গঙ্গাফড়িংকে খুব ভয় পেত চেরী, মানে আমার ছোট কাকার ছেলে – চেরীপদ ৷ তবে ব্যাপারটা চিরকাল যে ঠিক এরকমই ছিল, তা না৷ চেরী তখন বেশ ছোট – আমাদের মাঠে ঘাটে বাগানে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াত৷ সেদিন সন্ধেবেলা চেরী যখন একটা হলদে প্রজাপতি ধরে এনে তাকে সন্ধ্যামনি ফুলের মধু গেলাবার আপ্রান চেষ্টা করছে, একটা সিড়িঙ্গে সবুজ গঙ্গাফড়িং ওপরের ডালে শুঁড় বেঁকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল৷ তার লিকলিকে ঠ্যাং, আলুথালু চোখ, টিঙটিঙে শুঁড় আর সাহসী দৃপ্ত ভঙ্গি চেরীকে ভীষণ আকৃষ্ট করল – নাঃ এটাকে পুষতেই হবে৷
বড়দার গরু আছে, গোধূলী; মেজদার আছে নেড়ী, বিটকেল; আমারও একটা পোষা কাক আছে – কুন্তল, রোজ সকালে জলমুড়ী খেয়ে যায়! চেরীরই এখনো তেমন ভদ্র কিছু জোটেনি৷
পরদিন বিকেলে সিঙ্গারার ভেতর থেকে বাদাম খুটে খেতে খেতে চেরী যখন ব্যাপারটা ঘোষণা করল, সবাই রে রে করে উঠল একেবারে৷ পুষবিতো গিনিপিগ পোষ, নয়ত কোকিল – এমনকি ব্যাঙ বা ঝিঁঝিঁপোকা পর্যন্ত চলবে! গঙ্গাফড়িং নৈব নৈব চ৷ কিন্তু চেরীর চিরাচরিত জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হল সবাই৷ দিদুনের পেতলের পানের ডিব্বা ঘষে মেজে বানানো হল তার এক কামরার ফ্ল্যাট – বাইরে চিপকে দেওয়া হল একটা হোম স্যুইট হোম লেবেল৷ ছোড়দা একটা বেশ মিষ্টি নামও দিল গঙ্গাফড়িংটার – উড়নচন্ডী৷
চেরী আর উড়নচন্ডী দিব্যি মিলেমিশে দিন কাটাচ্ছিল, কিন্তু কার নজর যে লাগল কে জানে৷ সেদিন বৃষ্টির পর রামধনু উঠেছিল, তাই দেখাতেই চেরী আহ্লাদ ভরে ডাকল তার সাধের পোষ্যকে – উড়নচন্ডী অ্যাসো অ্যাসো! এই উদাত্ত আহ্বান শুনে সে গোমুখ্যু কি বুঝলো কে জানে, একবারে চড়ে বসল চেরীর মাথায় – ব্যাস আর নামার নামও করল না৷
হুরররর….হ্যাট হ্যাট….হুশ হুশ….নাঃ কোনকিছুই কাজে দিল না৷ জলকামান….মশা মারার ধূপ…মায় টাটকা কচি কেঁচোর লোভ পর্যন্ত উপেক্ষা করে সে সগৌরবে কোহিনূরের মত বিরাজ করতে লাগল৷ মেজদা একখানা বোম্বাই আমের আঁটি চুষতে চুষতে রগড়টা দেখছিল – হঠাৎ আঁটিটা টিপ করে ছুড়ল চেরীর মাথায়৷ লক্ষ্যভেদ হল ঠিকই, কিন্তু পা ভেঙ্গে প্রায় একমাস বিছানায় পড়ে রইল উড়নচন্ডী৷ সেরে উঠতেই তাকে চোখের জলে বিদায় দিয়েছিল চেরী৷ বড়দা আবার উড়নচন্ডীর স্মৃতিতে দুকলম লিখেও দিল –
সুখে দুখে তুই ছিলি মোর সাথী
হে প্রিয় উড়নচন্ডী,
এত স্থান ছিল বসিবার তবু
কেন বাছিলি মোর মুন্ডি ৷
করিনু ক্ষমা সব অপরাধ তোর
উড়ায়ে দিনু আজ ভোরে,
চাহিলেও হায় ভুলিতে না পারি
একটি দিনেরও তরে৷
এর কিছুদিনের মধ্যেই বড়দির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল সেই চেরাপুঞ্জিতে৷ পাকা দেখার দিন এক চাপা উত্তেজনা, অনেকদিন পর বিয়ে লাগছে বাড়ীতে৷ বড়মা আমাদের সবাইকে ডেকে কাজ ভাগ করে দিলেন৷ জামাইবাবু কালাকাঁদ খেতে নাকি ভয়ানক ভালোবাসেন – তাই চেরীকে কালাকাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হল৷ জামাইবাবু এলেন; আমাদের সঙ্গে গালগল্প করলেন; গাছের আম, জাম, পেঁপে খেলেন; কিন্তু চেরী কালাকাঁদ নিয়ে আর এল না৷ আমরা সবাই উশখুশ করতে লাগলুম৷
বড়দা দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বেরোতে যাবে, হঠাৎ হাসিমুখে চেরীর উদয় – পিঠে এককাঁদি পুরুষ্টু কলা৷ আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি দেখে চেরীর সাফাই – কি করব! কোথাও না পেয়ে মোড়ের নকুড়বাবুর বাগান থেকে কেটে নিয়ে এলুম৷ কালাকাঁদের জায়গায় এককাঁদি কলা! বড়মা জ্ঞানহারা, আমরা দিশেহারা – ওদিকে জামাইবাবুও বাক্যহারা! হঠাৎ গোঁতাগুঁতি করে এগিয়ে এলেন দিদুন – আহা ছেলেটা ঘাড়ে করে নিয়ে এল, ফেলে দেব বাবা! ছাড়িয়ে দি, খেয়ে নাওনা!
প্রায় ১৩টা কলা গলাঃধকরণ করে ছাড়া পেয়েছিলেন হবু জামাইবাবু৷ এর পরও অবশ্য পচিদির সঙ্গে বিয়েটা হয়েছিল, তবে এখনও চেরী বাড়ীতে আছে জানলে জামাইবাবু আর গেট খোলেন না৷ ওই বাইরে থেকেই হেঁ হেঁ…এই চলছে…ভালো ভালো…করতে করতে বিদায় নেন৷
ভেটকি মাছের পোকা ছিল চেরী৷ পচিদির বৌভাতের দিন বড়মা তাই খুব শখ করে ভেটকি মাছের পাতুরীর ব্যাবস্থা করেছিলেন৷ ইয়া বড় বড় ভেটকি কলাপাতায় মুড়ে বার করছে হেড রাঁধুনি পান্নাদা, আর আমাদের জিভ দিয়ে টুপ টুপ করে জল ঝরে পড়ছে শিশিরবিন্দুর মত৷ ফার্স্ট ব্যাচেই হাতা গুটিয়ে বসে পড়ল চেরী – কিন্তু খেতে গিয়ে এমন কাঁটা ফুটল গলায় যে সকলের খাওয়া মাথায় উঠল৷
মেজদা তখন সবে হোমিওপ্যাথি প্র্যাকটিস ধরেছে, সুযোগ পেলেই আমাদের চেপে ধরে রাক্সটক্স খাইয়ে দেয় দুফোঁটা৷ বাক্স খুলে গম্ভীর মুখে কি একটা বার করে ফেলে দিল চেরীর মুখে৷ কিছুক্ষণ পরেই চেরী ঘোষণা করল কাঁটা মিসিং – তবে মাছ খাওয়া চিরদিনের মত ত্যাগ করেছিল৷ আজকাল পাতে চিকেন দিলে ভুরু কুঁচকে জানতে চায় দেশী না ব্রয়লার৷ ভিটামিন বেশী বলে চেরী শুধু দেশী মুরগী খায়৷
তবে একটা ব্যাপারে আমরা সবাই একমত ছিলুম, চেরীর ব্রেন চাচা চৌধুরীর চেয়েও প্রখর৷ ধরো যদি জিজ্ঞেস করি ২ আর ৪ এর যোগফল কত? তোমর হৈ হৈ করে উঠবে সবাই – এ ত খুব সোজা, ৬!! চেরী তখন একটু মুচকি হেসে বলবে – VI, ও রোমানে যোগটা করছিলো আর কি! কণিষ্কের কেন মুড়ো নেই….পাল বংশ আগে না সেন বংশ…গঙ্গা ও ভলগা কোন দেশে অবস্থিত ….কোন মশায় ম্যালেরিয়া হয় আর কোনটায় ডেঙ্গু….রবি কেন ঠাকুর…এ সবের উত্তর চেরীর ঠোঁটস্থ৷
