প্রথম পর্ব ।।

মিহি সুরের তালে যখন ওর ঘুম ভাঙল, ওর ঘরটা ততক্ষণে নীল আলোয় ভরে গেছে। জানালা আর দরজার জায়গায় লাল কাঠের দেওয়েলারা এসে ভিড় জমিয়েছে। ওর মাথার কাছে একটা কানের লতির সাথে বাধা  wind-chime টা হাওয়ার তালে দুলে যাচ্ছে। ও হাত বাড়ালেই জলের বোতল তা পেতে পারে এখন। গলা শুকিয়ে গেছে। ওর কানের কোনাকুনি রাখা টেবিল এর উপর থাকা ডিজিটাল ঘড়ি টা বলে দিচ্ছে যে ওর কাছে আর এক মিনিট আছে। জলের বোতল টা হাল্কা ঝটাপটি শুরু করছে। ওর ডানা গজাচ্ছে। পুরোপুরি গজিয়ে গেলেই উরে যাবে বোতল টা। তখন , ডেকে সাড়া পাওয়া হবে মুস্কিল। তাও ভাল যে ওরা দেখতে পায়না। নইলে আরও কেলেঙ্কারি হত।

বোতল টা এতক্ষন হুল হীন মউমাছির মত ‘ বো’,’ বো ‘ শব্দ করে চক্কর কটছিল। ও একটু কসরত করে, কড়ে আঙ্গুল দিয়ে টিপে ধরল ওটাকে । দু হাতের তালুতে বন্দি হয়ে ‘ পি ‘ ‘ পি’ শব্দ করছে বোতল টা । ঝটপটানি টা কমে আসছে । ও ওর বাম হাতে বোতল টাকে ধরে , ধীরে ধীরে ছিপি খুলল ।একফোঁটা জলও বাইরে ফেলতে চায়না ও । ওর এখন জলের খুব দরকার । কিন্তু ও ভুল ভেবেছিল । বোতল টা পোষ মানে নি । সে সুযোগ নিয়েছে । পরক্ষনেই জলে ভিজে গেছিল ওর বিছানা। নরম তুলোটে জন্তু টা চুষে নিলো সবটুকু জল। ও কি রেগে যাচ্ছে ? নিরিহ টেবিল টাও জিভ চাটছে ।সব বীভৎস জানয়ারেরা এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে । ও যখন ওর পায়ের কাছে কেন্নোর মতো গুটিয়ে থাকা জামাকাপর দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে চেয়েছিল, দেখেছিলো ঘুলঘুলি দিয়ে জল ঢুকছে। উন্মাদের মতো কামুক ডিজিটাল clock তা নেতিয়ে পরেছে অনেকক্ষণ । এত জল ওদের সহ্য হবে কেন? ওর চোখ বুজে যাচ্ছে আবার । তবু নিজের শেষতম চেতনা টুকু নিংড়ে নিয়ে ও বুজতে পারছে, ও তলিয়ে যাচ্ছে গভীর অন্ধকারের অতলে ।

দ্বিতীয় পর্ব।।

ওর চোখ এখন ছায়াটার দিকে। লম্বা, কালো ,নগ্ন একটা ছায়া । জলের ওপর খালি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।এর অন্ধি সন্ধি এখন ওর নখ দর্পণে । বেশ সাবধানে নজর রাখতে হয় ওকে । ওর বা হাতে একটা ছোট মতো করাত , ডান হাতে, বগলের নিচের সরীসৃপ crutch টা । আজ আর কোনো সুযোগ ছারবে না ও। ছায়াটা এখনো খুঁজছে । একই জায়গায় খুঁজে চলেছে দুপুর ঘুমের মতো একঘেয়ে জান্তব ভঙ্গিতে । আজ ওর সব খোঁজা শেষ হবে। ওর ও । ছায়াটা এখন ওর দিকে পিছন ফিরে আছে। ও ওর হাতের ছোট করাত টার ধার পরখ করলো পাশের শুকনো গাছের শরীরে শরীর ঘষে । ছায়াটা কুকুরের মত ককিয়ে উঠেছিল । ওর চোখ চিক চিক করছে ।কুকুরের মতোই মরতে হবে আজ ওকে। একবারে রাস্তার ঘিয়ে ভাজা কুকুর গুলোর মতো । ছায়াটা আজ মরেই যেত যদি না পেছন থেকে মাথায় একটা চাটি পরত। “ পাজি , নচ্ছার ছেলে! কি নৃশংস! আয় আমার সাথে । আজ তোর মজা দেখাচ্ছি ।“ , আব্লুশ কাঠের মত কালো একটা মহিলা , রাবনের অভিশাপের মত উদয় হয়েছিল।

তর্ক সে করেনা । প্লাস্টিক এর সস্তা গাড়ি গুলোর মত মনে হচ্ছিল ওর নিজেকে । ওর ইচ্ছে ছাড়াই , টেনে নিয়ে যাচ্ছিল মহিলাটি । ও একবার চেঁচিয়ে উঠেছিল । বিশেষ সুবিধা হয় নি। ছায়াটা ‘ কেও’ ‘কেও’ থামিয়ে , ওর দিকে তাকিয়ে দাত বার করে বিচ্ছিরি রকম্ হাসতে শুরু করেছে। “মেরে দাত ভেঙ্গে দেব তোমার শালা… “, ওর গর্জন মিয়িয়ে গেল মহিলার কানমলায় । ওউ বেশ খানিকটা থুতু ছিটিয়ে দিয়েছিল। তারপর প্রচণ্ড একটা থাপ্পরের শব্দ হয়েছিল । crutch টা জোর ধাক্কা খেলো মাটিতে । ও মাটি তে শুয়ে পরেছিল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে হিশহিসিয়ে বলেছিলেন মহিলাটি,” আমার গায়ে হাত দেবার সাহস ও দেখাবিনা তুই ।“ । না , ও ভুল করেনি ।এটা আর কেও নয়। সেই কালো ছায়াটাই । ভোল পালটে এসেছে । হাতের ছোট করাতটার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে চাপা স্বরে বলেছিল ও ,” আজ তুই শেষ!” । তখন জল ঢুকছে । নদী আর ডাঙ্গা মিশে যাছে।একটা মিহি সুর ভাঁজতে ভাঁজতে চলছিল ও। ওর কাঁধের ওপর ঝুলছে একটা সদ্য এলোমেলো ভাবে কাটা কালো হাত। ওর হাতে কাটা জিভ এর মতো কি যেন ওটা ?

তৃতীয় পর্ব।।

“বয়স কত বললে তোমার ?”, সাদা coat পরা টাক মাথা পেটমোটা ভদ্রলোক টি হাতের রুমাল দিয়ে চশমার বা কাচ টা দ্বিতীয়বার মুছতে মুছতে জিগ্যাস করলেন।

“১২”, ভেঙ্গিয়ে উত্তর দিলো ও।

‘’ তোমার নাম টা কি বললে যেন?”, চশমা মোছা শেষ হয়েছে তার।

“বলিনি, এখনো। নিমো । আমার নাম নিমো ।“

“বাব্বা! এ যে দেখছি একবারে ল্যাটিন নাম। তা নামটার মানে জান না কি খোকা ?”

ডান দিক-বাদিকে মাথা দোলাল ও।

“তাহলে বাদ দাও। দরকার নেই জেনে। আর তা ছাড়া নামটার origin টা খুব বিচ্ছি…“

“তুমি জান ?”

“ অ্যাঁ ! কি?”

“নাম টার মানে। তুমি জানে?”

“হুম্মম , তা জানি বলেই ত মনে হয়।“

“বল আমাকে তাহলে”

“বলব , তার আগে…”

“আগে ফাগে নয়। নাম টার মানে বল আমাকে এখুনি…”

“হ্যাঁ হ্যাঁ সে ত বলবই, কিন্ত তার আগে একটু অন্য…………”

“কানে কম শোন তুমি? কি বললাম তোমাকে? নাম টার মানে বল এক্ষুনি। নইলে……”

বুলডগ এর মত লোকটার চোখ এর কোনায় কি আলগা ভয়ের চিহ্ন আছে?

ভদ্রলোকটি নিজেকে লুকালেন” শোন নিমো তুমি হয়ত জাননা তুমি কি করেছ…আমি জানি না আমার কি বলা……………”

“জানি , আমি জানি…”

“তু…তুমি জান! মাই গড!” অসস্তিতে ভুরু কোঁচকালেন ভদ্রলোক।

“ একটা কালো কুত্তির শরীর টা ফালা ফালা করে কেটেছি আর মাথাটা থেঁতো করে দিয়েছি crutch তা দিয়ে। এইত ! তুমি ওকে চেন না ।ওর জিভ তা এখন আমার কাছেই আছে। দেখবে তুমি…এই দেখ…”, পকেট এ হাত ঢোকায় ও

“ oh! Stop! You little devil! You insane idiot!……তুমি কি মানুষ !… you are a beast ! okay! Okay! I got it. Sorry! Sorry! I have heard about you!” নিজেকে সামলালেন ভদ্রলোক । চেয়ার টা দু হাতে শক্ত করে ধরলেন । বা দিকের বুক পকেট থেকে ল্যাভেন্ডার এর গন্ধ ওয়ালা রুমাল টা বার করে কপালের ঘাম মুছলেন একবার। “ শোন চিন্তার কিছু নেই। everything will be allright. ঠিক আছে। একটা ছোট্ট injection and we will reach there ….okay!” থা্মলেন ভদ্রলোক।

