বিকল্প – ছোট্ট এই শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে মানব সভ্যতার ইতিবৃত্ত। আভিধানিক অর্থ—পরিবর্তে কল্প, বিভিন্ন কল্পনা। বি( বিভিন্ন ) কল্প (বিধান)। অর্থাৎ বর্তমানের পরিচিত গণ্ডির বাইরে গিয়ে নতুন কিছুর চিন্তা ভাবনা করা, কল্পনা করা। এই সৃজনীকল্পনা, উদ্ভাবনীশক্তিই হল বিজ্ঞানের আধার। সেই কল্পনা, সেই ভাবনা, কখনো কখনো যুক্তি তর্কের পরোয়া না করে আপন খেয়ালে তৈরি করে ইচ্ছাপূরণের এক একটি স্বপ্নপুরী।
সভ্যতার আদিপর্ব থেকেই মানুষ উন্নততর জীবনের সন্ধানে সচেষ্ট। এই সন্ধান বিকল্পের সন্ধান, যা সভ্যতার ক্রমবিকাশের চাবিকাঠি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যা আছে, যেভাবে আছে তার পরিবর্তে আর একটু ভাল, একটু উন্নততর কিছুর সন্ধান। বর্তমানের জানা, দেখা, বোঝার ভিতের উপরে গড়ে ওঠে বিকল্পের কাঠামো। কিছু মানুষের আজীবন পরিশ্রম, গবেষণা এবং তজ্জনিত যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে পর্যায়ক্রমে আমরা খুঁজে পেয়েছি বিকল্পের নানান সম্ভার এবং আরোহণ করেছি সভ্যতার পরবর্তী সোপানগুলিতে। প্রাতঃস্মরণীয় এই বিজ্ঞানীদের অসংখ্য তত্ত্ব আর সমীকরণের সমাহারে এগিয়ে চলেছে সভ্যতার সিঁড়িভাঙ্গা। বিজ্ঞানীদের এই জটিল কর্মকাণ্ডে গণনা আছে, ভাবনা আছে, আছে গতি, স্থিতি, অক্ষ, তুলনা, মৌলিক, যৌগিক, অম্ল, ক্ষার, শক্তি এমন অনেক কিছু, কিন্তু কল্পনার জায়গাটা খুব সীমিত।
কল্পনা ডানা মেলে উড়ছে শিল্পী, সাহিত্যিক ও অসংখ্য কল্পনাবিলাসীর মনে। কল্পনাকে অবলম্বন করেই তৈরি হয়েছে রূপকথার জগত, ফেয়ারি টেল, আরো আনেক পরে সায়েন্স ফিক্সানের উপর অজস্র গল্প উপন্যাস।
কল্পনাবিলাসীরা ভাবে বিজ্ঞানীরাও ভাবে। বিজ্ঞানীদের ভাবনা যুক্তির সীমারেখাকে অতিক্রম করতে পারেনা। কারণ, তাদের শুধু ভাবলেই হবে না ভাবনাটাকে বাস্তবায়িত করার একটা দায় থাকে। কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকেরা সে দায় থেকে অনেকটাই মুক্ত। অসীম ধীশক্তির উন্মুক্ত সঞ্চালনজাত যে রত্নসম্ভার তাঁরা যুগে যুগে সমাজকে উপহার দিয়েছেন তারই ছটায় মানুষ সন্ধান পেয়েছে এক অনন্ত কল্পলোকের। নিজ নিজ জ্ঞান, বুদ্ধি, ভাবনার রথে চড়ে তারা পরিক্রম করেছে তার নানা অলিন্দ। এ ছাড়াও আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে ছিল বহু চারণ কবি ও কথক যাদের মুখে মুখে লোককথা এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে সঞ্চারিত হয়ে এসেছে। এরাও ছিলেন স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
মানুষ পশুকে বশ করে নানাভাবে ব্যবহার করেছে। তার মধ্যে মুখ্য হল বাহন রূপে প্রয়োগ। পরে পশুর সাথে জোড়া হয়েছে শকট। ধীরে ধীরে তাতেও ক্রমান্বয়ে এল পরিবর্তন। পরে পশুর পরিবর্তে এল বাষ্প, পেট্রল, ইলেকট্রিক, আনবিক ইঞ্জিন। এগুলো সবই বাস্তব, অত্যন্ত রকম বাস্তব, এসেছে এক একটি যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সৌজন্যে। এতে সুচিন্তিত ভাবনা আছে, আছে জীবনব্যাপী বিজ্ঞানের অনন্ত সাধনা। কল্পনার অবকাশ ও পরিসর এখানে সীমিত। অপরদিকে কল্পনাবিলাসী অশ্বারোহীর অশ্বের গতিবেগ অথবা অশ্বশক্তি নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। সে অশ্বারোহণের আনন্দ উপভোগ করতে করতে চারিপাশ পর্যবেক্ষণ করে। আনন্দ পায় শ্লথগতির কোন জীবকে অতিক্রম করে যাওয়ার মুহূর্তে। আবার মাথার উপর দিয়ে যখন কোন পাখী ডানা মেলে উড়ে যায় তখন হয় একটু আক্ষেপ – আহা আমি যদি অমন উড়তে পারতাম!
