ছয় বছরের ছোট্ট টিক্লু, ভালো নাম তীলক দে, মামনি জয়া ও বাপি নির্মলের বড় আদরের। সারাদিন বেশ সবার সাথে গল্প করে, দুষ্টুমি করে, হৈ-হৈ করে সময় কেটে যায় তার। সবাইকে বড় আপন করে নিতে পারে টিক্লু, তাই সবাই ভালোবাসে দুষ্টু-মিষ্টি টিক্লুকে। স্কুলের আন্টি-দেরও খুব আদরের সে, কখনও বকুনি খায় না। বন্ধুদের সাথে মাঝেমাঝে আরি হয়ে যায় বটে, কিন্তু আবার টিফিন টাইমে ভাবও হয়ে যায়। বন্ধুদের সাথে টিফিন শেয়ার করে খেতে বড্ড ভালোবাসে টিক্লু। আর মামনিও তার সব বন্ধুদের পছন্দ মতো একেকদিন একেকরকম টিফিন করে দেয় তাকে। স্কুলের গেট দিয়ে বেড়িয়েই মামনির হাত ধরে তিড়িং-বিড়িং করে বাড়ি ফেরার পথে, কখন তার চিপ্স খাবার কি কখনও ফটাফট্ ক্যান্ডির কেনার বায়না হয়। স্কুল বাড়ির কাছে হওয়ায় এইটুকু রাস্তা জয়ার সাথে হেঁটেই যাতায়াত করে টিক্লু। আর সাথে থাকে একগুচ্ছ গল্প, সারাদিন সে কি করল স্কুলে, কোন বন্ধু কি বলল, আন্টি তাকে ‘গুড বয়’ বলেছে কিনা, আরও কত কি! সব বলা চাই মামনি-কে। আবার সন্ধের পর বাপি, নির্মল, অফিস করে ফিরলে, চা খেতে খেতে বাপিকেও শুনতে হয় এইসব গল্প রোজ একপ্রস্থ।
জয়ার সাথে বাড়ি আসার পথে আর বাড়ি ফিরে স্নান করে ভাত খেতে বসার আগে অব্দি একমুখে বকে চলে টিক্লু। ভাত খেতে বসে সে তার বক্বকানি থামায়। তখন যে তার গল্প শোনার সময়। খেয়ে-দেয়ে মামনির পাশে শুয়ে ঘুম না আসা পর্যন্ত একমনে গল্প শোনে সে। দিনের গল্পে মামনি, আর রাতে বাপির পালা। কি ভালো ভালো গল্প বলে মামনি-বাপি। রাজকন্যা-রাজপুত্র, রাক্ষস-দৈত্য, কখন বা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, বীর যোদ্ধা-রাজাদের, আবার কখনও সমুদ্র-মন্থনের, সূর্য-চন্দ্র গ্রহনের, উরো-জাহাজ আবিষ্কারের, আরও কতরকমেরই না গল্প জানে টিক্লু। শুনতে শুনতে কত বিষ্ময়ই না জাগে তার শিশুমনে, জাগে অজানায় পাড়ি দিয়ে তাকে কাছ থেকে জানার কৌতুহল। সে মনে মনে ভাবে কবে বড় হয়ে ভালো করে পড়তে শিখবে, তাহলে এইসব বই সে নিমেষে পড়ে ফেলবে নিজে নিজেই। মামনি-বাপি ভাববে, “বাহ! টিক্লু কত পড়তে পারে।“ তাদের বসার ঘরের আল্মারি জুরে কত বই, সব পড়বে সে নিজে, আরও কত নতুন বই কিনবে বড় হয়ে। এইসব ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুম নেমে আসে টিক্লুর চোখে।
আবার কোনদিন ঘুম না এলে, মামনি ঘুমিয়ে পরলে সে বসার ঘরে গিয়ে রাজপুত্র সেজে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলে। দৈত্য বধ করে কোন এক অজ্ঞাত রাজপুরীর রাজকন্যা উদ্ধার করে আনে। টিক্লুর একটা খেল্না তলোয়ার আর গদা আছে, বাপি কিনে দিয়েছিল রথের মেলা থেকে, ওই দুটো দিয়ে খেলাটা বেশ জমে তার। যদিও একবার খেয়াল করেনি মামনি কখন ঘুম ভেঙ্গে উঠে এসে টিক্লুর গদা যুদ্ধ দেখছিল, হঠাৎ পেছন ফিরে মামনিকে দেখে ভারি লজ্জা পেয়েছিল সে। সেদিন তো আর দৈত্য মারাই হল না। আবার বাপি বাড়ি আসতে মামনি তার এই পাগলামির কথা গল্প করেছিল হাসতে হাসতে। বাপিও কি কম হেসেছিল! কি রাগ হয়েছিল টিক্লুর মামনির ওপর। তারপর থেকে সে খেলার সময় খুব সাবধান হয়ে গেছে, যাতে আবার কেউ দেখে না ফেলে।
একদিন স্কুল থেকে ফিরে খাবার টেবিলে বসে টিক্লু ভাতের থালা গোছানোর কাজে ব্যস্ত জয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল, “জানো মামনি আজ রাজীবকে বলছিলাম আমাদের বুল্বুলিগুলোর কথা। ওতো বিশ্বাসই করেনা, আমি বললাম একদিন এসে দেখে যায় যেন।“ রাজীব টিক্লুর স্কুলের বেষ্ট ফ্রেন্ড। সব কিছু একে অন্যকে না বললে হয়না। দুজনের খুব ভাব, যদিও মাঝেমাঝে আরি-পর্বও চলে বৈকি!
