনীর প্রার্থনা।
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments