গন্ধ
ডিসেম্বরের সকাল, বাইরে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া, কাঠের ক্যাম্প হাউসের বাইরে রাখা থার্মোমিটার টায় অবিনাশ টেম্পারেচার টা দেখে নিল, ২° সেন্টিগ্রেড। গাছের পাতায় শিশির বিন্দু গুলো জমে বরফ হয়ে গেছে। কম্বল টা শরীর থেকে সরাতে ইচ্ছা করছে না অবিনাশের৷ পাশের ঘরে গিয়ে দেখল, দীপঙ্কর তখন দুটো লেপ মাথা পর্যন্ত ঢাকা দিয়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে। দীপঙ্কর পান্ডা, অবিনাশের ফিল্ড পার্টনার। উড়িয়া হলেও বেশ বাংলা বলে নেয় দীপঙ্কর, ঐ মাঝে মধ্যে দু একটা “ছু” জুড়ে দেয় কিন্তু তাতে অবিনাশের কোন অসুবিধা হয় না। যতই হোক খাদ্যাভ্যাস দুজনেরই এক, দুজনেই স্বভাবজাত পেটুক, মাছ মাংসের পোকা। বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে কাজ করে ঠিক করে খাবার টাও না জুটলে খুব বিরক্তিকর ব্যাপার। অবিনাশ আর দীপঙ্কর, দুজন চাকরি করে জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া তে। এই দু বছর হল, প্রথম পোস্টিং ই পেয়েছে শিলং এ। জি এস আই এর কর্মজীবনে একবার নর্থ ইস্টে পোস্টিং নিলে, তার পরের পোস্টিং হোম স্টেট এ পাক্কা। খারাপ কী? আর এখনও বিয়ে থা হয় নি, কোন রেস্পন্সিবিলিটি নেই, ইয়ং বয়স, এটাই তো সময় পাহাড়ে ঘোরার। শিলং এ ওদের অফিস, কিন্তু ক্যাম্প হাউস টা শিলং থেকে প্রায় সত্তর কিমি দূরে জোয়াই শহরে। সেখানে পশ্চিম জয়ন্তিয়া পাহাড়ে ম্যাপিং এর কাজ করছে ওরা।
যাই হোক, অবিনাশ এক ঝটকায় দীপঙ্করের লেপ দুটো টেনে তুলে নিল৷ দীপঙ্কর একটা বিশ্রী উড়িয়া গালি দিয়ে, ফের লেপ দুটো কেড়ে নিল। অবিনাশ বলল, ” হারামজাদা ওঠ, আট টা বাজতে যায়, ফিল্ডে যাবি তো নাকি? ” দীপঙ্কর বলল, ” এই ঠান্ডায় মাথা খারাপ না পেট খারাপ! ক্ষমা কর ভাই। আজ পারলাম না। তাতে আজ তো লেবার ড্রাইভার কেউ নেই, কি একটা লোকাল ফেস্টিভ্যালে সব ছুটি নিয়েছে। ” অবিনাশ বলল, ” বলিস কী! ড্রাইভার টাও নেই? ” উত্তরে দীপঙ্কর বলল, ” তাহলে আর বলছি কি? শুধু আমাদের লিঙদো সাংমাই আছে। ও ই একমাত্র সম্বল। ” সাংমা ওদের ক্যাম্প হাউসের কুক, বেশ রান্না বান্না করে। অবিনাশ বলল, ” এরকম করিস না ভাই, কাজটা এ মাসের মধ্যে শেষ করতেই হবে আমায়। ” দীপঙ্কর বলল, ” সরি ব্রো, আজ তো আমি সারাদিন ওল্ড মঙ্ক খেয়ে গা গরম করব আর পাতি ল্যাদ খাব ; ” বলে সংমা কে ” ওই সংমা” বলে ডাক দিল। সাংমা এল, ” জি বাবু ” দীপঙ্কর জিজ্ঞাসা করল, ” কাল কা বাসি চিকেন কুছ হ্যায়? ” সাংমা বলল, ” নেহি বাবু, ও তো হাম খা লিয়ে। ” দীপঙ্কর একটু বেজার হয়ে বলল, ” আচ্ছা কিয়া হ্যায়, যাও পিঁয়াজ অর আলু কা পকোরি বানা দো।” সাংমা সম্মতিসূচক মাথা টা নেড়ে চলে গেল। অবিনাশ বুঝলো আজ আর দীপঙ্কর যাওয়ার নয়। ওদিকে পরের মাসে অবিনাশের পিসতুতো দাদার বিয়ে। না গেলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে৷ দুজন বেশ পিঠোপিঠি, ওর ছোটবেলার এক মাত্র বন্ধু। শিলং অফিসে ওর বস পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, আগে ম্যাপিং কমপ্লিট হবে, তারপর ছুটি। কাজ টা আর বেশি দিনের বাকি নেই, ঠিক ভাবে করলে দিন কুড়িতেই হয়ে যাবে। কিন্তু হলে তো! রোজ হাজার নাটক, আজ লেবার নেই, কাল রাস্তা বন্ধ তো পরশু পেট্রোল পাম্প স্ট্রাইক। মাসে অর্ধেক দিন তো ঠিক করে কাজই হয় না৷ অবিনাশ মনস্থির করে নিল আজ ও ফিল্ডে যাবে এবং একাই যাবে। স্যাম্পলিং এর কাজটা না হয় আজ করবে, লেবারের দরকার টা কি? ম্যাপিং টাও একা হাতেই সামলে নেবে৷
কনকনে হাড় হিম করা ঠান্ডা। গত তিন দিন ধরে স্নান করা হয় নি অবিনাশের। ভাবলো আজ না হয় সকাল সকাল ভগবানের নাম করতে করতে দু মগ জল গায়ে ঢেলেই নেবে। কিন্তু জলে স্পর্শ করতেই ইচ্ছাটা কর্পূরের মতো উবে গেল তার। অগত্যা শুধু ব্রাশ আর প্রাতঃকর্ম সেরে রেডি হতে লাগল সে। তার হ্যাভারস্যাক ব্যাগটায় ম্যাপ, ব্রানটন কম্পাস, হ্যামার, জি পি এস সব ভরে গুছিয়ে নিল। সাংমা ওদিকে পিঁয়াজ পকোড়ি তেই ব্যাস্ত, তাই কয়েকটা মুখে পুরে অবিনাশ বেরিয়ে পড়লো। বেরিয়েই বুঝতে পারল, একটা বোকামি করে ফেলেছে, স্পোর্টস সু এর জায়গায় ঘরে পড়ার স্যান্ডেল টা পড়েই আজ বেরিয়ে পড়েছে সে। স্পোর্টস সু টার শোল টায় কটা লম্বা লম্বা কাঁটা যা বিঁধেছে, এখনও বের করা হয় নি সেগুলো। যাই হোক, কই বাত নেহি, আদিম যুগে মানুষ তো খালি পায়েই সারা দুনিয়া ঘুরে বেরিয়েছে। অবিনাশের ফিল্ড এরিয়াটা ট্যির্শী ফলস্ এর দক্ষিণে এক -দুই কিলোমিটার এর মত। ক্যাম্প হাউস থেকে একটু পায়ে হেঁটে আগে যেতেই কোর্ট চক এর মুখেই একটা শেয়ারে অটো পেয়ে গেল অবিনাশ। জোয়াই থেকে ট্যির্শী ফলস্ ৫-৬ কিলোমিটার মত। পাহাড়ি রাস্তায় অটো টা ভট ভট শব্দ করে এগিয়ে চলল। মিনিট কুড়ি বাদ ট্যির্শী ফলস্ পৌঁছে , অটোওয়ালা কে টাকা মিটিয়ে এগিয়ে চলল অবিনাশ। ফলস্ এর সামনে কিছু ইয়ং ছেলে পুলের গ্রুপ, দু – চারটে কাপল্ আর একটা ফরেনার। তারা হুল্লোড় করতে আর সেলফি নিতে ব্যাস্ত। এ আর নতুন কি! অবিনাশের কলেজ লাইফের প্রথম এক্সকারশন এর কথা মনে পড়ে গেল৷ মাইথন গিয়েছিল সবাই মিলে ফিল্ড করতে৷ ইয়ার এণ্ডের সময়, লোকজন বক্স বাজিয়ে নেচে হইচই করে পার্টি পিকনিক করছে, আর ওদের না খাইয়ে সারাদিন ফিল্ড করিয়েছিল। খুব বিরক্ত লেগেছিল অবিনাশের। ভেবেছিল জিওলজি টা ছেড়েই দেবে, ফালতু সাব্জেক্ট, কোন লাইফ নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে সে ভালোবেসে ফেলেছে সাব্জেক্ট টাকে। এখন তার এসব কাজ, ফিল্ড ভালোই লাগে।
কিছু দূর এগোতেই ধীরে ধীরে পরিবেশ টা জনহীন হয়ে উঠল। তা এই শীতের সকালে কে আর এই বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াবে! ম্যাপটা আর ব্রানটন টা ব্যাগ থেকে বের করে নিল অবিনাশ। 7° SSW ধরে এগিয়ে চলল সে। স্যান্ডেল টা পড়াতে তার এই পাহাড়ি পিচ্ছিল রাস্তায় হাঁটতে বেশ কষ্টই হচ্ছে। পায়ে ঠিক মত গ্রিপ পাচ্ছে না, পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা চলার জন্য ওটা খুব দরকার৷ যাই হোক, এত কিছু করে, এত দূর এসে এই টুকুর জন্য আর ফিরে যাওয়ার মানে হয় না৷ সাবধানে এগোতে শুরু করল অবিনাশ৷ যেতে যেতে প্রয়োজনীয় ডিপ-স্ট্রাইকের রিডিং নিয়ে আর লোকেশনের জি পি এস রিডিং নিয়ে ম্যাপ এ প্লট করতে শুরু করল সে। কিছুটা দূরে সামনে খাড়াই দেওয়ালের মত খয়েরী রং এর একটা মাইকা- গ্রানাইটের টিলা, ওটার ওই পারে কোনদিন যাওয়া হয় নি অবিনাশের। ঐ দিকের ম্যাপিংটা এখনও বাকি। দীপঙ্করটা কুঁড়ে, অবিনাশ ভাবল, আজ একটু ওদিকে গিয়ে দেখাই যাক৷
অনেক সাবধানে, প্রায় আধ ঘন্টার প্রচেষ্টায়, অবিনাশ টিলা টা চড়ে ফেলল। চড়ার সময় মনে হচ্ছিল, ফুসফুস টা হয়তো আজ মুখ দিয়ে বেরিয়েই যাবে । কিন্তু ওঠার পর মনটা নির্মল প্রশান্তি তে ভরে গেল। টিলার অন্য দিকটায় খাড়াই খাদ, প্রায় ফুট চল্লিশ এর। জায়গাটা থেকে প্রায় ৩৬০° প্যানারমিক দৃশ্যপট দেখা যায়। চারদিকে ছোট খাটো ঝোপ ঝাড়, গোলাপি, বেগুনি, হলুদ নানা নাম না জানা অচেনা ফুল। জয়ন্তিয়া পাহাড়ের অপরূপ দৃশ্য চারদিকে। কোথাও সবুজ, কোথাও বা একটু কালচে খয়েরী। দূরে দিগন্তে পাহাড়ের চূড়ায় রুপোলী বরফের প্রলেপ, তাতে সূর্যের আলো পড়ে কোথাও সোনালী। পাহাড়কে ধাপে ধাপে কেটে, ছোট ছোট ধানের ক্ষেত গুলো দূর থেকে দেশলাইয়ের বাক্সের মত দেখাচ্ছে। এদিকে কিংসি নদী কুলু কুলু শব্দে বয়ে চলেছে। কাঁচের মত স্বচ্ছ সে জল। জলের নীচে থাকা গোলাকার কোবল্-পিবল্ গুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অবিনাশ তো এখান থেকেই চিনে ফেলবে এক একটা পাথর কে।