বাস্তবে নেই তো কি আছে। কল্পনায় মেলা ডানা ঘোড়ার পিঠে জুড়ে তৈরি হল পক্ষীরাজ। উড়িয়ে নিয়ে চলল রূপকথার এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে।
অতীতের রূপকথা থেকে আজকের কল্পবিজ্ঞান এ সবই স্বপ্ন দেখা ও দেখানোর এক চিরন্তন প্রয়াস।
এই যে কল্পনা, স্বপ্ন, যা সেই মুহূর্তে বাস্তবের সাথে সম্পর্কহীন কেবলই মনের এক খেলা, তার অনেক কিছুই পরে, অনেক পরে, বিজ্ঞানের হাত ধরে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি ঐহিক জাগতিক সত্ত্বা হিসাবে। আদি যুগে উল্লিখিত পুষ্পক রথ বা ভিনগ্রহের নানান ঘটনার মত অনেক তৎকালীন মনশ্ছবি আজ বাস্তব। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এই চিন্তা, ভাবনা, কল্পনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবকে কোনভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
বিকল্পের সন্ধান প্রতিটি মানুষ তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অহরহ করে। তার পরিচিত পরিবেশ, পরিস্থিতি, প্রতিবন্ধকতা, শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা, মনন ও কল্পনার ছোঁয়ায় নকশা তৈরি হয় সন্ধানের গতিপ্রকৃতির। বিকল্পের সন্ধান মানুষকে উন্নত থেকে উন্নততর জীবে রূপান্তরিত করে চলেছে। এই সন্ধান কেবল বস্তু কেন্দ্রিক নয়। জীবনকে সুন্দরতর করার জন্য যাবতীয় কিছুর সন্ধান। তাই ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে এসেছে সমাজ। এসেছে ন্যায়, নীতি, আদালত, শাসন, শিক্ষা ব্যবস্থা। এসেছে সঙ্গীত, খেলাধুলা ও আরো নানান বিনোদন। সমাজের বহুমাত্রিক বিকাশ সাধনার্থে এসেছে সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি, দর্শন ও আরো কত কিছু। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চলছে বিকল্পের বিরামহীন অনুসন্ধান। প্রতিনিয়তই উন্মোচিত হচ্ছে নতুন বিকল্পের অবয়ব যার কিছু আমরা আত্মস্থ করি কিছু পরিহার করি।
যুগ যুগান্ত ধরে বিশ্বব্যাপী সভ্যতার অগ্রগতির নিমিত্ত এই সাধনার সুফল কিন্তু সমাজ জীবনে সুচারু রূপে প্রতিফলিত এবং প্রত্যক্ষীকৃত হয়নি। যুদ্ধবিগ্রহ, দারিদ্র, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সন্ত্রাস, অপশাসন এর মত নানান উপদ্রবের ফলে নির্মল, সুন্দর পৃথিবী এখনও অধরা। এ তো আমাদের ঈপ্সিত নয়। তাহলে অনাকাঙ্ক্ষিত এই সমস্যাগুলির হেতু কি ?
কারণ একটাই, বিকল্প নির্বাচন এবং তার ব্যবহারে ত্রুটি। রাজনীতিতে এর অনেক উদাহরণ আমরা দেখতে পাই। যে সরকার বা শাসনের উপর বিরক্ত হয়ে মানুষ বিকল্প একটি দল বা ব্যবস্থাকে গদিতে বসাল, কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল তারা পূর্বাপেক্ষা অধিক নিকৃষ্ট। তখন ভ্রম সংশোধনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই। একই পরমাণুর সঠিক ব্যবহারের ঋদ্ধ হয় বিজ্ঞান ও মানব জীবন আবার জিঘাংসার প্রতিরূপ হলে প্রত্যক্ষ করি হিরোশিমা নাগাসাকির ভয়াবহ বিনাশ। সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং তজ্জনিত সন্ত্রাস, এমন অনেক কিছুই শিশু বা কিশোরের মানসিক বিকাশকালে সঠিক শিক্ষার বিকল্পে উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে অসামাজিক মগজ ধোলাই এর ফল। কিছু মানুষ, কিছু গোষ্ঠী এবং বৃহত্তর প্রেক্ষিতে কখনো কখনো কিছু দেশ আপন স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে বিষাক্ত করে সমগ্র বিশ্বকে এবং সেই বিষের যাতনা একসময় তাদেরও দগ্ধায়।
অতএব কেবল বিকল্পের সন্ধান নয়, প্রয়োজন সঠিক নির্বাচন ও ব্যবহারের। ভয় নয়, ব্যক্তি স্বার্থ নয়, আপোষ নয়। অন্যথায় সাময়িক বিচ্যুতিও সভ্যতাকে সঙ্কটে ফেলতে পারে, আবাহন করে আনতে পারে মহা প্রলয়কে।