প্রতি বছর পরীক্ষা শেষে বাড়ীতে গোলটেবিল বৈঠক বসত৷ হয় দেখা যেত গঙ্গা নদীর অববাহিকা নিয়ে প্রশ্ন, চেরী এভারেষ্টের উচ্চতা দিয়ে শুরু করেছে….আকবরের অবদানে চেরী হূন সাম্রাজ্যকেও ছাড়েনি….নারকেল গাছের উপকারিতাতে সে তাল আর খেজুরকেও ঢুকিয়েছে৷ কিন্তু চেরীবধ পর্ব শুরু হওয়ার আগেই দিদুন এসে পড়ত, এবং যা করেছে বেশ করেছে…ঐ এ বংশের মুখ রাখবে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেত৷
আমাদের কালিঝুলি স্পোর্টিং ক্লাবের এক অন্যতম সদস্য ছিল চেরী৷ যেকোন ফুটবল ম্যাচে গোলকিপারের পজিশনটা ছিল তার বাঁধা৷ বল যেদিক দিয়ে যে গতিতেই আসুক না কেন চেরী ডাইভ মারবেই৷ তাতে গোল বাঁচত কতটা সন্দেহ, তবে পুরো ব্যাপারটা খুব দৃষ্টিনন্দন হত৷ কিন্তু সমস্যা হল চেরী যখন প্রথম ক্রিকেট খেলতে নামল৷ বোলারের হাত থেকে বল ব্যাটসম্যান পর্যন্ত যাওয়ার আগেই চেরী মারত জন্টি রোডস মার্কা ইয়া এক ডাইভ৷ ব্যাটসম্যান বেচারী বল মারার কোন সুযোগই পেত না৷ চেরীকে পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল যে ব্যাটসম্যান বল মারার পরই তার ডাইভ চলতে পারে৷ তখনকার মত মিটে গেলেও কোনদিনই ব্যাপারটা সে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি৷
তবে খেলাধুলোয় তুখোড় হলেও ডাংগুলিটা কোনদিনই ঠিক বাগে আনতে পারেনি চেরী৷ সেদিন বাগানে খেলা চলছিল – চেরী পাজামা গুটিয়ে, ডান্ডাটা গদার মত ওপরে একবার ঘুরিয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে হেঁইয়ো বলে মারল এক ঘা! আমরা সবাই সঙ্গে সঙ্গে ওই ঊর্দ্ধগগনে বাজে মাদলের মত চোখ রাখলুম আকাশে! অবিশ্বাস্যভাবে গুলিটা পড়ল ঠিক দেড় ইঞ্চি আগে৷ চেরীর অবস্থা তখন চক্রব্যুহে বন্দী অভিমন্যুর মত৷ চারিদিকে দ্রোণ, কর্ণ আর শকুনির রক্তচক্ষু৷ মিইয়ে গিয়ে চেরী একবার বলার চেষ্টা করেছিল, ওই গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্সটা এমন মোক্ষম সময় বিট্রে করল যে ….. কিন্তু আর শেষরক্ষা হয়নি৷
তোমরা এবার হয়ত জানতে চাইবে চেরী এখন কোথায়? দিল্লীর কুতুবমিনারের ঠিক পাশেই দোতলা বাড়ীর দক্ষিণ দিকের বারান্দায় যদি দেখ একজন পেপার পড়ছে, আর এক দাঁড়কাক ওমলেট টেষ্ট করতে করতে সমানে নুন নেই কেন বলে তারস্বরে অভিযোগ করছে, তুমি একদম ঠিক জায়গায় এসেছ৷ দর্শনের সময় – সোম থেকে শনি, সন্ধে ৭টা থেকে ৯টা৷ রোব্বার বন্ধ!!