“উপর-নিচে ঘার দুলিয়ে সম্মতি জানাল ও।

বুড়ো বুলডগ টা ওর দিকে পিছন ফিরে আছে এখন। ইঞ্জেকশান তৈরি করছে। টেবিল এর উপর রাখা কাইচি টা এতক্ষন শুঁড় তুলে ওর দিকে ঘন ঘন দেখছিল । অগত্যা । কাছে ডাকতেই হল ওটা কে। বুড়ো বুলডগ টা এগিয়ে আসছিল ওরদিকে। এক পা , এক পা। খুব কাছে এসে গেছিল সে। হ্যাঁ , ও আবারও ঠিক। সেই কালো লম্বা ছায়াটাই বটে। ও ওর হাতের কাইচি টার মাথায় আলতো করে হাত বোলাল ।

বাইরের বৃষ্টির ঝমঝমে শব্দে কিছুটা কি আর্তনাদ মিশে যাচ্ছে ?

কাইচি টা কামড়ে খামচে উপড়ানো একটা চোখ চিবাচছিল । ও এখন বসে আছে লাল ঘড়টার বা কোনে , যেখান থেকে জানালাটা পরে সোজা। বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছে ।পড়ুক । কিছুক্ষন পরে জল ঢুকবে । কাইচি টা ওর ডান পায়ে মাথা ঘশ্ছিল। ওর শুঁড়ে ওর সুরসুরি লাগছিল। জল ঢুকছে ।একটা মিহি সুরের তালে ওর নাচতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু ওর ঘুম পাচ্ছে। খুব ঘুম পাচ্ছে।

চতু্র্থ পর্ব।।

“আমরা এতক্ষন ধরে একসাথে আছি কিন্তু তোমার নাম টাই জানা হোলো না। কি নাম তোমার?”

“নেই।“

“সে কি ! কোন নাম দেইনি কেও তোমাকে ?”

“ orphanage এ আমায় লাংরু বলে ডাকত । কিন্তু ওই নাম টা আমার পছন্দ নয়। “

“হুমম! তাহলে তোমাকে তো আগে একটা নাম দিতে হয়। বেশ যার কোন নাম নেই তার নাম হোক নিমো । no one.”

কারুর সাথে উলঙ্গ হয়ে শুতে ওর ভালো লাগে না আর এই লম্বা, কালো , রোগা লোকাটার সাথে ত নয়ই । ওর মনে হয় খুব কান্না পাছছে। একটা ভোঁতা যন্ত্রনা হচ্ছে কোথাও একটা । বাথ্রুমের কলটায় কি আজ লাল রঙের জল পড়ছে ?

“স্যার , একবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। কেটে ফালা ফালা করে দিয়েছে। মনে হয় victim এর উপর খুব রাগ ছিল স্যার। একেই বলে স্যার ঘোর কলি …যে রাস্তা থেকে তুলে এনে ঘরে থাকতে দিল… তাকেই কিনা…আমার বাড়ি স্যার? ওই যে ওই দিকে……

সাদা পোশাকের পুলিশেরা আনাগোনা করছিল হাড় জিলজিলে বাড়িটার আশেপাশে ।

“হ্যাঁ , স্যার বাচ্ছা টাকে পেয়েছি । হ্যাঁ , স্যার হ্যাঁ, হ্যাঁ … এক মিনিট এর মধ্যে আমরা বেরুচ্ছি…………”

পুলিশের জীপ এ বসে ও ওর হাতে ধরে থাকা কালো কানের লতিটার দিকে তাকিয়েছিল । নিমো । নামটার মানে টা যেন কি? জীপ এর পায়রার খোপের মত ছোট জানালা দিয়ে ও দেখতে পেয়েছিল জল ঢুকছে । কিন্তু ওর ঘুম পাচ্ছে। খুব ঘুম পাচ্ছে।

“এই ,ছেলেটা গেলো কোথায়? জান না মানে ?এখানেই ত ছিলে সব…উবে গেল নাকি…………উফফ………”

ও কি হাসছে? কে জানে!

নাম টার মানে টা মনে পরেছে এতক্ষণে । কেও না । একবারে কেও না ।

মিহি সুরের তালে যখন ওর ঘুম ভাঙ্গল , ওর ঘরটা ততক্ষণে নীল আলোয় ভরে গেছে।

।।সমাপ্ত ।।

Print Friendly, PDF & Email
Previous articleবৈকাল
Next articleএখনি একটা সূর্য ওঠা দরকার
Gogole PI Mukherjee
I am better known as PI. I am an thinker and an anarchist.
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments