মা বাবার মধ্যে প্রায় রোজই ‘তেল আনো ,নুন আনো চাল বারন্ত’। আর তিন, চার বা সারে চারটে বাড়ির মায়েদের মতই আমার মায়েরও, বাপের বাড়ি চললাম বলার গতি নেই। বলাই বাহুল্য, সে সুযোগেই আমার বাবা বা সমবয়সী বাবাদের ট্রাম্প-রাজত্ব।মাঝে মাঝে মনে হয় এরা বিয়ের নামক যাত্রায় পাঠ নিতে গেছলো কেন? ফের হুঁশ আসতে বুঝি ,আমাকে অবতরণের প্রয়োজনার্থে ।
আমার বাবা সরকারি দাস বটে, দোহারা চেহারা মাইনে সত্ত্বেও অভাব বোধ হয়, সম্ভাবত এটি স্বভাবে ( যদিও এটা আমার রাগের কথা, দু- দুটো মেয়ে আছে, গোত্রান্তর বাকি, একটি প্রতিষ্ঠিত অপরটি বাকপটু ব্যাতিত কিছুই নয়, মানে আমি)। সবে আমরা বাড়ি চেঞ্জ করে ফ্ল্যাটে এসেছি, এরই কিছুদিনের তফাতে একটি সদ্যোজাতর আগমন হয় একতলায় থাকা এক হিন্দুস্তানি (যদিও আমরা পাকিস্তানি নই, ওনাদের নন-বেঙ্গলি বলাই যায়) ফ্যামিলির । ছোটবেলা থেকেই দেখছি ,মা আমার কচি-কাচা প্রেমিক, নিঃসঙ্গতায় তাদের নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়া, লোকের ব্যাস্ততায় তাদের বাচ্চা সামলানো অথবা ফ্রী তে প্রাথমিক অঙ্ক-ইংরেজি সালটে দেওয়ায়, মা কোথাও যেন আমাদের মাসে একদিন বিয়ার খাওয়ার মত পরিতৃপ্তি পায়।
কলেজ যেতে আসতে ছোট মানুষটার আওয়াজ পেয়ে চটকানোর মানসিকতা জন্মালেও আমল দিইনা কেননা আমি সেই জেনারেশানের একজন যারা ফেসবুক তথা অদেখা বান্ধব সচ্ছল কিন্তু সামনে থাকা মানুষের সাথে যেচে কথাবার্তা , বেরোয় না আর কি। আমি ফিরছি এরকম এক বিকেলে ভাবি (নীচের তলার নন বেঙ্গলি) অনুনয়ের সাথে বাচ্চাটাকে কিছু সময়ের জন্য ধরতে পারব কিনা জানতে চাইল,কেননা তিনি তার বরের এক অফিস পার্টির জন্য রেডি হবে, যেটা সুস্থভাবে কোনভাবেই সম্ভবপর হচ্ছেনা। অগত্যা হোক, বন্ধুত্ব হোল। যদিও ভাবি তখনও আমার মা যে শিশুপ্রেমিক, এ তথ্য থেকে অগ্যাত ছিল।
যেহেতু ভাইয়া আই.টি কোম্পানির ভাড়া করা ইঞ্জিনিয়ার-ভাবির এম.কম সত্ত্বেও সাংসারিক দায়বোধ আর নতুন সংসারের অনভিজ্ঞতা ছোটমানুষটার সাথে হুল্লর করার লোকের বড্ড অভাব এনে দিয়েছিল। ভাবি মিশুকে হওয়ায় মা’ও এক সঙ্গী পেল। ধীরে আসা যাওয়া বেড়ে ও বড় হয়ে ওঠা , বলাই বাহুল্য মা বাবার ঝগড়ার সময়টা কমে তিনিই অগ্রাধিকার পেলেন। এটা বুঝতে বুঝতে মায়ের দেওয়া নাম বাবুয়া হোল আর হামাগরি টু সারা বারান্দা চষে বেড়ানো চটজলদি শেখার দৌলতে পাকু নামেই আমি ডাকতে থাকি, ভালবেসেই মানুষ ভিন্ন ছোট ছোট নামে আদর জাহির করে কিনা। পাকু আর্লি রাইসার (ভাইয়া’র অফিস –ভাবি’র সারাদিনের ব্যাস্ততা ) বলে সাত সকালে ফিটবাবু হয়ে চলে আসত। বাবার কাছে খাওয়া-ঘুম, মার কাছে সারাদিনের দৌরাত্য আর ডায়পার’স্ –র দয়ায় রোজকার বেশ কাটছিল।
