-“হ্যাঁ রে বাবলা, কাল কালী পুজো | আর তুই বাড়ি থাকবি না ?”
-“ উফ মা, কানের কাছে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কোরো না তো ! পুজো বলে কি বাড়ি বসে থাকবো ? আর পুজোর কোন দিনে আমি বাড়ি থাকি বলো তো ?”
-“ জানি বাবা | তুই সারাদিন মন্ডপে পরে থাকিস , নাহয় বন্ধুদের সাথে | তবুও ডাক পারলে তো তোকে পাওয়া যায় !”
-“ এতো ভেবো না তো মা ! আমি কি বাচ্চা আছি ? বললাম তো দুদিনেই ফিরে আসবো | আমার নতুন জিন্স আর বেল্টটা দাও তো | ব্যাগে ঢোকাই |”
-“ কোথায় যাচ্ছিস, তাও তো বলছিস না রে | বুকের ভেতরটা বড় ধড়ফড় করে রে বাবলা |”
জিন্সের প্যান্টের প্যাকেটটা নিতে গিয়ে মায়ের মুখের দিকে চোখ পড়ে বাবলার | মায়ের মুখটা কেমন শুকনো আর ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে | মাকে জড়িয়ে ধরে বাবলা …..
-“কেন চিন্তা করছো মা ! দুটো দিনের তো মামলা | দরকার হলেই ফোন করবে | আর আমি তো একা নই | এতগুলো বন্ধু-বান্ধব যাচ্ছে সাথে !”
-“সেই টাই তো জিগাচ্ছি তখন থেকে, কাদের সাথে যাচ্ছিস, কোথায় যাচ্ছিস ?”
-“তুমি কি চিনবে নাকি ! সব কলেজের বন্ধু | আরে একসাথে থাকবো সবাই, ঘুরবো ফিরবো, আনন্দ করবো | মিন্টিকে বলবে, আমি কিন্তু ফোঁটা নেবো | ভালো করে নাড়ু বানাতে বলো তো ! মামিমার হাতের নাড়ু খাওয়া হয়নি এবার | আর ওই দিন দুপুরে কিন্তু আমি জম্পেস মাংস-ভাত খাবো | মিন্টিকে বলতে ভুলো না মা |”
বাবলা জুতো পরে রেডি | বারবার মোবাইল দেখছে | কারুর অপেক্ষা নাকি !
-“ সেতো বলবো বাবা , এখনো বলছি আজ না গেলেই নয় রে !”
-“আহ মা … তুমি বরং মামারবাড়ি চলে যাও | একা থাকলেই এখানে আল-ফাল ভাবনা চিন্তা করতে থাকবে | আমি ডিরেক্ট মামারবাড়ি চলে যাবো |”
কথার মাঝেই বেজে উঠলো মুঠোফোন | কানে ধরেই বাবলা ছুট লাগায় | মায়ের দিকে ফিরে হাত নাড়ার সময় টুকুও আর হয়ে ওঠে না | বড্ড তাড়া…..
সদর ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন অনিতা | যতক্ষণ ছেলেটাকে দেখা যায় ! শূন্যে হাত নেড়ে চলেন …. আজ মনটা বড় কু গাইছে | ছেলেটাকে কাছছাড়া করতে মন চাইছিলো না একদমই | কিন্তু সে কি আর সেই দুধের শিশুটি আছে ! যে কথা শুনবে !! সঙ্গী-সাথীদেরও চেনেন না তেমন | বুকের ভেতরটা কেমন হ্যাঁচড়-প্যাঁচড় করে | তবে যাওয়ার আগে যে বুদ্ধি করে একজন বন্ধুর নাম ফোন নম্বর দিয়ে গেছে, এই অনেক | বাবলাকে ফোনে না পেলে অন্তত ওর এই বন্ধুকে পাওয়া যেতে পারে |
ঘরে ঢুকে টুকটাক কাজ সারতে সারতেই ভাবেন অনিতা, বাপের বাড়ি গেলেই হয় | কি করবেন এখানে একা বসে বসে | স্বামী তো সেই কবেই বছর দশেক আগে সব ছেড়ে মায়ার বাঁধন কাটিয়ে চলে গেছেন | সহায়-সম্বল বলো আর ধন-সম্পদ বলো, আর নিরাপদ আশ্রয়ই বলো…সবই ওই বাবলা | বয়সটাও কাঁচা | বছর বাইশের ছেলে কে বলবে ! ফাঁপালো গড়নতো ! লোকে ভাবে অনেক বড় বুঝি |
হাতের কাজকর্ম সেরে টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে অনিতা রওনা দিলেন বাপেরবাড়ি | খুব দূরে নয় | একা থাকার থেকে এই ভালো | ভাই-বৌয়ের হাতে হাতে কাজ করেও সময় কাটবে | বাবলা না থাকলে একার জন্য রাঁধা-বাড়া করতেও আর ইচ্ছা করে না |
বাপের বাড়ি জমজমাট | একা ওই মিন্টি আর ওর ভাই বান্টিই জমিয়ে রাখে বাড়ি | মিন্টি ক্লাস সেভেন আর বান্টি সবে ক্লাস ফোর | দুটিতে যত ভাব, যত ঝগড়া | ভাই-বৌ তো এদের নিয়ে তটস্থ হয়ে থাকে একদম | তবে অনিতার বড় ভালো লাগে এই দুটির খুনসুটি | নিজের বাড়িটা তো ভুতের বাড়ি মনে হয় বাবলা না থাকলেই | মন টেঁকে না | আজও এদের মাঝে এসেও মনের খুঁত-খুঁতুনি কিছুতেই যাচ্ছে না | ছেলেটা না গেলেই পারতো ! এখানে একসাথে কত আনন্দ করতে পারতো !
-“আরে দিদি, এত ভাবিস কেন বলতো ! ইয়াং ছেলে , এই সময়ে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আনন্দ-ফুর্তি করবে, তাই না ? এত বেঁধে বেঁধে রাখিস না ওকে |” অনিতার ভাই দেবাশিষ দিদিকে স্বান্তনা দেয় |
-“ আমি কি ওকে বেঁধে রাখি দেবা ? এই বারটা কেমন জানি মন খুঁত-খুঁত করছে রে | একটা ফোন করে দেখিস না রে ভাই, কাদের সাথে গেলো..সেটাই তো বুঝছি না | লোকজন কেমন, জানিনা তো .. তাই আরো কেমন অস্থির মতো লাগছে খালি |”
-“ আচ্ছা, দাঁড়া | একটা ফোন লাগাই বাবলাকে | তুই আর টেনশন নিস না |”
মিন্টি এসে গলা জড়িয়ে ধরে পিসির |
-“ও পিম্মা.. এসো না গো আমার ঘরে | একটা জিনিষ দেখাবো তোমায় |”
-“কি রে !”
এই মেয়েটির আদরে বড্ড গলে যান অনিতা | বড় মায়া এই একরত্তি মেয়েটির মধ্যে |
-“তুমি তো পুজোর মধ্যে এলে না একবারও | জানো না তো ! বাবা এবারে আমাকে সেই লাল ঘাঘরাটা কিনে দিয়েছে | দেখবে না ?”
-“দেখেছি তো |”
-“ কি করে দেখলে? তুমি তো আসোই নি |”
-“আমার তো আর একটা চোখ আছে | জানিস না !”
-“ধ্যাত, আমার সাথে মজা করছো তুমি | চলো না পিম্মা !!”
হাত ধরে টানতে টানতে মিন্টি চললো তার পিম্মাকে নিয়ে…..
-“ এইইদ্দেকো…. কি সুন্দর সোনালী কাজ দেখেছো পিম্মা ! পুরো ওই সোনার শাড়ি পড়া ঠাকুরের মতো দেখতে | সোনার ঘাঘরা | আমার বন্ধুরা তো কি হিংসে করছিলো ! মুন্নি বলে কি, আমায় কালীপুজোতে পড়তে দিবি ? হুঃ..কক্ষনো দেবো না ! সবে একদিন পড়েছি , এইটা পরে আমি ভাইফোঁটাতে ভাইদাদার সাথে বিকালে সিনেমা দেখতে যাবো | ভাইদাদা কখন আসবে গো পিম্মা ?”
-“ আসবে রে আসবে | কোথায় যে গেলো বন্ধুদের সাথে | বলছে একেবারে এখানেই আসবে | হ্যাঁ রে মিন্টি কি নিবি ভাইদাদার থেকে ?”
-“ সে তোমায় বলবো কেন ? আসুক ভাইদাদা , বলবো তখন |”
-“পাকা বুড়ি |”
আদরে গাল ধরে চুমু এঁকে দেন অনিতা ভাইঝির গালে |
ভাইয়ের কাছে এসে বসেন আবার |
-“ফোন করলাম রে দিদি | এতো এক দঙ্গল গেছে মনে হচ্ছে | হই হট্টগোল হচ্ছে খুব | ভালো করে শোনা গেলো না | চাপ নিস না | ঠিক থাকবে | এতো জন গেছে, একটু আমোদ-আহ্লাদ তো করবে !”
অনিতা চুপ করে থাকেন | কি করে যে বোঝান কেন তার এত অস্থির লাগছে | নিজেও এর কারণ বুঝে পাচ্ছেন না |
রাত পোহালেই কালী পুজো | বাচ্চাগুলো এখন থেকেই ফুলঝুড়ি পটকা নিয়ে মেতে উঠেছে | রাত যথেষ্ট হয়েছে | বিছানায় শুয়ে উসখুস করছেন অনিতা | ঘুম আসছে না | বাবলাকে ফোনেও পেলেন না | নট রিচেবেল বলছে সমানে | সেই কোন ভোরে বেরিয়েছে , সারাদিনে একটা ফোনও করলো না ছেলেটা | এখন চেষ্টা করেও ফোনের লাইন পাচ্ছেন না | এতো দুশ্চিন্তা নিয়ে কি আর ঘুম আসে ! আজ রাতটা এইভাবেই কাটবে বোধ করি | কেন যে বোঝে না ছেলে-মেয়েগুলো …বাপ-মায়ের কথাও বাসি লাগে , তাদের মনের চাপান-উতরোনটাও বুঝতে চায় না | একটা সময়ের পরে তো আর শাসন চলে না ! বুঝিয়েও যদি না কথা শোনে… তখন শুধুই দীর্ঘশ্বাস!
সারাদিন হুটোপাটি, বাচ্চাদের কলকাকলি .. বাড়ির সামনেই বড় প্যান্ডেল | বারান্দায় বসেই পুজো দেখা হয়ে যায় | আজ রাতে আবার জলসা হবে | দেদার আয়োজন | বড় বড় আর্টিস্ট আসবে নাকি ! ছেলে মেয়েদের উত্তেজনা তুঙ্গে একেবারে | বারান্দায় এসে বাচ্চাদের মাতামাতি, কম বয়সী ছেলে মেয়েদের বাহারি সাজগোজ দেখতে দেখতে মন চলে যায় পিছনে | বাবলা কি বায়না করতো ছোটবেলায় .. বাজি-পটকাতে খুব ভয় ছিলো .. ফুলঝুড়ি ছাড়া হাতে নিতোই না কিছু | শুধু বায়না ছিলো ক্যাপ আর বন্দুকে | বাক্স বাক্স ক্যাপ ফুরিয়ে যেতো আর বায়না, পয়সা দাও মা…ক্যাপ কিনবো | ক্যাপের আর কত দাম ! দুটো পয়সার জন্য ছেলেটা পিছু পিছু ঘুরতো আর বায়না জুড়তো |
ঠোঁটের কোনে হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে | কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলো ছেলেটা | বড় আফসোস হয় ওই দিনগুলো ফিরে পাওয়ার জন্য , ওই দুই হাতের বেড়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরা.. গায়ে মিষ্টি পাউডারের আর দুধের গন্ধ …. সব কেমন সময়ের সাথে হারিয়ে যায় |
-“দেবা , ব্যস্ত নাকি রে ?”
