বিবাহ ! কত আশা, আকাঙ্খা আর প্রত্যাশা থাকে এই একটি বিষয় নিয়ে। মেয়ে শিশুগুলো খেলনা ঘটি বাটি নিয়ে খেলা করতে করতে শিখে সংসার সাজানো। মেহমান আসবে চা খাওয়াব, তারা সাজানো সংসার দেখে চোখ কপালে তুলবে। মেয়েরা আমাদের সমাজে বেড়ে ওঠে এরকম কত স্বপ্ন নিয়ে? সংসার – তাতে কত না জানি আনন্দ। আহারে! তার উপর যদি হয় প্রেমের বিয়ে তাহলে তো কথাই নেই। একই সাথে ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাবার আনন্দ আর সুন্দর সংসারের আকাঙ্খা – সব মিলিয়ে বর্ণিল স্বপ্ন ভরা তরুণ-তরুনীদের হৃদয়, যেন এক একটি তাজমহল।
সেরমই এক তরুন-তরুনী, বিভা আর বিনয় এর বিবাহ। তাদের বহুদিনের পরিচিত, ঘনিষ্ট বন্ধু, তার পর ভালোবাসা আর এখন তারা বিয়ে করতে যাচ্ছে। তাদের পরিবার প্রথমে রাজি ছিল না। পরে তাদের দাবির সামনে দুপক্ষই একমত হয়েছে যদিও শেষমেষ পারিবারিক বিয়ে, বিভা আর বিনয়কেই করতে হচ্ছে ওদের বিয়ের আয়োজন। ওরা দুজনই স্বাবলম্বি। পরিবারের পক্ষ থেকে ওদের বিয়ের জন্য সবাই রাজি এই ঢের ওদের জন্য। কিছু নিজেদের, কিছু ভাইবোনদের, আর সকলের কাছ থেকে এদিক সেদিক করে মোটামোটি সবকিছুর জোগাড় করে ফেলে তারা।
এবিয়েতে দু’পরিবারের মধ্যেকার সম্পর্কটা অস্পষ্ট, কিছু ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দু’পরিবারের লোক একে ওপরের সাথে দেখা হলে ছোট করে হয়ত একটু ভাবের আদান-প্রদান করে তার পর যে যার দিকে হেটে চলে যায়। একই শহরের দু’টি, একই ধরনের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবার দেখা তো হরহামেশাই হচ্ছে।
বাংঙ্গালী বিয়ে কি চারটিখানি কথা সামান্য করে করলেও হলুদ, বিয়ে আর বৌভাত তো করাই লাগে। ছেলের হলুদে মেয়ে পক্ষ যে পাঞ্জাবিটি নিয়ে গেল, তা কারো পছন্দ হলো না ও বাড়িতে। ছেলের আংটি, তাও না। ছেলের হলুদের দিন মেয়ে পক্ষ ছেলে পক্ষের আতœীয়স্বজনদের চোখমুখ দেখেই ঠান্ডা। বিভার মামা বাড়ি ফিরে বিভাকে বলল, তুই এই বিয়ে করিস না। ওরা শিক্ষিত হলেও ভদ্্র মনে হলো না। এই ধরনের কথা বিভা এর আগেও অনেক শুনেছে ওর অন্য আতœীয়স্বজনদের মুখে, বাবা-মার মুখে কিন্তু সে এসব পাত্তা দেয় না। তার সাথে বিনয়ের কথা হয়েছে বিনয় বলেছে তার বাবা-মা মুখে এদিক সেদিক বললেও মানুষ খুব ভালো।