কিছু সময় এই ভাবে কেটে যাওয়ার পর, অবিনাশ কাজে মন দিল। নাহ, এত টা কষ্ট করে যখন এসেইছে আর পাহাড়ও চড়েছে, তার সদ্ব্যবহার করা অবশ্যই উচিত। ম্যাপটা হাতে নিয়ে পেন্সিল টা বসিয়েছে, এমন সময় হঠাৎ একটা গন্ধ তার নাকে এল। বড় অদ্ভুত গন্ধ টা। খুব মৃদু কিন্তু বেশ মায়া ময়। বলে ঠিক বোঝানো যাবে না। গন্ধ টার মধ্যে একটা অদ্ভুত নেশা আছে। গন্ধরাজ, হাসনুহানা, বেলি ফুল সব কিছু মেশালেও হয়তো এই মাদক গন্ধ সৃষ্টি হবে না। একটা মিষ্টতা কিন্তু তার সাথে যেন মেশানো আছে বিষাদের সুর। গন্ধটা ধীরে ধীরে তাকে আচ্ছন্ন করে তুলছে। গন্ধ টা তার চেনা নয়, কিন্তু এর সাথে যেন অনেক পুরোনো নাড়ীর টান। তার মন ডাইভার্ট হয়ে গেল। গন্ধটা তাকে টানতে লাগল নিজের দিকে। অবিনাশ ভাবল, কোনো জংলী ফুল থেকেই হয়তো আসছে গন্ধ টা। সে এক এক করে আশে পাশে যত রকম ফুল ছিল, সব ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুরু করল। নাহ, ওই গন্ধ টার ধারে কাছেও কোন ফুলের গন্ধ নয়। তাহলে কি কোন ফল, পাতা বা কোন অচেনা জানোয়ার এর? ভাবতে ভাবতে সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। তার মাথায় যেন আর কিচ্ছু ঢুকছে না, সে আর কিচ্ছু অনুভব করতে পারছে না। তার স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে যেন বয়ে যাচ্ছে গন্ধ টা। গন্ধটার মধ্যে একটা মুক্তির উচ্ছ্বাস আছে, পরম শান্তির সংকেত আছে। ভাবতে ভাবতে অবিনাশ কখন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল, হঠাৎ অনুভব করল তার পায়ের তলা থেকে জমি সরে যাচ্ছে। আর কিছু মনে নেই তার।
যখন চোখ খুলল, অবিনাশ দেখলো ও একটা হাসপাতালের বেড এ শুয়ে। শরীরটা নড়াতে ও পারছে না। প্রায় সারা শরীরে প্লাস্টার। ওর পাশে বসে দীপঙ্কর। ওকে চোখ খুলতে দেখে দীপঙ্কর ওকে উদ্দেশ্য করে এক গুচ্ছ গালি গালাজ করল। তারপর দীপঙ্কর ই বলল, অবিনাশ যে টিলা টায় চড়েছিল, ওটার ধস নামে এবং তার নীচে চাপা পড়েছিল সে। ভাগ্য খুব ভালো, সেই সময় একটা মজদুর দের ট্রাক পাস দিয়ে যাচ্ছিল। ওরাই অবিনাশকে দেখতে পেয়ে জোয়াই এর ডিসট্রিক্ট হসপিটালে ভর্তি করে দেয় এবং অবিনাশের আইডেন্টিটি কার্ড দেখে জি এস আই এর ক্যাম্প হাউসেও খবর দেয়। পায়ে তিনটে, হাতে দুটো, কলার বোনে দুটো, রিব কেজে একটা এবং কোমরে একটা, মোট ন’টা ফ্রাকচার। “ভাগ্য ভালো এ যাত্রা প্রানে বেঁচে গেছ, বারণ করেছিলাম, বেশি হিরো!” বলে উঠলো দীপঙ্কর।
ঠিক ভাবে সেরে উঠতে অবিনাশের প্রায় চার মাস লেগে গেল৷ পিসতুতো দাদার বিয়েতে আর তার যাওয়া হল না। যদিও তার অবস্থা জেনে কেউ আর রাগারাগি করে নি। অবিনাশের মা ছুটে এসেছিলেন, তাঁর আদর যত্নেই সেরে উঠল সে। কিন্তু ওই গন্ধ টা অবিনাশ ভুলতে পারল না৷ ঐ গন্ধ টা যেন তার নাকে লেগে আছে, বুকের মধ্যে জমে রয়েছে। সেরে ওঠার পর বেশ কয়েক বার অবিনাশ গেছে ঐ গন্ধটার খোঁজে কিন্তু আর পায় নি সেখানে গন্ধটা। অনেক স্থানীয় লোকজনের কাছে গন্ধটার বর্ননা দিয়েছে, কিন্তু গন্ধ কি আর বলে বোঝানো যায়!! তাই কারোর কাছে কোন সদুত্তর ও পায় নি। দীপঙ্করকেও অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু দীপঙ্কর অত পাত্তা দেয় নি। এই প্রসঙ্গ উঠলেই বলে, “আরে গন্ধ তো কত কিছুরই উদ্ভট হয়, তা ওই নিয়ে অত পড়ে থাকার কি আছে ভাই!! “। কাউকে ব্যাপারটা ঠিক করে বোঝাতেই পারল না অবিনাশ। মা তো দিব্যিই দিয়ে দিল, ” ওই দিকে তুই একদম যাবি না..এই আমার দিব্যি রইল। ”
বছরকয়েক পর অবিনাশের বদলি হয়ে গেল কলকাতায়। বিয়ে থাও হল। মৃন্ময়ী ওর স্ত্রী, পরমা সুন্দরী, দুজনের বেশ মনের মিল আছে৷ দুজনের একটা ফুটফুটে নাদুস নুদুস বাচ্ছাও হল। সুখী সংসার যাকে বলে। কিন্তু এত কিছুর মাঝেও অবিনাশ সেই গন্ধ টা ভুলতে পারল না। বার কয়েক সে স্বপ্নের মধ্যে অনুভব করেছে গন্ধটা। গন্ধটা যেন তাকে টানছে, তাকে নিয়ে অন্য কোথাও যেতে চায়, অবিনাশ ও তার সাথে যাতে চায়। কিন্তু চোখ খুললেই ব্যাস! আর কিচ্ছু নেই। মৃন্ময়ীকে দু একবার বলেছে অবিনাশ, কিন্তু অন্যদের মতই সেও খুব একটা গুরুত্ব দেয় নি, তাই ও আর বেশি ঘাঁটায় নি। গন্ধ নিয়ে নিজে অনেক পড়াশোনা করেছে, ইন্টারনেটে সার্চ করেছে, কত কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখেছে; কিন্তু নাহ, কোন কিছুতেই কিছু লাভ হয় নি। এমন কি অফিসিয়াল ট্যুর এর নাম করে সে বার দশেক জোয়াই ঘুরে এসেছে, ঐ জায়গাটাকে নতুন করে খোঁজার জন্য। সব চেষ্টাই তার ব্যার্থ৷ পুরোনো স্মৃতি থেকেই সে গন্ধটাকে আনফোল্ড করার চেষ্টা করে ; ওটা কি সত্যিই কোন ফুলের গন্ধ ছিল! ঐ গন্ধটার মধ্যে কি একটা শুকিয়ে যাওয়া রক্তের গন্ধ মিশে ছিল! গন্ধটা কোন অশরীরী বা অশুভ কিছুর নয় তো! না না ওসব কিছু হয় না। আর তার চেয়েও বড় কথা গন্ধটা তো তার ভালো লাগে, তাকে তো সেটা কাছে টানে।
দেখতে দেখতে অবিনাশ চাকরি জীবন পেরিয়ে আজ জীবনের সোনালী পর্বে পা দিয়েছে৷ অবিনাশ এখন প্রৌঢ় অবিনাশ বাবু। সল্টলেক সেক্টর ফাইভে ফ্ল্যাট, সেডান গাড়ি, প্রেসিডেন্টের হাত থেকে ভালো কাজের জন্য ন্যাশনাল মিনারেল অ্যাওয়ার্ড, বিদেশ ভ্রমণ, সব ইচ্ছাই তাঁর পূরণ হয়েছে। ওদিকে তাঁর ছেলেও ডাক্তারি পাস করে, আজ কলকাতার সেরা কার্ডিওলজিস্ট দের মধ্যে একজন। গর্বে অবিনাশ বাবুর বুক ভরে যায় । এ পারফেক্ট লাইফ! শুধু মনে একটাই আফসোস, একটাই শেষ জিজ্ঞাস্য, ঐ গন্ধটা কিসের ছিল? ওটা জানতে পারলেই অবিনাশ বাবুর যেন শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়। ঐ গন্ধটা কি আর কোনদিন ফিরে পাবেন অবিনাশ বাবু?
সেদিন অবিনাশ বাবুর নাতির মুখে ভাত ছিল। দিনটা বেশ হই হুল্লোড় এর মধ্যে দিয়েই কাটল। ঘর ভর্তি আত্মীয়-স্বজন, পুরোনো বন্ধুদের সাথেও দেখা হল। দীপঙ্করও এসেছিল। তার এখন মাথা ভর্তি টাক, চেহারাটাও একটু বেশিই ভারী হয়ে গেছে৷ দেখতে কেমন লাফিং বুদ্ধর মত লাগছে। কিন্তু মুখে অবিনাশ বাবু বললেন, ” বয়সের সাথে গ্ল্যামারও বাড়ছে যে তোমার, “। বিভিন্ন হাসি তামাশা আনন্দ পর্বের মধ্যে দিয়ে দিনটা বেশ কাটল। আজ তিনি সত্যিই খুব খুশী। সারাদিন খাওয়া দাওয়া টাও বেশ জমিয়েই হল। দুপুরে ইলিশ মাছ, চিংড়ির মালাইকারি, দই, রসগোল্লা তো আছেই। রাতে আবার লুচি সাথে মটন কষা। বহুদিন পর মন খুলে, কোলেস্টেরল, বি.পি র সব চিন্তা ভুলে অবিনাশ বাবু খেলেন।
কাজ কর্ম সেরে শুতে যেতে প্রায় রাত বারোটা বেজে গেল। মৃন্ময়ী ততক্ষণে হাঁ করে নাক ডাকছে, ও একটু ঘুম কাতুড়ে। আগে অবিনাশ বাবু খুব জ্বালাতেন, মৃন্ময়ীর নাকে গামছা বা চাদর এর কোনা টা মুড়িয়ে সুরসুরি দিতেন বা মুখে পেন্সিল ঢুকিয়ে মজা করতেন। কিন্তু এখন বয়স হয়েছে, এসব আর মানায় না। মৃদু হেসে উল্টো দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে পড়লেন অবিনাশ বাবু। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল অবিনাশ বাবুর। শরীরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর, গরম লাগছে খুব, বুক টাও ভারী ভারী লাগছে, এসি র মধ্যেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি মনে মনে বললেন, ” খাওয়াটা বেশিই হয়ে গেছে আজ, একবার বাথরুম গেলে ভালো হয়। ” হঠাৎ অবিনাশ বাবু বহু পরিচিত, বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই পুরোনো গন্ধটা আজ আবার পাচ্ছেন। তিনি নিজেকে চিমটি কেটে দেখলেন, হ্যাঁ সত্যিই পাচ্ছেন, স্বপ্ন নয়। গন্ধটা ধীরে ধীরে প্রচ্ছন্ন থেকে প্রকট হচ্ছে। অবিনাশ বাবুর মুখ প্রশান্তিতে ভরে গেল। যে গন্ধকে এতদিন তিনি হন্যে হয়ে খুঁজেছেন , যে গন্ধর জন্য তিনি পাগলের মত এখান ওখান করেছেন আজ সেই গন্ধ নিজে এসে ধরা দিয়েছে অবিনাশ বাবুর কাছে। তিনি বাকি সব কিছু ভুলে প্রান ভরে গন্ধটা অনুভব করতে লাগলেন। একবার মনে হল মৃন্ময়ীকে জাগিয়ে তিনি বলবেন, ” এই তো সেই গন্ধ, যা এত বছর ধরে তোমাদের বোঝাতে চাইছি।” তিনি মৃন্ময়ীর কাঁধে হাত রাখলেন।
মৃন্ময়ী ঘুমকাতুরে হলে কি হবে, ঘুমটা পাতলা। মৃন্ময়ী চোখ বুজেই বলল, ” কি হল? কিছু বলছো? আজ খুব খাটনি গেছে, ঘুমাতে দাও।” কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে উত্তর না পাওয়ায় চোখ খুলে উঠে বসলো মৃন্ময়ী। দেখলো, অবিনাশ বাবুর শরীরটা এলিয়ে শুয়ে আছে এবং তাঁর মুখে একটা প্রশান্তির চিহ্ন। মৃন্ময়ী অনেক ডাকাডাকি করল কিন্তু অবিনাশ বাবু চোখ খুললেন না। চেঁচিয়ে ডেকে উঠলো মৃন্ময়ী, ” খোকা…. দেখে যা… তোর বাবা সাড়া দিচ্ছে না… কি হল তোর বাবার। ” মায়ের চিৎকারে ওদের ছেলে এসে, পালস্ ও হার্ট চেক করলো অবিনাশ বাবুর । নাহ, সব শেষ। মুখটা নামিয়ে বলল, “বাবা আর নেই…. স্ট্রোক।” গোটা ঘর কান্নায় ভেঙে পড়লো। জল জ্যান্ত মানুষটা এই ভাবে চলে গেল!
মাস খানেক পেরিয়ে গেছে তারপর। সময়ের সাথে মানুষ এগিয়ে চলে। কারোর জন্য কিছু থেমে থাকে না। অবিনাশ বাবুর নাতি এখন হামাগুঁড়ি দিতে শুরু করেছে, মাঝে মধ্যে কিছু একটা ধরে দাঁড়ানোর ও চেষ্টা করছে। সেই নিয়ে পুরো বাড়িতে খুশির আলোড়ন। মৃন্ময়ীও ধীরে ধীরে তার অবিনাশ কে ভুলে ছেলে ও নাতিতে মনোনিবেশ করেছে। শুধু মৃন্ময়ীর নাকে মাঝে মাঝে একটা অচেনা গন্ধ আসে, কেমন নেশাতুর মৃদু গন্ধটা..মাথা ধরে যায়। আজ ও পাচ্ছে হালকা অথচ স্পষ্ট। মৃন্ময়ী বলে উঠলো, ” খোকা… গন্ধটা আবার পাচ্ছি… তুই পাচ্ছিস না? ” তার ছেলে উত্তর দিল, ” কিসের গন্ধ? কই না তো!”