জয়া ভাতের থালা টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “পাগল ছেলে! চল, এখন তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, আজ তোকে বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর গল্প শোনাবো।“ টিক্লু বলে, “জানলার পর্দাটা সরিয়ে দাওনা মামনি, ছানাগুলোও তো খাবে, ওদের খাওয়া দেখবো।“ জয়া পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে খাওয়াতে বসেন।
আজকাল এই এক নেশায় পেয়েছে টিক্লুকে। তাদের বাড়ির পেছনে, কুয়ো-পাড়ের গাছটাতে দুটো বুলবুলি পাখি বাসা বেঁধেছে। বাসাতে আছে তাদের তিন ছানা। বড্ড ছোট, এখনও চোখ ফোটেনি। মা-বুল্বুলি এসে কিসব যেন খাওয়ায় ওদের, ঠিক যখন মামনি খাওয়াতে বসে টিক্লু-কে। কেমন সুন্দর ছোট ছোট ঠোঁট ফাঁক করে হাঁ করে ছাল-ছাড়ানো ছানাগুলো। ভারি মজা পায় টিক্লু। মনে হয় এরা যেন তার নিজের কেউ। ছানাগুলো একটু বড় হলে ওদের সাথে ভাব করে ওদের নিয়ে খেলবে টিক্লু। সারাটাদিন সে এই খাবার সময়ের দৃশ্যটুকু দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকে। খাওয়া হয়ে গেলে মামনি যখন রান্নাঘরে যায় এঁটো বাসন তুলতে তখন সে জানলায় দাঁড়িয়ে দেখে ওদের। বুল্বুলি মা-টা খাইয়ে দিয়েই আবার কোথায় যেন উড়ে যায়। টিক্লু ভাবে অতটুকু ছানা, ছেড়ে যেতে আছে কখনও? বাবা-টাও তো থাকেনা কাছে। কোথায় যে যায় ছানাগুলোকে ছেড়ে বাবা-মা দুটো! একদিন আচ্ছা করে বকে দিতে হবে ওদের, কিন্তু টিক্লুর ভাষা কি ওরা বুঝবে? নাহ! পাখিদের ভাষাটা এবার শিখতেই হবে। কিন্তু কার থেকে যে শেখে? তার তো আর ‘সুজন হরবোলা’ কি ‘মোগলির’ মতো বন্ধু নেই! এইসব ভাবতে ভাবতে মামনির কাছে শেখা ‘শালিক পাখি’ ছড়াটা আওড়ায় সে:
“জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম,
তাল-গাছেতে শালিক-ছানা।
মা নেই কাছে, মা যে গেছে
আন্তে ধরে গঙ্গা ফড়িং,
বড্ড খিদে পেয়েছে তাই
ডাকছে মা-কে কড়িং-কড়িং।“
ছড়াটা আওড়ে হঠাৎ খেয়াল হয় তার, তাহলে কি বুল্বুলি মা-টাও যায় খাবার জন্য ফড়িং ধরতে? আর বাবা বুল্বুলিটা কি তার বাবার মতো অফিস যায়? “ধুস! না, ওতো পাখি। পাখিদের কি অফিস থাকে? কে জানে তা থাকতেও পারে!”
“কিরে কি বিড়বিড় করছিস নিজের মনে?” জয়ার ডাকে চমকে ওঠে টিক্লু। তারপর লাজুক হেসে প্রশ্ন করে, “মামনি পাখিদের অফিস হয়?” জয়া হেসে বলেন, “কেন রে হঠাৎ এই খেয়াল?” টিক্লু বলে, “বড় বুল্বুলিগুলো কোথায় থাকে সারাদিন ছানাগুলোকে একা ছেড়ে? সেই সন্ধের শাঁখ বাজার আগে ফেরে!” মামনি বললেন, “ওরা ছানাদের আর নিজেদের জন্য খাবার শিকারে যায়। মানুষের মতো কিনে বা রান্না করে তো ওরা খায়না, সারাদিন শিকার ধরে খেয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরে ঘুমোয় ওরা। ছানাগুলোর ডানা গজালে ওরাও যাবে শিকারে। পশু-পাখিদের শিকার করার গল্প তো তোমায় বলেছি টিক্লু মোগলির গল্প বলার সময়।“ অবাক লাগে টিক্লুর, ওইটুকু ছানা, ওরা নাকি শিকার করবে। উফ্! কি দারুণ ব্যাপারই না হত, যদি টিক্লুও ওদের সাথে শিকারে যেতে পারতো। ঠিক যেমন মোগলি যেত নেকড়েদের সাথে।
টিক্লু জয়াকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে, “ আজ আমায় মোগলির গল্পটা বলো না মামনি।“ মামনি তার গালে আল্তো চুমু খেয়ে বললেন, “আচ্ছা বলছি, শোবে চলো।“
এমনিভাবেই কেটে গেল বেশ কদিন। টিক্লু রোজ স্কুলে তার বুল্বুলিগুলোর গল্প করে, আর বাড়ি ফিরে জানলা দিয়ে ওদের দেখতে দেখতে ভাবে যে কবে ছানাগুলো উড়তে শিখে শিকারে যাবে।
সেদিন রবিবার, সবার ছুটির দিন,নির্মল গেছেন বাজারে, আর জয়া ব্যস্ত সকালের জলখাবারের আয়োজনে। টিক্লুর ঘুম ভেঙ্গে যেতে সে এসে দাঁড়ালো জানলাটার কাছে। বড় বুল্বুলিগুলো যথারিতি নেই। ছানাগুলোর ইদানিং বোধহয় চোখ ফুটেছে, তারা বাসার ভেতর নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করে মাথা তোলে একটু একটু। হয়তো আকাশ দেখার চেষ্টায়। ডানা তো গজায়নি ভালো, এখনও তাই উড়তে পারেনা। দূর থেকেই তাই টিক্লুরই মতো আকাশে মেঘ-আলোর খেলা দেখে।
হঠাৎ হাঁউমাঁউ করে ওঠে টিক্লু। জয়া ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন, ভয়ে টিক্লুর কি না কি হয়ে গেল। মামনিকে পেয়ে টিক্লু ভয়ে আর উত্তেজনায় কাঁপা গলায় বলে, “নিয়ে গেল মামনি, কাকটা নিয়ে গেল। এখন কি হবে?” সকালের আলোয় ছানাগুলো যেমনি একটু মাথা তুলেছিল, আর কোথা থেকে একটা বড় কাক এসে ছোঁ মেরে ওদের একটাকে তুলে নিয়ে উড়ে গেছে কোথায় কে জানে! মামনি ভালো করে ব্যাপারটা বোঝার আগেই টিক্লু তাকে টান্তে টান্তে ছাদে নিয়ে যায়। যতদুর নজর যায় দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু কোথাও চিহ্নমাত্র নেই কাকটার বা ছানাটার। টিক্লু এখন কি করে বুঝতে পারেনা সে। মামনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আচ্ছা, বাপি ফিরুক বাজার থেকে আমি বলব বাসাটা কাগজ দিয়ে আড়াল করে দিতে।“ কিছুটা আশ্বস্তবোধ করে টিক্লু, এই ব্যবস্থাটা বেশ ভালোই মনে হয় তার।
বাপি ফিরতেই আর দেরী সয় না, এমনকি তার অতো পছন্দের, মামনির হাতের লুচি-বেগুনভাজা দিয়ে সকালের জলখাবারটা অব্দি ঠিক মতো খেতে পারেনা সে। বাপিকে তাড়া লাগায়, “ওঠো না বাপি, তাড়াতাড়ি ঢেকে দাও কাগজ দিয়ে।“ টিক্লুর ভয়, যদি আবার কাক আসে!