বাবুয়া রাতের শেষে সকালে কখন আসবে ভেবে অনিদ্রা প্রকপ থেকে ক্রমে মুক্তি ঘটছিল মায়ের। দারুন রকমের ভালো লাগত মা-বাবার একে অন্যের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ।ভোজপুরী -হিন্দির বদলে বাংলাই সে জলদি রপ্ত করছিল।তাতে তার (পাকুর)মা-বাবা র কোনোরূপ খেদ নেই বরং তাদের ভাষায় তারা বাপ-মা (আমার মা-বাবা) পেয়েছেন ,শুধু বাবুয়া-র নয় বাবুয়ার মা-র’ও মাঝেমধ্যে অসুস্থতার প্যারাসিটামল আমার মা।এটা বলতেই হচ্ছে,ছেলে থাকলে মা খুব বুঝদার রকমের ভালো শাশুড়ি হত, যদিও বাবা র অফিস কলিগদের মতে, ছেলে/বাবা খুনোখুনি হত বা ছেলে বউ নিয়ে আলাদা সংসার সাজাত। যাক গে, পাকু ম্যাক্সিমাম সময়টাই বাবা র সাথে কাটাত কিনা, তাই ‘নানা’ ছাড়া বেচারা যেথায় বেরাতে যায় সেথায় কান্নায় কুপোকাত হয়।
অগত্যা ব্যাক টু নানার কোল আর ঘরের সব জিনিস লণ্ডভণ্ড তথা উঁচু ডেস্কের থেকেও ভাসমান গোড়ালি তে সে সবই ছুঁতে পায়। একদা ডেঙ্গু উপদ্রবে সার্ভে করতে আসা ভদ্রমহিলা তো পাকুকে, মা-বাবার শেষ বয়সের হঠাৎ ভীমরতি ধরেই ফেলছিল(ভুলটা আমি শুধরাই)। পাকুর গোটা প্রি-ভাত খাওয়ার সময়টাই আমার নিকনের মস্তিস্কে। ভাবি নিজেও ছবি তুলতে বা ফেবু-তে ঝোলাতে ভালোবাসতো। ডি.এস.এল.আর আমায় তাদের পার্সোনাল ছবিগ্রাফার করে । রোজ ব্রেকাপ-ফ্রাস্তেসানের চিবনো জীবনটায় এককোথায় মাতিয়ে রেখেছিল ঐ শান্ত নিরিহ মুছকি মুছকি হাসা ছোটমানুষটা। আমার-তেনা’র মত দুটো আবেগে ফুসছে জীবন স্বপ্ন দেখে একটা ফ্ল্যাটে একা সংসারের। শ্বশুর শাশুড়ির প্রয়োজন বোধ, হয় এখানেই।
প্যাক-প্যাক-প্যাকাও সকালের ঘুমটার ক্যাওম্যাও করলেও শেষের দিকে একাপ্রিয় আমিও বিরক্ত হতাম না কিন্তু। পাকুর এক বছর তিন মাসের দোরগোড়ায় ল্যান্ডলর্ডের হুকুমে তাদের ঘর বদল হল।কাছাকাছি পছন্দমত বাড়ি না পাওয়ায় বেশ কিছুটা দূরেই চলে গেল পাকু। সেদিন মা’কে কিছু কাঁদতে দেখেছিলাম,বাবাও। ফোনের ওপার থেকে বার্তা আসত যে সে ভালো নেই। হ্যাঁ বলেতেই ভুলে গেছি , পাকু র নাম শমিত। বেশ কিছু দিন পর শমিতের এক ফোল্ডার ভরতি ছবির মধ্যে বেশ কিছু স্টারের নটী বিনোদিনী‘তে সিলেক্টড এবং নন্দনের ন্যাপ দ্বারা অনুষ্ঠিত ফোটো এক্সিবিশানে চর্চারত এবং পুরস্কৃত হয়। যাতায়াত ভালই আছে তবে এখন, আমাদের আশেপাশে ফ্ল্যাট নেওয়ার তালে ওরা ,নিজের ছাদ। জীবনটা মার্বেল পেপারের ন্যায় ঠেকছিল ,রঙ্গিনটা শমিতের সাথে থাকা সময় –ফ্যাকাশেটা আবার পুরনো সময়ের মতো।
হয়ত বা আমার ভিতরেও মা বাবার মতন শূন্যতা- ভগ্নাংশরা সমাধানচ্যুত অঙ্ক কষ্ত। তাই খিটকে থাকতাম আর চাকরি পেয়ে কাটটে চাইতাম। প্রেম মানুষ কে আরেকজনের দায়িত্বজ্ঞান শেখায়,বাচ্চা দায়িত্ববোধ। ভাগ্য কোন্ মোহনায় ফেলবে জানিনা তবে মা বাবা কে লড়তে দেখলে অর্ধেক বিরিয়ানি খাওয়া ছেড়ে, উঠে হলেও থামাবো।