বিয়ের দিন – সবই ঠিক কিন্তু ছেলে পক্ষের লোকের মুখ ভারী, কেন? কে জানে, বিভা কিন্তু খুশি, কারণ সে জানে বিনয় সব সামলে নেবে। বিয়ে শেষে বিনয় বউ নিয়ে ঘরে ফেরে। বাড়ী ভর্তি মানুষ। কেউ কেউ তো বিভাকে দেখে পলকই ফেলতে পারে না। বাবা! একেতো ইঞ্জিনিয়ার মেয়ে তার উপর অপরূপ সুন্দরী, যেন একটি প্রতিমা বসে আছে। বিভা লক্ষ্য করে তার শ্বাশুরীর কোন ক্লান্তি নেই সে একনাগারে রান্না করেই যাচ্ছে। এক ফাকে তার কানে আসে তিনি বলছেন ’মানুষ মরে গেলে মরা বাড়ীতেও খাওন লাগে। আর এ তো বিয়ে বাড়ী।’ বাড়ীতে একটি মাত্র ছোট কাজের মেয়ে তাকে নিয়ে কাজ করে চলেছে তার শ্বাশুড়ী। তবে ও বাড়ীর মেয়েরা কিছু করছে না। বিভা কিছুটা আচ করতে পারে এবাড়ীর নিয়ম।
এ বাড়ীতে নাকি জোড়ে হাসা নিষেধ। তার শ্বশুর পছন্দ করে না। বিভা একথা তার ননদের মুখে শুনে তো অবাক। হাসার উপর কি সরকার টেক্স নেয় নাকি যে জোড়ে হাসা যাবে না। কি আশ্চর্য নিয়ম! বিভার শ্বশুরবাড়ীর নিয়ম অন্যরকম। এসব নিয়ম বুঝে নিতে অনেক সময় লাগে বিভার। ততদিনে বাবার বাড়ী ফিরে যাবার সময় হয়ে যায়। তাদের পারিবারিক প্রথা আড়াই দিন পর মেয়েকে ফিরতি নিতে আসে, মেয়ে বাড়ীর লোক।
এই আড়াইদিনে কি ঘটল তা ফিরে ভাববার সাহস হয় না বিভার অজানা আতন্ক ছেয়ে যায় তার বুকে। মুখে শুধু একটি কথা ’আমি এ কি করলাম’। অভাব অভিযোগ, বিপদ হলে কাটিয়ে উঠা যেত কিন্তু মানুষের মনের ভিতরের কুসংস্কার কিভাবে মুছে দেয়া যেতে পারে। বাইরের লোকেদের এমন হলে মেনে নেয়া যেত কিন্তু নিজের ঘরের মানুষ কিভাবে এমন হলে সহ্য করা যায়। বিভা তো এভাবে বেড়ে ওঠেনি।
বিভার বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। তার একটি ভাই আছে। তার বাবা-মার স্বপ্নের মতো সাজানো সংসারে সে বড় হয়েছে। তার বাবা কখন তাদের দুই ভাই-বোনকে একটি আচড়ও কাটেনি। অথচ ওর শ্বশুর কথায় কথায় তার ছেলেমেয়েদের ভৎসনা করছেন। বিয়ের আজের মধ্যেই এমন তাহলে স্বাভাবিক অবস্থায় না জানি কেমন।
২
বিভার বাড়ীর লোকজন এসেছে। তারা বসে আছে একসাথে। বিভাকে আর কিছুক্ষনের মধ্যে নিয়ে যাবে ফিরতি। সকলের খাওয়া-দাওয়া শেষ। হঠাৎ বিভার শ্বশুর তার বাবাকে বলে, মেয়েকে তো খালি হাতেই পার করে দিলেন। বিভার বাবা নিজেকে সমলায় কয়েকমুহুর্ত তারপর বলে ‘ ওরা সংসার শুরু করুক আমার সামর্থ্য অনুযায়ী সবই দেব আমি আমার মেয়েকে। বিভা আমার অনেক আদরের মেয়ে।’
বিভার বর দাড়ানো। সেও অস্বস্তিতে পরেছে।
বিভা আর থাকতে পারে না। যদিও আড়াই দিন কিন্তু এ আড়াই দিন মানে বিভার জীবনের সবচেয়ে অস্বস্তি আর কষ্ঠের সময়।
বিভা তো টাকা সয়-সম্পত্তি চায়নি। চাইলে এর চেয়ে ভালো বর ও পেতে পারত। সে নিজেকে গুছিয়ে নেয়। সে ভাবে – আজ যদি বলতে পারি সবার সামনে তাহলেই নারী হয়ে সকল নারীর জন্য র্সাথ্যক হবে আমার পথ চলা।
শক্ত হয়, বাড়ী ভর্তি মানুষ। সাহস করে। সবার সামনে পষ্ট করে বলে ‘আপনারা এসব কি বলেন আমার বাবা আমাকে কিছুই দিবে না। আমিও আমার বাবার কাছ থেকে কিছু নেব না। আমার নতুন সংসার আমি আর আমার স্বামী মিলেই সাজাবো। তার জন্য সকলে আপনারা দোয়া করবেন।’
বিভার শ্বশুর বাড়ীর মানুষের মুখ আগুন হয়ে ওঠে। ওরা বলে ‘দেখছ কত বড় সাহস মুরুব্বীদের মধ্যে কথা কয়। বউ মানুষ চুপ করে থাকবে।’ ’মাফ চাও তুমি তোমার শ্বশুরের কাছে।’ তারা চাপ সৃষ্টি করে বিভার ওপর, যে বিভা দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চায়। বিভা আরো শক্ত হয়। প্রয়োজনে সে সব কিছু ছাড়বে কিন্তু অন্যায় আবদার কিংবা যৌতুক সে দিতেও দেবে না নিতেও দেবে না। বিনয় বিভার ভাব মুঝে যায়।
বিনয়ের বাবা বলে এ বউ আমরা রাখবো না। আপনারা আপনার মেয়ে নিয়ে যান।
অপমানে বিভার চোখ ছলকে যায়, কিন্তু সে কোনোদিকে দেখে না। সে চলে যেতে তৈরী। সে শিক্ষিত, স¦াবলম্বী। কেউ যদি ঠাই নাও দেয়। সে একা চলতে পারবে। বিভার মা হতাসায় অস্তির হন, তিনি বলেন এসব কি করছিস। ক্ষমা চা। বিভা বলে তোমরা যদি আমাকে না রাখ তাহলে আমি একা থাকব আজীবন। কিন্তু অন্যায়ের হতে দিব না।
কোনো গতি না দেখে শেষ মেষ বিভার বাবা-মা বিভাকে নিয়ে রওনা হন বাড়ী ফিরতে। হায়! এভাবে তো তারা ফিরতে চাননি। বিভার বাবা-মার হৃদয় বিপন্ন হয়ে ওঠে। তাদের সোনার টুকরা মেয়েটার জীবন শুরু না হতেই এভাবে শেষ হয়ে গেল! তারা সবাই এক এক করে আসতে থাকে গাড়ীর দিকে ফিরার পথে।
বিভা যখনই দুয়ার পার করে বিনয় বলে দাড়াও। যেখানে তুমি থাকবার অনুমতি পাবে না সেখানে আমিও থাকবো না।
৩
দুপুরের রোদে খেলছে দু’টি সোনামনি। একটি ছেলে একটি মেয়ে। তারা দিনের বেলাটা তাদের দাদা দাদুর কাছেই থাকে। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে তাদের মা। দু’টো ছেলেমেয়ে যেন দাদা-দাদুর দু’ চোখের মনি। দাদি তাদেরকে গল্প শোনায় ”বাববা তোদের মার যে রাগ, যে সাহস!”
আমাদের বিভা এখন বিরাট বড় একটি চাকরি করে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তখনও লড়ত এখনও লড়ে। কখনো নিজের জন্য, কখনো অন্যের জন্য। নিজের অধিকার মাঝে মাঝে নিজেকেই আদায় করে নিতে হয়। কেউ সেধে হাতে ধরিয়ে দেয় না। বিশেষ করে আমাদের সমাজে মেয়েদের।