-“ না বল , এই কাগজ পড়ছিলাম |”
-“চা টা ধর | বেলা তো অনেক হলো | চা টা খেয়ে নিয়ে চান সেরে নে |”
-“হ্যাঁ এই যাই | কত তাড়াতাড়ি বেলা পড়ে যাচ্ছে | বাবলা কি বলছে ? কখন আসছে? আজ রাতে নাকি কাল ! পাঁঠার মাংস আনবো বুঝলি দিদি .. জমিয়ে খাবো মামা ভাগ্না |”
উত্তর না পেয়ে কাগজ থেকে মুখ তুলে চায় দেবা |
-“ কি রে দিদি.. বাবলা ফোন করেনি তোকে ? কথা হয়নি তোদের ?”
বুকের ভিতরের জমা ছটপটানিটা বেরিয়ে আসে চোখের জলে…
-“ না রে দেবা… কাল সারা রাত ওকে ফোনে পাইনি | সকাল থেকে তো ফোন বন্ধ বলছে |”
-“ সেকি ! বলিসনি কেন আমায় ?”
-“ সকাল থেকে এত ব্যস্ত থাকিস তুই | পুজোর সেক্রেটারি তো ! তাই…”
-“ আরে, তাই বললে হয় ! বলবি তো আমায় !! আর কোনো নম্বর আছে ?”
-“ হ্যাঁ | বাবলা ওর এক বন্ধুর নম্বর দিয়ে গেছিলো | এই যে কাগজটা | এখানেও চেষ্টা করে যাচ্ছি | ফোন তুলছে না |”
-“ দে দে.. চেষ্টা করি | নাহলে থানায় যাব |”
ফোন লাগানোর চেষ্টা চলতে থাকে | ফোন বেজে যায়.. ওই প্রান্তে কারুর সাড়া পাওয়া যায় না | এপ্রান্তে চলতে থাকে নিরন্তর প্রচেষ্টা আর দেবার অস্থির পায়চারি |
বার ছয়েক চেষ্টার পরে সাড়া মেলে ওই প্রান্ত থেকে … একটি চিকন গলা | ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে দেবা চলে যায় বারান্দাতে | ঘরের এক কোনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অনিতা | বুকটা এতো ধড়াস ধড়াস করছে কেন ?
-“ মানে টা কি ? কি বলতে চাইছো টা কি তুমি ?”
ভাইয়ের চিৎকারে ছুটে আসেন অনিতা | পিছু পিছু মিন্টি আর তার মা |
-“ কি হলো ! কি বললো ফোনে !!”
আর্তনাদ করে ওঠেন অনিতা |
-“ থানায় যাবো আমি এক্ষুনি | আরে ছোঁড়াটা বলে কিনা ,বাবলা ওদের সাথে যায়নি ! ওরা জানে না বাবলা কোথায় আছে ?”
-“ মানে !!”
মাথাটা টলে যায় | সামনে সব কিছুই দোদুল্যমান! মিন্টির মা এসে জাপটে ধরেন ননদকে | জ্ঞান হারান অনিতা |
গেঞ্জিটা গলিয়ে এক ছুটে বেরিয়ে যায় দেবা | হাতে সময় নেই | ক্লাব থেকে কিছু ছেলে তুলে এক্ষুনি থানায় যেতে হবে |
দীপালি মহা বিপদে পড়েছে | মিন্টির বাবা সেই যে থানায় গেছে তো গেছে, ফেরার আর নাম নেই | ফোন ও তুলছে না | এদিকে দিদি তো ঘনঘন মূর্ছা যাচ্ছে | মিন্টি আর বান্টিকে ওদের পিসির কাছে বসিয়ে রেখে ঘরবার করছে দীপালি | একবার অন্তত স্বামীর সাথে কথা বলতে পারলে শান্তি পেতো | কি যে হলো বাবলাটার !! ঈশ্বর করুন যেন ছেলেটার কোনো ক্ষয়-ক্ষতি না হয় | দিদির যে ওই একটি মাত্র সম্বল |
এমন টালমাটাল অবস্থায় মিন্টির মাথা যে বেশ ঠান্ডা থাকে , আজ সেটা চাক্ষুস করলো দীপালি | দিদিকে সামলাতে যখন হিমসিম খাচ্ছে সে, মিন্টি এক দৌড়ে পাড়ার মিত্তির ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসেছিলো | ভাগ্গিস ! ডাক্তারের ইঞ্জেকশনে দিদি এখন নিতালে ঘুমাচ্ছে | তবে সে আর কতক্ষণ ! ডাক্তার বলে গেছে, দিদি বড় শক পেয়েছে , একটু সাবধানে চোখে চোখে রাখতে | এখন মিন্টির বাবা যদি একটা ভালো খবর আনতে পারে !! হে মা কালী, দয়া করো মা |
রাত প্রায় একটা | অনিতা এখনো ঘুমে তলিয়ে | ইনজেকশনটা হয়তো ভারী ডোজের দিয়েছে ডাক্তার | নাহলে এতক্ষণ ঘুমায় ! কেমন যেন অজ্ঞানের মতো পড়ে আছে দিদি | মিন্টি পিসির পাশেই শুয়ে পড়েছে | দীপালি বান্টিকে কিছু খাইয়ে ঘরে পাঠিয়েছে | ছেলে মেয়ে দুটো অন্তত বিশ্রাম নিক | এই অবস্থায় ওদের শরীর খারাপ হলে মুশকিল | আজ আর দাঁতে কিছু কাটা হলো না | মিন্টিকে অনেক কষ্টে অল্প খাওয়াতে পেরেছে | পিসি অন্ত প্রাণ মেয়ের | মুষড়ে পড়েছে | খুব স্বাভাবিক |
অপেক্ষাতেও বোধকরি ক্লান্তি আসে | চোখ লেগে এসেছিলো | হঠাৎ……
-“দীপা ওঠো |”
ধড়মড় করে উঠে বসে দীপা..
-“কি হলো গো? খবর পেলে কিছু ?”
-“বাইরে এসো |”
শব্দ নয়, এ যেন ভেসে আসা বার্তা ….. চারপাশে হাওয়া যেন আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেলো | বড্ড গুমোট লাগছে | স্বামীর পিছুপিছু বাইরে বেরিয়ে আসে দীপালি |
স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে | দেবার মুখ এত পাংশু কেন? স্বামীর বুকের উপর হাত রাখে দীপালি …..
-“কি গো, সব ঠিক আছে তো?”
-“নাহ দীপা, কিচ্ছু ঠিক নেই, কিচ্ছু ঠিক নেই |”
ডুকরে কেঁদে ওঠে দেবা | দীপালি হাত চাপা দেয় স্বামীর মুখে |
-“করো কি ! দিদি উঠে পড়বে যে !!”
-“বাবলা নেই দীপা, বাবলা নেই…”
গোঙানি ভেসে বেড়ায় বাতাসে | দীপালির চাপা হাতের ফাঁকে বেরিয়ে আসা শব্দগুলো দেবা আর দীপালিকে ঘিরে বনবন ঘুরতে থাকে…. কানে শুধুই অনুরণন হয়, নেই..নেই…নেই …
অনিতার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না | খবরটা পাওয়ার পরে খালি হয়ে যাওয়া মায়ের বুকের হাহাকার , আর্তনাদ উৎসবমুখর দিনরাত্রির সর্ব-শরীরে একরাশ আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে | সর্বহারা মায়ের আছাড়ি-পিছাড়ি কান্নায়, উন্নত্ত প্রলাপে চারপাশের জমাট কালো অন্ধকার ক্রমে ক্রমে ঘন থেকে ঘনতর হয়ে চলেছে |
বাবলা কথা রেখেছে | ভাইফোঁটার দিনেই এসেছে | লাশকাটা ঘর থেকে সরাসরি মায়ের কোলে | একমাত্র সন্তানের থ্যাঁতলানো মুখ, ঘিলু বেরিয়ে আসা ফাটা মাথা দেখে কোনো মা স্থির থাকতে পারে কিনা জানা নেই….. কিন্তু অনিতা পারলো | পারলো পাথর হয়ে যেতে | যে মায়ের সুতীব্র হাহাকারে ভারী বাতাস তার অশ্রু ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছিলো, যে মায়ের দুচোখের জ্বালাধরা দৃষ্টি সবাইকে নতমস্তক হতে বাধ্য করছিলো, যে মায়ের “কেন, আমি কেন” প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারেনি ….. যে মায়ের সন্তানের বীভতস মৃতদেহকে পরম মমতায় আদর করে আঁচল দিয়ে মুখের চারপাশে লেগে থাকা রক্তের দাগ মুছিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টার দৃশ্য দেখে আশেপাশের সবাই চোখে আঁচল চাপা দিয়েছিলো … সেই মায়েরই নিথর হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাকেও মেনে নিতে পারার মতো সহনশীলতা কি ছিলো কারুর ?
প্রকারান্তে সকলেই হয়তো মনেমনে পাথর হয়ে গেছিলো | কি বলে স্বান্তনা দেবে এই অভাগী মাকে? কি ভাবে গিয়ে হাতটা ধরবে? একমাত্র মিন্টিই পিসিকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে বসে আছে | পারলে হয়তো এই মেয়েটিই পারবে বুকের ভিতরের ফল্গুধারাকে বরফ না হতে দিতে |
দাহ-কার্য সমাপ্ত করে ফিরে এসেছে দেবা | ক্লান্ত বিদ্ধস্ত শরীরটা এগিয়ে দিয়েছে সোফাতে |
অনিতা সামনে এসে দাঁড়ালেন |
-“বল..”
-“কি বলবো !”
দিদির মুখের দিকে তাকানোর ক্ষমতা নেই দেবাশীষের |
-“ওরা কেন মারলো বাবলাকে?”
চমকে উঠলো দেবা | দিদি কি বলছে এসব !! তাহলে কি ………!!!
-“দিদি এটা তো এক্সিডেন্ট |”
হাত তুলে ইশারায় থামায় দেবা তার স্ত্রীকে | দিদির মুখোমুখি তাকেই হতে হবে |
-“আমি জানি দিদি তুই কি ভাবছিস | আমিও মানতে পারছি না যে এটা কোনো এক্সিডেন্ট | এতোজন গাড়িতে ছিলো… কি এমন এক্সিডেন্ট হলো যে সবাই ঠিক আছে, আর একমাত্র আমাদের বাবলা এত উন্ডেড হলো যে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হলো ?”
-“বাবলার বন্ধু ফোনে কেন বলেছিলো বাবলা নেই ওদের সাথে ?”
-“তুই বোস দিদি | আমি সব খুলে বলছি তোকে |”
বাধ্য মেয়ের মতো অনিতা এসে বসলেন ভাইয়ের পাশে |
-“আমি শুরু থেকে সবটা বলছি তোকে | থানায় গিয়ে আমি রিপোর্ট করি আগে | আমার জানাশোনা কিছু লোকজন আছে বলেই চটপট কাজ শুরু হয়েছিল | হাতে বাবলার ওই বন্ধুর ফোন নম্বর ছাড়া আর তো কোনো ক্লু ছিলো না আমাদের কাছে | আর পুলিশি জেরা তো ভয়ানক ! তখনই ছেলেটার পেট থেকে কথা বার করে নিয়েছিলো |”
অনিতা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সামনে লাইন দিয়ে চলা এক সারি পিঁপড়ের দিকে |
দীপালি প্রশ্ন করে..
-“ছেলেটা আমাদের তাহলে উল্টোপাল্টা বললো কেন?”