নির্মলের সাথে টিক্লুও গেল পেছনে দাঁড়িয়ে পাখির বাসা ঢাকা দেওয়া দেখতে। নির্মল বাড়ির উঁচু চেয়ারটা নিয়ে গেছিলেন, ওর ওপর উঠে বাসা ঢাকতে সুবিধা হবে বলে। ছানাদুটো আগে থেকেই ভয় পেয়েছিল বাসায় কাকের হামলা হওয়াতে, তাই নির্মলকে হঠাৎ এত কাছে এসে বাসায় হাত দিতে দেখে ওরা দিশেহারা হয়ে উঠল। চিঁ-চিঁ করে ডেকে ঠোক্রাতে গেল ওরা। বোকাগুলো বুঝতে পারছেনা যে ওদের সাহায্য করতেই এসেছে টিক্লু আর তার বাপি। বোকামি করে ঠোক্রাতে আসার ফলে যা হবার নয় তাই ঘটলো। নির্মল পাখির ঠোকর বাঁচানোর জন্য হাত সরিয়ে নিতেই ছানাদুটো নিজেদের বোকামি আর অসাবধানতার ফলে ধুপ-ধুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। টিক্লু কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোথা থেকে একটা বেড়াল এসে একটা ছানাকে মুখে পুরে দিল দৌড়। টিক্লুও দৌড়লো বেড়ালের পেছনে, কিন্তু সেটা পাঁচিল টপ্কে কোথায় যেন পালিয়ে গেল।
হাঁপাতে হাঁপাতে টিক্লু যখন ফিরে এলো দেখলো তার বাপি চেয়ার থেকে নেমে পরেছে, মাটিতে বসে কি যেন দেখছে। টিক্লু ভাবলো অন্তত এই একটাকে যদি বাঁচানো যায়। সেও তাই নির্মল কি দেখছেন তা দেখতে ঝুঁকে পরলো। বুঝতে চেষ্টা করলো তার বাপি কি দেখছে। দেখলো মাটিতে পড়ে থাকা শেষ ছানাটা খুব আস্তে, থির্থির্ করে কাঁপছে। টিক্লু বুঝতে না পেরে বলল, “বাপি ওকে বাসায় তুলে দাওনা।“ বাপি তাকে ইশারায় চুপ করতে বললেন। টিক্লু বুঝতে পারেনা, সে একবার ছানাটার দিকে আর একবার তার বাপির দিকে বড়-বড় চোখে তাকায়। দেখে আস্তে আস্তে ছানাটার থির্থিরানি কমে আসছে। তারপর যেন ধীরে ধীরে একদম থেমে গেল কাঁপা, সব চুপ শান্ত একদম। খুব ছোট ছিল তো, তাই উঁচু ডাল থেকে পড়ে যাবার ধাক্কা সামলাতে পারলোনা ছানাটা। নির্মল মৃত ছানাটাকে হাল্কা হাতে তুলে পাশেই বাগানের মাটির তলায় পুঁতে দিলেন।
এতক্ষ্ণ কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছিল টিক্লু সব। পাখিটার দেহ মাটির তলায় অদৃশ্য হয়ে যেতেই ভেতরটা যেন হু-হু করে উঠলো টিক্লুর। তার এতদিন ধরে তিল-তিল করে দেখা ছানাগুলোকে নিয়ে নানা রকমের রোমাঞ্চকর স্বপ্ন সব যেন এক নিমেষে মাটিতে মিশে গেল এই পাখিটার সাথে। এই তো কাল রাতেই ঘুমোতে যাবার আগে সে রাতপরীর কাছে প্রার্থনা করেছিল যেন তার নিজেরও একজোড়া ডানা হয়, তাহলে সেও এই ছানাগুলোর সাথে খেলতে পারবে, শিকারে যেতে পারবে। রাজীবকে গিয়ে নিজের ডানা দেখাবে, শিকারের গল্প বলবে। তখন রাজীব এই ছানাগুলোর সাথে বন্ধুত্ব করতে এলেও তারা ওকে দলে নেবেনা। এরা যে শুধু টিক্লুরই বন্ধু! কি আনন্দই না লেগেছিল এইসব ভাবতে কাল রাতে। আর এখন সব কেমন হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। ছানাটা কত কষ্ট পাচ্ছিলো, কেমন কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেল। তাহলে একেই বলে মরে যাওয়া! ডুঁক্রে কেঁদে উঠলো টিক্লু। নির্মল তাড়াতাড়ি তাকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতর চলে গেলেন।
কান্না শুনে জয়াও বেড়িয়ে এলেন রান্নাঘর থেকে। মামনিকে দেখে টিক্লুর কান্না আরও বেড়ে গেল। স্বামীর কোল থেকে ছেলেকে নিয়ে জয়া বিছানায় এসে বস্লেন। জয়া যতই চেষ্টা করেন ছেলেকে ভুলিয়ে শান্ত করতে, টিক্লুর কান্না তত বেড়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে সে বলে, “মামনি মরে যেতে খুব কষ্ট হয় তাই না? আমি মরে গেলেও এরম কষ্ট হবে?” মায়ের হৃদয় কেঁপে ওঠে। তিনি হাল্কা ধমকের সুরে বলেন, “ছিঃ টিক্লু! এমন বলতে নেই। তুমি অনেকদিন বাঁচবে। আর এমন কথা বলবেনা কোনদিন।“ বলতে বলতে ক্রন্দনরত ছেলেকে নিবিরভাবে বুকে জড়িয়ে ধরেন জয়া। স্বামী নির্মলের দিকে চেয়ে বলেন, “এই থামাও না ওকে, এভাবে কাঁদলে শরীর খারাপ করবে যে।“ নির্মল পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন, বললেন, “ওকে কাঁদতে দাও, জীবনের প্রথম দুঃখ, প্রথম মৃত্যুর উপলব্ধি। জীবনের অমোঘ সত্যির সাথে প্রথম পরিচয় আজ ঘটলো, ওকে কেঁদে নিতে দাও।“ জীবনের প্রথম শোকে মুহ্যমান ছেলেকে কোলে করে বসে রইলেন জয়া, পড়ে রইলো রান্না আর ঘরের কাজ।
অনেকক্ষ্ণ কাঁদার পর যখন কান্নার বেগ একটু প্রসমিত হল মায়ের কোল থেকে মাথা তোলে টিক্লু। কান্নার দমকে চোখ-মুখ রাঙা হয়ে ফুলে উঠেছে। হঠাৎ এমন সময়ে বুঝি মা-বুল্বুলিটা বাসায় ফিরেছিল। ছানাদের খুঁজে না পেয়ে বড় করুন সুরে ডাকতে লাগলো সে। টিক্লুর যত রাগ গিয়ে পড়লো এই বড় বুল্বুলিগুলোর ওপর। ওদের দায়ীত্বজ্ঞানহীনতার জন্যই তো আজ ছানাগুলো আর নেই। সত্যিই তো, কি হত যদি বাচ্চাগুলো বড় হওয়া অব্দি বুল্বুলিগুলো নিজেরা একটু কম খেতো? আর যদি মা আর বাবা বুলবুলি একসাথে না গিয়ে একজন পালা করে পাহারা দিত আর অন্যজন খাবার শিকারে যেত তাহলেও নাহয় একটা কথা ছিল! তা নয় বেশি খাবারের লোভে দুজনে একসাথে বেড়িয়ে পড়তো। সব দোষ ওদের!
টিক্লু রাগে, কষ্টে ফোঁপাতে লাগলো। মা-বুল্বুলির একটানা করুন ডাক তার সহ্য হচ্ছেনা। সে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বড় অভীমানের সাথে জয়াকে বলল, “মামনি ওকে তাড়িয়ে দাও ঢিল মেরে। আর এখুনি জানলাটা বন্ধ করে দাও। আর বাপিকে বলবে যেন কাটিয়ে দেয় ওই গাছটা। কাল স্কুল থেকে ফিরে আমি আর ওই গাছটা দেখতে চাই না। তাড়িয়ে দাও বুল্বুলিগুলোকে, ওরা যেন না আসে আমাদের বাড়ি। কোনদিন না, কখনও না!” কথাকটা বলেই আবার মায়ের কোলে মাথা গুঁজে দেয় টিক্লু। জয়া আবেগপ্রবণ, অভীমানি ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।