সহস্রলোচন ইন্দ্র ত্রিলোচন দেবেন্দ্র
অন্যেরা দ্বিলোচন জানি,
তুমি কে হে একলোচন করহ ন্যায়শাস্ত্র বচন
যুক্তি তব মোরা নাহি মানি ।”
কানা রঘুনাথ উদ্দেশ্যে গুরু পক্ষধর শিষ্যে
চলিত এমনই কটুক্তি,
কিন্তু রঘুনাথ সনে ভঙ্গ সবে তর্ক রণে
এমনই অকাট্য ছিল যুক্তি।
কে ইনি রঘুনাথ কি হেতু তাঁহার সাথ
চলিত এহেন ক্লেশাচার,
বর্ণনা করিব এবে সুধীজন শুন সবে
ছন্দে ছন্দে করিব বিস্তার।
নবদ্বীপ অধিবাসী জিজ্ঞাসা রাশি রাশি
শৈশবেই অতি বুদ্ধিমান,
অকস্মাৎ পিতৃহারা জননী পাগলপারা
কানভট্ট ব্রাহ্মণসন্তান।
বাসুদেব সার্ব্বভৌম গুরুদেব জ্ঞানসৌম্য
তাঁহার শিষ্য রঘুনাথ,
একদা সায়ংকালে কীট দংশন ভালে
এক চক্ষু নাশ অকস্মাৎ।
মেধাবী ছাত্র প্রতি বাসুদেব প্রসন্ন অতি
ন্যায়তর্কে গুরু পরাভূত,
আজ্ঞা দিলেন শিষ্যে মৈথিলী পক্ষধর মিশ্রে
কর এবে বিদ্যা অধিগত।
গুরুর আজ্ঞা লভি ন্যায়শাস্ত্রে নব রবি
মিথিলায় করিলেন গমন,
সেথায় গুরু কি ছাত্রে এক চক্ষু হীন সূত্রে
কহিতেন তাঁহারে একলোচন।
তীক্ষ্ণধী রঘুনাথে তর্কযুদ্ধ সংঘাতে
সব শিষ্য হইত পরাভূত,
এমনকি পক্ষধর ন্যায়শাস্ত্রে ধুরন্ধর
তিনিও হইতেন লজ্জিত।
এমনই এক অপরাহ্নে শিষ্য রঘুর সনে
ন্যায়তর্কে পক্ষধর বিদ্ধ,
বুদ্ধি মান জলান্জলী দিলেন অশ্রাব্য গালি
কানভট্ট বিষম ক্রুদ্ধ।
প্রতিশোধপরায়ণ রঘুনাথ তনুমন
শুভবুদ্ধি হইল অসার,
দিবেই উচিত দণ্ড গুরু নহে, মিশ্র ভণ্ড
করিবে তাঁহার সংহার।
সেদিন গভীর নিশা রঘুনাথ হারায়ে দিশা
উদ্যত তরবারি করে,
লক্ষ্য পক্ষধর কক্ষ প্রতিহিংসা দীর্ণ বক্ষ
শমনের রূপ বুঝি ধরে।
চন্দ্রাতপ আলোকিত গুরুকক্ষ সুশোভিত
পতি পত্নী পার্শ্বে উপবিষ্ট,
হেরিয়া এমত দৃশ্য রঘুনাথ বুঝি নি:স্ব
কিরূপে সে করিবে অনিষ্ট !