-“ছেলেটা নাকি বলতে চেয়েছিলো যে বাবলা আমাদের মধ্যে আর নেই | তার বদলে বলেছে যে আমাদের সাথে নেই |”
-“বাজে কথা | পুলিশের সামনে সত্যি বেরিয়েছে |”
-“আমরা তারপর জানলাম, বর্ধমান হাইওয়ের উপরে কোন একটা ভেড়ি আছে, তার আশেপাশে শুনশান কোনো জায়গায় গাড়ি নাকি এক্সিডেন্ট করেছে | এতো ভয়ানক এক্সিডেন্ট হয়েছে যে গাড়ি নাকি দুবার পালটি খেয়েছে |”
-“গাড়ি দুবার পালটি খেয়েছে ?? আর বাবলা ছাড়া বাকি সবাই একদম ঠিক আছে ? এটা কাকতালীয় নাকি গল্প?”
-“সেটাই তো ! জায়গাটার নাম নাকি হিরাপুর | থানা থেকে সাথে সাথে সেখানে যোগাযোগ করা হয়েছিল | মানে হিরাপুরের লোকাল থানায় |”
-“কি বললো?”
-“কি বলবে বলো? কাল গেছিলাম তো হিরাপুরে | আমাদের থানার এসি দত্ত সাহেবের সাথেই গেছিলাম | সেখানে তো ব্যাপার স্যাপার অন্য দেখলাম | বাবলাকে নাকি পোস্ট মর্টেমে পাঠিয়েও দিয়েছে | অদ্ভুত ব্যাপার | বাড়ির লোককে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলো না হিরাপুরের পুলিশ | গাড়ির ড্রাইভারকে নাকি পাওয়া যায়নি | ফেরার |”
-“ফেরার মানে কি? বাবলার বন্ধুদের কাছে তো নাম ঠিকানা থাকবে ড্রাইভারের |”
-“না নেই | বন্ধুদের বক্তব্য ড্রাইভার নাকি বাবলা ঠিক করেছিল | বাকিরা নাকি কিছুই জানে না |”
-“মানে টা কি?”
-“প্রচুর গোলমাল আছে দীপা | ড্রাইভার নাকি তার বউ নিয়েই গেছিলো | বাবলারা প্রায় জনা সাতেক ছেলে মেয়ে ছিলো একসাথে | বুঝতেই পারছো, বেশ বড় গাড়ি নিয়ে গেছিলো |”
-“মেয়েও ছিলো নাকি? আর ড্রাইভারের বউ গেছে মানে? ড্রাইভার ওদের বন্ধু নাকি? তাহলে ড্রাইভারের খোঁজ-খবর শুধু বাবলার কাছে থাকবে কেন? সবার কাছেই থাকা উচিত |”
-“সেই খানেই তো সন্দেহ দীপা | গোলমাল তো সেই খানেই | আর শুনলাম ড্রাইভারের বউ ছাড়াও দুটো আরো মেয়ে ছিলো ওদের সাথে | আর ড্রাইভারের সাথে ওর বৌও ফেরার |”
-“কি বলছো গো তুমি ? হাত পা কাঁপছে আমার | একি প্রেম ঘটিত ব্যাপার কোনো?”
-“একথা যে মাথায় আসেনি তা নয় | কোনো প্রমান তো নেই | অন্ধকারে হাতড়াচ্ছি আমরা | আরো গোলমাল কি জানো? বাবলার বন্ধুদের মধ্যে উঁচুতলার কারুর ছেলে ছিলো | তাই সবকিছুই চোখের নিমেষে জলের মতো সমাধান করে দিলো হিরাপুরের পুলিশ |”
-“আমাদের ওসি? দত্তবাবু? উনি কিছু বললেন না ?”
-“উনি আর কি বলবেন দীপা | থানায় ডায়েরি করতে বললেন | ঘটনাটা ঘটেছে হিরাপুরে | ওখানকার পুলিশের দায় সব | এখানে আমরা বড়জোর এফ আই আর করতে পারি |”
লাইনে চলা পিঁপড়েগুলোর বোধহয় কাজ শেষ হয়ে গেছে | হয়তো তাদের লক্ষ্যপূর্ণ হয়ে গেছে | ধীরে ধীরে ছত্রভঙ্গ হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে, ফিরে যাচ্ছে তাদের ডেরায় |
সেদিক থেকে চোখ না সরিয়ে অনিতা জানতে চাইলেন,
-“বাবলার ফোনটা কোথায়?”
-“বাবলার ফোন নাকি পাওয়া যাচ্ছে না দিদি | ওই ফোনেই নাকি একমাত্র ড্রাইভারের ডিটেলস ছিল সব | তাই পুলিশ ড্রাইভারকে ধরতে পারছে না | আমাকে তো হিরাপুরের ওসি বললেন, ‘এটা সিম্পল এক্সিডেন্ট কেস | দুর্ভাগ্য যে একটি তরতাজা ছেলেকে অকালে চলে যেতে হলো | ফোনটা আমরা হাতে পেলে এতক্ষণে ড্রাইভারকে ধরে লকাপে পুরতাম | তবে ভাববেন না, আমাদের নেটওয়ার্ক ছড়ানো আছে | যাবে কোথায় বাছাধন !’………”
-“এমন এক্সিডেন্ট হলো যে সবাই ঠিক থাকলো আর বাবলার মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে মুখ থেঁতলে এতো ভয়ঙ্কর হয়ে গেলো ?? আর এটা সিম্পল এক্সিডেন্ট কেস?”
গর্জে ওঠে দীপালি ….
-“আমরা ছা-পোষা মানুষ দীপা | আমাদের কতটুকু ক্ষমতা ? বড় বাপের ছেলে ছিল বলেই না এতো সহজে সবকিছুর সমাধান হয়ে গেলো !”
চাপা নিস্তব্ধতা ঘর জুড়ে ……………. শুধু কান পাতলে শোনা যাবে বিষন্ন দীর্ঘশ্বাস ………
অনিতা উঠে দাঁড়ালেন | পিঁপড়ে গুলো সব ঘরে ফিরে গেছে | খাদ্যের সন্ধানে ছিলো বোধ হয় | তাদের কাজ শেষ, তাই ফিরে গেছে ঘরে | অনিতারও সব কাজ সমাধা | এবার তারও ঘরে ফেরার পালা | আর কোনো কাজই রইলো না আর তার |
-“দিদি !!” কাতর স্বরে পিছু ডেকে ওঠে দেবা |
অনিতা ফিরে তাকান |
-“আমরা কেস করবো দিদি | যত বড় ঘরের ছেলেই থাকুক | টাকা দিয়ে সত্যি চাপা দেওয়া যাবে না | আমরা লড়বো দিদি | একসাথে লড়বো |”
-“কি হবে আর দেবা? বাবলা কি আর ফিরে আসবে? মাঝখান থেকে সত্যি বেরিয়ে আসলে হয়তো আরো মায়ের কোল খালি হবে | কি দরকার ! থাক না !! এই কোল খালি করার লড়াইটা নাহয় এবার থামুক |”
ধীর পায়ে এগিয়ে চলেন অনিতা | ঘরের দোরে মিন্টি দাঁড়িয়ে আছে | হাত বাড়িয়ে দেয় তার আদরের পিম্মার দিকে | মিন্টির বাড়ানো হাত আলতো ছুঁয়ে উষ্ণ স্পর্শ খোঁজেন অনিতা | সন্তানের উষ্ণ ওম |
এক হাত দূরে অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্বামী-স্ত্রীর কাছে এই মুহুর্তে অনিতাকে অনেক দুরের কোনো মানুষ বলে ভ্রম হয় | যার কাছে পৌঁছাতে গেলে এই মুহুর্তে হয়তো অনেক আলোকবর্ষ হেঁটে যেতে হবে |
বাইরে থেকে ভেসে আসে হুল্লোড় | বেপাড়ার ছেলেরা হাসি তামাশা হুল্লোড়ে গানে মেতে ঘরে ফিরছে | মায়ের বিসর্জন হয়ে গেলো যে !!!…