বাতায়ন পার্শ্বে গুপ্ত হিংসা হইল সুপ্ত
শ্রবণি দোঁহার আলাপন,
শারদীয়া বিভাবরী পূর্ণিমা কোজাগরী
অপরূপা চন্দ্রিমা কিরণ।
আননে মধুর হাসি গুরুমাতা জিজ্ঞাসি
“এমনই ঊজ্জ্বল নিশামণি,
আর হেথা আছে প্রভু নাকি হেথা ছিল কভু
আহা কি অপূর্ব লাবণি।”
কহিলেন পক্ষধর “আছে হেথা ভাস্বর
ঊজ্জ্বলতম এক রতন,
আমি অতি ভাগ্যহীন অন্তর অস্বচ্ছ দীন
জ্যোতিষ্মানে করি অযতন।”
“বঙ্গদেশী নৈয়ায়িক রঘুনাথ তার্কিক
মিথিলাকে করিয়াছে অপ্রদীপ্ত,
আজ এক তর্করণে জ্ঞানঅর্ক শিষ্য সনে
তব পতি বিজিত বিক্ষিপ্ত।”
“পূর্ণচন্দ্র দীপ্তি ম্লান এমনই তাহার জ্ঞান
শিষ্য মোর ভানুসম দৃপ্ত,
হৃদয়ের তমসা রাজি করিয়াছে দূর আজি
পরাহত তথাপি আত্মতৃপ্ত।”
“কিন্তু অন্যায় রোষে আপন অহং দোষে
করিনু তাহারে কটুক্তি,
রঘুনাথে যবে হৃদে রাখিব গুরুর পদে
হইবে তবেই পাপমুক্তি।”
কপোলে অশ্রুরাশি কাণভট্ট বাণভাসি
স্খলিত উদ্যত কৃপাণ,
প্রবেশি’ অকস্মাৎ গুরুকক্ষে রঘুনাথ
অবসান মান অভিমান।
মাগেন মার্জনা ভিক্ষা “গুরুদেব তব শিক্ষা
জীবনের পরম সম্পদ,
ক্ষমা মাগি মহামতি পাপিষ্ঠ আমি অতি
ইচ্ছা ছিল তব প্রাণবধ।”
সব শুনি পক্ষধর বিষ্ময়ে বাকহর
মহামিলন ঘটে অত:পর,
নব্য যুগের সৃষ্টি নবদ্বীপের কৃষ্টি
ভারতবর্ষে শ্রেষ্ঠ অনন্তর।
পূরণ করিয়া লক্ষ্য পক্ষধরের পক্ষ
শাতন অন্তে একলোচন,
ফিরিলেন বঙ্গভূমে নবদ্বীপের ধামে
মান্য করি’ গুরুর বচন।”
মিথিলা বিজয় কথা পক্ষধরের ব্যাথা
কহিলেন সবই গুরুদেবে,
আলিঙ্গনে শিষ্যে সৌম্য আদেশি’ সার্বভৌম
“শিক্ষাদান কর পুত্র এবে।”
খুলিতে হইবে টোল সর্ব অর্থে ডামাডোল
অর্থহীন নি:স্ব ব্রাহ্মণ,
হরি ঘোষ জমিদার কিংবদন্তী সমাচার
তিনিই শিরোমণি শরণ।
তাঁহার গোয়াল ঘরে ভিন্ন ভিন্ন সুরে
ন্যায়চর্চার হয় হাতেখড়ি,
হরি ঘোষের গোয়াল প্রবচনে চিরকাল
বাক্যজালে তাঁহারেই স্মরি।
রঘুনাথ শিরোমণি মাতামহ সূলপানি
নৈয়ায়িক স্মার্ত পণ্ডিত,
স্মৃতিশক্তি অসামান্য আপন কর্মে ধন্য
ন্যায়শাস্ত্র সকলই অধীত।
কিন্তু বাঙালী জাতি স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ অতি
বিস্মৃত আপন সংস্কৃতি,
ব্রাত্য তাই জ্ঞানবৃদ্ধ ন্যায়শাস্ত্রে সর্বসিদ্ধ
কানভট্ট্ নাহি কোন মতি।
নবদ্বীপ ইতিহাস অনিন্দ্য প্রতিভাস
ছন্দপুষ্পে মালিকাটি গাঁথি,
রঘুনাথ ইতিবৃত্ত আলোকিত করুক চিত্ত
অহর্নিশ জ্ঞানাদীপ ভাতি।